যদিও একটা দিনও নষ্ট করেনি ওরা, তারপরেও দক্ষিণ সাগরে ওদের প্রথম সাময়িক ঘাঁটিটাতে পৌঁছতেই এক মাস পার হয়ে গেল। অনেক কাজ করতে হয়েছে। বসে বসে প্ল্যান করেছে ওমর, এ-ব্যাপারে তাকে সাহায্য করেছে কিশোর। কারণ এই বুদ্ধিটুদ্ধিগুলো তার মাথায়ই ভালো খেলে। জিনিসপত্র কিনতে ডজকে সাহায্য করেছে মুসা। ডাইভিঙের ব্যাপারটা কিশোরের চেয়ে ভালো বোঝে সে। রবিন সত্যিই আসতে পারেনি, পারলো না বলে অনেক দুঃখ করেছে। তবে রকি বীচে থাকতে অনেক সাহায্য করেছে সে, জিনিসপত্র জোগাড়ের কাজে। আরও নানারকম সাহায্য করেছে। হঠাৎ করে জরুরী কাজে বার্টলেট লজ ইউরোপে চলে না গেলে সে অবশ্যই বসে থাকতো না মিডজিকের ব্যবসা নিয়ে; আসতোই সঙ্গে।

ওমর আর কিশোরকে অনেক জটিল সমস্যার সমাধান করতে হয়েছে। যেমন প্রথমেই ভাবতে হয়েছে, দ্বীপে বিমান নামানোর ব্যাপারটা। কি করে নিয়ে যাবে? অনেক জটিলতা আছে। নিয়ে যাওয়ার জন্যে সরকারী অফিস থেকে অনুমতি জোগাড় করতে হয়। তবে সেটা সহজ কাজ। কঠিন কাজটা হলো বিমানটাকে জায়গামতো নিয়ে যাওয়া। আর কোন ধরনের বিমান নিয়ে গেলে সুবিধে হবে সেটাও বুঝতে হবে।

যেরকম জায়গা, বিমান নিয়ে যাওয়ার দুটো উপায় আছে। এক, জাহাজে করে বয়ে নিয়ে যাওয়া। দুই, উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া। সহজে যাওয়া আর খরচ কমাতে চাইলে জাহাজে তুলে নিয়ে যাওয়াটাই ভালো। আরেকটা বড় সমস্যা হলো, এসব কাজের জন্যে বিমান ভাড়া দিতে চায় না কেউ। কিনতে হবে। আধুনিক বিমানের অনেক দাম। কম দামে পুরনো আমলের জিনিস পাওয়া যায়। তবে কাজ চলার মতো মজবুত আর ভালো জিনিস পাওয়াটা সহজ নয়। তবু খুঁজতে শুরু করলো ওমর।

পেয়েও গেল বিমান বাহিনীর পুরনো বিমান ফেলে রাখার গুদামে। অনেক পুরনো আমলের একটা ফ্লাইং বোট, টুইন ইঞ্জিন। বেশি চলেনি। তবে পড়ে থেকে থেকে অনেক জিনিস নষ্ট হয়ে গেছে। তা নিয়ে ভাবে না ওমর। নিজেই সারিয়ে নিতে পারবে। একটু বেশি খাটতে হবে আরকি। লম্বা ডানাওয়ালা মনোপ্লেন ওটা। বড় ট্যাঙ্ক। একবার তেল ভরে নিলে অনেক দূর যাওয়া যায়।

দরাদরি করে বেশ শস্তায়ই জিনিসটা কিনে নিয়ে এলো ওমর। মেরামতের কাজ শুরু করে দিলো। তাকে এ-ব্যাপারেও সাহায্য করতে লাগলো কিশোর আর মুসা, খুশি হয়েই। বিমান সম্পর্কে অনেক কিছু জানা হয়ে যাবে তাতে। কাজও চলতে লাগলো, সেই সঙ্গে আলোচনাও, কোথায় কিভাবে নিয়ে যাবে বিমানটাকে। ডজ পরামর্শ দিলো, জিনিসপত্র সব নিয়ে আগেই রওনা হয়ে যাবে সে। গিয়ে কিছু প্রয়োজনীয় কাজ সেরে রাখবে। এতো পুরনো একটা ফ্লাইং বোট নিয়ে তাহিতিতে গেলে একটা আলোড়ন সৃষ্টি হবেই। একটা হৈ চৈ শুরু হয়ে যাবে। সেটা এড়ানো গেলেই ভালো। গোপন একটা মিশনে চলেছে ওরা, এতো মানুষের নজরে পড়ে যাওয়া ঠিক হবে না। তার চেয়ে অস্ট্রেলিয়ার কোনো এজেন্টের সঙ্গে যোগাযোগ করে যদি রারাটোঙ্গা দ্বীপে পেট্রোল আর তেল পাঠানোর ব্যবস্থা করা যায়, তাহলে খুব ভালো হয়। দ্বীপটা যেহেতু অস্ট্রেলিয়ার প্রধান জাহাজ-পথটাতেই পড়ে, তেল পাঠানোর অসুবিধে হবে না। তাই সরাসরি রারাটোঙ্গায় চলে যেতে চায় সে। সেখানে বিমানটার জন্যে খানিকটা তেল রেখে দেবে। বাকিটা জলপথে পাঠানোর ব্যবস্থা করবে ভেইটিতে। কুক দ্বীপপুঞ্জের সব চেয়ে ছোট দ্বীপগুলোর একটা হলো ডেইটি। দ্বীপ ছোট হলে হবে কি, অনেক বড় একটা লেগুন আছে ওখানে। ফ্লাইং বোট নোঙর করিয়ে রাখার চমৎকার ব্যবস্থা হতে পারে ওই লেগুনে। বার বার তেল ভরা যাবে ওখানে রেখে। রারাটোঙ্গা থেকে বিমানটাকে উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হবে ওখানে। ভেইটি থেকে ডজকে তুলে নিয়ে সোজা রওনা হয়ে যাবে বিমানটা ভজ আইল্যান্ডের উদ্দেশে। এই ব্যবস্থায় অনেক সুবিধে। অকারণ অনেক ঝুঁকি এড়ানো যাবে।

আরও কিছু পরিকল্পনা করা হলো। তবে সবগুলোর মধ্যে ডজের পরামর্শটাই উপযুক্ত মনে হলো। ওমরের মন খুঁতখুঁত করতে লাগলো যদিও। এর চেয়ে ভালো আর কোনো বুদ্ধি বের করতে না পেরে অবশেষে সেটাই মেনে নিলো সে। বিমানটাকে তুলে দেয়া হলো একটা স্টীমারে। রারাটোঙ্গায় নামিয়ে দেবে। ওটার সঙ্গেই যাবে ওমর, কিশোর আর মুসা।

সব কিছু গুছিয়ে নিয়ে রওনা হয়ে গেল ডজ। মাসখানেক পরে রারাটোঙ্গায় পৌঁছে কিশোররা দেখলো প্ল্যানমাফিক তেল রেখে ভেইটিতে চলে গেছে সে।

তেল-টেল ভরে, বিমানটাকে একবার পরীক্ষামূলক ভাবে উড়িয়ে দেখলো ওমর। ঠিকই আছে। তিন অভিযাত্রীকে নিয়ে রওনা হয়ে গেল ওটা ভেইটির উদ্দেশে। ওখানে পৌঁছে দেখলো একটা অ্যাক্সিডেন্ট করে ফেলেছে ডজ, এতে ওদের পরিকল্পনায় একটা বড় রকম পরিবর্তন হয়ে গেল। সে ঠিকমতোই পৌঁছেছে ওখানে, তেল আর জিনিসপত্রও বহাল তবিয়তেই আছে, কিন্তু তার নিজের হাতটা রয়েছে স্লিঙে ঝোলানো। বেশ লজ্জিত হয়েই সে তার এই দুর্ঘটনার কাহিনী শোনালো।

ভেইটিতে সময়মতোই পৌঁছেছিলো সে। দ্বীপটায় মানুষের বসবাস নেই। পালতোলা ছোট যে জাহাজটায় করে সে ওখানে পৌঁছেছে তার ক্যাপ্টেন স্থানীয় লোক, পলিনেশিয়ান, নাম হাইপো-বললো, একটা কাজে তাহিতিতে ফিরে যাচ্ছে। ফেরার পথে খাবার পানি নেয়ার জন্যে আবার থামবে ভেইটিতে। শুনে ডজের মাথায় একটা বুদ্ধি এলো। অযথা দ্বীপে বসে থেকে একা একা কি করবে? জিনিসপত্র রেখে চলে যেতে পারে হাইপোর সঙ্গে। জাহাজটা তো ফিরবেই, তখন আবার না হয় ফিরে আসা যাবে। তাহিতিতে গিয়ে বরং গুডু কারনেসের খোঁজখবর নেয়া ভালো। লোকটা কোথায় আছে এখন, কি করছে, জানা থাকলে সুবিধে। ডজ মুক্তোর খেতটা আবিষ্কারের পর অনেক সময় পেরিয়ে গেছে। হয়তো ইতিমধ্যে ওটা বের করে ফেলেছে কারনেস। ফেলে থাকলে খবরটা চেপে রাখতে পারবে না। সেটাই জানার জন্যে তাহিতিতে চললো আবার ডজ।

বন্দরে পা দিয়েই প্রথম যে লোকটার ওপর চোখ পড়লো তার, সে হলো স্বয়ং কারনেস। তাড়াতাড়ি আবার জাহাজে উঠে পড়তে চেয়েছিলো ডজ, পারলো না, দেখে ফেললে তাকে কারনেসের এক সাগরেদ। একটা গন্ডগোল বাধিয়ে হামলা করে বসলো। হাতে ছুরির খোঁচা খেলো ডজ।

দ্বীপের গভর্নরকে ব্যাপারটা জানাতে পারতো সে। তাতে হয়তো কারনেসকে পাকড়াও করতে পুলিশ। কিন্তু কেন এই শত্রুতা তা জানার চেষ্টা করতেনই গভর্নর। মুক্তোর খেতের কথা ফাঁস হয়ে যাওয়ার ভয় ছিলো তাতে। কাজেই বাড়াবাড়ি না করে সোজা এসে আবার জাহাজে উঠলো ডজ। হাইপোকে অনুরোধ করলো তখনি তাকে ভেইটিতে নিয়ে যাওয়ার জন্যে।

নিয়ে এসেছে হাইপো। কিশোররা আসার একটু আগে ভেইটিতে পৌঁছেছে ডজ। তখনও নোঙর করা রয়েছে হাইপোর জাহাজ। যায়নি।

জখমটা এক পলক দেখেই বুঝতে পারলো ওমর, ডাইভিঙের ক্ষমতা নেই এখন ডজের। মুক্তো তোলার জন্যে সাগরে ডুব দিতে পারবে বলেও মনে হলো না। অনেকখানি মাংস কেটেছে, চিরে একেবারে হাঁ হয়ে আছে। পচবে কিনা কে জানে! জ্বর এসে গেছে ইতিমধ্যেই। এই অবস্থায় তাকে নিয়ে যাওয়া বিপজ্জনক। এমনিতেই ওসব গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চলে ঘা শুকাতে দেরি হয়। তা-ও ঠিকমতো ওষুধপত্রের ব্যবস্থা করা গেলে। অভিযানে যাওয়া বাদ, ভাবলো ওমর। বরং এখানে থেকে এখন ভালোমতো ওষুধ দিয়ে ডজের জখমের চিকিৎসা করা দরকার।

অযথা বসে থাকতে হবে। তার চেয়ে বরং তাহিতিতে চলে যাওয়া ভালো, ভাবলো সে, হাইপোর জাহাজটা যখন রয়েছে। লোকটার যেতে কোনো আপত্তি নেই, সে ভাড়া পেলেই খুশি। তাহিতিতে বিমান নামাতে চায়নি ডজ, লোকের নজরে পড়ে যাওয়ার ভয়ে। সেটা এড়ানো গেছে। জাহাজে করে এখন ওমর আর আরেকজন যদি যায়-মুসা কিংবা কিশোর, যে কোনো একজন হতে পারে, তাহলে কারো চোখে পড়বে না। কতো নতুন লোকই তো তাহিতিতে যায়, আসে। আরেকটা ভয় ছিলো ডজের, কারনেসের চোখে পড়ার ভয়। সে ভয় করেও আর লাভ নেই। যা ঘটার ঘটে গেছে, চোখে পড়েই গেছে লোকটার। হাইপোর জাহাজে করে গিয়ে এখন আবার ওমররা তাহিতিতে নামলে কারনেস দেখে ফেলবে, আর অনেক কিছু অনুমান করে ফেলবে। করুক। তাতে আর কিছু যায় আসে না। ডজকে দেখেই হয়তো যা করার করে বসে আছে সে। বরং গিয়ে এখন খোঁজ নেয়া দরকার কতোটা বুঝেছে কারনেস, আর কি পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে।

কাজেই সেই রাতেই হাইপোর জাহাজে করে তাহিতিতে ফিরে চললো কিশোর আর ওমর। মুসাকে রেখে এসেছে ডজের কাছে। জখম বেশি খারাপ হয়ে গেলে যাতে বিমানে করে উড়িয়ে নিয়ে আসতে পারে তাহিতিতে।

এরকম ছোট জাহাজে বিশাল মহাসাগরে বেরোনো কোনো নতুন অভিজ্ঞতা নয় কিশোরের কাছে। আগেও এসেছে এখানে। শুধু নারকেল গাছের কান্ড সম্বল করে ভেসে পড়েছিলো বিপজ্জনক সাগরে। রেলিঙের কাছে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলো জাহাজ ঘিরে হাঙরের ঘোরাফেরা। খাবারের গন্ধ পেয়ে গেছে যেন প্রাণীগুলো, কাছছাড়া হতে চাইছে না আর।

বাতাস চমৎকার। আবহাওয়াও ভালো। নিরাপদেই তিনদিন পরে তাহিতিতে এসে পৌঁছলো জাহাজ। বেশি সময় ওখানে থাকার ইচ্ছে নেই ওমরের। কারনেসের খোঁজ নেয়া হয়ে গেলেই ফিরে যাবে ভেইটিতে।

ডজের পরামর্শ মতো প্রথমেই দুজনে চলে এলো রেস্টুরেন্ট ডু পোর্টে। প্রায় ভরে গেছে জায়গাটা। মানুষ আর তাদের বিচিত্র আচরণ দেখতে ভালো লাগে কিশোরের। কৌতূহল নিয়ে তাকালো। মানুষ দেখার জন্যে এরকম জায়গা খুব কমই আছে। ভালো পোশাক পরা কয়েকজন টুরিস্ট দেখা গেল। তাদের বেশির ভাগই আমেরিকান। জাহাজের ক্যাপ্টেন রয়েছে কয়েকজন, ওরা সব স্থানীয় লোক। শ্বেতাঙ্গ রয়েছে বেশ কিছু, দাঁড়িওয়ালা, নানা দেশ থেকে এসেছে জীবিকা আর রোমাঞ্চের সন্ধানে। পৃথিবীতে যতো রঙের চামড়ার মানুষ আছে, কালো থেকে হলুদ, সব আছে এখানে। রয়েছে চীনা ব্যবসায়ী। পলিনেশিয়ান আছে কয়েকজন, কানের পেছনে আর চুলে রঙিন ফুল গোঁজা। ঢুকতেই ইংরেজি, ফরায়ী, জার্মান, চীনা আর আরও অসংখ্য ভাষার মিলিত কণ্ঠ এসে কানে ধাক্কা মারলো যেন কিশোরের।

এক কোণে দুটো চেয়ার দেখে এগিয়ে গেল ওমর। কিশোরকে নিয়ে বসে খাবারের অর্ডার দিলো। গলা নামিয়ে কিশোরকে বললো, কোথেকে তদন্ত শুরু করবো বুঝতে পারছি না। হাইপো তো বললো কাজ সেরে আসবে। তাকে দিয়ে যদি কোনো সুবিধে হয়। কি বলো?

কারনেসের কথা তাকে বলেছেন? জিজ্ঞেস করলো কিশোর। জাহাজে তো দেখলাম আপনাদের দুজনের খুব ভাব।

না। তবে ও আন্দাজ করে ফেলেছে, কারনেসের সঙ্গে মন কষাকষি চলছে আমাদের কোনো কারণে। ডজকে মারতে দেখেছে ও। শত্রুতা যে আছে বুঝে গেছে। মুক্তোর কথা জেনেছে কিনা কে জানে। ভেইটিতে আমরা অনেক কথা বলছি। আড়ি পেতে কিছু শুনে থাকতে পারে।

যদি আড়ি পাতে। বিশালদেহী, স্বাস্থ্যবান পলিনেশিয়ান লোকটাকে খারাপ মনে হয় না কিশোরের। আমার মনে হয় ওকে বিশ্বাস করতে পারি আমরা। তার সাহায্য পাবো। এখানকার লোক সে। তার ওপর নাবিক। এখানকার অনেক গুজবই তার কানে যাবে। তার কাছে…ওই তো, এসে গেছে।

কিশোর লক্ষ্য করলো, শুধু ওরা দুজনেই নয়, হাইপো ঢোকার পর অনেক জোড়া চোখই তার দিকে ঘুরে গেছে। সে চোখগুলোতে কৌতূহল। সোজা কিশোরদের টেবিলের দিকে এগিয়ে এলো সে। একটা চেয়ার টেনে বসলো। আপনারা ক্যাপ্টেন কারনেসের খোঁজ করছেন তো? ইংরেজি আর ফরাসী ভাষার একটা অদ্ভুত মিশ্রণে কথা বলে সে। ফিসফিস করে বললো।

চিন্তিত ভঙ্গিতে একটা মুহূর্ত তার দিকে তাকিয়ে রইলো ওমর। মাথা ঝাঁকালো। হ্যাঁ, খুঁজছি।

খারাপ লোক।

আমারও তাই বিশ্বাস।

সাবধানে থাকবেন।

কেন? আমাদের সঙ্গে কেন লাগতে আসবে সে? চিনিই তো না।

ওই লোক সবার সঙ্গেই ঝগড়া বাধায়। কালও গন্ডগোল করেছিলো।

তার মানে এখানেই আছে?

হ্যাঁ। তার স্কুনার হোয়াইট শার্ক পাপিতি বন্দরে নোঙর করা রয়েছে। রাটুনা থেকে এসেছে আজ সকালে। কাল ভোরেই আবার জাহাজ নিয়ে বেরোবে। মালপত্র বোঝাই করছে জাহাজে, অনেক জিনিস।

গন্ডগোলটা কি করেছে?

রাটুনা থেকে জোর করে একটা ছেলেকে ধরে নিয়ে এসেছে কাজ করানোর জন্যে। কাল বন্দরে নেমেই পালানোর চেষ্টা করেছিলো ছেলেটা। ধরে ফেলে তাকে প্রচন্ড মার মেরেছে কারনেস। সে বলছে, জাহাজে কাজ করার জন্য চুক্তি করেছে ছেলেটা, আগাম টাকাও নিয়েছে, এখন পালারে কেন? জোর করে ধরে আবার জাহাজে তুলেছে।

কাল ভোরে চলে যাচ্ছে, না?

হ্যাঁ। গভর্নর তাকে বেরিয়ে যাওয়ার হুকুম দিয়েছেন।

কোথায় যাচ্ছে?

বলেনি। কারনেস আর তার সাগরেদরা ছাড়া আর কেউ কিছু জানে না। কেউ জিজ্ঞেস করতে গেলে শুধু চোখ টেপে ওরা, আর মিটমিট করে হাসে।

আপনি জানলেন কি করে?

আমার লোকেরা শুনে এসেছে। বন্দরে নেমেছিলো, সেখান থেকে।

ছেলেটার কি অবস্থা? রাটুনা থেকে যাকে ধরে এনেছে?

কি জানি! হাত ওল্টালো হাইপো। তবে খারাপই হবে। কারনেসের হাতে কেউ পড়লে তার আর ভালো হওয়ার উপায় নেই। সবাই ভয় পায় লোকটাকে।

গভর্নরও?

মনে তো হয়। নইলে ধরে কিছু করেন না কেন? শুধু বেরিয়ে যেতে বলেছেন।

এতোই খারাপ, বিড়বিড় করলো কিশোর। তো, ছেলেটা পালিয়েছিলো কিভাবে? ওরকম একজন লোকের হাত ফসকে?

জাহাজের রেলিঙ টপকে সাগরে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো। পানিকে ওরা ভয় পায় না।

কি যেন ভাবছে কিশোর। আনমনেই বিড়বিড় করলো, রাটুনা থেকে ধরে আনলো…পানিকে ভয় পায় না…হাইপোর চোখের দিকে তাকালো। ছেলেটার নাম বলতে পারেন?

পারবো না কেন? সবাই জানে। ঝিনুক।

ঝট করে কিশোরের দিকে তাকালো একবার ওমর। হাইপোর দিকে ফিরলো। কি বললেন!

ঝিনুক।

হুঁ, যা ভেবেছিলাম! নিচু গলায় বললো কিশোর।

কি ভেবেছিলে? জানতে চাইলো হাইপো। অবাক হয়েছে।

না, কিছু না, আরেক দিকে মুখ ফেরালো কিশোর। সে কি ভাবছে বুঝতে পারলো ওমর। হাইপোকে জিজ্ঞেস করল, রাটুনা থেকেই এনেছে তো?

নিশ্চয়।

আর কোনো সন্দেহ রইলো না কিশোর কিংবা ওমরের। রাটুনাতে গিয়েছিলো কারনেস। কোনো ভাবে জেনেছে, ঝিনুকই উদ্ধার করে এনেছে ডজকে। তার মানে যে দ্বীপ থেকে এনেছে সেটার অবস্থান বলতে পারবে এবং তার অর্থ ওই দ্বীপের কাছাকাছিই কোথাও রয়েছে মুক্তোর খেত। ছেলেটাকে ধরে এনেছে সেই জায়গা চিনিয়ে দেয়ার জন্যে।

এখানে এসে ভালোই করেছি, বুঝলে? কিশোরের দিকে তাকিয়ে বললো ওমর। একটা জরুরী খবর জানা গেল। এখুনি ভেইটিতে ফেরা দরকার। দেরি করা… দরজার কাছে একটা হৈ চৈ শুনে ফিরে তাকালো সে। হঠাৎ করেই নীরব হয়ে গেল সবাই। সব কটা চোখ ঘুরে গেছে সেদিকে। মোটা, গাট্টাগোট্টা একজন ইটালিয়ান লোক ঢুকেছে। ধীরে ধীরে এগোতে লাগলো। মুখের মসৃণ চামড়া কালো দেখাচ্ছে রক্ত জমায়। আধবোজা চোখ। আস্তে করে মোচড় দিচ্ছে গোঁফে। তাকে দেখে সবাই যে এমন চমকে গেছে, এটা যেন উপভোগ করছে খুব।

চেয়ার থেকে অর্ধেক উঠে পড়েছিলো হাইপো, বসে পড়লো আবার। হাত রাখলো ওমরের বাহুতে। কারনেস! তার কণ্ঠে অস্বস্তি।

তাতে কি হয়েছে? আপনি তো আর কিছু করেননি। এতো ভয় পাওয়ার কি হলো?

বুঝতে পারছেন না আপনি। আমার ওপর ওর কুনজর পড়লে বিপদে পড়ে যাবো। আমি কিছুই করতে পারবো না।

কেন পারবেন না?

কারনেস শাদা মানুষ। শাদা মানুষের গায়ে হাত তুললে মুশকিল হবে।

অবাক হয়ে গেল ওমর। ঔপনিবেশিক শাসনের ছোঁয়া এখনও পুরোপুরি দূর হয়নি এই অঞ্চল থেকে। এখনও এখানকার মানুষের মনে রয়ে গেছে শাদা মানুষের ভয়। নিশ্চয় এখনও ওদেরকে অত্যাচার করে শ্বেতাঙ্গরা। মাথা ঝাঁকালো সে, বুঝেছি। পকেট থেকে টাকা বের করলো বিল দেয়ার জন্যে। চোখের কোণ দিয়ে একটা নড়াচড়া দেখতে পেয়ে মুখ তুলে তাকালো। ওদের টেবিলের কাছাকাছি এসে থেমেছে করসিকান লোকটা। ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রয়েছে হাইপোর দিকে।

এই কুত্তা! খেকিয়ে উঠলো কারনেস, আমার জাহাজের কাছে ঘুরঘুর করছিলি কেন?

আপনার জাহাজের কাছেও যাইনি আমি, ক্যাপ্টেন কারনেস, তাড়াতাড়ি জবাব দিলো হাইপো।

বাঁকা হয়ে গেল কারনেসের ঠোঁটের এক কোণ। আরও কুৎসিত করে তুললো মুখটাকে। মুঠো হয়ে গেল আঙুল। ব্যাটা মিথুক… বলতে গিয়েই থেমে গেল। তাকালো ওমরের দিকে। উঠে দাঁড়িয়েছে সে।

দেখুন, কঠিন কণ্ঠে বললো ওমর। এটা আমার টেবিল। আপনাকে ডেকেছি বলে তো মনে পড়ে না।

চুপ হয়ে গেছে সবাই। থমথমে পরিবেশ।

জ্বলন্ত চোখে ওমরের দিকে তাকিয়ে রয়েছে কারনেস। দাঁতে দাঁত চেপে বললো, তোমাকে কথা বলতে কে বলেছে? বসো!

তার ধমকের পরোয়াই করলো না ওমর। ভদ্রভাবে কথা বলো। তোমার সাগরেদ পেয়েছো নাকি আমাকে?

বসো! চেঁচিয়ে উঠলো, কারনেস। আমার কাজ আমাকে করতে দাও।

কি করবে?

এই কুত্তাটাকে ভর্তা বানাবো।

মাথা নাড়লো ওমর। না, তা তোমাকে করতে দেয়া হবে না। কিছু করতে গেলে আমাকে নাক গলাতেই হবে।

অবাক হলো যেন কারনেস। আমি কে জানো?

জানি। তুমি কে, কী, ভালো করেই জানি। তোমার নাম কারনেস। একটা সাধারণ গুন্ডা। যে মনে করে এই দ্বীপটা তার সম্পত্তি। সরো, আমার টেবিলের সামনে থেকে!

চোখের পলকে পকেটে হাত চলে গেল লোকটার। বেরিয়ে এলো একটা ছুরি। ঝিক করে উঠলো আলোয়।

বিদ্যুৎ খেলে গেল ওমরের শরীরে। এসব ছুরি-টুরির থোড়াই পরোয়া করে সে। থাবা দিয়ে পানির একটা গেলাস তুলে নিয়েই ছুঁড়ে মারলো কারনেসের মুখে। একলাফে এগিয়ে এলো। ধা করে গিয়ে বাঁ হাতটা আঘাত হানলো লোকটার সোলার প্লেক্সাসে। প্রচন্ড আঘাতে ঝটকা দিয়ে সামনে ঝুঁকে এলো করসিকানের মাথা। ওমরের ডান হাতের ঘুসি লাগলো তার চোয়ালে। মাঠ পার করে দেয়ার জন্যে ক্রিকেট বলকে ব্যাট দিয়ে বাড়ি মারলে যেমন হয় শব্দ হলো সেরকম।

গুঙিয়ে উঠলো কারনেস। টলে উঠলো। ধারালো দা দিয়ে এক কোপে কলাগাছের গোড়া কেটে দেয়া হলো যেন, ধীরে ধীরে কাত হয়ে তেমনি ভঙ্গিতে উল্টে পড়লো লোকটা, চেয়ার টেবিল নিয়ে। সেই টেবিলের সামনে বসেছিলো একজন তরুণ আমেরিকান, লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালো সে। চেঁচিয়ে বলতে লাগলো, দারুণ! দারুণ মার মেরেছেন! দেখালেন বটে!

ঘরের কেউ নড়লো না। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাত ডলছে রেস্টুরেন্টের মালিক, কিন্তু কিছুই করতে এগোলো না। যেখানে ছিলো সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো ওমর। তাকিয়ে রয়েছে কারনেসের দিকে।

ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালো আবার করসিকান। মাথা নেড়ে যেন ভেতরটা পরিষ্কার করতে চাইছে। শুয়োরের চোখের মতো খুদে কুকুতে চোখ জোড়ায় তীব্র ঘৃণা। দ্রুত একবার দৃষ্টি ঘুরে এলো সারা ঘরে, তার এই হাস্যকর পরিণতিতে কে কতোটা খুশি হলো যেন দেখলো। ঘুরে এসে চোখজোড়া আবার স্থির হলো ওমরের ওপর। জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলছে। দ্বিধা করলো একটা মুহূর্ত। তারপর দাঁতের ফাঁক দিয়ে হিসহিস করে বললো, আবার দেখা হবে আমাদের।

আলোয় আর দেখা করতে এসো না, শান্তকণ্ঠে বললো ওমর। অন্ধকার রাতে আমার পেছন দিক থেকে এসো, যদি আমাকে মারতে চাও। আরেকবার সামনে পড়লে দাঁত কটা খসিয়ে দেবো, মনে থাকে যেন। যাও, ভাগো! চুরি করে মদ বিক্রি করে গিয়ে। যেটা ভালো পারো।

আরেকবার সারা ঘরে চোখ বোলালো কারনেস। কয়েকজন হাসছিলো, তার চোখে চোখ পড়তেই হাসি মিলিয়ে গেল ওদের। ছুরিটা আবার পকেটে ভরলো করসিকান। তারপর শান্ত পায়ে এগোলো দরজার দিকে। বেরিয়ে গেল বাইরের অন্ধকারে।

একসাথে কথা বলে উঠলো অনেকগুলো কণ্ঠ। কিশোরের মনে হলো, ঝাঁপ দিয়ে এসে পড়লো যেন শব্দগুলো।

ভালো হয়েছে! আচ্ছা, শিক্ষা হয়েছে! বললো একটা কণ্ঠ। শয়তানটাকে একটা শিক্ষা দেয়া দরকার ছিলো!

তাহলে কেন এতোদিন দিলেন না? জিজ্ঞেস করলো ওমর। ভালোমতো একবার দিয়ে দিলেই তো ঠান্ডা হয়ে যেতো। ঘরের সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললো, নিন। খাওয়া শুরু করুন। আপদ বিদেয় হয়েছে।

উঠে দাঁড়ালো একজন লম্বা, সুন্দর চুলওয়ালা স্ক্যানডিনেভিয়ান লোক। পরনে নাবিকের পোশাক, পুরনো, মলিন হয়ে গেছে। এগিয়ে এসে হাত বাড়িয়ে দিলো। আমার নাম স্ট্রাডস স্যানটোজ। একটা কাজের কাজ করেছেন। আমার একটা জাহাজ আছে। সাহায্যের দরকার পড়লে জানাবেন, খুশি হয়েই করবো।

থ্যাংকস, স্যানটোজ, ওমর বললো। মনে থাকবে আপনার কথা। আর বসলো না। কিশোর আর হাইপোর দিকে ফিরে বললো, চলো।

দরজার দিকে এগোলো সে। প্রশংসার দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইলো ঘরের সব কটা চোখ। বাইরে বেরিয়েই হাইপোকে জিজ্ঞেস করলো, আপনার কাজ শেষ হয়েছে?

হয়েছে, বস। শেষ।

জাহাজ ছাড়া যাবে?

যক্ষুণি বলবেন।

গুড। আমি গভর্নরের সঙ্গে দেখা করবো। ঝিনুক ছেলেটার ব্যাপারটা তদন্ত করতে অনুরোধ করবো। কারনেসের হাত থেকে ওকে ছাড়িয়ে আনা দরকার।

জ্যোৎস্নায় আলোকিত বন্দরের দিকে তাকিয়ে বললো হাইপো, দেরি হয়ে গেছে, বস।

মানে? কি বলতে চান?

কারনেসের জাহাজ ছেড়ে দিয়েছে। হাত তুলে দেখালো হাইপো, ওই যে তার স্কুনার, চলে যাচ্ছে।

ওমর আর কিশোরও দেখলো। ধীরে ধীরে বন্দরের মুখের দিকে এগিয়ে চলেছে একটা জাহাজ নোঙর থেকে পানি ঝরছে এখনও।

এইমাত্র ছাড়লো, তিক্ত কণ্ঠে বললো ওমর। আর কিছুই করার নেই। তবে আমার বিশ্বাস, কারনেসের সঙ্গে আবার দেখা হবে আমাদের। চলুন, ভেইটিতে ফিরে যাই।

হাইপোর জাহাজটা যেখানে নোঙর করা রয়েছে, সেদিকে হেঁটে চললো তিনজনে।

<

Super User