কাঁকড়ার যন্ত্রণায় রাতে ভালো ঘুমোতে পারেনি কিশোর। ঘরের মধ্যে এসে ঢুকেছে ওগুলো, বার বার গায়ের ওপর উঠেছে। মুসা আর ওমরের ঘুম ভেঙেছে ওগুলোর জ্বালায়। তবে ডজ, সাগরের হাসি আর ঝিনুকের কিছু হয়নি। ওদের অভ্যেস, হয়ে গেছে।

ঝিনুক তুলতে যাওয়ার জন্যে ফ্লাইং বোটে চড়লো ওরা। সকালটা বেশ ভালো। ওরকম একটা কাজে যাওয়ারই উপযুক্ত। এমনকি খোলা সাগরও শান্ত।

ট্যাক্সিইং করে চললো ওমর। পাশে বসে নির্দেশ দিতে লাগলো ডজ, কোনদিক দিয়ে যেতে হবে। বাইরে যদিও ঢেউ প্রায় নেই, তবু লেগুনে ঢোকার মুখটায় জোয়ারের পানি ঢোকার তীব্র স্রোত রয়েছে। বিমানটাকে এগোতে বাধা দিচ্ছে। তবে ঠেকাতে পারলো না। কারণ দুটো এঞ্জিন রয়েছে। তাছাড়া ওটার উইং ফ্লোটগুলো পানিতে তেমন ডোবে না। কামড় বসাতে পারলো না পানি। নৌকা-টৌকা হলে অবশ্য অন্য কথা ছিলো।

খোলা সাগরে বেরোতেই হাত তুলে একটা দিক নির্দেশ করলো ডজ, ওদিকে যেতে হবে। ওড়ার দরকার নেই। সাগর যে রকম শান্ত, এভাবেই চালিয়ে চলে যাওয়া যাবে। তবে প্রবালের দেয়াল-টেয়াল আছে কি না লক্ষ্য রাখতে হবে। এসব সাগরে ওসবের বিশ্বাস নেই। কোথায় যে পানির তলায় ঘাপটি মেরে থাকে, কিছু বোঝা যায় না। এমনিতে মনে হবে শুধু পানি, কিন্তু ফুটখানেক নিচেই হয়তো রয়েছে দেয়াল। লাগলে ফ্লোটের বারোটা বেজে যাবে।

জানালার পাশে বসে দেখছে কিশোর। সাগরের ওপর দিয়ে এভাবে ট্যাক্সিইং করে ছুটে যেতে দারুণ লাগছে তার। জাহাজ কিংবা স্পীড বোট এতো জোরে ছুটতে পারে না। কোথাও কোনো বাধা নেই। শুধুই ছুটে চলা। আনন্দে বেসুরো গলায় গানই গেয়ে উঠলো সে।

পনেরো মিনিট একটানা সামনে ছুটলো ওমর। তারপর গতি কমাতে বললো ডজ। তার মনে হলো জায়গাটার কাছে পৌঁছে গেছে। চেনার মতো কোনো চিহ্ন নেই। কয়েকশো গজের মধ্যে চলে এলেও বোঝার উপায় নেই। সাগরে এমনকি যন্ত্রের রিডিংও সঠিক হয় না। গড় কিংবা প্রায় ধরে নিতে হয়।

গতি একেবারে কমিয়ে ফেললো ওমর। ডজকে জায়গাটা খুঁজে বের করার সুযোগ দিলো।

বেশ কিছুক্ষণ খোঁজাখুজি করলো। বের করতে না পেরে বললো, আশপাশে থাকতে পারে। এক কাজ করো। গতি এরকমই থাক। চক্কর দিতে শুরু করো তো।

যে ভাবে যা করতে বলা হলো, সে ভাবেই করতে লাগলো ওমর। সব কটা চোখ এখন পানির দিকে। সাগরের তল খুঁজছে।

দেখি, রাখ তো এখানে, ডজ বললো ওমরকে। ভাসুক। পেট্রোল খরচ বাঁচবে। ডজ আইল্যান্ড দেখা যায় ওখান থেকে। সেটার দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে খেতটা কোন জায়গায় হতে পারে বোঝার চেষ্টা করতে লাগলো। এখানেই আছে কোথাও। মুশকিলটা হলো, এখন সাগর শান্ত। আমি দেখেছি ঢেউয়ের সময়। এখন ডুব দেয়া সহজ বটে, কিন্তু জায়গাটা খুঁজে বের করা কঠিন।

স্টার্ট বন্ধ করলো না ওমর, তবে গতি বন্ধ করে দিলো। সাগরের ওপর ভেসে রইলো ফ্লাইং বোট। একটু একটু করে সরছে। পেরিয়ে গেল কয়েকটা নীরব মুহূর্ত। এখনও সব কটা দৃষ্টি পানির দিকে, সাগরের তল খোঁজায় ব্যস্ত।

আমাদের এই কান্ড দেখলে এখন, হেসে বললো মুসা। পাগল বলতো লোকে। ফ্লাইং বোটে বসে সাগরের দিকে এভাবে তাকিয়ে থাকা। হাহ হাহ।

হ্যাঁ, ওমরও হাসলো।

তোমাদের সন্দেহ হচ্ছে মনে হয়? ভুরু কোঁচকালো ডজ। এখানে নেই ভাবছো নাকি?

না না, তা ভাবছি না। তবে যে রকম করে খুঁজছি আমরা সেটা হাস্যকর।

এই দেখ, ওটা কি? আচমকা চিৎকার করে উঠলো কিশোর। কি যেন দেখলাম মনে হলো!

কিশোরের মুখের দিকে তাকিয়ে হাসলো সাগরের হাসি। বললো, আমি দেখে আসি। বলেই খুব সামান্য একটা ঢেউয়ের আঙটি তৈরি করে ডুবে গেল গানিতে।

অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে কিশোর। কয়েক মুহূর্ত একই জায়গায় থেকে মুখ নিচু করে নিচের দৃশ্য দেখলো সাগরের হাসি। তারপর ডুবতে শুরু করলো। মাছ যেভাবে আস্তে আস্তে পাখনা দোলায় অনেকটা তেমনি করে পা দোলাচ্ছে মেয়েটা। পানি এতো পরিষ্কার, স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে ওকে। এক ঝাঁক মাছ চলে গেল ওর শরীরের ওপর দিয়ে। অদৃশ্য হয়ে গেল সাগরের হাসি। আর ওঠে না। ভয়ই পেয়ে গেল কিশোর। সাগরের এই মাঝখানে কিছু হলো না তো তার!

সাগরের হাসিকে আবার ভেসে উঠতে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো কিশোর। মাথা তুললো মেয়েটা। হাতটা তুলে দেখালো। মস্ত একটা ঝিনুক নিয়ে এসেছে। নাক উঁচু করে দম নিতে লাগলো। শিসের মতো শব্দ বেরোতে লাগলো নাক দিয়ে। এই শব্দের সঙ্গে পরিচিত হয়ে গেছে কিশোর, অনেকক্ষণ পানির নিচে ডুব দিয়ে এসে এভাবেই দম নেয় দক্ষিণ সাগরের উভচর মানুষগুলো।

মেয়েটার হাতে ঝিনুক দেখে আনন্দে চিৎকার করে উঠলো ডজ। ওই তো! পেয়েছে, পেয়েছে! সাগর এখানে বেশি হলে একশো ফুট গভীর। কেন দেখা যাচ্ছে বুঝতে পারছি। সূর্য অনেক নিচুতে রয়েছে। খাড়া রোদ না পড়লে দেখা যাবে না তল। আমি যখন দেখেছি, তখন ঠিক দুপুর, মাথার ওপরে ছিলো সূর্য।

হ্যাঁ, এটা ঠিক বলেছে, একমত হয়ে মাথা দোলালো ওমর।

ঝিনুকটা বিমানের ভেতরে ছুঁড়ে দিয়ে বেয়ে উঠে এলো সাগরের হাসি। উত্তেজিত কণ্ঠে মারকুইজান ভাষায় দ্রুত কিছু বললো ডজকে। নিচের দিকে দেখাতে লাগলো।

ও বলছে, অনুবাদ করে বললো ডজ। সাগরের তলা এখানে পাহাড়ের ঢালের মতো নেমে গেছে। আর ওদিকটায় গভীরতা কম। আমি যা ভেবেছিলাম। আসলে সাগরের তল নয় এটা, একটা ডুবো পর্বতের চূড়া। ওমর, ওদিকটায় নিয়ে যাও।

চালাতে শুরু করলো ওমর। ফ্লাইং বোটটাকে নিয়ে এলো ডজের নির্দেশিত স্থানে।

হ্যাঁ, হ্যাঁ, রাখো এখানেই! চেঁচিয়ে বললো ডজ। তল দেখতে পাচ্ছি। ওই তো! বলেছিলাম না? পানি বেশি হলে বিশ-তিরিশ ফুট হবে!

অন্যেরও তাকিয়ে দেখলো, ঠিকই বলছে ডজ পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে সাগরের তল। অসংখ্য ঝিনুক ছড়িয়ে আছে, ডালা ফাঁক করা।

দেরি করলো না ডজ। ডাইভিং স্যুট পরতে আরম্ভ করলো। তার দিকে তাকিয়ে মুসাও উসখুস করে উঠলো ওই পোশাক পরে ডুব দেয়ার জন্যে। কাজটা বিপজ্জনক, তার পরেও আনন্দ পায় সে। খুব ভালো ডুবুরি মুসা। কানে বাজছে ওস্তাদের কণ্ঠস্বর, অনেকে পেশা হিসেবে নেয় কাজটাকে। ভয়ানক বিপজ্জনক পেশা। দুনিয়ার কোনো বীমা কোম্পানিই ডুবুরির জীবন বীমা করতে রাজি নয়। কারণ যে কোনো মুহূর্তে যা খুশি ঘটে যেতে পারে তার।

ঠিক যেন সেই ওস্তাদের কথাগুলোই নকল করে বলতে লাগলো ডজ, মুসার সেরকমই মনে হলো, বিপদে পড়াটা এখানে কিছুই না। অনেক ব্যাপার আছে। সেগুলো এখন কোনোটাই মনে করতে চাই না। তবে একটা কথা না বলে পারছি না। বাথটাবের মতো বড় বড় ঝিনুক আছে সাগরে, এখানটায়ও থাকতে পারে। টন খানেক ওজন হবে। ডালা ফাঁক করে ছড়িয়ে পড়ে থাকে অনেক সময়, শিকার ধরার জন্যে। ওটার মধ্যে পা পড়লে আর রক্ষা নেই। ঝট করে বন্ধ হয়ে যাবে ডালা। টেনে খোলা অসম্ভব। কপাল ভালো হলে তখন ডাইভারের কোনো একজন সঙ্গী গিয়ে যদি পা কেটে আলাদা করে তুলে আনতে পারে। আর কোনো উপায় নেই। সাগরের হাসি আর ঝিনুককে দেখিয়ে বললো, ওরা এসেছে, খুব ভালো হয়েছে। ওরকম অবস্থায় পড়লে কি করতে হবে জানে। দুজনের সঙ্গে কথা বললো সে। একটা করে হাতকুড়াল তুলে দিলো ওদের হাতে। মাথা ঝাঁকাল দুজনেই। হাসি হাসি ভঙ্গিটা দূর হয়ে গেছে মুখ থেকে।

এসব কথা কিশোরেরও জানা আছে। সে আর রবিনও মুসার সাথে একই সময়ে ট্রেনিং নিয়েছে। তবে মুসা জাতসাঁতারু, ওরা নয়। কিছুদিন দক্ষিণ সাগরের কোনো দ্বীপে মুসাকে রেখে দিলে সে-ও ঝিনুক কিংবা সাগরের হাসির সঙ্গে সমানে পাল্লা দিতে পারবে।

সংকেতগুলো মনে আছে তো? কিশোর, মুসা আর ওমরের দিকে তাকিয়ে বললো ডজ। ঈশ্বর যেন সেরকম অবস্থায় না ফেলেন! দড়িতে চারটে টান দিলে বুঝতে হবে, ভয়ানক বিপদে পড়েছি। যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব তখন দড়ি টেনে তুলে আনতে হবে। ওরকম করার প্রয়োজন সাধারণত পড়ে না, দশ লাখে একবার হয়তো পড়তে পারে, আমি যদ্দুর জানি। তবু, ওই একটা বার আমার কপালেও ঘটতে পারে। টানতেই থাকবে, দড়ি ছিড়ে যায় যাক, তবু থামবে না। তবে সংকেত না পেলে কক্ষণাে ওরকম করবে না, বুঝলে? শেষ কথাটা ওমরের দিকে তাকিয়ে বললো সে।

হ্যাঁ, বুঝেছি, শান্তকণ্ঠে বললো ওমর।

বেশ। এবার আমাকে সাজিয়ে দাও, এই কথাটা কিশোর আর মুসাকে উদ্দেশ্য করে বললো ডজ।

ডাইভিং স্যুটের বেল্ট বাঁধতে তাকে সাহায্য করলো দুই গোয়েন্দা। সব শেষে হেলমেটটা মাথায় গলিয়ে সকেটে বসিয়ে দিলো। নাটগুলো টাইট করে দিলো দুজনে। বেজায় ভারি পোশাক। পা টেনে টেনে এগোলো ডজ বিমানের দরজার পাশে ঝুলিয়ে রাখা মইয়ের দিকে, ওটা বেয়েই নামতে হবে।

নেমে গেল নিচে। পানিতে মাথা ডোবানোর আগে এক মুহূর্ত থেমে ওপরের দিকে তাকালো। হেলমেটের কাচের ঢাকনার ভেতর দিয়ে দেখা যাচ্ছে তার মুখ। হাসলো। তারপর ডুবে গেল। ডাইভিং স্যুটের সঙ্গে যুক্ত এয়ারপাম্পের হ্যান্ডেল ঘোরাতে শুরু করে দিয়েছে মুসা। কিশোর ছাড়ছে লাইফ লাইন। স্কুবা ডাইভিঙে যেসব পোশাক ব্যবহার হয়, ওগুলোতে এতো সব ঝামেলা করতে হয় না। তবে ওগুলো নিয়ে বেশি দূর যেমন নামাও যায় না, বেশিক্ষণ ডুবেও থাকা যায় না পানিতে। কারণ পিঠে বাধা অক্সিজেন সিলিন্ডারে থাকে সীমিত অক্সিজেন। আর নিজের দায়িত্বে ঘুরে বেড়ায় ডুবুরি। কিছু ঘটলে বাইরের কেউ জানতে পারে না তার কিছু হয়েছে।

মিনিটখানেক পরে দড়ি হঠাৎ ঢিল হয়ে যাওয়ায় বোঝা গেল তলায় পৌঁছেছে ডজ। ঝিনুকের দিকে তাকিয়ে মাথা ঝাঁকালো কিশোর। সঙ্গে সঙ্গে দড়িতে বাঁধা একটা তারের ঝুড়ি নামিয়ে দিলো ছেলেটা, ঝিনুক ভোলার জন্যে। ওর হাতে কুড়াল। তাকিয়ে রয়েছে পানির দিকে।

কয়েকটা মিনিট কেটে গেল। দড়িতে একটামাত্র টান পড়লো।

ঝুড়ি তোলো, নির্দেশ দিলো কিশোর।

তোলা হতে লাগলো। পানির অনেক নিচে থাকতেই দেখা গেল ঝুড়িটা। বিশ-পঁচিশটা বড় বড় ঝিনুকে বোঝাই। কোথায় রাখতে হবে দেখিয়ে দিলো ওমর। কেবিনের মেঝেতে ওখানে ঝিনুকগুলো ঢেলে দিয়ে আবার ঝুড়িটা নিচে পাঠিয়ে দিলো ঝিনুক।

কয়েকবার করে চললো এরকম। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে অনেক ঝিনুক জমে গেল কেবিনে। সেগুলোকে ছড়িয়ে দেয়া হলো মেঝেতে, বিমানের ভারসাম্য সমান রাখার জন্যে। নইলে একদিকে বেশি কাত হয়ে যাবে। সবচেয়ে কম গভীর জায়গাটা প্রায় খালি করে ফেললো ডজ। তারপর সরে গেল আর একটু গভীরে মাঝে মাঝে ওপর থেকে তাকে দেখা গেল হালকা রঙের প্রবালের ওপর দিয়ে পার হয়ে যাওয়ার সময়। কিন্তু গাঢ় রঙের প্রবালের মাঝে যেখানে অন্ধকার হয়ে আছে, সেখানে থাকলে দেখা যায় না। পানিতে বেশিক্ষণ ডুবে থাকলে, কিংবা গভীর পানিতে থাকলে ডুবুরির রক্তে এক ধরনের রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটতে থাকে। তখন তাকে তাড়াতাড়ি তোলার চেষ্টা করলে মারাত্মক প্রতিক্রিয়া হয়। এতে অকল্পনীয় কষ্ট পেয়ে মারা যায় রোগী। তবে ডজ এখন যে গভীরতায় রয়েছে, তাতে সেরকম কিছু ঘটার সম্ভাবনা নেই।

ডজের উঠে আসার ইঙ্গিত পেয়ে হাঁপ ছাড়লো কিশোর। কয়েক মিনিট পর তার  মাথা ভেসে উঠলো পানির ওপরে। দুর্বল ভঙ্গিতে মই বেয়ে উঠে এসে মেঝেতে বসে পড়লো সে। তার হেলমেট খুলে নেয়া হলো।

ভালোই তুলেছি, তাই না? ঝিনুকগুলোর দিকে তাকিয়ে বললো ডজ। জিরাতে এলাম।

নিচেটা কেমন? জিজ্ঞেস করলো কিশোর।

চমৎকার। দুএকটা বিশ্রী খাঁজ আছে অবশ্য। ডাঙার ওপরের পাহাড়েও থাকে ওরকম। তাতে হোঁচট খেয়ে পড়ার সম্ভাবনা আছে। আরেকটা বাজে জিনিস হলো প্রবাল, আকৃতির কোনো ঠিকঠিকানা নেই। লাইফ লাইন আর এয়ার টিউবের ওপর কড়া নজর রাখতে হয়েছে সারাক্ষণ। প্রবালে ঘষা লেগে কিংবা জড়িয়ে গিয়ে নষ্ট হয়ে যেতে পারে। স্রোতও বেশ জোরেই টানে।

দড়ি প্যাঁচ লাগে নাকি?

লাগে মানে? প্রবালে ওটাই তো বেশি লাগে। সব চেয়ে বড় ভয় এখানে।

ডাইভিং স্যুট খুললো না ডজ। আরেকবার নামার ইচ্ছে। যতগুলো তুলেছি, আরও অতগুলো তুলবো, বললো সে। ঝিনুককে বললো আবহাওয়ার দিকে নজর রাখতে। কারণ কখন বাতাস বইতে আরম্ভ করবে তার ঠিক নেই। ঝিনুকই সেটা ভালো বুঝতে পারবে। সাগরে হঠাৎ ঢেউ উঠলে বিপদে পড়তে চায় না ডজ।

তবে আবহাওয়া পরিবর্তনের কোনো লক্ষণ আপাতত দেখা যাচ্ছে না। আগের মতোই শান্ত রয়েছে সাগর। কিছুক্ষণ জিরিয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো ডজ। নেমে গেল পানিতে।

পঁয়তাল্লিশ মিনিট পেরোলো। বিমানে যারা বসে আছে তাদের কাছে অনেক দীর্ঘ লাগছে। তবে ঝিনুক তোলার বিরাম নেই। কিছুক্ষণ পর পরই ঝুড়ি ভর্তি করে পাঠাচ্ছে।

অনেক হয়েছে, অবশেষে ঝিনুকের স্কুপের দিকে তাকিয়ে মন্তব্য করলো ওমর। আর বেশি তুললে বিপদে পড়তে পারি।

বিপদ? বুঝতে পারলো না মুসা।

বাতাস বইতে শুরু করলে আর ঢেউ উঠলে মহাবিপদ হবে। এতো ভার নিয়ে কিছুতেই আকাশে তোলা যাবে না প্লেন। সীসার মতো ভারি হয়ে যাবে, উঠতেই চাইবে না পানি থেকে। বাঁচার তাগিদে তখন ঝিনুক ফেলেও দেয়া লাগতে পারে। এতো কষ্ট করে তুলে এনে ফেলার কোনো মানে হয় না। তার চেয়ে কম রাখাই ভালো। আকাশের দিকে তাকালো সে। আকাশ অবশ্য ভালোই আছে। হঠাৎ খারাপ হবে বলে মনে হয় না। তবে এখানকার আবহাওয়াকে বিশ্বাস না করাই ভালো।

সেটা খুব ভালো করেই জানে কিশোর আর মুসা। আগের বার এখানে এসে হারিকেনের রূপ দেখছিলো ওরা। ভাবলেই পিলে চমকে যায়।

ভাবতে চাইলো না কিশোর। বললো, আর বেশি তুলবেও না। ঘড়ি দেখলো সে। উঠে চলে আসবে। লাইফ লাইনটাকে এমন ভাবে ছুঁলো, যেন বড়শি ফেলে মাছের অপেক্ষায় রয়েছে, ফাৎনায় টান পড়লেই মারবে কষে টান।

আরও কয়েক মিনিট পেরোলো। টেনে তোলার সংকেত আর আসে না। অনেকক্ষণ হলো, কিশোর বললো, আর কোনো ঝিনুকও তো পাঠাচ্ছে না।

কেউ জবাব দিলো না। ধীরে গড়িয়ে চলেছে সময়, মিনিটের পর মিনিট কাটছে। ঘড়ির দিকে তাকালো ওমর। তারপর ইনস্ট্রমেন্ট বোর্ডের দিকে। এক ঘণ্টা হয়ে গেছে। ঘোষণা করার মতো করে বললো।

নড়ছে, বললো কিশোর। দড়িতে টের পাচ্ছি। তবে বেশি না। ঝিনুকের খোলে পা দিলো না তো? বড়গুলোর?

বিমানের পিঠের ওপর উপুড় হয়ে শুয়ে নিচে তাকিয়ে রয়েছে সাগরের হাসি বেশ কিছুক্ষণ যাবৎ কোনো কথা বলছে না। হঠাৎ কোমর থেকে একটানে ছুরিটা খুলে নিয়ে দাঁতে কামড়ে ধরলো। পিছলে নেমে গেল পানিতে। মাথা নিচু করে দ্রুত সাঁতরে নেমে যেতে লাগলো।

চট করে মুসার চোখে চোখে তাকালো কিশোর। দৃষ্টি ফেরালো ওমরের দিকে।

শ্রাগ করলো ওমর। বুঝলাম না কেন ওরকম করলো! নিশ্চয় কোনো কারণ আছে।

খাইছে! প্রায় চেঁচিয়ে উঠলো মুসা। উঠে আসছে! এতো তাড়াহুড়ো করছে কেন?

ভুস করে পানির ওপরে মাথা তুললো সাগরের হাসি। মুখ থেকে পানি ছিটিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো, ফেকি! ফেকি! দুই হাত ছড়িয়ে দিয়ে বললো, অনেক বড়!

ফেকি! খোদা! অকটোপাসের কথা বলছে! ফ্যাকাসে হয়ে গেছে কিশোরের চেহারা। ওমর ভাই, কি করবো? টেনে তোলার চেষ্টা করবো?

ও তো বললো সংকেত না দিলে না টানতে, কঠিন হয়ে উঠেছে ওমরের মুখ।

ভাবভঙ্গিতে আর ভাঙা ইংরেজিতে মেয়েটা জানালো, অকটোপাসের সঙ্গে লড়াই করছে ডজ। সাগরের হাসি তাকে সাহায্য করতে যেতে সাহস করেনি। দড়িতে জড়িয়ে যেতে পারে। আটকে গিয়ে দম আটকে মরবে তখন।

মুসা, থেমো না! কিশোর বললো, পাম্প চালিয়ে যাও! দড়ি টান দিলো সে। একটুও উঠলো না। টানটান হয়ে গেল দড়ি। কাঁপছে, মৃদু।

এভাবে হবে বলে মনে হয় না! উৎকণ্ঠা আর উত্তেজনায় ভারি হয়ে উঠেছে মুসার নিঃশ্বাস। অন্য কিছু করা দরকার!

মিনিটখানেক সময় দিয়ে দেখা যেতে পারে! কিছু করার সিদ্ধান্ত ওমরও নিতে পারছে না। রক্ত সরে গেছে মুখ থেকে। হয়তো তাড়িয়ে দিতে পারবে। প্রয়োজন হলে নিশ্চয় তোলার জন্যে সংকেত দিতো।

হাতটাত সব জড়িয়ে ধরেছে কি না তাই বা কে জানে! কিশোর বললো। হয়তো নড়তেই দিচ্ছে না! জানোয়ার তো না ওগুলো, শয়তানের চেলা!

দাঁড়াও! টেনো না!

মিনিটখানেক কেউ কোনো কথা বললো না। দড়ি ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছে কিশোর। মূর্তির মতো।

ঝিনুক, অবশেষে বললো ওমর। নিচে গিয়ে দেখবে কি হয়েছে?

হাত থেকে ঝুড়ির দড়িটা ছেড়ে দিলো ঝিনুক। কোমর থেকে ছুরিটা নিয়ে দাঁতে কামড়ে ধরে ঝাপ দিতে যাবে এই সময় চিৎকার করে উঠলো কিশোর, টানছে!…এক…দুই…তিন… চার! তার মানে টানতে হবে, যতো জোরে পারা যায়! টানতে শুরু করলো সে। একচুল নড়লো না দড়ি। যেন পাথরে আটকে গেছে। ওমরভাই! ঝিনুক! ধরো!

দুজনেই ছুটে এলো তাকে সাহায্য করার জন্যে। কিন্তু তিনজনে মিলে টেনেও এক ইঞ্চি তুলতে পারলো না দড়ি।

ইয়াল্লা! বলে উঠলো ওমর। আর জোরে টান দিলে ছিড়ে না যায়! খসখসে হয়ে উঠেছে তার কণ্ঠ। না টেনে আর কিছু করারও নেই। মুসাকে পাম্প চালিয়ে যেতে বলে আবার টান দিলো দড়িতে। তিনজনে মিলেই টানছে। দড়ি আর নড়ে না।

হবে না, দাঁতের ফাঁক দিয়ে বিড়বিড় করলো কিশোর। বোধহয় পেঁচিয়ে ফেলেছে কোনো কিছুতে। দেখি আরেকবার চেষ্টা করে। সাগরের হাসি, এসো, তুমিও ধরো।

চারজনে মিলে টানতে শুরু করলো। ঘাম বেরিয়ে এসেছে সকলেরই। টানের চোটে একপাশে কাত হয়ে গেছে বিমানটা। তবু এক ইঞ্চি নড়লো না দড়ি। মনে হচ্ছে ওমরের অনুমানই ঠিক। পেঁচিয়ে গেছে কিছুতে।

সোজা হয়ে দাঁড়ালো ওমর। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজালো। ও বলেছে যততক্ষণ দড়ি না ছেড়ে, টানতে। ঠিক আছে। হয় সে উঠবে, নয়তো দড়ি ছিড়তে যাচ্ছি আমি। এটাই ওর শেষ সুযোগ! কিশোর যেখানে ধরেছে, তার পেছনের দড়ির অংশটুকু নিয়ে একটা সীটের পায়ায় পেঁচিয়ে বাঁধলো সে। সবাইকে দড়ি ছেড়ে দিতে বলে গিয়ে উঠে বসলো পাইলটের সীটে। থ্রটলে চেপে বসলো আঙুলগুলো। মৃদু ঝিরঝির করে চলছিলো এঞ্জিন, সেটা রূপান্তরিত হলো গর্জনে। সামনে টান দিলো বিমান। ধনুকের ছিলার মতো টানটান হয়ে গেল দড়ি। প্রচন্ড চাপে ডানে কাত হয়ে গেল বিমান। ডানার ডগা পানি ছুঁই ছুঁই করছে। কিন্তু আগে আর বাড়তে পারছে না। শেষে ডানে কেটে, চক্রাকারে ঘুরতে শুরু করলো।

কতোটা দিয়েছেন? চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলো কিশোর।

হাফ থ্রটল।

আরো লাগবে। দড়ি নড়ছে না। চালিয়ে যান।

ভয় লাগছে, প্লেনটাই না উল্টে যায়!

যাবে না। টানুন।

আরও গম্ভীর হয়ে গেল এঞ্জিনের গর্জন।

উঠছে? উঠছে! চিৎকার করে উঠলো কিশোর।

আরো জোর বাড়ালো ওমর। বুনো ঘোড়ার লাগাম পরানো হয়েছে যেন, খেপে গেছে, ওরকম আচরণ করছে বিমান। যেখানটায় ঘুরছে ওটা, সেখানে ফেনার ঘূর্ণি সৃষ্টি হয়েছে।

আসছে। আবার চেঁচিয়ে বললো কিশোর। দড়ি ধরে টানতে শুরু করেছে সে। ঠেলে বেরিয়ে আসবে যেন চোখ, পরিশ্রমে।

হঠাৎ থ্রটলের পাওয়ার কেটে দিয়ে লাফিয়ে নেমে গেল ওমর, কিশোরকে সাহায্য করার জন্যে। ঝিনুক আর সাগরের হাসিকেও ডাকলো। টানো! টানো! ছাড়বে না!

মুসা পাম্প ছাড়ছে না। উঠে আসছে ডেজা দড়িটা, প্রতিবারে এক ফুট করে।

ওমাথায় ডজ ছাড়াও আর কিছু আছে, ওমর বললো। ভাগ্যিস, নতুন দড়ি। মোটা দেখে লাগিয়েছিলো ডজ।

নাইলন না হলে যতো মোটাই হোক, টিকতো না, মুসা বললো।

হ্যাঁ। ঝিনুক, কুড়াল নিয়ে গিয়ে দাঁড়াও।

এক ফুট এক ফুট করে উঠে আসছে দড়ি। সাংঘাতিক কাত হয়ে গেছে বিমান। এখন শুধু কিশোর আর ওমর টানছে। সাগরের হাসিও চলে গেছে দরজার কাছে, উবু হয়ে বসে তাকিয়ে রয়েছে পানির দিকে। হঠাৎ লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালো। আসছে! আসছে! ওই তো! একটু থেমে আবার চিৎকার করে উঠলো তীক্ষ্ম কণ্ঠে। আসছে! ফেকি আসছে! হাতে ছুরি, সামান্য ফাঁক হয়ে আছে দাঁত। চকচকে চোখ। পুরোপুরি বন্য লাগছে এখন তাকে, আদিম মানবী, ভয়াবহ শত্রুর সঙ্গে লড়াইয়ের জন্যে তৈরি।

পানির ওপরে ঝটকা দিয়ে বেরিয়ে এলো একটা শুঁড়, বীভৎস ভঙ্গিতে পেঁচালো আর খুললো, প্রজাপতির শুঁড়ের মতো করে। কিলবিল করে উঠলো।

খবরদার! টান ছাড়বে না! চিৎকার করে বললো ওমর।

টেনে ডুবিয়েই না ফেলে!

টান ছেড়ো না! প্লেন ডুববে না। ওই তো, আরও উঠছে। ডজকে পেঁচিয়ে ধরে রেখেছে অকটোপাসটা। ধরে রাখো, ছেড়ো না। বলে দড়ি ছেড়ে দিলো ওমর। তুলে নিলো একটা হাতকুড়াল। সাগরের হাসিকে তখন যেটা দিয়েছিলো। কোপ মারলো পানিতে।

দড়ি কাটবেন না! সাবধান! চেঁচিয়ে হুশিয়ার করলো কিশোর।

কিশোর, আমিও যাই! হাত নিসপিস করছে মুসার। পাম্পের কাছে এভাবে বসে থাকতে আর ভালো লাগছে না ওর।

না! তাড়াতাড়ি বললো কিশোর। যা করছো করো।

ওমর কিছুই বললো না। কুপিয়ে চলেছে। ভেসে উঠলো একটা, কাটা শুঁড়। এখনও পাক খুলছে আর বন্ধ করছে। টিকটিকির লেজের মতোই যেন শরীর থেকে আলাদা হয়ে গেলেও মরে না। আরেকটা শুঁড় বেরিয়ে এসে বিমানের কাঠামো পেঁচিয়ে ধরে টান দিলো। কাত করে ডুবিয়ে দেয়ার ইচ্ছে যেন বিমানটাকে। ধা করে কোপ মারলো ওমর। শুঁড় কেটে প্লাইউডে বসে গেল কুড়ালের ফলা। হ্যাচকা টান দিয়ে তুলে আনলো আবার।

কুড়াল দিয়ে কোপাতে বোধহয় ভালো লাগেনি ঝিনুকের, সেটা রেখে দিয়ে ছুরি দিয়ে খোঁচা মারছে ঘ্যাঁচ ঘ্যাঁচ করে। সাগরের হাসিও খোঁচাচ্ছে। দুজনে পানির একবারে কাছাকাছি চলে গেছে। সাংঘাতিক ঝুঁকি নিয়েছে। যে কোনো মুহূর্তে একটা শুঁড় এসে টেনে নিতে পারে ওদেরকে পানিতে।

দড়ি ছাড়ছে না কিশোর। টেনে ধরে রেখেছে। বাঁকা হয়ে গেছে তার শরীর। টপটপ করে ঘাম ঝড়ছে কপাল থেকে।

দেখা যাচ্ছে, অকটোপাসের বড় বড় চোখ, কেমন সম্মােহনী দৃষ্টি। কুড়াল রেখে দিয়ে পিস্তল বের করলো ওমর। পিরিচের মতো বড় চোখদুটোর মাঝখানে সই করে গুলি শুরু করলো। খালি করে ফেললো ম্যাগাজিন।

আচমকা ঢিল হয়ে গেল দড়ি। চিত হয়ে পড়ে গেল কিশোর। কোনোমতে উঠে দেখলো, পানিতে ভাসছে ধূসর রঙের একটা মাংসের দলা, তাতে যেন জোড়া লেগে রয়েছে কতোগুলো কুৎসিত শুঁড়, তার কয়েকটা আবার কাটা, আরও ভয়ংকর লাগছে। ধক করে উঠলো বুক। ডজ কি নেই! না, আছে। ওই তো, হেলমেট দেখা যায়। নিচু হয়ে হাত বাড়িয়ে দিলো ওমর আর সাগরের হাসি। টেনে তুললো ডজকে। চিত হয়ে মেঝেতে পড়ে রইলো ডুবুরি।

হেলমেটটা খোল! নির্দেশ দিয়েই ককপিটের দিকে ছুটলো ওমর। গর্জে উঠলো এঞ্জিন।

ম্যাকো! ম্যাকো! বাচ্চা মেয়ের মতো হাততালি দিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো সাগরের হাসি। হাত তুলে দেখালো। ফেকিকে এবার শেষ করবে!

সবাই দেখলো, কয়েকটা হাঙর এসে হাজির হয়েছে। কামড়াতে শুরু করেছে অকটোপাসটাকে। সাবাড় করতে সময় লাগবে না, বোঝা গেল। কেঁপে উঠলো কিশোর। ডজকে তুলতে আরেকটু দেরি হলেই…ভাবতে চাইলো না সে। মুসাকে ডাকলো তাকে সাহায্য করার জন্যে। হেলমেট খুলতে শুরু করলো। নিথর হয়ে পড়ে আছে ডজ। ছাই হয়ে গেছে মুখের রঙ। সেদিকে তাকিয়ে বলে উঠলো মুসা, খাইছে! মরেই গেল নাকি!

ছুটে গিয়ে কেবিন থেকে একটা ফ্লাস্ক বের করে নিয়ে এলো সে। আঙুল দিয়ে টেনে ঠোঁট ফাঁক করে মুখের ভেতরে ঢেলে দিলো খানিকটা ব্র্যান্ডি।

ততোক্ষণে লেগুনের কাছে পৌঁছে গেছে বিমান। প্রায় ওড়ার গতিতেই ছুটছে। পানির ওপর দিয়ে। কয়েকবার লাফিয়ে উঠেই পড়েছিলো কয়েক ইঞ্চি করে। মুখের কাছে পৌঁছেও গতি কমালো না ওমর। তীব্র গতিতে ঢুকে পড়লো সরু চ্যানেলে। নিয়ে এলো শান্ত পানিতে, যেখানে নোঙর করেছিলো। এঞ্জিন বন্ধ করে দিয়ে অন্যদেরকে সাহায্য করলো ডজকে তীরে নামাতে।

নারকেল গাছের ছায়ায় এনে আস্তে করে বালিতে শুইয়ে দেয়া হলো তাকে। চোখ মেললো ডজ। নীল আকাশের ছায়া পড়লো তার চোখে। দুর্বল কণ্ঠে ককিয়ে উঠলো, ঝিনুকগুলো আছে তো?

নিজে যে মরতে বসেছিলে, সেটা নয়, প্রথমেই ঝিনুকের চিন্তা, স্বস্তি মেশানো ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললো ওমর। তোমাকে যে বাঁচাতে পেরেছি এতেই আমরা খুশি। চুলোয় যাক ঝিনুক। কিশোর, ধরো তো, স্যুটটা খুলে ফেলা যাক। ডজকে জিজ্ঞেস করলো, খুলতে পারবে তো? তোমার অসুবিধে হবে?

না। আমি ভালো আছি। কয়েকটা আঁচড় শুধু লেগেছে।

কয়েকটা আঁচড় যে কি পরিমাণ পোশাক খুলতেই দেখতে পেলো সবাই। মাথা থেকে পা পর্যন্ত কোনো জায়গা আর বাকি নেই, কালো কালো দাগে ভরা। থেঁতলে গেছে। ওসব জায়গায় শুড় দিয়ে পেঁচিয়ে ধরে চাপ দিয়েছিলো দৈত্যটা। তবে জখম তেমন নেই, রক্ত বেরুচ্ছে না, হাতের ছুরির ক্ষতটা বাদে। কেননা কোনো জায়গা এখনও কাঁচা রয়েছে, যা পুরোপুরি শুকায়নি, সেখান থেকে বেরিয়ে এসেছে দুই এক ফোটা রক্ত। উঠে বসলো সে। কয়েক ঢোক ব্র্যান্ডি পেটে পড়তেই আরেকটু সুস্থ হলো।

ঝিনুক তোলার অভিযান তাহলে আমাদের শেষ? চোখে প্রশ্ন নিয়ে ভজের দিকে তাকালো ওমর।

কেন? এটা কোনো একটা ব্যাপার হলো নাকি? ডুবুরির জীবনে প্রায় প্রতিদিনই ওরকম ঘটনা ঘটে।

হাঁ করে ডজের দিকে তাকিয়ে রয়েছে কিশোর। তার মানে… তার মানে, আপনি আবার ওই জায়গাটায় নামবেন?

নিশ্চয়। আগের চেয়ে নিরাপদ ভাবলো এখন নিজেকে।

কেন? মুসার প্রশ্ন।

এজন্যে, ওখানে আর ওরকম দানব নেই, ডজ বললো। জানা কথা। এক রাজ্যে দুই রাজা বাস করতে পারে না। একটাই থাকে, আর সেটাকে মেরে ফেলা হয়েছে। সাগরের আতঙ্ক ওই শয়তানগুলো, সাধে কি আর ডেভিল ফিশ বলে। অনেকেই ভয় পায় ওগুলোকে, এড়িয়ে চলে।

হাঙররা পাচ্ছে না, কিশোর বললো।

মরা বলে। জ্যান্ত হলে আসতো না। হাসলো ডজ। এমন ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়াতে গেল, যেন শক্ত হয়ে গেছে পা। অকটোপাসটাকেও খুব একটা দোষ দিই না। গাধামীটা আমিই করেছি। কালো একটা গর্ত দেখতে পেলাম। মাছটাছ কিংবা অকটোপাসের বাচ্চা দেখলাম না তার মধ্যে। ওরকম গর্তে যা প্রায়ই থাকে। ওগুলো কোনো ক্ষতি করতে পারে না। মানুষ দেখলেই বরং সরে যায়, বিশাল মাকড়সার মতো দেখতে লাগে। ভেতরে কিছু নেই দেখে অবাকই লাগলো। তবে গুরুত্ব দিলাম না। ভাবলাম, এরকম গর্তে অনেক ঝিনুক থাকবে। দেখতে গেলাম। কপাল ভালোই বলতে হবে আমার। কারণ প্রথম শুঁড়ের মাথাটা এসে আলতো করে ছুঁয়ে দেখলো আমার হেলমেট। সঙ্গে সঙ্গে বুঝে গেলাম ওটা কি। তারপর যা করার তা-ই করলাম। হাত দুটো তুলে ফেললাম ওপর দিকে, যাতে শরীরের সঙ্গে পেঁচিয়ে ধরে আটকে ফেলতে না পারে। ভাগ্যিস, তুলেছিলাম! আরেকটা শুঁড় এসে জড়িয়ে ধরলো আমার কোমর। তখন আমার হাত তোলা না থাকলে শেষ করে ফেলতো। লড়াই করার একটা সুযোগ অন্তত পেলাম। ছুরি বের করে ফেলেছি আগেই। খোঁচাতে শুরু করলাম। বোধহয় মিনিট বিশেক ওরকম লড়াই করেছি। তবে আমার মনে হয়েছে কয়েক যুগ। গর্তের ভেতর থেকে জুলজুল করে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলো জীবটা। চারটে শুঁড় ব্যবহার করেছে আমাকে কাবু করার জন্যে। বুঝলাম, বাকি চারটে দিয়ে পাথর আঁকড়ে ধরেছে, গ্যাট হয়ে বসে থাকার জন্যে। আসলে চারটে শুঁড়ই আমাকে শেষ করে দেয়ার জন্যে যথেষ্ট। বাকিগুলো আর খাটাতে যাবে কেন? আমাকে তোলার সংকেত দিয়ে তখন লাভ নেই। তুলতে পারবে না। হাত দিয়ে টেনে তো দূরের কথা, যুদ্ধ জাহাজ দিয়ে টানলেও উঠতো কিনা সন্দেহ। তাই জোর যাতে কমানো যায় সেই চেষ্টা চালালাম। চারটে শুঁড়ের গোটা দুই যদি কেটে দেয়া যায় তাহলে জোর কমবে। আমার বড় ভয় ছিলো, দড়ি আর এয়ার টিউবের লাইন না ছিড়ে ফেলে। তাহলে আর কেউ বাঁচাতে পারতো না আমাকে। দড়িটা টানটান হয়ে ছিলো বলেই পেঁচিয়ে যায়নি কোনো কিছুতে। অনেক চেষ্টা করে আমার গায়ে পেঁচানো দুটো শুঁড়ের মাথা কেটে দিলাম। আরও দুটো বের করে আনলো তখন ওটা। পেঁচিয়ে ধরলো। ভাবলাম, সংকেত দিই। তার পরে মনে হলো, না, ছিড়ে যেতে পারে। আরেকটু জোর কমানো যাক। কিন্তু দুর্বল হয়ে গেছি ততোক্ষণে। আর সেটা বুঝতে পেরেছে জানোয়ারটা। টানতে শুরু করলো নিজের দিকে। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি তখন চোখজোড়া। শয়তানীতে ভরা। একবার ভাবলাম, যাই, গিয়ে ছুরি দিয়ে খোঁচা মেরে গেলে দিই। কিন্তু ওই চেষ্টা করাটাই বোকামি। চোখের কাছে কিছুতেই পৌঁছতে দেবে না আমাকে। একটু পর পরই কালি ছুঁড়ে অন্ধকার করে দিচ্ছে পানি, যাতে ওর শরীর কিংবা শুঁড় দেখতে পারি আমি। প্রায় শেষ করে এনেছিলো আমাকে। পাথরের মতো ভারি হয়ে উঠছিলো হাত। নড়নোর শক্তিও পাচ্ছিলাম না আর। একটা হাত পেঁচিয়ে ফেললো শরীরের সঙ্গে। আরেকটাও আটকে ফেলবে যে কোনো সময়। দড়ি না টেনে আর উপায় নেই। আমাকে টেনে তার মুখের দুই গজের মধ্যে নিয়ে গেছে। টান দিলাম। পর পর চার বার। তার পর আর কিছু মনে নেই।

হুঁ, আনমনে মাথা দোলালো মুসা। অকটোপাসের সঙ্গে হাতাহাতি লড়াইটা যে কেমন, হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি আমি। আপনাকে তো সাহায্য করার জন্যে অনেকেই ছিলাম আমরা, আমাকে করার কেউ ছিলো না। কেউ জানতোই না যে আমাকে অকটোপাসে ধরেছে।

হ্যাঁ, বুদ্ধির জোরেই বেঁচে এসেছিলে সেদিন, কিশোর বললো। আর কপাল অসম্ভব ভালো ছিলো বলে।

ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেললো ওমর। যা-ই বলো, ডজকে বললো সে। আর তোমাকে ওখানে নামতে দিতে রাজি নই আমি। আমার ভালো মনে হচ্ছে না।

অহেতুক ভয় পাচ্ছো। একদিন বিশ্রাম নিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। কিছু হবে না আমার। আর, হাসলো সে। লক্ষ লক্ষ টাকা কামাতে চাইলে ওরকম একআধটু ঝুঁকি নিতেই হবে। টাকা জিনিসটা তো আর সহজে পাওয়া যায় না।

দেখা যাক, ওমর বললো। ভাবনাচিন্তা করি। ঝিনুক যা তুলে এনেছো সেগুলো কি করবো?

সৈকতে ফেলে রাখতে হবে। পশ্চিম দিকে। ওপরে, যাতে জোয়ারের পানি নাগাল না পায়। দিন দুয়েকের মধ্যে পচে যাবে। দেখতে পারবো, অকটোপাসের সঙ্গে লড়াই করে কি আনতে পেরেছি। হাসলো ভজ। ঝিনুক খোলাটা একটা মহা উত্তেজনার কাজ, দারুণ খেলা। বোঝার উপায় নেই, কোনটা খুললে বেরিয়ে পড়বে অনেক টাকার সম্পদ।

হু। আপাতত পেটপূজাটা সেরে নেয়া যাক। খিদে পেয়েছে। খেয়েদেয়ে তুমি রেস্ট নাও। আমরা ঝিনুকগুলো সরিয়ে ফেলবো।

<

Super User