খুব সাবধান হতে হবে তোমাকে, মুসা, কিশোর বললো। মেকসিকোর সব খাবার কিন্তু ভালো না। পাকস্থলী জ্বালিয়ে দেয়ার ওস্তাদ।

সব খেতে যাচ্ছে কে? ভুরু নাচালো মুসা। যেগুলোতে ঝাল কম সেগুলো খাবো। টরটিলা খাবো, এনচিলা খাবো। ওসব নাকি দারুণ খাবার। তবে লাল মরিচের চকলেট সস, ওরিব্বাপরে, হাত তুলে ফেললো সে। একশো হাত দূরে থাকবো আমি।

সুর করে গেয়ে উঠলো রবিন,

ফর মেকিং টরটিলাস ইউ উইল ইউজ আ মিটেট,

অ্যান্ড ফর আ বেড উই উইল ইউজ আ পিটেট।

ভ্রূকুটি করলো মুসা। নাম কি! পিটেট! তা যে-টেটই হোক, আমি বাপু ওই। ঘাসের মাদুরে ঘুমোতে পারবো না। আমি অ্যাজটেক নই।

হেসে উঠলো রবিন আর কিশোর। মূসাও হাসলো।

রবিন, কিশোর বললো। দেখ, ছবিগুলো শুকালো কিনা।

ডার্করুমে গিয়ে কয়েকটা ছবি নিয়ে এলো রবিন। ভেজা রয়েছে। বিছিয়ে দিলো টেবিলে। আগ্রহে সামনে ঝুঁকলো মুসা।

যেসব জায়গায় ছবি তুলেছেন মিস্টার রেডফোর্ড, কিশোর বললো। সবখানে যাবো আমরা।

তারমানে প্রাচীন কীর্তিগুলো দেখার সুযোগ পাচ্ছি? মুখ তুললো মুসা।

হ্যাঁ। সবগুলো না হলেও কিছু কিছু।

হাসি দূর হয়ে গেল মুসার মুখ থেকে। সেই জায়গায় ফুটলো সন্দেহ। ছবির পিরামিডের সিঁড়িতে আঙুল রেখে বললো, এখানে আবার ওঠার কথা বলবে না তো? যা সরুরে ভাই, আর যা খাড়া! কোমর ভাঙার কোনো ইচ্ছেই আমার নেই!

আমারও না, সুর মেলালো কিশোর। ইনডিয়ানরা একটা বিশেষ কায়দায় ওপরে ওঠে, হাঁটাচলা করে। সেভাবে চললে আর পড়বে না।

কিছুক্ষণ পরে ফোন করলেন মিস্টার সাইমন। জানালেন, সব ব্যবস্থা হয়ে গেছে। তিনটে পাস যোগাড় করেছি। মেকসিকো সিটিতে হোটেলও বুক করা হয়েছে। ওখানে উঠবে। তার পর ইচ্ছে মতো যেখানে খুশি যাবে। কোথায় যাবে, কিভাবে যাবে, সেটা তোমাদেরকেই ঠিক করতে হবে।

প্লেনের টিকেট?

লাগবে না। আমার প্লেনটাতে করেই যেতে পারবে। ল্যারি কংকলিন গিয়ে পৌঁছে দিয়ে আসবে তোমাদের। আসার আগে ফোন করে দিও আমাকে। আবার প্লেন পাঠিয়ে দেবো।

টাকার অভাব নেই মিস্টার সাইমনের। বই লিখে, গোয়েন্দাগিরি করে অনেক টাকা আয় করেছেন। ব্যক্তিগত বিমান কিনে, পাইলট সহ সেটার খরচ বহন করারও ক্ষমতা আছে তার। ল্যারি কংকলিন হলো তাঁর পাইলট। বিমানটা খুবই ভালো। তাতে উড়েছে তিন গোয়েন্দা। কংকলিনের পাশে বসে কয়েকবার ওটাকে উড়িয়েছেও মুসা।

কখন রওনা হচ্ছি? জানতে চাইলো কিশোর।

কাল সকালে।

আচ্ছা, ফোন রেখে দিলেন সাইমন।

গাড়ির কাজ শেষ করে মুসাকে তৈরি হয়ে নিতে বললো কিশোর। তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেল সহকারী গোয়েন্দা। আরও কিছু ছবি প্রিন্ট করার জন্যে ডার্করুমে গিয়ে ঢুকলো রবিন। টেবিলের ছবিগুলো কাছে টেনে নিলো কিশোর। ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে ভালোমতো পরীক্ষা করে দেখবে, নতুন কিছু পাওয়া যায় কিনা।

কয়েক মিনিট পর আবার ফোন করলেন মিস্টার সাইমন। জানালেন, বারোজের জ্ঞান ফিরেছে। তিনি হাসপাতালে যাচ্ছেন। কিশোররা চাইলে আসতে পারে।

এখুনি আসছি, বলে উঠে দাঁড়ালো কিশোর। ডাক দিলো রবিনকে।

হাসপাতালের গেটে দেখা হলো সাইমনের সঙ্গে। ওদের অপেক্ষায়ই দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। ইনফরমেশন ডেস্কে জিজ্ঞেস করতেই জানিয়ে দেয়া হলো বারোজের ঘর কোথায়। এলিভেটরে করে তিনতলায় চলে এলো ওরা। ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে রয়েছেন ফাউলার। গোয়েন্দাদেরকে ভেতরে নিয়ে গেলেন।

ফ্যাকাসে হয়ে আছে বারোজের চেহারা। মলিন হাসি হাসলো। আপনাদেরকে অনেক কষ্ট দিচ্ছি। মাপ করে দেবেন। ওই বাড়িতে ঢুকে একটা গাধামি করেছি। বছরখানেক আগে একটা ডুপ্লিকেট চাবি দিয়েছিলেন আমাকে রেডফোর্ড।

টাকার খুব প্রয়োজন তার, জানালো বারোজ। সেজন্যেই উইলের পাওনাটা তাড়াতাড়ি আদায়ের জন্যে অ্যাজটেক যোদ্ধার খোঁজ করতে গিয়েছিলো। কারণ যোদ্ধাকে বের করে তার সম্পত্তি ফিরিয়ে দিলেই টাকা জোগাড়ের ব্যবস্থা হয়ে যাবে। টাকা তো পেলামই না, আক্ষেপ করে বললো সে। ঘটালাম দুর্ঘটনা। এখন আরো বেকায়দা অবস্থা আমার।

অ্যাজটেক যোদ্ধা কে, বা কি, সে-ব্যাপারে কোনো ধারণা আছে কিনা বারোজের জিজ্ঞেস করলেন সাইমন। মাথা নাড়লো অসুস্থ মানুষটা। অনেক দিন আগে একবার রেডফোর্ড বলেছিলেন আমাকে, অ্যাজটেকদের একজন উত্তরাধিকারীর কাছ থেকে একটা দামী জিনিস পেয়েছেন। তবে সেটা কি, বলেননি। আমার ওই ভাইটা ছিলেন সাংঘাতিক চাপা স্বভাবের। জিনিসটা কি আন্দাজ করতে পারেন? না। বারোজ জানালো, রেডফোর্ড নাকি বলেছেন, জিনিসটা তাঁকে রাখতে দেয়া হয়েছিলো পাঁচ বছরের জন্যে। তারপর আবার ফিরিয়ে দেয়ার কথা। আমার বিশ্বাস, বারোজ বললো। এই জিনিসটার কথাই উল্লেখ করা হয়েছে উইলে।

তাহলে এমনও তো হতে পারে, ফাউলার বললেন। পাঁচ বছর মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। যার জিনিস তাকেই আবার ফেরত পাঠিয়েছেন মিস্টার রেডফোর্ড। উইলে সেকথা লেখার আর সুযোগ পাননি।

মাথা নাড়লো বারোজ। আমার তা মনে হয় না। যদ্দূর মনে পড়ে, বছর তিনেক আগে আমাকে কথাটা বলেছিলেন রেডফোর্ড। আমাকে বিশ্বাস করতেন। অনেক গোপন কথাই বলতেন। বলেছেন, জিনিসটা তিনি যত্ন করে লুকিয়ে রেখেছেন। কিন্তু কি জিনিস, তা বলেননি। আমিও চাপাচাপি করিনি। বাড়িতেও থাকতে পারে ওটা, কিংবা অন্য কোথাও। জানি না।

আর কিছু বলার নেই বারোজের। রাস্তায় নেমে কিশোর প্রস্তাব দিলো আরেকবার রেডফোর্ড এস্টেটে যাওয়ার। মেকসিকোতে যাওয়ার আগে আরও একবার খুঁজে দেখতে চায়। ওদেরকে নিয়ে চললেন ফাউলার।

সব সময় কিছু বিশেষ যন্ত্রপাতি থাকে সাইমনের গাড়ির বুটে। তদন্তের সময় কাজে লাগে। নেমে গিয়ে বুট খুললেন তিনি।

তিনটে গাড়ি নিয়ে এসেছে চারজনে। নিজের গাড়ি থেকে নেমে এলেন ফাউলার। কিশোর আর রবিন নামলো রবিনের ফোক্সওয়াগন থেকে। সাইমনকে যন্ত্রপাতি নামাতে সাহায্য করতে এগোলো।

পোর্টেবল ফ্লোরোস্কোপ আর একটা মেটাল ডিটেকটর বের করা হলো। বাড়ির দেয়াল, মেঝে, হাত, সব জায়গায় খোঁজা হলো যন্ত্রের সাহায্যে। কয়েকবার মিটমিট করে জানান দিলো যন্ত্রের বাতি, জিনিস রয়েছে। তবে সেগুলোর কোনোটারই কোনো গুরুত্ব আছে বলে মনে হলো না।

সারাক্ষণ গোয়েন্দাদের সঙ্গে সঙ্গে থাকলেন ফাউলার। কিছুই পাওয়া গেল না দেখে জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, এভাবে হবে না। সমস্ত রহস্যের চাবিকাঠি রয়েছে, আমার ধারণা, পিন্টো আলভারোর কাছে।

সাইমনও একমত হলেন। মনে পড়লো সেই লোকটার কথা,সন্ধ্যাবেলা যাকে তাড়া করেছিলো কিশোর আর রবিন। তার কোনো খবর আছে কিনা জিজ্ঞেস করলেন উকিলকে।

না, জবাব দিলেন ফাউলার। বেনিফিশারিদের কেউ হতে পারে ভেবে, উইলে যতজনের নাম লেখা রয়েছে, সবার খোঁজখবর নিয়েছি আমি। কেউ আসেনি ওরা। সবারই অ্যালিবাই রয়েছে, হাসলেন তিনি। গোয়েন্দা হওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছি অযথা। কিছুই করতে পারলাম না।

ভূল বললে, হেসে বললেন সাইমন। অনেক কিছুই করেছে। এই যে খোঁজাখুঁজিটা করলে, এতে অনেক লাভ হয়েছে। আর এতো দুঃখ পাওয়ার কিছু নেই তোমার। আমরা তো অভিজ্ঞ গোয়েন্দা। কি করতে পারলাম? এখনও অন্ধকারেই রয়েছি।

সেদিন আর কিছু করার নেই। অফিসে চলে গেলেন ফাউলার। সাইমন চলে গেলেন কাজে। দুই গোয়েন্দা ফিরে এলো ইয়ার্ডে।

পরদিন সকালে মালপত্র গুছিয়ে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো তিন গোয়েন্দা। ট্যাক্সি নিয়ে চলে এলো বিমান বন্দরে। অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বিল্ডিঙের ভেতর দিয়ে ঢুকে বেরিয়ে এলো একটা খোলা অঞ্চলে। ওখানে রাখা হয় ব্যক্তিগত বিমান। অবশ্যই ভাড়া দিতে হয়। মিস্টার সাইমনের বিমানটা দেখতে পেলো ওরা। রানওয়ের শেষ মাথায়।

হঠাৎ চলতে শুরু করলো ওটা। কিন্তু ছেলেদের দিকে এগিয়ে এলো না। বরং রানওয়ে ধরে উল্টোদিকে রওনা হয়েছে। গতি বাড়ছে দ্রুত। দেখতে দেখতে মাটি ছেড়ে শূন্যে উড়াল দিলো।

খাইছে! বলে উঠলো মুসা।

আমাদের রেখেই চলে যাচ্ছে! রবিনও কিছু বুঝতে পারছে না।

আমার তা মনে হয় না! উত্তেজিত শোনালো কিশোরের কণ্ঠ। নিশ্চয় কিছু ঘটেছে! হাইজ্যাক করা হয়েছে প্লেনটা?

<

Super User