চমকে জেগে গেল কিশোর। কানে আসছে চিৎকার। কিছুই বুঝতে না পেরে লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালো। দরজার দিকে ছুটলো। মনে হচ্ছে কোনো গোলমাল হয়েছে। দরজা থেকেই সৈকত চোখে পড়ে। ভোর হয়ে গেছে। পুবের আকাশ লাল। মৃদু বাতাসে যেন অস্বস্তি বোধ করছে, এমনি ভঙ্গিতে কাঁপছে নারকেল পাতা। লেগুনের পানি শান্ত। আগের জায়গাতেই ভাসছে ফ্লাইং বোট। একটা নড়াচড়া চোখে পড়তেই ঝট করে তাকালো সেদিকে। সৈকত ধরে দৌড়ে আসছে সাগরের হাসি। আসছে! আসছে! চিৎকার করছে সে, শয়তানটা আসছে!

কি হয়েছে? ভেতর থেকে জিজ্ঞেস করলো ওমর। উঠে পড়েছে বিছানা ছেড়ে। জ্যাকেট চড়াচ্ছে গায়ে।

কারনেস আসছে বলে!

দুই লাফে দরজার কাছে চলে এলো ওমর। কই?

দেখতে তো পাচ্ছি না।…হ্যাঁ হ্যাঁ, ওই যে! পাথরের দেয়ালটার দিকে দেখালো কিশোর। লেগুনে ঢোকার মুখে খুদে একটা দ্বীপ পড়ে। ওটার পেছনে দেখা যাচ্ছে স্কুনারের পাল। সব কটা পালই ফুলে উঠেছে ভোরের বাতাসে। সাগরের পানিতে রাজহাঁসের মতো স্বচ্ছন্দে ভেসে চলেছে জাহাজ। আরেকটু এগিয়ে ঘুরে গেল ওটার নাক। ঢুকে পড়লো লেগুনে। সোজা এগিয়ে আসতে লাগলো সৈকতের দিকে।

করছে কি? পাল নামায় না কেন? কাঁধের ওপর দিয়ে বললো ডজ। সে-ও এসে দাঁড়িয়েছে পেছনে।

খাইছে! ওটা… মূসার কথা শেষ হওয়ার আগেই কিশোরও বুঝে ফেললো। চেঁচিয়ে উঠলো, প্লেনটাকে ভাঙতে যাচ্ছে! ধাক্কা মারবে!

একটা মুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে রইলো সে। তারপরেই নড়ে উঠলো। মুসা, এসো! বলেই সৈকতের দিকে দৌড় দিলো কিশোর। যেখানে ক্যানুগুলো রয়েছে। ওদের পেছনে ছুটলো সাগরের হাসি।

ধরো, ধরো, হাত লাগাও! একটা ক্যানুকে টানতে শুরু করলো কিশোর, পানিতে নামানোর জন্যে। বেজায় ভারি। বললো, নাহ! নামানো যাবে না! বলে একটা মুহূর্তও আর দেরি না করে গিয়ে পানিতে ঝাঁপ দিয়ে পড়লো। কিছুই বুঝতে না পেরে মুসাও নামলো তার সঙ্গে। সাগরের হাসিও নামলো।

বিমানটার দিকে সাঁতরাচ্ছে কিশোর। পাশে চলে এলো মুসা আর সাগরের হাসি। কিশোরের চেয়ে ভালো সাঁতরায় মুসা, তার চেয়েও অনেক ভালো সাগরের হাসি, একেবারে মাছের মতো। মুসা জিজ্ঞেস করলো, কি করবে?

নোঙরের দড়িটা কেটে দিতে হবে! হাঁপাতে শুরু করেছে কিশোর। মুসা, জলদি!

আমি যাচ্ছি, বলেই গতি বাড়িয়ে দিলো সাগরের হাসি। পানির ওপর দিয়ে পিছলে চলে যেতে লাগলো যেন। অনেক পেছনে পড়ে গেল মুসা আর কিশোর।

একশো গজ দূরে রয়েছে বিমানটা। কিশোরের মনে হলো, কয়েক মাইল। জাহাজটার আগে সে কিছুতেই পৌঁছতে পারবে না, বুঝে গেছে। মুসাও না। সাগরের হাসিই এখন একমাত্র ভরসা। ওরা অর্ধেক যাওয়ার আগেই পৌঁছে গেল মেয়েটা। নোঙরের দড়ি বেয়ে উঠে গেল ওপরে। কোমর থেকে ছুরি টেনে নিয়ে কাটতে শুরু করলো দড়ি। ভোরের রোদে ঝিক করে উঠছে ছুরির ফলা। জাহাজটাও প্রায় পৌঁছে গেছে। ভালো বাতাস পেয়েছে। ফুলে উঠছে সব কটা পাল।

সাগরের দিক থেকে বইছে বাতাস, দড়ি কাটা হয়ে গেল। বিমানটাকে ঠেলে নিয়ে আসতে লাগলো তীরের দিকে। নাক ঘোরাতে শুরু করলো হোয়াইট শার্ক। ধাক্কা মারবেই, যে করেই হোক।

তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে কিশোর। ঝড়ের গতিতে চিন্তা চলছে মগজে। কিছু একটা করা দরকার, কিছু একটা…আবার সাঁতরাতে শুরু করলো সে বিমানের দিকে। জাহাজের ধাক্কা খাওয়ার ঝুঁকিকে অগ্রাহ্য করে চলে এলো বিমানের কাছে। নোঙরের দড়িটা চেপে ধরলো। মুসাকে বললো, ধরো! দড়িটা ছেড়ে দিয়েই হাত বাড়িয়ে ধরে ফেললো একটা উইং ফ্লোট। যেগুলোর ওপর ভর করে পানিতে ভেসে থাকে ফ্লাইং বোট। একপাশে কাত হয়ে গেল বিমান। পরোয়াই করলো না সে। মুসা দড়ি ধরেছে কি না সেটাও দেখতে গেল না। ফ্লোট থেকে এক ডানার ওপরে চড়লো। নাকের ওপর বসে জাহাজটার দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে সাগরের হাসি। কি করবে বুঝতে পারছে না। ডানার ওপর দিয়ে দৌড় দিলো কিশোর। মেয়েটাকে চুপ করে বসে থাকতে বললো। পিঠের ওপর দিয়ে পার হয়ে এসে নামলো আরেক ডানায়। চলে এলো ডানার একেবারে প্রান্তে। ওদিক দিয়েই এগোচ্ছে স্কুনারটা। লোহায় বাঁধানো গলুইয়ের একটা ধাক্কা লাগলেই চুরমার হয়ে যাবে ফ্লাইং বোট। ইঞ্জিন স্টার্ট দিতে পারলে সরিয়ে নেয়া যেতো, কিন্তু সময় নেই। কারনেসও বুঝতে পারছে সেটা। হুইল ধরে দাঁড়িয়েছে। মুখে কুৎসিত হাসি। নিশ্চিত হয়ে গেছে, তারই জিৎ হবে।

তবে একটা ব্যাপার সে জানে না, যেটা কিশোর জানে। উইং ফ্লোটের ওপর খুব হালকা হয়ে ভাসে ফ্লাইং বোট। একটা বাচ্চা ছেলেও টেনে ওটাকে সহজেই সরিয়ে ফেলতে পারে। তবে কোনো কিছুর ওপর দাঁড়িয়ে। দাঁড়ানোর মতো সেরকম কোনো জায়গা পায়নি কিশোর। তাই বিমানের ওপরই দাঁড়িয়েছে।

নোঙরের দড়ি ধরে রেখেছে মুসা। কিশোরের উদ্দেশ্য বুঝে ফেলেছে। ধাক্কা দেয়ার আগেই দু হাত বাড়িয়ে স্কুনারের গলুইয়ের নিচেটা ধরে ফেলতে চায় কিশোর। তাহলে আর বিমানের গায়ে ধাক্কা লাগবে না। জাহাজের সঙ্গে সঙ্গে বিমানটাও সরতে থাকবে।

দুরুদুরু করছে কিশোরের বুক। আতঙ্কিত চোখে তাকিয়ে রয়েছে গলুইয়ের নিচের লোহাবাঁধানো জায়গাটার দিকে। ঠেকাতে পারবে তো? চট করে তাকালো একবার জাহাজের নোঙরটার দিকে। কাদা লেগে রয়েছে। পানি ঝরছে ফোটা ফোটা। বলা যায় না, রেগে গিয়ে ওটা তার মাথার ওপরে ছেড়ে দিতে পারে কারনেস।

দুই পা ফাঁক করে শক্ত হয়ে দাঁড়ালো কিশোর। এসে গেছে গলুই। ধাক্কা প্রায় লাগে লাগে এই সময় হাত বাড়িয়ে ধরে ফেললো গলুইয়ের নিচের অংশ। প্রচন্ড একটা ঝাঁকুনি লাগলো। পলকের জন্যে মনে হলো তার, পায়ের নিচ থেকে পিছলে সরে যাচ্ছে বিমানের ডানা। দুলুনিতে পড়ে যাচ্ছিলো সে আরেকটু হলেই। কোনোমতে সামলে নিয়ে জোরে এক ঠেলা মারলো জাহাজের গায়ে। জাহাজ সরলো না, সেটাকে সরানোর চেষ্টাও করেনি সে, পায়ের ধাক্কায় বিমানটাই বরং সরলো। এবার আর তাল সামলাতে পারলো না কিশোর। মাথা নিচু করে পড়ে গেল পানিতে ঝাঁ ঝাঁ করে উঠলো কানের ভেতর। বিশাল একটা ছায়া উঠে আসছে মাথার ওপরে। ডাইভ দিয়ে নিচে নেমে যেতে লাগলো সে। বাতাসের জন্যে আকুলি-বিকুলি করছে ফুসফুস। ফেটে যাবে যেন। কিন্তু ওঠার উপায় নেই। জাহাজের তলায় বাড়ি লেগে ছাতু হয়ে যাবে খুলি। হাত-পা ছোড়াছুঁড়ি করে ছায়াটার নিচ থেকে সরে আসার আপ্রাণ চেষ্টা চালালো সে। সে সরলো, না ছায়াটাই সরলো, বলতে পারবে না। সুযোগ পেয়েই উঠতে শুরু করলো ওপরে। যখন মনে হলো, আর টিকবে না ফুসফুসটা, ঠিক ওই মুহূর্তে ভুস করে মাথাটা ভেসে উঠলো ওপরে। হাঁ করে শ্বাস টানতে শুরু করলো সে।

দীর্ঘ কয়েকটা সেকেন্ড একভাবে ভেসে থেকে বাতাস টানলো সে। শক্তি ফিরে এলো খানিকটা। মুখ ঘুরিয়ে তাকালো বিমানটার কি হয়েছে দেখার জন্যে। স্পষ্ট হয়নি এখনও দৃষ্টি। আবছা ভাবে দেখলো, তার দিকে সাঁতরে আসছে সাগরের হাসি। তীরের দিকে বিমানটাকে টেনে নিয়ে চলেছে মুসা। মুসার মুখটা দেখা যাচ্ছে ককপিটের জানালায়। স্টার্ট নিয়েছে ইঞ্জিন। তীরে দাঁড়িয়ে আছে ওমর আর ডজ। দুজনের হাতেই পিস্তল।

চলতে শুরু করলো বিমান।

ওটাকে ধরতে পারবে না বুঝেই যেন সমস্ত আক্রোশ কিশোর আর সাগরের হাসির ওপর এসে পড়লো কারনেসের। জাহাজের নাক ঘোরালো ওদের দিকে। মেরেই ফেলবে। গুলি আরম্ভ করলো ওমর আর ডজ। কিন্তু হুইল হাউসে কারনেসের গায়ে লাগাতে পারলো না একটা গুলিও।

বিমানটাও ছুটে আসছে।

কিশোরের হাত ধরে টান মারলো সাগরের হাসি। ডুব দাও! বলেই ডুব মারলো সে।

কিশোরও ডুব দিলো। সাঁতরে চললো তীরের দিকে। কোনোমতে অল্প পানিতে চলে যেতে পারলেই হয়, যেখানে পৌঁছতে পারবে না জাহাজ। আবার যখন বাতাসের জন্যে তাগাদা দিতে লাগলো ফুসফুস, তখন ভাসলো। দেখলো, অনেকটা সরে এসেছে জাহাজের কাছ থেকে। আবার দিলো ডুব। আবার ভাসলো। আর ডুবলো না। নিরাপদ জায়গায় চলে এসেছে। এখানে আর পৌঁছতে পারবে না স্কুনার। আর পারলেও ধরতে পারবে না ওকে।

তীরের অনেক কাছাকাছি চলে গেছে সাগরের হাসি। দৌড়ে আসছে ঝিনুক। পানির কিনারে এসে একটা মুহূর্ত থমকালো। দেখলো পুরো অবস্থাটা। তারপর নেমে পড়লো পানিতে কিশোরকে সাহায্য করতে এগোলো।

ফ্লাইং বোট নিয়ে উড়াল দিলো মুসা।

তীরে উঠে ধপাস করে বালিতেই বসে পড়লো কিশোর। থু থু করে মুখ থেকে ছিটিয়ে ফেললো নোনা পানি আর বালি।

নাক ঘুরিয়ে ফেলেছে স্কুনাটা। আর কিছু করার নেই, বুঝে গেছে কারনেস। ফিরে যাচ্ছে খোলা সাগরে।

জাহাজটা বেরিয়ে যাওয়ার পর লেগুনে নামলো আবার মুসা।

জিরিয়ে নিয়ে কাপড় পরে ডজ আর ওমরের সঙ্গে নাস্তা সেরে নিলো কিশোর ও মুসা। তারপর বিমানে করে রওনা হলো ডজ আইল্যান্ডের উদ্দেশে। ঝিনুক আর সাগরের হাসিকেও নেয়া হয়েছে সঙ্গে। এতোগুলো মানুষ নিয়ে আকাশে উড়তে বেশ কষ্টই হলো ফ্লাইং বোটের। তবে যেটুকু অসুবিধে হয়েছে, তা ওঠার সময়। ওপরে উঠে আর কিছু হলো না। উড়ে চললো নিরাপদেই।

দশ মিনিটের মধ্যেই নজরে এলো ডজ অ্যাইল্যান্ড।

দ্বীপের লেগুনে বিমান নামালো ওমর। দক্ষিণ সাগরের অনেক দ্বীপেরই লেগুন দেখেছে কিশোর আর মুসা। তবে এটার মতো এতো সুন্দর আর দেখেনি। ওদের দিকে তাকিয়ে হাসলো কিশোর। জীবনে এই প্রথম প্লেনে চড়েছে ওরা। দারুণ খুশি। গড়গড় করে কি যেন বললো আঞ্চলিক ভাষায়। কয়েকটা শব্দ শুধু বুঝলো কিশোর আর মুসা। ডজকে জিজ্ঞেস করলো, কি বলেছে।

ওরা বলছে, ডজ জানালো। বিদেশী মানুষের কাজকারবারই আলাদা। এমন কোনো মজার কান্ড নেই, যা তারা করতে পারে না। বাক্সের ভেতর থেকে গান বের করে দিতে পারে। ক্যানুতে ডানা লাগিয়ে আকাশে উড়তে পারে।

হাসলো দুই গোয়েন্দা। এসব কথায় কান দিচ্ছে না ওমর। সে তখন নোঙরের জায়গা খুঁজছে। বিমানের উইং ফ্লোট চিরে দিচ্ছে যেন লেগুনের শান্ত পানিকে, লাঙল দিয়ে মাটি ফাড়ার মতো করে। বিশাল ঢেউ উঠছে। এখানেই রাখলাম, কি বলো? ডজের দিকে তাকালো সে।

রাখো, যেখানে খুশি, ডজ বললো।

ক্যাম্পের কাছাকাছি রাখাই ভালো। চোখের আড়াল করা উচিত না। একবার করেই তো শিক্ষা হয়েছে।

ওই যে ওই নারকেল গাছগুলোর কাছাকাছি নিয়ে রাখো। তীরের কাছেও পানি বেশ গভীর। প্লেন থেকেই লাফ দিয়ে ডাঙায় নামতে পারবো। জুতো ভেজাতে হবে না। ওই যে, ওটাই আমার কুঁড়ে। নারকেল পাতায় তৈরি ছাউনিটা দেখলো ডজ।

তিনটে মাস থেকেছো ওর মধ্যে! বিড়বিড় করলো ওমর।

থেকেছি। বিল্ডিং আর এখানে পাবো কোথায়।

ডজ যে জায়গাটা দেখিয়েছে ধীরে ধীরে বিমানটাকে সেখানে নিয়ে এলো ওমর। ইঞ্জিন বন্ধ করলো। পানি ওখানে এতো পরিষ্কার, মনে হয় নেইই, অবিশ্বাস্য লাগে।

প্রবালের একটা চড়ায় নামলো সে। বললো, এখানেই বাঁধি। জিনিসপত্র নামিয়ে নিয়ে যাবো। যাতে সকালে উঠেই কাজে লেগে যেতে পারি।

চোখা পাথরের মতো বেরিয়ে থাকা এক টুকরো প্রবালে বিমানের দড়ি বাঁধা হলো। ভেসে যাওয়ার ভয় নেই। টান লেগে ছুটবেও না, কারণ সামান্য ঢেউও নেই পানিতে। রসদপত্র আর পেট্রোল তীরে নামানো হলো প্রথমে। তারপর বয়ে আনা হলো ডজের কুঁড়েতে। ঘরটা অতো খারাপ না। মেরামত করে নিলে সবারই জায়গা হয়ে যাবে। সাগরের হাসি আর ঝিনুকও অভিযাত্রীদের কাজে সাহায্য করলো। অনর্গল বকবক করে যাচ্ছে ওরা আঞ্চলিক ভাষায়। ভালো লাগলো অন্যদের। ছেলেমেয়ে দুটো সহজ করে রেখেছে পরিবেশ। ডাইভিঙের পোশাক আর অন্যান্য সরঞ্জাম বিমানেই রেখে দেয়া হলো। আগামী দিন সকালে কাজে লাগবে ওগুলো।

মুক্তো খেতটা কোনদিকে? ওমর জানতে চাইলো।

ওদিকে, হাত তুলে দেখালো ডজ। কাল এই সময়ে অনেক ঝিনুক তোলা হয়ে যাবে আমাদের।

আচ্ছা, একটা কথা, মুসা বললো। ঝিনুক খুলতে যাবে কে? যে রকম বড় বড় বললেন। ঝিনুক খোলা খুব কঠিন।

হাসলো ডজ। ঠিকই। একটা দুটো হলে সম্ভব। কিন্তু আমাদেরকে যতোগুলো তুলতে হবে, অতোগুলো জ্যান্ত অবস্থায় ছুরি দিয়ে খুঁচিয়ে খোলা.. হাত নাড়লো সে। কিছুতেই পারবো না। তুলে এনে সৈকতে ছড়িয়ে রাখতে হবে, পচানোর জন্যে। ঝিনুক মরে গেলে আপনা আপনি ডালা ফাঁক হয়ে যাবে।

এতো ঝিনুক পচে নিশ্চয়ই খুব গন্ধ বেরোয়? ওমর জানতে চাইলো।

খুব মানে? ভয়াবহ! এতো দুর্গন্ধ পৃথিবীতে আর কিছুর আছে কি না জানি। তবে ভয় নেই। আমরা ওগুলোকে ফেলবো দ্বীপের একধারে, বাতাস যেদিকে বইবে তার উল্টো দিকে। তাহলেই আর গন্ধ লাগবে না।

আলোচনা আর খাবার তৈরি একসাথে চললো। তারপর খেতে বসলো ওরা। তখুনি একবার মুক্তো খেত দেখতে যেতে চাইলো কিশোর। ওমর রাজি হলো না। বললো, প্লেনটা একবার পরীক্ষা করে দেখবে। যাতে পরে কোনো বিপদ না ঘটায়। আর ক্যাম্পেও সব কিছু গোছগাছ করা দরকার। ডজ বললো, সে ডুবুরির পোশাক আর সরঞ্জামগুলো পরখ করবে। তাকে সাহায্য করতে চাইলো মুসা।

আপাতত কিশোরের কিছু করার নেই। সে সাগরের হাসি আর ঝিনুককে নিয়ে চললো লেগুন দেখতে। ওটা কেমন, ভাবতে একটা শব্দই শুধু মাথায় এলো তার পরীর রাজ্য। রঙের বাহার অভিভূত করে ফেললো তাকে। স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ পানিতে গাঢ় নীল আকাশের ছায়া পড়ে পানিকেও নীল করে তুলেছে। এর পটভূমিতে নারকেলের ঘন সবুজ পাতাকে লাগছে ছবির মতো। পানিতে সাঁতার কাটছে হাজার রকমের মাছ। কোনোটা ছোট, কোনোটা বড়। রামধনুর সমস্ত রঙই রয়েছে ওগুলোর শরীরে। যেমন রঙ তেমনি ছটা। রীফের গায়ের কাছে এখানে ওখানে দেখা যাচ্ছে প্রবালের ছড়াছড়ি। সূর্য রশ্মি তেরছা ভাবে এসে পড়েছে তার ওপর। কোথাও কোথাও এমন লাগছে, মনে হচ্ছে মেঘ করেছে পানির তলায়। কোথাও তুষার-শুভ্র প্রবাল পাথরের বিশাল চাইয়ের মতো মাথা তুলেছে পানির ওপরে, ভাসমান বরফখন্ড ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না ওগুলোকে। লেগুনের নিচেটা যেন রূপকথার এক রহস্যময় জগৎ। প্রবালের বিচিত্র আকার, আজব চেহারা। রঙও তেমনি। লালই আছে কয়েক রকম। ঘন লাল, রক্ত লাল, টুকটুকে লাল, ফ্যাকাসে লাল, গোলাপী। আছে নীল, সবুজ, হলুদ। মোট কথা একজন শিল্পীর তুলি দিয়ে যতগুলো রঙ তৈরি করা সম্ভব, সবই আছে এখানে। অসাধারণ সুন্দর। জ্যান্ত উদ্ভিদের মতো লাগছে গোলাপী আর আশমানি রঙের প্রবালের ডালপালা। কোনোটা বড় পাতার মতো দেখতে, কোনোটা কৌণিক, কোনটা আবার বিশাল ব্যাঙের ছাতার মতো। সে-এক উজ্জ্বল পৃথিবী। কোথাও কোনো অসামঞ্জস্য নেই। কঠিন অথচ দেখতে লাগে কোমল। সব কিছুতেই যেন জাদুর পরশ। অবিশ্বাস্য! এই সুন্দরের মাঝে দুই ফুট লম্বা একটা শুঁয়াপোকার মতো জীবকে বুকে হেঁটে এগোতে দেখে গায়ে কাঁটা দিলো কিশোরের। মনে পড়ে গেল ডজের কথা, সৌন্দর্য আর কদর্যের ঠাই এখানে পাশাপাশি।

জীবটাকে দেখে কিশোরের মুখ বিকৃত করে ফেলা নজর এড়ালো না সাগরের হাসির। ঝাঁপ দিয়ে পড়লো সে পানিতে। স্বচ্ছন্দে ডুবে গেল পানির তলায়। তুলে নিয়ে এলো জীবটাকে। কিশোরের চেহারা দেখে খিলখিল করে হাসলো। ওটাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে উঠে এলো ওপরে। কুকুরের মতো গা ঝাড়া দিয়ে শরীর থেকে পানি ফেলছে।

কিশোর অনুমান করলো দ্বীপটা তিন কি চার মাইল লম্বা। পাশে একেবারেই কম, মাত্র কয়েকশো গজ। তা-ও সব চেয়ে চওড়া অংশটায়। লেনের দিকটায় হ্রদের পানির মতোই শান্ত পানি, কিন্তু সাগরের দিকটায় ঢেউ আছড়ে ভাঙছে ভীমবেগে। হাজারো বজ্রের আওয়াজ তুলে ফাটছে পানির পর্বত, অনবরত পানি ছিটাচ্ছে বৃষ্টির মতো। প্রবালের ওপর এসে জমা হয়েছে হাজারে হাজারে ঝিনুকের খোসা, সাগরে যতো রকম আর আকারের থাকতে পারে সব রকম-কিশোরের অন্তত তা-ই মনে হলো। আছে মাছের কঙ্কাল। বড় বড় দাঁতও পড়ে থাকতে দেখা গেল। সেগুলো কোন জীবের বুঝতে পারলো না সে। তবে যারই হোক, সে-যে দৈত্যাকার প্রাণী, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ঢেউ আসছে, আর সঙ্গে করে বয়ে আনছে ওসব।

দ্বীপে উদ্ভিদের প্রজাতি তেমন বেশি নেই। এসব অঞ্চলের প্রধান যে গাছ, নারকেল, তা আছে প্রচুর পরিমাণে। পানির ধার ঘেঁষেও জন্মেছে অনেক। ওপরের উঁচু দিকটায় জন্মেছে ঘন সবুজ ঘাস। কিছু অচেনা ঝোঁপ হয়ে আছে, তাতে উজ্জ্বল রঙের ফুল ফুটেছে। সব চেয়ে উঁচু জায়গাটাও পানির সমতল থেকে পঁচিশ ফুটের বেশি উচু হবে না। হারিকেনের সময় নিশ্চয় ওখানেও পানি উঠে যায়। নোনা পানির এই অত্যাচারের কারণেই এসব অঞ্চলে উদ্ভিদ তেমন জন্মাতে পারে না।

ডাঙায় জীবনও অনেক কম, পানির তুলনায় প্রায় শূন্য বললেই চলে। যারা আছে তারাও বেশির ভাগই পানির জীব। বালিতে ঋষি কাঁকড়ার ছড়াছড়ি, হাজারে হাজারে, অদ্ভুত খোলাওলো বিচিত্র শব্দ করে বন্ধ করছে, আবার খুলছে। পাথরের ওপর নুড়ি পড়লে যেরকম আওয়াজ হয়, বন্ধ করার শব্দটা অনেকটা তেমন। এছাড়া আছে কিছু সামুদ্রিক পাখি।

বিকেলের দিকে ভাটায় যখন টান পড়লো, আশ্চর্য রকম নীরব হয়ে গেল তখন পরিবেশ। কেমন যেন গায়ে লাগে সেই নীরবতা। অসহ্য মনে হয়। বিষন্ন করে দেয় মন। সাংঘাতিক নিঃসঙ্গ মনে হলো নিজেকে কিশোরের। এখানে তিনটে মাস একা একা থাকলে কি করে ডজ! পাগল যে হয়নি এটাই যথেষ্ট। অস্বাভাবিক মনের জোর আর সহ্য ক্ষমতা তার। কিশোর হলে পারতো না। অনেকে তো সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যাই করে বসে। তাড়াতাড়ি ফিরে এলো সে অন্যদের কাছে। সবাই কেমন যেন চুপচাপ হয়ে আছে। পরিবেশের চাপ ওদের ওপরও পড়েছে, বোঝা যায়। এমনকি সাগরের হাসি আর ঝিনুকও অগ্নিকুন্ডের দিকে তাকিয়ে ঝিম মেরে রয়েছে।

অবশেষে নীরবতা ভাঙলো ওমর, কিশোরের দিকে তাকিয়ে বললো, পাহারায় থাকতে হবে। কারনেসকে বিশ্বাস নেই। প্রথম পালা তোমার।

ঠিক আছে, বস, পরিবেশটাকে হালকা করার জন্যে হেসে নাটকীয় ভঙ্গিতে বললো কিশোর। আগুনের দিকে তাকিয়ে আনমনে মাথা নাড়তে নাড়তে বললো, মনে হচ্ছে, এই পৃথিবীতে নেই আমরা, অন্য কোনো গ্রহে চলে গেছি! আশ্চর্য! আগেও তো দক্ষিণের দ্বীপে এসেছি, আটকা পড়েছি, পানির অভাবে মরতে বসেছি, তখন তো এরকম লাগেনি!

লাগেনি, ডজ বললো। তার কারণ, তখন বাঁচার জন্যেই ব্যস্ত ছিলে। চুপ করে বসে থাকার সময়ই ছিলো না। ফলে বিষন্নতাটা টের পাওনি। যে কোনো জায়গাতেই থােক, বাড়িতেও, কাজকর্ম না থাকলে, শুধু শুধু বসে থাকতে হলে মন খারাপ হয়ে যায়।

আস্তে ঘাড় নাড়লো কিশোর। হ্যাঁ, তা বটে।

<

Super User