বেশি দূরে যেতে হলো না। সৈকতেই এসে জড়ো হয়েছে গাঁয়ের লোক। উত্তেজিত হয়ে কলরব করছে। কয়েকজনের কথা শুনলো ডজ। ফিরে সঙ্গীদেরকে জানালো, অবাক কান্ড! কারনেই এসেছে। তবে এদিকে না এসে চলে গেছে কার আরেক ধারে। ওখানে নোঙর ফেলেছে। এটা ভাবা উচিত ছিলো আমাদের। এখানে জাহাজ ভেড়াতে সাহস করবে না, এ-তো জানা কথা। গায়ের লোকে ধরে খুন করে ফেলবে। এখুনি কয়েকজনে গিয়ে কাজটা সেরে আসতে চাইছে। আমি ওদের মানা করেছি। অন্তত আমরা যতোক্ষণ এখানে রয়েছি কোনো খুনখারাপি চলবে না।

তাহলে কি করা যায়? পরামর্শ চাইলো ওমর। ঘুরে যেতে হলে কতদূর?

হেঁটে যাওয়ার উপায় নেই। ঘুরে যেতে হলে ক্যানুতে চড়ে। তাতে পনেরোবিশ মাইলের কম হবে না।

শিস দিয়ে উঠলো ওমর। এতো? দ্বীপের মাঝখান দিয়ে সরাসরি গেলে?

সাত-আট মাইল। তবে যাওয়াটা অতো সোজা না। খানিক দূর গিয়েছিলাম একবার, পুরোটা যেতে পারিনি। যাওয়া যায় না তা নয়। তবে সাংঘাতিক কঠিন। যেতে হয় পাহাড় ডিঙিয়ে, তিন হাজার ফুট উঁচু। ভয়ানক বিপজ্জনক। শুধু যে পড়ে মরার ভয় আছে তা নয়, বুনো জানোয়ারও আছে।

এখানে বুনো জানোয়ার? মুসা অবাক।

মহাসাগর পেরিয়ে এই দ্বীপে জানোয়ার এলো কোত্থেকে? কিশোরও বুঝতে পারছে না।

এসেছে। ষাঁড় আর কুকুর। কুত্তাগুলো হলো সব চেয়ে খারাপ। আমি অবশ্য দেখিনি, শোনা কথা বলছি। একপাল শাদা কুত্তা নাকি বাস করে পাহাড়ে। হিংস্র। আগে পোষা ছিলো, ছাড়া থাকতে থাকতে বুনো হয়ে গেছে। কয়েক বছর আগে তিমি-শিকারীদের এক জাহাজে করে নিয়ে আসা হয়েছিলো ওগুলোকে, ফেরার সময় ফেলে চলে গেছে জাহাজের মালিক। গরুও বোধহয় অনেক আগে ওভাবেই ফেলে যাওয়া হয়েছে। আশপাশের অনেক দ্বীপে বনবেড়াল আছে, আগে পোষা ছিলো। ফেলে যাওয়ার পর বনে থাকতে থাকতে বন্য হয়ে গেছে।

হুঁ, ওমর বললো। ওসব জানোয়ারকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। যাওয়া যাবে কিনা তাই বলো। কারনেসকে ঠেকাতেই হবে। ছেলেটাকে অন্তত কেড়ে রেখে দেয়া উচিত।

দেখি, অশান্ত সাগরকে জিজ্ঞেস করে। মোড়লের কাছে এগিয়ে গেল ডজ। কথা বলে ফিরে এলো। বললো, হ্যাঁ, যাওয়া যাবে বলছে। তবে পথ খুব খারাপ। গাইড হিসেবে তার কয়েকজন লোক দিতেও রাজি হয়েছে।

তাহলে তাড়াতাড়ি রওনা হওয়া দরকার। অস্ত্র-টস্ত্র নেবো নাকি? রাইফেল?

বেশি বোঝা নিলে অসুবিধে হতে পারে। যা দরকার শুধু তা-ই। আমরা তো আর যুদ্ধ করতে যাচ্ছি না। পিস্তল নিলেই যথেষ্ট।

বেশ। মোড়লকে বলো এখুনি রওনা হতে চাই আমরা।

কয়েক মিনিটের মধ্যেই রওনা হলো ওরা। সঙ্গে চললো ছয়জন যোদ্ধা। মশাল জ্বেলে নিয়েছে। দেখতে দেখতে চলে এলো পাহাড়ের গোড়ায়। আঁকাবাকা পাহাড়ী পথ ধরে ঢাল বেয়ে উঠতে শুরু করলো। দুপাশে ঘন জঙ্গল। মশালের আলোয় আরো বেশি ঘন লাগছে, মনে হচ্ছে লতাপাতার দুর্ভেদ্য দেয়াল। এর মধ্যে প্রবেশ করা যাবে না।

কিছুদূর এগোনোর পর হাতে একটা আলতো ছোঁয়া পেলো মুসা। তার বাহু খামচে ধরলো নরম একটা হাত। অবাক হয়ে ফিরে তাকিয়ে দেখলো, সাগরের হাসি। হাসলো। মশালের আলোয় ঝিক করে উঠলো শাদা দাঁত। এলাম।

মেয়েটার খালি পায়ের দিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠলো মুসা। যে হারে ধারালো পাথর খোঁচা খোঁচা বেরিয়ে রয়েছে, তাতে জুতো না থাকলে কেটে পা ফালাফালা হয়ে যাওয়ার কথা। বললো, কেটে যাবে তো!

কাটবে না, হেসে বললো সাগরের হাসি। কতো উঠলাম। প্রবালের ওপর দিয়েও হাঁটতে পারি খালি পায়ে।

পাশাপাশি চলছে কিশোর। বিশ্বাস করলো কথাটা। কথা শুনে ফিরে তাকিয়ে ওমর বললো, এই, তুমি এসেছো কেন?

আসুক, ডজ বললো। ওকে নিয়ে ভাবতে হবে না তোমাকে। বিপদে ফেলবে ভাবছো তো? ফেলবে না। বরং সাহায্য করবে। ঝিনুক ওর বন্ধু। ও যাবেই। বলেও ফেরাতে পারবে না।

আর কিছু বললো না ওমর। মশালের আলোয় জঙ্গল দেখতে দেখতে চললো। বুনো ফুল ফুটে আছে। অর্কিডের অভাব নেই, অনেক জাতের, অনেক ধরনের। একধরনের দানবীয় পাতাসর্বস্ব গাছ জন্যে রয়েছে, এর নাম কুমারীর চুল। ওই চুলের মাঝে বিচিত্র অলংকরণ সৃষ্টি করেছে অর্কিডগুলো। কিছু লতানো অর্কিড ঝুলে রয়েছে বড় গাছের ডাল থেকে। হাজারে হাজারে গিনিপিগ রয়েছে। হুটোপুটি করছে, ছুটে যাচ্ছে সামনে দিয়ে।

যতোই উঠছে খাড়া হচ্ছে আরও পথ। দুপাশে খাড়া হয়ে আছে পাহাড়ের দেয়াল, গিরিপথের মতো লাগে। কখনও হঠাৎ করে শেষ হয়ে যাচ্ছে দেয়াল, তার পরে রয়েছে গভীর গিরিখাত। পড়লে ছাতু হয়ে যেতে হবে। কখনও পথ মোড় নিচ্ছে বিপজ্জনক ভঙ্গিতে। নারকেল আর রুটিফল গাছ পড়ে আছে অনেক নিচে, এখানে উঠতে পারেনি। আরেকটু এগিয়ে বড় বড় পাথরের চাঙরের ভেতরে হারিয়ে গেছে পথ। কখনো তার ভেতরে ঢোকা যায়; কখনো যায় না। তখন এক পাথর থেকে আরেক পাথরে লাফিয়ে লাফিয়ে এগোতে হয়।

একটা খোলা জায়গা পেরোনোর সময় নিচে তাকালো কিশোর। অদ্ভুত একটা শৈলশিরা চোখে পড়লো। ধারের ওপরটা করাতের দাঁতের মতো হয়ে আছে। আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ ছিলো ওটা একসময়, বুঝতে পারলো। আরো অনেক নিচে পানিতে ভাসতে দেখা যাচ্ছে বিমানটাকে, ওটার রূপালি ডানায় চাঁদের আলো পড়ে চিকচিক করছে। বিমান আর মনে হচ্ছে না এখান থেকে, এতোই ছোট দেখাচ্ছে। বরং মনে হয় পানিতে ভেসে আছে ডানা মেলে দেয়া কোনো নিশাচর পতঙ্গ। লেগুনের বাইরে সাগরকে লাগছে রূপালি চাদরের মতো। পানি বলে মনে হয় না। যেন এই পৃথিবীর কোনো কিছু নয় ওসর, অপার্থিব।

উঠেই চলেছে পথ। অনেক পাহাড়ে চড়েছে মুসা, কিন্তু এরকম পাহাড় আর দেখেনি। মনে হয় যেন পৃথিবীর বুকের বিশাল এক ফোড়া ফেটে গিয়েছিলো। পুঁজের বদলে বেরিয়ে এসেছিলো পাথর। সেসব ছড়িয়ে রয়েছে। আর ফোঁড়ার মুখের কাছটা বিকৃত হয়ে গেছে।

পথ এখানে সরু। একপাশে গভীর খাদ। পাশাপাশি চলার আর উপায় নেই। একসারিতে এগিয়ে চলেছে মশালধারীরা। শুধু তাদের দিকে চোখ রেখে এগিয়ে চলেছে কিশোর। পাশে খাদের দিকে তাকাতে সাহস করছে না। যদি মাথা ঘুরে পড়ে যায়?

কিশোরের মনের অবস্থা কি করে জানি টের পেয়ে গেছে সাগরের হাসি। হাসতে লাগলো সে। পাহাড়ী ছাগলের মতো আশ্চর্য ক্ষিপ্রতায় হালকা পায়ে লাফিয়ে লাফিয়ে চলেছে। পড়ে যাওয়ার ভয় নেই। কোনো কিছুরই পরোয়া করছে না।

একটা জায়গায় এসে সমতল হয়ে গেছে খানিকটা জায়গা। তার ওপাশ থেকে নামতে আরম্ভ করেছে পথ। দ্রুত নেমে গেছে পেয়ালা আকৃতির একটা খাদের মধ্যে। কোনো গাছপালা নেই তাতে। ওটাই মৃত আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখের নিচের গহ্বর, অনুমান করতে পারলো কিশোর। ওখানে নেমে থামলো যোদ্ধারা। বিশ্রাম নিতে। মশালের আলোও নিভু নিভু হয়ে এসেছে। থামতে পেরে খুব খুশি হলো কিশোর।. গড়িয়ে পড়লো মাটিতে। দরদর করে ঘামছে।

কিন্তু শুয়েও সারতে পারলো না, লাফিয়ে উঠে দাঁড়াতে হলো আবার। রক্ত জমাট করা একটা চিৎকার শুনতে পেয়েছে। নেকড়ের ডাকের সঙ্গে সাদৃশ্য রয়েছে। যোদ্ধারাও উঠে পড়েছে। চেঁচিয়ে বলতে লাগলো, কুকুর! কুকুর! ভয় পেয়েছে ওরা।

খাইছে! বলে সাগরের হাসির হাত ধরে একটানে তাকে পেছনে সরিয়ে দিলো মুসা। পিস্তল বের করলো।

ওমরও পিস্তল বের করে ফেলেছে। ওই যে! এসে গেছে! তাকিয়ে রয়েছে কুকুরগুলোর দিকে। চাঁদের আলোয় ভূতুড়ে লাগছে শাদা জানোয়ারগুলোকে। সোজা ছুটে আসছে এদিকেই।

গুলি করলো সে। প্রায় তার গায়ের ওপর এসে পড়লো একটা মৃত জানোয়ার।

গুলি করেই সাগরের হাসিকে টেনে নিয়ে একপাশে সরে গেল মুসা। গর্জন করতে করতে ছুটে আসছে কুকুরগুলো। মানুষকে ধরতে পারলে ছিড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলবে।

কিশোর আর ডজও গুলি চালাতে লাগলো।

রুদ্ধ জায়গায় প্রচন্ড শব্দ হতে লাগলো গুলির। প্রতিধ্বনি উঠতে লাগলো। সেই সঙ্গে কুকুরের আর্তনাদ আর গর্জন। নরক গুলজার শুরু হয়ে গেল যেন।

মশালগুলো জ্বালিয়ে ফেলেছে আবার যোদ্ধারা। শুকনো ঘাস জড়ো করে তাতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। দেখতে দেখতে ঘাসের একটা চক্র তৈরি করে ফেললো ওরা। আগুন লাগালো। তার মধ্যে ঢুকে পড়তে অনুরোধ করলো অভিযাত্রীদেরকে।

ঢুকে পড়লো সবাই। আগুনের বৃত্তের বাইরে এসে থেমে গেল কুকুরগুলো। চারপাশ ঘিরে গোল হয়ে বসে পড়লো। লম্বা টকটকে লাল জিভ বের করে দিয়েছে। ঝুলছে ওগুলো, লালা গড়াচ্ছে। কয়েক মিনিট মানুষের দিকে তাকিয়ে থাকলো ওগুলো। আগুন পেরিয়ে এসে ধরতে পারবে না বুঝে অন্য কাজে মন দিলো। মরা আর আহত সঙ্গীদেরকে ছিড়ে ছিড়ে খেতে শুরু করে দিলো। মাঝে মাঝে মুখ ফিরিয়ে মানুষদের দিকে তাকিয়ে দাঁত খিচাচ্ছে। জানোয়ারগুলোর হিংস্রতা দেখে গায়ে কাঁটা দিলো কিশোরের।

এখন কি করবো? জিজ্ঞেস করলো ওমর।

যোদ্ধাদের সঙ্গে আলোচনায় ব্যস্ত ডজ। ফিরে তাকিয়ে বললো, ওরা বলছে, নতুন করে মশাল বানিয়ে নেবে। আগুনকে ভয় পায় কুকুরগুলো। এগোতে সাহস করবে না।

কিছু একটা করা দরকার, গম্ভীর হয়ে বললো ওমর। এভাবে আটকে থাকলে কারনেস ওদিকে চলে যাবে।

আরেক ধরনের মশাল বানাতে শুরু করলো যোদ্ধারা। শুকনো ঘাসকে শক্ত করে পাকিয়ে নিয়ে লাঠির মাথায় বাঁধলো। যে ঘাস তুলছে, তাকে আগের মশাল নিয়ে পাহারা দিলো অন্যেরা। তবে ওদের দিকে এখন আর তেমন খেয়াল নেই কুকুরগুলোর। ভোজে ব্যস্ত। মশাল বানানো শেষ করার পর এলো কুকুর তাাড়নোর পালা। যোদ্ধারা শুকনো ডালের মাথায় আগুন ধরিয়ে ছুঁড়ে মারতে শুরু করলো ওগুলোর দিকে। সেই সঙ্গে পাথর। কয়েক রাউন্ড গুলিও চালানো হলো, মেরে ফেলা হলো আরও কয়েকটাকে।।

এই বার ঘাবড়ালো কুকুরের পাল। পালালো। পেছনে মশাল হাতে তেড়ে গেল যোদ্ধারা। তবে বেশি দূর গেল না। কুকুরগুলো আবার সাহসী হয়ে উঠলে মুশকিল।

রওনা হলো আবার ওরা। জ্বালামুখটা পেরিয়ে এলো দ্রুত। ঝপ করে যেন হঠাৎ নিচে নেমে গেছে পথটা। সামনে আবার আরম্ভ হয়েছে জঙ্গল। পায়ের নিচে এখন নরম শ্যাওলা। হাঁটছে ওরা আর বার বার পেছনে ফিরে তাকাচ্ছে। আর কোনো সাড়া নেই কুকুরগুলোর।

বেশ সুন্দর একটা ফুল দেখতে পেলো মুসা। পাপড়িগুলো কেমন পালকের মতো ছড়িয়ে গেছে, কোমল মনে হচ্ছে দেখে। হাত বাড়িয়ে সেটা ছিড়তে গেল, সাগরের হাসিকে উপহার দেয়ার জন্যে। খপ করে তার হাত চেপে ধরলো মেয়েটা সরিয়ে আনতে আনতে বললো, পাকে!

ডজও দেখলো ফুলটা। ছুঁয়ো না। ওটা পাকে!

পাকেটা কি জিনিস? জানতে চাইলো কিশোর।

ছুঁয়ে দেখ, তাহলেই বুঝবে। জীবনে ভুলবে না আর। আগুনের পোড়ার মতো জ্বলতে শুরু করবে। বিছুটি এর কাছে কিছু না।

ঠিকই বলেছিলো ডজ, স্বর্গেও সাপ থাকে-ভাবলো কিশোর। দক্ষিণ সাগরের দ্বীপগুলো খুব সুন্দর, কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এই সৌন্দর্যের মাঝেও এমন সব ব্যাপার রয়েছে, যা অনেক ভালো লাগাকেই ম্লান করে দেয়।

আরও ঘণ্টাখানেক একনাগাড়ে হাঁটলো ওরা। শেষ দিকে নামলো হুড়মুড় করে বৃষ্টি। নারকেল গাছের এলাকা শুরু হয়েছে তখন। থেমে মশাল নিভিয়ে ফেললো যোদ্ধারা। ডজকে একজন বললো, এর বাইরে বেরোলেই সৈকত, শুনেছি।

আমি আগে যাই, ওমর বললো। দেখে আসি। বলেই হাঁটতে আরম্ভ করলো। হারিয়ে গেল নারকেল কুঞ্জের ভেতরে। ফিরে এলো একটু পরেই। ঠিকই। জাহাজটা দেখে এলাম। তীর থেকে শখানেক গজ দূরে। আলো একটা জ্বলছে বটে, তবে কোনো সাড়াশব্দ নেই। লোকগুলো জাহাজে আছে না ডাঙায় বুঝতে পারলাম না। ছোট একটা গা দেখে এলাম পানির কিনারেই। ওখানে গিয়ে থাকতে পারে।

আমার মনে হয় না কারনেস গিয়েছে, ডজ বললো। গেলে তার সাগরেদরা গিয়েছে। সে জাহাজেই রয়ে গেছে। লোকগুলো গায়ে মদ খেতে গেছে।

মদ? মুসার প্রশ্ন।

হ্যাঁ। নারকেলের ফুল থেকে তৈরি করে এখানকার লোকে।

তাই নাকি! নারকেলের ফুল থেকে মদ…

ব্রান্ডির চেয়ে কোনো অংশে খারাপ না…

আচ্ছা, মদের আলোচনা বাদ দাও এখন, হাত নেড়ে বাধা দিলো ওমর। কাজের কথা বলো। কারনেসটার একটা ব্যবস্থা হওয়া দরকার। যেমন কুকুর তেমন মুগুর পেটা করা উচিত। তবে আগেই কিছু করবো না। যদি শয়তানী করে, তাহলে। সৈকতে কিছু ক্যানু দেখে এলাম। একটায় করে জাহাজে গিয়ে তাকে সোজাসুজি বলতে হবে ঝিনুককে ফিরিয়ে দেয়ার জন্যে। এক ক্যানুতে করেই আমরা সবাই যেতে পারবো। আমি কারনেসকে সামলাবো। কিশোর, তুমি আর মুসা পাহারায় থাকবে, সাগরেদগুলো ফিরে আসে কিনা দেখবে। ডজ, তুমি থাকবে নৌকায়। যোদ্ধাদেরকে বলো, আমরা না ফেরাত যেন এখানেই থাকে।

আবার সৈকতের দিকে রওনা হলো ওমর। নারকেল কুঞ্জের ভেতর থেকে বেরোনোর আগেই চোখে পড়ে ঝলমলে সাগর। চাঁদের আলোয় মনে হচ্ছে গলিত রূপা। তার পেছনে এলো অন্য তিনজন।

নীরব নির্জন সৈকত। জীবনের চিহ্ন নেই। খোলা জায়গায় বেরোলো না ওরা, একধারে কয়েকটা রুটিফল গাছ জন্মে রয়েছে, তার নিচে এসে দাঁড়ালো। গাঁয়ের উঠনে আগুনের কুন্ড জ্বলছে। শুধু ওই আগুন আর স্কুনারটা প্রমাণ করছে যে এখানে মানুষ আছে। গাছের ছায়ায় ছায়ায় নীবে এগিয়ে চললো ওরা, ক্যানুগুলোর দিকে। বালির ওপরে কাত হয়ে পড়ে আছে ওগুলো। একটা ক্যানু টেনে নামালো চারজনে মিলে। পানিতে পড়েই টলে উঠলো ওটা। জীর্ণ দশা। মেরামত করা জরুরী হয়ে পড়েছে। সবগুলো ক্যানুর একই অবস্থা। কিশোরের ভয়ই হলো, চারজনে উঠলে না ডুবে যায়। তবে ডুবলো না নৌকাটা। সাবধানে দাঁড় বাইতে শুরু করলো ওমর আর মুসা। জাহাজের দিকে এগিয়ে চললো যতোটা সম্ভব কম শব্দ করে আর ঢেউ না তুলে। আস্তে করে এসে স্কুনারের গায়ে ভিড়লো নৌকা। মুসার তুলে রাখা দাঁড়ের পানি ফোটা ফোটা ঝরছে, তার শব্দও কানে আসছে, এতোই নীরব হয়ে আছে চারপাশ।

বেয়ে ওপরে উঠে গেল ওমর। তার পেছনে উঠলো মুসা আর কিশোর। ডজ নৌকায় বসে রইলো।

থাকো, ফিসফিস করে বললো ওমর। পিস্তল তো আছে। গুলি চালাতে দ্বিধা করবে না।

দেখেশুনে করবেন, নীরবে হাসলো মুসা। আমাদের গায়ে আবার লাগিয়ে দেবেন না।

কম্প্যানিয়ন ওয়ের দিকে চললো তিনজনে। সবে সিঁড়ির গোড়ায় পৌঁছেছে। ওরা, এই সময় গর্জে উঠলো একটা কণ্ঠ, কে?

যে কেবিন থেকে কথা বলেছে লোকটা, একটানে ওটার দরজা খুলে ফেললো ওমর। নাকেমুখে এসে ধাক্কা মারলো যেন তামাকের ধোঁয়া আর কড়া মদের গন্ধ। হ্যারিকেন জ্বলছে। ধোঁয়ার জন্যে ছড়াতেই পারছে না হলদেটে আলো, অন্ধকার কাটেনি। ঘরের মাঝখানে একটা টেবিল। তার ওপরে একটা চার্ট বিছিয়ে দেখছে কারনেস। আস্তে করে উঠে দাঁড়ালো সে। দরজায় দাঁড়িয়ে রয়েছে ওমর, যেন বিশ্বাস হচ্ছে না এটা। আচমকা গাল দিয়ে উঠে এক ধাক্কায় একপাশে সরিয়ে দিলো টেবিলটা। খেঁকিয়ে উঠলো, এখানে কি?

তোমার কাছেই এসেছি, কঠিন গলায় জবাব দিলো ওমর। সেই রাটুনা ছেলেটাকে চাই।

তাই নাকি? রাগে ফুসতে শুরু করলো কারনেস।

হ্যাঁ, তাই। আসতে বলবে, নাকি আমরাই গিয়ে ডেকে আনবো?

তোমাকে তোমাকে আমি…

বুঝেছি। আমরাই ডেকে নিয়ে যাচ্ছি। এই কিশোর, ছেলেটা কোথায় দেখ তো?

ঝিনুকের নাম ধরে ডাকতে ডাকতে সরু করিডর ধরে এগোলো কিশোর। কয়েকবার ডাকতেই সাড়া এলো দুর্বল কন্ঠে। একটা দরজার সামনে এসে থামলো কিশোর। ওটার ভেতর থেকেই শব্দটা এসেছে। কিন্তু দরজায় তালা দেয়া। ডেকে জিজ্ঞেস করলো, ঝিনুক, তুমি ভেতরে আছো?

আছি।

করিডরের দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে জুতোসহ একটা পা পাল্লার ওপরে তুলে দিলো কিশোর। তারপর ঠেলা দিলো। হলো না কিছু। আরো জোরে ঠেলতে লাগলো। চাপ সইতে না পেরে তালা ছুটে গিয়ে ঝটকা দিয়ে খুলে গেল পাল্লা। নাকে এসে লাগলো দুর্গন্ধ। কিছু দেখতে পাচ্ছে না অন্ধকারে। পকেট থেকে টর্চ বের করে জ্বাললো। মেঝেয় বসে আছে একটা ছেলে।

তোমার নাম ঝিনুক? কিশোর জিজ্ঞেস করলো।

হ্যাঁ। আমি ঝিনুক।

গুড। তোমাকে নিয়ে যেতে এসেছি। এসো, ওঠো।

দুর্বল ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ালো ছেলেটা। ঘর থেকে বেরিয়ে কিশোরের পেছন পেছন চললো।

এই যে, নিয়ে এসেছি, ওমরকে বললো কিশোর। দরজায় আগের জায়গাতেই দাঁড়িয়ে আছে ওমর। হাতে পিস্তল।

খাঁচায় আটকা জানোয়ারের মতো আচরণ করছে কারনেস। মুখ খারাপ করে গালাগাল করছে। হুমকি দিচ্ছে বার বার।

এবার ছেড়ে দিলাম, ওমর বললো। আর যদি দেখি কখনও শয়তানী করেছে, এমন শিক্ষা দেবো তোমাকে বুঝবে তখন। বরফের মতো শীতল হয়ে উঠেছে তার কণ্ঠ। ঘর থেকে বেরোবে না বলে দিলাম। তোমার মাথা দেখলেই গুলি চালাবো আমি, মনে রেখো। কিশোরকে নির্দেশ দিলো, ছেলেটাকে নৌকায় নিয়ে যাও।

ডেকের কিনারে এসে দেখলো ওরা, তীরের দিকে তাকিয়ে রয়েছে ডজ। আরেকটা নৌকা নামানো হয়েছে। অনেকগুলো ছায়ামূর্তি নড়ছে তাতে। কারনেসের সাগরেদরা ফিরে আসছে, নিচু গলায় বললো সে। কি করবো? দেখলে গন্ডগোল করবেই।

না, করবে না, বলে উঠলো আরেকটা কোমল কণ্ঠ। ক্যানুর কিনার থেকে।

অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখলো কিশোর, চাঁদের আলোয় সাগরের হাসির হাসি হাসি মুখটা। বললো, আরে তুমি। তুমি এখানে কি করছো?

দেখাচ্ছি, বলেই ডুব দিলো মেয়েটা। খুব হালকা একটা আলোড়ন তুলে তলিয়ে গেল মাছের মতো।

নৌকায় নামো, নির্দেশ দিলো ওমর। সৈকতে ফেরা দরকার।

ওদের ক্যানুটা এগোতে লাগলো সৈকতের দিকে, অন্য ক্যানুটা আসছে জাহাজের দিকে। দ্রুত। ডেকে বেরিয়ে এসেছে কারনেস। চেঁচিয়ে আদেশ দিলো তার সাগরেদদেরকে। আঞ্চলিক ভাষায়।

কি বললো, ব্যাটা? ডজকে জিজ্ঞেস করলো ওমর।

আমাদেরকে ডুবিয়ে দিতে বললো।

চেষ্টা করেই দেখুক।

তবে লড়াইটা আর হলো না। কারনেসের আদেশ পালন করার জন্যে ঠিকই তৈরি হয়েছিলো তার লোকেরা। নৌকার মুখও ঘুরিয়েছিলো কিশোরদের ক্যানুর কয়েক গজের মধ্যে এসে। কিন্তু হঠাৎ করেই এমন একটা কান্ড ঘটলো, যা কল্পনাও করতে পারেনি বিরোধী দল। পানিতে ঝপ করে একটা শব্দ হলো। মড়মড় করে উঠলো নৌকার পচা কাঠ। পরক্ষণেই কাত হয়ে গেল ক্যানুটা। একে অন্যের ঘাড়ের ওপর গিয়ে পড়লো লোকগুলো। পর মুহূর্তেই পানিতে। চেঁচাতে শুরু করলো ওরা। তাদের চিৎকারকে ছাপিয়ে পানির ওপরে ছড়িয়ে পড়লো যেন মেয়েলী কণ্ঠের খিলখিল হাসি।

টা-টা-টা-টা! চেঁচিয়ে উঠলো ঝিনুক। অকটোপাস মারার সময় সাগরের হাসিকেও এরকম শব্দ করতে শুনেছে কিশোর, অনুমান করলো বেশি উত্তেজিত কিংবা আনন্দিত হলেই বোধহয় ওরকম শব্দ করে এখানকার লোকে। ঝিনুক বলছে, দিয়েছে। নৌকা ডুবিয়ে দিয়েছে সাগরের হাসি! সে-ও ঝাপ দিলো পানিতে।

কিশোর আশা করলো, তার মাথাটা ভেসে উঠবে এখনই। উঠলো না। সাগরের হাসি কিংবা ঝিনুক, কারো মাথাই আর দেখতে পেলো না।

মুসাও খুঁজছে দুজনকে। না দেখে বললো, খাইছে! ডজ, ঠিকই বলেছিলেন! এগুলো মানুষ না, মাছ!

জাহাজের দিকে সাঁতরাতে শুরু করেছে কারনেসের সাগরেদরা। এছাড়া আর কিছু করারও নেই ওদের, জানে এখন ওমরদেরকে ধরতে এলে হয় বৈঠার বাড়ি খাবে, কিংবা পিস্তলের গুলি। ছুরির খোঁচা খাওয়ারও আশঙ্কা আছে। কে যায় শুধু শুধু মরতে।

নিরাপদেই তীরে পৌঁছলো অভিযাত্রীরা। ঝিনুক আর সাগরের হাসির জন্যে অপেক্ষা করবে ভেবেছিলো, কিন্তু ডাঙায় উঠে দেখলো ওরা দুজনই ওদের অপেক্ষায় রয়েছে।

যাক, জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেললো ওমর। যা করতে এসেছিলাম, করেছি। এবার বাড়ি ফেরা যাক।

গায়ের দিক থেকে এগিয়ে এলো কয়েকজন লোক। তবে খারাপ লোক মনে হলো না ওদেরকে। মারমুখো হয়ে আসেনি। ঝিনুক আর সাগরের হাসির সঙ্গে কয়েকটা কথা বলে আবার ফিরে চললো ওরা।

নিজের দলকে নিয়ে রওনা হলো ওমর, যোদ্ধারা যেখানে অপেক্ষা করছে সেখানে। ঝিনুককে দেখে খুব খুশি হলো ওরা।

অনেক পরিশ্রম করেছে। খানিকক্ষণ জিরাতে বসলো কিশোররা। সবাইকে বিস্কুট আর চকলেট ভাগ করে দিলো ডজ। খেতে খেতে ঝিনুককে জিজ্ঞেস করলো, কারনেস শয়তানটা তোমাকে অনেক প্রশ্ন করেছে, না?

করেছে। কোন দ্বীপে আপনাকে পাওয়া গেছে জানতে চেয়েছে বার বার।

বলেছো?

না। বলেছি, অনেক দূরে। বিশ্বাস করেনি। আমাকে মিথুক বলেছে। মেরেছে। ধমক দিয়েছে, না বললে একেবারে মেরে ফেলবে।

হয়েছে, আর কিছু করতে পারবে না, ছেলেটার কাঁধ চাপড়ে দিলো ডজ।

ঢাল বেয়ে যখন পাহাড়ে চড়ছে ওরা, তখনও মৃদু ভাবে কানে আসতে থাকলো কারননসের চেঁচামেচি।

আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখের কাছে পৌঁছতে পৌঁছতে ভোর হয়ে গেল। বোধহয় একারণেই কুকুরগুলোর আর কোনো সাড়াশব্দ পেলো না এখানে এসে। যদিও মশাল জ্বেলে তৈরিই রয়েছ যোদ্ধারা। দিনের আলোয় পথ চলতেও সুবিধে। পাহাড়ের যেসব জায়গা ভয়াবহ মনে হয়েছিলো রাতের অন্ধকারে, এখন আর ততোটা বিপজ্জনক লাগছে না। চলার গতিও বাড়লো।

অবশেষে নারকেল কুঞ্জে ঘেরা গায়ে প্রবেশ করলো ওরা। ঝিনুককে দেখে এমন কান্ড শুরু করলো গায়ের লোকে, এমন করে স্বাগত জানাতে লাগলো, যেন কবর থেকে ফিরে এসেছে সে।

অনেক পরিশ্রম করেছে। অভিযাত্রীরা সবাই ক্লান্ত! কারনেসের স্কুনারটা ফিরে আসতে পারে, আবার কোনো শয়তানীর চেষ্টা করতে পারে সে। অশান্ত সাগরকে কড়া নজর রাখার ব্যবস্থা করতে বলে তিন সহকারীকে নিয়ে কুঁড়েতে এসে ঢুকলো ওমর। ঘুমাতে হবে। ডজ আইল্যান্ডে যাওয়াটা স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নিলো আগামী দিন ভোর পর্যন্ত।

<

Super User