ভেইটিতে ফিরে দেখা গেল, ডজের জখমের অনেক উন্নতি হয়েছে। ঝিনুক কারনেসের হাতে পড়েছে শুনে চমকে গেল সে। ঘাবড়ে গেল রীতিমতো।

ফুঁসে উঠলো ডজ, সোজা মুক্তো খেতের দিকে যাচ্ছিলো ব্যাটা। পথে রাটুনা থেমেছে খাবার পানি নেয়ার জন্যে। থামতেই হবে। কয়েকটা কারণ। মিষ্টি পানি আছে। ওখানকার যে কটা দ্বীপ আছে, তার মধ্যে ওটাই সব চেয়ে বড়। লোকেরা নিশ্চয় বলেছে আমি কয়েক দিনের জন্যে উঠেছিলাম ওখানে। এজন্যে ওদেরকে দোষ দেয়া যায় না। এমনিতেই ঘটনা ওসব জায়গায় খুব কম ঘটে। আর আমার মতো একজন বিদেশীর ওখানে থাকাটা বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছে ওদের মাঝে, সহজে ভুলবে না। এটা একটা খবরের মতো খবর ওদের কাছে। কারনেস নেমে জিজ্ঞেস করলেই জানতে পারবে আমার কথা। আর তা-ই সে করেছে। জেনেছে সাগরের হাসি আর ঝিনুক, নামের দুটো ছেলেমেয়ে সাগরের মাঝের এক দ্বীপ থেকে উদ্ধার করে এনেছে আমাকে। মেয়েটার গায়ে হাত দেয়ার সাহস করবে না কারনেস। কারণ মেয়েদের অপমান সহ্য করবে না দ্বীপের লোকে। এরকম অন্যায় করে অনেক বিদেশীকে মুন্ডু খোয়াতে হয়েছে। তাই ছেলেটাকে ধরেছে সে। লোভ-টোভ দেখিয়েই হয়তো বের করে নিয়ে এসেছে দ্বীপ থেকে। রসদপত্র ফুরিয়ে গিয়েছিলো হয়তো, তাই ফিরে গিয়েছিলো তাহিতিতে। এখন যখন বেরিয়ে গেছে, নিশ্চয় আবার গেছে মুক্তো খেতের দিকে।

মন দিয়ে শুনলো হাইপো। একমত হয়ে মাথা ঝাঁকাল, ঠিকই বলেছেন। অনেক মালপত্র কিনেছে সে। ডুবুরির পোশাক কিনেছে।

কি করে জানলেন? তীক্ষ্ণ হলো ডজের কণ্ঠ।

হু চি মিনের কাছে নারকেলের ছোবড়া বিক্রি করি আমি। ওর কাছে ডুবুরির পোশাক আছে। এবার গিয়ে শুনলাম সেটা নাকি বেচে দিয়েছে কারনেসের কাছে।

কেন নিয়েছে সে-তো বোঝাই যায়, ওমর বললো। ওসব নিয়ে আলোচনা করে আর লাভ নেই। দেরি করা যাবে না এখন। কারনেসের আগে গিয়ে পৌঁছতে হবে আমাদের।

এই তাড়াহুড়োটা করতে হতো না, বিড়বিড় করলো ডজ। ছেলেটাকে ধরেই সর্বনাশটা করলো।

ছেলেটা তাকে কতোটা বলবে, তার ওপর নির্ভর করবে অনেক কিছু। মুখ খুলবে?

কি জানি। মারকুইজানরা কখন যে কি করবে বলা কঠিন। ওদের দাদাৱা ছিলো মানুষখেকো, ভুলে যেও না। মানুষ খাওয়ার ব্যাপারে কানাঘুষা কিছু কিছু এখনও শোনা যায়। ভীষণ জেদী। যদি কোনো বিদেশীকে পছন্দ করে তো, তার জন্যে জীবন দিয়ে দেবে। আর না করলে, তার কথাই শুনবে না। কেটে ফেললেও একটা কথা বের করবে না মুখ থেকে। কারননসকে পছন্দ করার কোনো কারণই নেই ঝিনুকের। হয়তো ভুল জায়গায় নিয়ে চলে যাবে। ইচ্ছে করে।

পথে আবার রাটুনায় থামবে নাকি কারনেস? জানতে চাইলো ওমর। কি মনে হয়? দরকার আছে?

আছে। তাহিতি থেকে ডজ আইল্যান্ড অনেক দূরে। যেতে যেতে খাবার আর পানি ফুরোবেই। রাটুনায় থামতে বাধ্য হবে সে।

তাহলে এক কাজ করলেই পারি, কিশোর পরামর্শ দিলো। আগেই গিয়ে রাটুনায় বসে থাকি আমরা। কারনে গেলেই ধরবো। ঝিনুককে ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করবো।

হুঁ, বুদ্ধিটা মন্দ না, ডজ বললো। কারনেসও ভাববে সে বেরিয়ে গেছে। জাহাজ নিয়ে তার পিছু নিলেও আগে দ্বীপে পৌঁছতে পারবো না আমরা। সে তো আর জানে না যে প্লেন আছে আমাদের। ওর আগে গিয়ে ওত পেতে থাকবো আমরা, এটা কল্পনাই করতে পারবে না।

পারি, আর না পারি, মুসা বললো। চেষ্টা করে দেখতে দোষ কি?

ওমরও ভেবে দেখলো কথাটা। পছন্দ হলো।

লেগুনের পানিতে ভাসছে ফ্লাইং বোট। ওড়ার জন্যে তৈরি। কিশোরকে নিয়ে ওর চলে যাওয়ার পর বসে থাকেনি মুসা। বিমানটাকে স্টার্ট দিয়ে পানিতেই চালিয়েছে কিছুক্ষণ। কোনো খুঁত আছে কিনা বোঝার চেষ্টা করেছে। ট্যাঙ্কে ভরার পর পেট্রোল যা বাকি রয়ে গেছে, আর যেসব জিনিস তখুনি নেয়ার প্রয়োজন নেই, সেগুলো সুবিধে মতো জায়গায় লুকিয়ে ফেলেছে। যাতে প্রয়োজনের সময় এসে বের করে নিতে পারে।

রওনা হতে কোনো অসুবিধে নেই। হাইপো আর তার হাসিখুশি তিনজন নাবিককে ধন্যবাদ জানালো ওরা। তারপর গিয়ে উঠলো বিমানে। ইঞ্জিন স্টার্ট দিলো ওমর। মিনিট কয়েক পরেই শাদা রেখা তৈরি করে নীল পানিতে ছুটতে শুরু করলো বিমান। জয়স্টিক চেপে ধরেছে সে। ইনসট্রুমেন্ট বোর্ডের ওপর সাঁটানো রয়েছে চার্ট।

কয়েক ঘণ্টা ধরে মাঝারি গতিতে সাগরের ওপর দিয়ে উড়ে চললো ওরা। মাঝে মাকে নিচে দেখা গেল দ্বীপ, নীল মখমলের মাঝে সবুজ পান্নার মতো। একবার নিচে কালো একটা ফুটকির মতো দেখে ডজ জানালো ওটা আদিবাসীদের ক্যানু। শেষ বিকেলে দিগন্তের দিকে হাত তুলে দেখালো, স্কুনার! নিশ্চয় কারনেস!

আরেকটু পরেই সামনে লম্বা একটা ঝিলিমিলি দেখা গেল। আবছা থেকে স্পষ্ট হতে লাগলো ওটা। ভজ ঘোষণা করলো, রাটুনা এসে গেছে। ঘন নীল আকাশে এখন সবুজ একটা প্রতিবিম্ব। এসব জায়গায় বিমান থেকে দ্বীপগুলোকে ওরকমই দেখায়, দূর থেকে আরো কাছে এগোলে আকাশ থেকে যেন পানিতে নেমে পড়লো সবুজ রঙের ঝিলিমিলি। ধীরে ধীরে রূপ নিচ্ছে পর্বতের উঁচু চূড়াগুলো।

আগেও দেখেছি এসব, কিশোর বললো। তার পরেও নতুন মনে হয়। যতোবারই দেখি, অবাক হই।

হওয়ারই জিনিস, ডজ বললো। আমি তো কতদিন ধরে আছি। বার বার দেখেছি। তার পরেও পুরনো হয় না। বেশির ভাগ দ্বীপই তৈরি করেছে প্রবালকীট। পানির সমতলের বেশি ওপরে উঠতে পারেনি সেজন্যেই। পমেটো ওই রকম দ্বীপপুঞ্জ। কিন্তু মারকুইস দ্বীপপুঞ্জ আলাদা। বড় বড় পাহাড় পর্বত যেন সাগরের ভেতর থেকে ঠেলে উঠেছে। প্রথমবার দেখে কেমন ভয়ই লাগতো। হাজার হাজার ফুট উঁচু পাহাড়। প্রবালের তৈরি দ্বীপের চেয়ে অবশ্য ওই পাহাড়ওয়ালা দ্বীপগুলোর সৈকতই সুন্দর। ধবধবে শাদা বালি। পাহাড়ের গোড়ায় ঘন জঙ্গলও আছে।

সাপটাপ নেই তো? মুসা জিজ্ঞেস করলো। অতো সুন্দর বনে সাপ থাকলে ভালো লাগবে না।

না, তা নেই। তবে বিষাক্ত পোকামাকড়ের অভাব নেই। দশ ইঞ্চি লম্বা শতপদী আছে। ওগুলো সাপের চেয়ে কম বিষাক্ত না। কামড়ে দিলে টের পাবে।

কিছুটা নিচে নামলো ওমর। ডজ তাকে দেখালো, ওই যে, গ্রাম। সৈকতের কিনারে কয়েকটা কুঁড়ে চোখে পড়ছে। নারকেল পাতার ছাউনি। দ্বীপের আরেক ধারে আরেকটা গ্রাম আছে। তবে সেটার চেয়ে এই গ্রামটা বড়। লোকজন এখানেই বেশি। সৈকতের ধারে যেখানে খুশি নামাতে পারো। টিলাটকর কিছু নেই। তবে ক্যানু থাকতে পারে।

গাঁয়ের ওপরে ধীরে ধীরে চক্কর দিতে লাগলো ওমর। উচ্চতা কমিয়ে আনলো আরও। তারপর নাক নিচু করে উড়ে গেল নীল পানির দিকে। যেখানে পানির গা ঘেঁষে রয়েছে একফালি বাঁকা শাদা সৈকত।

চিলের মতো ডানা মেলে দিয়ে যেন ভেসে ভেসে নামতে শুরু করলো ফ্লাইং বোট। সামনে ঝুঁকে এসে কোন জায়গায় নামতে হবে ওমরকে দেখিয়ে দিলো ডজ।

তাকিয়ে থাকতে থাকতে একসময় কিশোর মন্তব্য করলো, পৃথিবীর দেশ বলে মনে হয় না! একেবারে স্বর্গ!

তা ঠিক, কথাটা ডজও স্বীকার করলো। এতো সুন্দর জায়গা পৃথিবীতে কমই আছে। তবে স্বর্গেও সাপ থাকে।

সাপ! অবাক হয়ে বললো মুসা। এই না বললেন নেই!

আরে না না, ওই সাপের কথা বলছি না, ডজ বললো, ব্যাখ্যা করে কিভাবে বোঝাই! বলতে চাইছি ভালোর পাশাপাশিই মন্দ জিনিস তৈরি করে রাখে প্রকৃতি। এই যেমন রুটিফল আর কলার কথাই ধরো। কতো ভালো খাবার। ওই পাহাড়ের গোঁড়ায় প্রচুর জন্মায়। তেমনি জন্মায় বিষ। বনের ভেতরে বিষাক্ত অর্কিড জন্মায়। এমন সব মাছি আছে কামড়ালে সাংঘাতিক জ্বালা করে। সাগরে যেমন মুক্তো আছে, তেমনি রয়েছে হাঙর আর অন্যান্য ক্ষতিকর জিনিস। জ্যান্ত প্রবাল তো পৃথিবীর সুন্দরতম জিনিসগুলোর একটি। কিন্তু গিয়ে ঘষা লাগিয়ে দেখ না। কেটে রক্ত তো বেরোবেই, বিষও ঢুকে যেতে পারে। সবার ওপর রয়েছে অসুখ, দক্ষিণ সাগরের এই স্বর্গগুলোতে। একশো বছর আগে এই দ্বীপটাতেই শুধু ছিলো দশ হাজার মানুষ। এখন আছে মোটে দুশো। বাকি সব মরেছে শাদা মানুষের বয়ে নিয়ে আসা অসুখে। কেউ এনেছে যক্ষ্মা, কেউ কুষ্ঠ। আর কয়েক বছর পরে এখানে একজন মানুষ থাকবে কিনা সন্দেহ! পঙ্গপালের মতো মরে সাফ হয়ে গেছে এখানে মানুষ…

পানিতে নেমে পড়েছে ফ্লাইং বোট। ছুটলো গায়ের দিকে। বিমানের শব্দ শুনেই ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে গায়ের লোক। জটলা করছে সৈকতের ধারে। কেউ কেউ উত্তেজনায় নাচতে শুরু করেছে।

এই প্রথম এখানে প্লেন নামছে। জানালার বাইরে মাথা বের করে দিলো ডজ। চেঁচিয়ে বললো, কাওহা!

আরও বেড়ে গেল সৈকতে উত্তেজনা। ডজকে চিনেছে। তাকে চেনা সহজ, লাল রঙের চুলের জন্যে। ঝপাঝপ কয়েকটা ক্যানু টেনে নামানো হলো পানিতে। ছুটে এলো বিমানের পেছনে। ঘিরে ফেললো এসে। কেউ কেউ সাঁতরে চলে এলো। নারী, পুরুষ, ছেলেমেয়ে, সব রকমের মানুষ। চেঁচিয়ে ডজের নাম ধরে ডাকতে লাগলো ওরা, স্বাগত জানাচ্ছে, তবে ডজ নামটা বলছে না, বলছে লাল চুল। কাওহা কাওহা বলে তার জবাব দিচ্ছে ভজ। শান্ত পানিতে বিমানের নোঙর ফেলে ক্যানুতে নামলো বৈমানিকেরা। নিয়ে আসা হলো ওদেরকে নারকেল গাছে ঘেরা সৈকতে।

উঁকি দিয়ে শরীরে অনেক বেশি আঁকিবুকি আঁকা বয়স্ক একজন লোককে হাত ধরে টেনে নিয়ে এলো ডজ। পরিচয় করিয়ে দিলো, ওর নাম অশান্ত সাগর। তারপর হো হো করে হেসে উঠলো যখন অভ্যর্থনা জানানোর জন্যে ওমরের নাকে নাক ঘষার আগে মোড়ল ভালোমতো তার মুখটা শুকে নিলো। মোড়ল ইংরেজি তেমন জানে না। বললো সে, ফরাসী ভাষা জানে। তবে তার মাতৃভাষা মারকুইসাসে কেউ কথা বললেই বেশি খুশি হয়। আমি কিছু কিছু জানি। আলোচনা চালাতে পারবো।

মোড়লের পেছনে দাঁড়িয়ে রয়েছে কয়েকজন তরুণ ওদেরকে দেখিয়ে ডজকে বললো ওমর, ওদের ভাবভঙ্গি তো সুবিধের লাগছে না। মনে হচ্ছে মাথায় মুগুরের বাড়ি মারার জন্যে হাত নিসপিস করছে ওদের।

মোড়লের সঙ্গে কথা বললো ডজ। লোকগুলোর দিকে একবার ফিরে তাকিয়ে আবার ডজের দিকে ফিরলো মোড়ল। মারকুইসাসে কিছু বললো। সঙ্গীদেরকে জানালো ডজ, ওরা ভয় পাচ্ছে। জোর করে আমরা ধরে নিয়ে যেতে পারি, এই ভয়। ভয়টা পাইয়েছে ওদের কারনেস, ঝিনুককে জোর করে ধরে নিয়ে গিয়ে।

ওদের বলো, ওমর বললো। ঝিনুককে ছাড়িয়ে আনতে যাবো আমরা।

আবার মোড়লের সঙ্গে কথা বললো ডজ। মোড়ল কি বললো সেটা অনুবাদ করে শোনালো, খুশি হয়েছে ওরা। বলছে এই দ্বীপকে আমরা নিজেদের বাড়ির মতো মনে করতে পারি। তারপর নিজে থেকে বললো, ওরা যা বলে, ঠিক তাই বোঝায়। ফাঁকি-ঝুঁকি নেই। যাকে পছন্দ করবে তাকে সব দিয়ে দিতে রাজি। এখুনি আমাদের জন্যে একটা ঘর বানাতে হুকুম দিয়ে দিয়েছে মোড়ল। রাতের বেলা ভোজ হবে।

ঘর বানিয়ে দেবে, ঠিক আছে, ওমর বললো। তবে খাবার দাওয়াতটা রাখতে পারবো কিনা সন্দেহ। আসার সময় কারনেসের স্কুনার দেখে এসেছি। সত্যিই যদি তারটাই হয়, তাহলে সন্ধ্যার পর পরই পৌঁছে যাবে সে। ভোজফোজের মধ্যে না গিয়ে তার ওপর নজর রাখাটা জরুরী।

আরেক দফা লম্বা আলোচনা হলো ডজের সঙ্গে মোড়লের। ওমরের দিকে ফিরে ডজ বললো, ও বুঝতে পেরেছে। কয়েকজন যোদ্ধাকে পাহাড়ে পাঠিয়ে দেবে নজর রাখার জন্যে। স্কুনারটাকে দেখা গেলেই আমাদের হুঁশিয়ার করে দেবে।…আহ্, ওই যে আসছে সাগরের হাসি, ঝিনুকের বান্ধবী। বছর পনেরোর এক কিশোরী এগিয়ে এলো। খুব সুন্দরী। পরনে হালকা নীল রঙের পোশাক, দ্বীপের লোকেরা যেমন পরে। ছেলে আর মেয়েতে কোনো ভেদাভেদ নেই, একই রঙের কাপড় পরে। চমৎকার স্বাস্থ্য। তেল চকচকে বাদামী চামড়া। হাসতে হাসতে এসে হাত চেপে ধরলো জজের, কোনো জড়তা নেই, বললো, কাওহা, কাওহা।

আদর করে তার চুলে হাত বুলিয়ে দিলো ডজ, মেয়েদেরকে এখানে অভ্যর্থনার জবাব দেয়ার এটাই নিয়ম। বললো, ঝিনুককে ছাড়িয়ে আনতে যাবো আমরা।

বন্ধুর নাম শুনে মেঘ জমলো যেন মেয়েটার বাদামী মুখে। ওর জন্যে আমার খুব খারাপ লাগে। কাঁদি।

ডজ, এসো, ডাকলো ওমর। প্লেন থেকে কিছু খাবার নামিয়ে নিয়ে আসি। আর মোড়লের জন্যে কিছু উপহার। তার পর কথা বলা যাবে যতো খুশি। এসো।

বিমান থেকে মাল নামানো, কোনো কাজই না, কিন্তু ইচ্ছে করেই এগিয়ে এলো অনেকে, সাহায্য করার জন্যে। মানা করলেও শোনে না। বরং মুখ বেজার করে ফেলে। আপাতত মোড়লের ঘরে ওদেরকে নিয়ে আসা হলো। পরে নতুন ঘর তৈরি হলে সেখানে নিয়ে যাওয়া হবে।

তোমার দ্বীপ থেকে কত দূরে আছি? ডজকে জিজ্ঞেস করলো ওমর।

বিশ-তিরিশ মাইল। এর বেশি না।

এই দ্বীপেই আমাদের হেডকোয়ার্টার করলে কেমন হয়?

পেট্রোলের অসুবিধে হবে। বার বার যেতে আসতে অনেক তেল খরচ হবে, অতো নেই স্টকে। আবহাওয়া ভালো হলে ওড়ারও দরকার পড়বে না, পানিতে ট্যাক্সিইং করে চলে যেতে পারবো। রোজ সকালে রওনা হতে হবে তাহলে। রোজ এভাবে নিয়মিত যেতে-আসতে থাকলে সন্দেহ করে বসতে পারে এখানকার লোকে। সেটা উচিত হবে না। যতো কম লোক জানাজানি হয় ততোই ভালো। ওদের লোভ নেই, এটা ঠিক। কিন্তু বিদেশী কোনো জাহাজ চলে আসতে পারে। ফাঁস হয়ে যেতে পারে খবরটা।

মাথা ঝাঁকাল ওমর। ঠিকই বলেছো। যাকগে, সেটা নিয়ে পরে ভাবা যাবে। আগে কারনেসের ব্যাপারটার একটা মীমাংসা করে নিই।

হালকা খাবার খেয়ে নিলো ওরা। ঘুরতে বেরোলো কিশোর আর মুসা। উঁচু উঁচু অসংখ্য নারকেলের জটলার ফাঁকে ফাঁকে তৈরি হয়েছে কুঁড়েগুলো। বেরিয়ে চলে এলো ওরা সৈকতে। শান্ত নিথর হয়ে আছে সাগর। দিগন্ত সীমায় হেলে পড়ছে সূর্য! ফ্যাকাসে হয়ে গেছে আকাশের ঘন নীল, মাঝেমাঝে লালচে-হলুদ রঙের ছোপ। মৃদু বাতাস বইছে, যেন সাগরের শেষ নিঃশ্বাস, থিরথির করে কাঁপছে নারকেলের ডগা। আশ্চর্য এক নীরবতা। সামনে ছড়ানো শাদা সৈকত। জীবনের কোনো চিহ্নই নেই, কিছু ঋষি কাঁকড়া বাদে। চুপটি করে দাঁড়িয়ে থাকছে, যেন বোঝাতে চাইছে-না, না, আমরা জীবন্ত কিছু নই, পাথর। কিন্তু কাছে গেলেই ঝট করে বেরিয়ে আসছে দাঁড়া। বিদ্যুতের গতিতে ছুটে গিয়ে ঢুকে পড়ছে অসংখ্য গর্তের কোনো একটাতে। সৈকতের কিনার ধরে হাঁটতে হাঁটতে সামনে বাধা দেখতে পেলো ওরা। পথ রুদ্ধ করে দিয়ে যেন দাঁড়িয়ে গেছে, পাথরের দেয়াল। দেখলে মনে হবে হয় আকাশ থেকে ঝুপ করে পড়েছে হঠাৎ করে, কিংবা ধীরে ধীরে সাগরের নিচ থেকে ঠেলে মাথা তুলেছে। বেশি দূরে যেতে ওদেরকে মানা করে দিয়েছে ডজ। থামলো ওরা। এই সময় পেছনে শোনা গেল হালকা পায়ের আওয়াজ। ফিরে তাকিয়ে দেখলো হাতে একটা আদিম মাছ ধরার বড়শি নিয়ে এগিয়ে আসছে সাগরের হাসি।

অনেক টুপা, হেসে হাত তুলে কাঁকড়াগুলোকে দেখালো সে। মাছও অনেক আছে। দেখবে? এসো। দুজনের মধ্যে হাত ধরার জন্যে মুসাকেই বেছে নিলো সে টেনে নিয়ে চললো পাথরের দেয়ালের পাশের একটা বড় চাঙড়ের দিকে। সঙ্গে সঙ্গে চললো কিশোর।

চাঙড়টা আসলে দেয়ালেরই অংশ। ওপরে উঠে বোঝা গেল, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে চূড়াটা কেটে চলে গেছে। জায়গা বেছে নিয়ে বসে পড়লো সাগরের হাসি। সাথে করে নিয়ে এসেছে অনেক কুঁচো চিঙড়ি। বড়শিতে সেগুলো গেঁথে পানিতে ফেলে দেখতে দেখতে অনেক মাছ ধরে ফেললো। একেকটা করে মাছ ধরে, আর সেগুলোর স্থানীয় নাম বলে, মুসাকে দিয়ে আবার উচ্চারণ করায় সেগুলোর।

শুনে কিশোরও শিখে ফেলেছে। তাকিয়ে রয়েছে স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ পানির দিকে। একেবারে তল পর্যন্ত দেখা যায়। যেন ভিডিওতে নেচারাল ওয়ার্ল্ড দেখছে। আজব, সুন্দর সেই জগৎ। বিশাল এক অ্যাকুয়ারিয়াম যেন। খেলে বেড়াচ্ছে নানা রকম রঙিন মাছ। কোনোটা চুপ করে ভাসছে, কোনোটা ছোটাছুটি করছে, তাড়া করছে একে অন্যকে, পাথরের খাঁজ থেকে সুডু়ং করে বেরিয়ে আসছে কেউ, কেউ বা আবার ধীরে সুস্থে গিয়ে ঢুকে পড়ছে।

মস্ত একটা বান মাছ দেখতে পেলো। পুরো পনেরো ফুট লম্বা। কুৎসিত, ভয়ংকর মুখ। পাথরের কালো গর্ত থেকে বেরিয়ে পিছলে গিয়ে যেন ঢুকে পড়লো আরেকটা পাথরের ফাটলের ভেতরে। দেখতে দেখতে এতেই তন্ময় হয়ে গেল, অনেকক্ষণ থেকেই যে নীরব হয়ে আছে সাগরের হাসি, সেটা লক্ষ্যই করলো না। করলো অনেক পরে, যখন তার গায়ে কনুই দিয়ে গুতো দিলো মুসা।

পাথরের দেয়ালের গায়ে কালো বিষন্ন চেহারার একটা গুহামুখের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে মেয়েটা। নিশ্চয় কিছু দেখতে পেয়েছে। মুসাও দেখেনি, কিশোরও পাচ্ছে না। তবে পেলো খুব তাড়াতাড়িই। চামড়ায় একধরনের শিরশিরে অনুভূতি হলো কিশোরের, ভয় পেলে কিংবা বেশি অবাক হলে এরকমটা হয় মানুষের। কালো কিছু একটাকে নড়তে দেখেছে।

সাগরের হাসির তীক্ষ্ণ চিৎকার ফালা ফালা করে দিলো যেন অখন্ড নীরবতা। গাঁয়ের দিকে ফিরে মুখের ওপর দুই হাত জড়ো করে চেঁচিয়ে বলতে লাগলো, ফেকি! ফেকি! ফেকি!

চিৎকার শুনেই ছুটে ঘর থেকে বেরোলো চার-পাঁচজন মানুষ। হাতে মাছ মারার বর্শা। দৌড়ে আসতে লাগলো এদিকে। কাছে এসে ওরাও চেঁচাতে শুরু করলো। কি হয়েছে জিজ্ঞেস করছে সাগরের হাসিকে। হাত তুলে গুহাঁটা দেখিয়ে মেয়েটা আবার বললো, ফেকি!

পানির আরও কিনারে গিয়ে দাঁড়ালো লোকগুলো, দ্বিতীয়ার বাঁকা চাঁদের মতো গোল হয়ে। ওদের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে নিচে উঁকি দিলো কিশোর আর মুসা। কিন্তু ঠেলে সরিয়ে দেয়া হলো ওদেরকে। মনে হলো বিপজ্জনক কোনো ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে। বেশি দূরে সরলো না গোয়েন্দারা। গলা বাড়িয়ে তাকিয়ে রইলো কালো গুহাঁটার দিকে।

ঝট করে বেরিয়ে এলো একটা লম্বা লিকলিকে বাহু। আরেকটা। তারপর আরেকটা।

মোচড় দিয়ে উঠলো কিশোরের পেট। এই জীব আগেও দেখেছে সে, তবু চমকে গেল। কিলবিলে ওই কুৎসিত গুড়গুলো দেখলে অনেকেরই হয়, এরকম, জানা আছে তার, ওয়াপোকা দেখলে যেমন হয়। ঘেন্না লাগে, শিউরে ওঠে শরীর।

কাঁপতে কাঁপতে একটা শুঁড় উঠে এলো লোকগুলোর দিকে। লাফিয়ে কিশোরদের কাছে সরে এলো সাগরের হাসি। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছে, টাটা-টা-টা! ছেলেদের দিকে চেয়ে হেসে বললো, ভয় লাগছে? আমরা ভয় পাই না। ও আমার ভাই। লম্বা, জোয়ান একটা লোককে দেখালো সে। দুর্দান্ত সাহসী। ঠিক মেরে ফেলবে। অনেক ফেকি মেরেছে। এটাকেও মারবে।

জীবটা কি? শরীরটা এখনও বেরোয়নি, আন্দাজ করতে পারছে কী, তবু জিজ্ঞেস করলো।

ফেকি! কিশোরের মুখের দিকে তাকিয়ে ভাঙা ইংরেজিতে অশুদ্ধ উচ্চারণে অনুবাদ করে দিলো সাগরের হাসি, ডেবিল ফিশ! ডেবিল ফিশ! ডেভিল ফিশ, অর্থাৎ শয়তান মাছ।

এই জীবের সঙ্গে লড়াইয়ের তিক্ত অভিজ্ঞতা আছে মুসার, অথৈ সাগর অভিযানে যখন এসেছিলো। মরতে মরতে বেঁচেছিলো সেবার। দ্বিতীয়বার আর এর কবলে পড়তে চায় না। ওই শুঁড়ের ভয়ংকর ক্ষমতা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলো সেবার। ভয়ে ভয়ে দেয়ালের দিকে পিছিয়ে গেল সে।

কিশোর নড়লো না। বেরিয়ে এলো শুঁড়ের চেয়ে কুৎসিত শরীরটা। জীবটাকে কেউ দেখে না থাকলে তার কাছে হরর ছবির ভয়াবহ দানব বলে সহজেই চালিয়ে দেয়া যাবে। মস্ত, কালচে-লাল একটা মাংসের দলা যেন। সেটা থেকে বেরিয়ে রয়েছে অসংখ্য আঁচিল, দেখলেই গা গুলিয়ে ওঠে। মুখটা হাতির মুখের মতো, শুঁড় বাদ দিয়ে। গোল গোল বিশাল দুটো চোখ, শরীরের তুলনায় অনেক বড়, তাতে একধরনের শয়তানী উজ্জ্বলতা, এতোই কুৎসিত, না দেখলে বলে বোঝানো যাবে না। মোট আটটা বাহুঁ, হাতির শুঁড়ের মতো গুটিয়ে নিয়ে আবার লম্বা করে দিচ্ছে, একেকটা চোদ্দ-পনেরো ফুটের কম হবে না। লাফ দিয়ে এসে পড়লো একটা শুঁড়ের মাথা, কিশোরের কয়েক ফুটের মধ্যে। ভয় পেয়ে লাফিয়ে সরে গেল সে কয়েক পা। লোকগুলো সরছে না। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থেকে একনাগাড়ে খুঁচিয়ে চলেছে ওদের পায়ের কাছে এসে পড়া শুঁড়গুলোকে।

পরোয়াই করছে না যেন বিশাল অকটোপাস। গর্ত থেকে পুরোপুরি বেরিয়ে পড়েছে, এগিয়ে আসছে ধীরে ধীরে। একটা মানুষকে ধরতে পারলেই রাতের খাবার হয়ে যাবে তার। শিকার ধরতে গেলে কিছুটা আঘাত সইতেই হয়, কাজেই বর্শার খোঁচাগুলো হজম করে যাচ্ছে সে।

পানি থেকে ছিটকে বেরিয়ে যেন উড়ে এসে কিশোরের পায়ের কাছে পড়লো একটা শুঁড়ের মাথা। ছুঁয়ে ফেললো পা। লাফ দিয়ে পিছিয়ে গেল কিশোর। জড়িয়ে ধরতে পারলে আর মুক্তি ছিলো না ওই গুঁড়ের কবল থেকে। ঠান্ডা ভেজা স্পর্শ। নিজের অজান্তেই গলা চিরে বেরিয়ে এলো চিৎকার। তার হাত ধরে একটানে সরিয়ে নিলো মুসা, দেয়ালের কাছে, শুঁড়ের নাগালের বাইরে।

ভোজালি দিয়ে এক কোপে শুঁড়ের মাথাটা কেটে আলাদা করে ফেললো একজন যোদ্ধা। টিকটিকির লেজের মতো কুৎসিত নাচ শুরু করলো কাটা অংশটা।

রাগে ব্যথায় ভীষণ খেপে গেল অকটোপাস। যে করেই হোক মানুষ শিকার করবেই, পণ করে ফেললো যেন সে। একসঙ্গে পানি ওপরে তুলে দিলো আটটা শুঁড়। এরই জন্যে অপেক্ষা করছিলো যোদ্ধারা। প্রচন্ড আক্রমণ চালালো। কুপিয়ে টুকরো টুকরো করে ফেলতে লাগলো শুঁড়গুলো।

পানিতে মাথা তুলেছে অকটোপাস। যন্ত্রণায় শরীর মোচড়াচ্ছে। ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে কাটা শুঁড়ের মাথা থেকে। রীতিমতো হরর ছবি। অনেকটা মানুষের মতো করেই গোঙাতে আরম্ভ করেছে মৃত্যু যন্ত্রণায়। শরীরের যেখানে সেখানে বর্শা বিদ্ধ হচ্ছে। আক্রমণ করছে না আর, অস্ত্রই নেই, করবে কি দিয়ে? অদ্ভুত আচরণ করছে। মুসার মনে হলো, অন্তিম মুহূর্ত উপস্থিত, বুঝে গেছে জীবটা। গর্তের ভেতরে থেকে লড়াইয়ের সময় অকটোপাসের বুদ্ধির যে পরিচয় পেয়েছিলো সে, তাতেই এরকমটা ভাবতে পারলো।

খোঁচানোর বিরাম নেই। যতো তাড়াতাড়ি শেষ করে দেয়া যায়, সেই চেষ্টা করছে যোদ্ধারা।

আনন্দে নাচতে শুরু করেছে সাগরের হাসি। ওকে খাবো! ওকে খাবো! মজার মাংস! মুসা আর কিশোরের দিকে তাকিয়ে বাচ্চা মেয়ের মতো হাততালি দিয়ে হাসতে লাগলো সে। তোমরাও খাবে!

তুমি খেয়ো। হাত নেড়ে বললো কিশোর, আমি এর মধ্যে নেই। বাপরে বাপ, কি বিচ্ছিরি! শুয়াপোকা এর চেয়ে অনেক সুন্দর!

মুসা কিছু বললো না। খাবারটা কেমন হয়, না দেখে আগেই মানা করে দিতে রাজি নয়।

পানি থেকে তোলা হলো মৃত অকটোপাসটাকে। ওখানেই কুপিয়ে কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলা হতে লাগলো। সাগরের হাসিও যোগ দিলো সেই কাটাকাটিতে।

ঘন হয়ে আসছে গোধূলী। ঘরে ফিরে চললো কিশোর আর মুসা! কুঁড়েতে ফিরে দেখলো কথা বলছে ডজ আর ওমর। অকটোপাসের সঙ্গে লড়াইয়ের কথা ওদেরকে বলতে যাবে, এই সময় পাহাড়ের দিক থেকে ভেসে এলো চিৎকার, আসছে! আসছে!

জাহাজটাকে দেখতে পেয়েছে, ডজ বললো। চলো, দেখি, কতোটা এগোলো।

<

Super User