ফ্যানটাসটিক! চিৎকার করে উঠলেন প্রফেসর ওয়ালটার সাইনাস, চকচক করছে চোখ। কোনো সন্দেহ নেই, ইয়াং ম্যান, কোনো সন্দেহ নেই! এগুলো ক্যাসটিলির রয়াল কোট অভ আরমরেই চিহ্ন!

শুক্রবার বিকেল। হলিউডে প্রফেসরের স্টাডিতে বসে আছে তিন গোয়েন্দা। সেদিন সকালে ফোন করে বিখ্যাত চিত্রপরিচালক ডেডিস ক্রিস্টোফারকে সব বলেছিলো, কিশোর, তিনিই তাঁর বন্ধু সাইনাসের সঙ্গে ওদের যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছেন। স্প্যানিস আর মেকসিকান ইতিহাসের বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ওয়ালটার সাইনাস। সেদিন ইস্কুল ছুটি হলে স্যালভিজ ইয়ার্ডের ট্রাকটা নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে ওরা। চালক অবশ্যই বোরিস।

তলোয়ারের এই খোলসটা মোল শতকের গোড়ার দিকে তৈরি, বললেন প্রফে। জিনিসটা ছিলো স্পেনের রাজার, আমি শিওর। তোমরা কোথায় পেলে?

মূর্তিটার কথা জানালো কিশোর। জিনিসটা কি করটেজ সোর্ডের? অতো পুরানো?  করটেজ সোর্ড? ভুরু উঠে গেল প্রফেসরের। হ্যাঁ, তা হতে পারে। তবে তলোয়ারটা হারিয়ে গেছে। আঠারোশো ছেচল্লিশ সালে পিউটো আলভারেজের সঙ্গে সাগরে পড়ে হারিয়ে গেছে ওটা…কেন, একথা জিজ্ঞেস করছো কেন? ওটাও পেয়েছে নাকি?

না, স্যার, জবাব দিলো রবিন।

এখনও পাইনি, এমনভাবে হাসলো মুসা, যেন অদূর ভবিষ্যতে পাবে।

স্যার, কিশোর জিজ্ঞেস করলো, পিউটো আলভারেজের সত্যি সত্যি কি হয়েছিলো, একথা কোথায় গেলে জানতে পারবো?

রকি বীচ হিসটোরিক্যাল সোসাইটিতে গেলে পেতে পারো, প্রফেসর বললেন। আলভারেজরে তো বটেই, মেকসিকোর যুদ্ধের ইতিহাসও জানতে পারবে।

প্রফেসরকে ধন্যবাদ জানিয়ে উঠতে গেল ছেলেরী। হাত তুললেন তিনি, এক মিনিট। আচ্ছা, তলোয়ারটার কথা জিজ্ঞেস করলে কেন? যোজটোজ পেয়েছে নাকি ওটার?

পাইনি এখনও, কিশোর কললো। পাওয়ার আশা করছি আরকি।

তাই? আবার চকচকে হলো প্রফেসরের চোখ। পেলে জানিও আমাকে।

নিশ্চয়ই জানাবো, স্যার, বলে উঠে পড়লো কিশোর।

বাইরে গুঁড়ি গুড়ি বৃষ্টি আরম্ভ হয়েছে। ওদেরকে নামিয়ে দিয়ে ট্রাক নিয়ে একটা কাজে গেছে বোরিস, এখনও ফেরেনি। একটা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো ছেলেরা।

তলোয়ারটার কথা শুনে কেমন চমকে গেলেন প্রফেসর, দেখেছো? মুসা বললো।

হা, ভ্রূকুটি করলো কিশোর, অনেকেই ওরকম চমকাবে। করটেজ সোর্ডের নাম পারতপক্ষে আর কারও কাছে বলা উচিত হবে না। লোভে পড়ে কে এসে বাগড়া দিতে শুরু করবে কে জানে! একটা ব্যাপারে শিওর হয়ে গেছি, খোলসটা করটেজ সোর্ডেরই, আর ওটা খুঁজে পাওয়ার চান্স আছে।

হিসটোরিক্যাল সোসাইটিতে যাবে? রবিন জিজ্ঞেস করলো।

যাবো।

কি খুঁজবো ওখানে? মুসার প্রশ্ন।

জানি না এখনও, জবাব দিলো কিশোর। ভাবহি, ইতিহাস থেকে কোনো সূত্র পেয়েও যেতে পারি।

বোরিস আসতে আসতে বৃষ্টি বেড়ে গেল অনেক। ট্রাকের পেছনে ওঠার আর উপায় নেই, কেবিনেই গাদাগাদি করে বসতে হলো সবাইকে। রকি বীচে পৌঁছে ওদেরকে হিসটোরিক্যাল সোসাইটিতে নামিয়ে দিয়ে আরেকটা কাজে চলে গেল বোরিস।

ঘরটা নীরব, নির্জন, শুধু নির্দিষ্ট জায়গায় বসে রয়েছেন অ্যাসিসটেন্ট হিসটোরিয়ান। তিন গোয়েন্দাকে চেনেন। হেসে বললেন, আরে, তিন গোয়েন্দা যে। তা কি মনে করে? নতুন কোনো কেস-টেস?

এই কর…, শুরু করেই আঁউউ করে উঠে থেমে গেল মুসা। তার পা মাড়িয়ে দিয়েছে কিশোর। হিসটোরিয়ানের দিকে চেয়ে হেসে বললো তাড়াতাড়ি, না, স্যার, কোনো কেস-টেস না। ইস্কুলের ম্যাগাজিনের জন্যে একটা গবেষণামূলক লেখা লিখতে চায় রবিন। তাকে সাহায্য করছি। রকি বীচ আলভারেজ ফ্যামিলির ওপর গবেষণা করছে সে।

ও। আলভারেজদের ফাইল তো আছে আমাদের কাছে। জায়গামতোই এসেছে।

ডন পিউটো আলভারেজের কথাও নিশ্চয় লেখা আছে?

মাথা ঝাঁকিয়ে উঠে গেলেন হিসটোরিয়ান। দেয়াল ঘেঁষে সারি সারি তাকে বই ঠাসা। কতগুলো আলমারি আর শেলফও আছে। শেলফ থেকে দুটো ফাইল রে করে আনলেন তিনি। হেসে বাড়িয়ে দিলেন ছেলেদের দিকে।

ফাইলের আকার দেখেই দমে গেল মুসা। তবে কিশোর আর রবিনের মুখ দেখে কিছু বোঝা গেল না।

ফাইল দুটো কোণের একটা টেবিলের কাছে বয়ে নিয়ে এলো কিশোর। এটা তোমরা দেখো। যুদ্ধের ওপর লেখা ফাইলটা রবিন আর মুসার দিকে ঠেলে দিলো সে। নিজে নিলো আলভারেজদের ওপ্র লেখা ফাইল। এটা আমি দেখছি।

পরের দুটো ঘন্টা পাতার পর পাতা উল্টে গেল ওরা। ডন পিউটো আলভারেজ আর করটেজ সোর্ডটার কথা কিছু লেখা আছে কিনা খুঁজছে। হিসটোরিয়ান কাজে ব্যস্ত, ছেলেদেরকে বিরক্ত করলেন না। ইতিমধ্যে অন্য কেউ ঢুকলো না ওঘরে।

দুই ঘণ্টা পর দুটো ফাইলই ওল্টানো শেষ হলো। তার ফাইলে একটা জিনিসই শুধু দৃষ্টি আকর্ষণ করলো কিশোরের, একটা চিঠি পুরানো হতে হতে হলদে হয়ে এসেছে কাগজ। দুই সহকারীকে জানালো সে, ছেলের কাছে এই চিঠি লিখেছিলেন ডন পিউটো আলভারেজ। রকি বীচে একটা ঘরে তাকে বন্দি করে রাখা হয়েছে তখন। ওই সময় তাঁর ছেলে ছিলো মেকসিকো সিটিতে, মেকসিকান আর্মির একজন অফিসার।

কি লিখেছেন? জানতে চাইলো মুসা।

ভাষাটা স্প্যানিশ, তা-ও আবার পুরানো ঢঙে, নাক কুঁচকালো কিশোর, খুব কঠিন। ভালো বুঝলাম না। তবে এটুকু বুঝেছি, সাগরের কাছে একটা বাড়িতে আটকে রাখা হয়েছিলো ডন পিউটো আলভারেজকে। লোকজন বোধহয় দেখা করতে আসতো তার কাছে, ওরকম কিছু লিখেছে। বিজয়ের পরে ছেলের সঙ্গে দেখা করবেন তিনি, এরকম কথাও আছে। বোধহয় পালিয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত এটা, তবে আমি শিওর না। চিঠিটার তারিখ তেরো সেপ্টেম্বর, উনিশশো ছেচল্লিশ। তলোয়ারটার কথা কিছু লেখা নেই।

বন্দি অবস্থায় লিখেছে, না? চিন্তিত ভঙ্গিতে গাল চুলকালো মুসা। আচ্ছা, কিশোর, সাংকেতিক কিছু লেখা নেই তো?

তা থাকতে পারে, মাথা ঝাঁকালো কিশোর। রিগোকে দিয়ে পড়াতে হবে। মানে ঠিকমতো না বুঝলে কিছু বলা যাচ্ছে না…

পড়িয়ে লাভ হবে বলে মনে হয় না, রবিন বললো। এই যে আরেকটা চিঠি, আমেরিকান আর্মি লিখেছিলো ডন পিউটোর ছেলে স্যানটিনোকে। যুদ্ধের পর সে তখন বাড়ি ফিরেছে। চিঠিতে দুঃখপ্রকাশ করেছে আমেরিকান প্রকার, ডন পিউটোর মৃত্যুর জন্যে। আঠারোশো ছেচল্লিশের পনেরোই সেপ্টেম্বর পালাতে গিয়ে মারা পড়েন ডন। তাকে গুলি করা ছাড়া নাকি আর কোনো উপায় ছিলো না সৈন্যদের, কারণ তিনি সশস্ত্র ছিলেন, এবং আগে হামলা করেছিলেন। গুলি খেয়ে সাগরে পড়ে যান তিনি…

ওসব তো পুরানো খবর, বাধা দিয়ে বললো মুসা, জানি আমরা। নতুন কি লিখেছে?

ডনের এভাবে সাগরে পড়ে যাওয়ার কথা রিপোর্ট করেছে জনৈক সার্জেন্ট রবার্ট ডগলাস। তার পক্ষে সাক্ষি দিয়েছে দুজন করপোরাল, তিনজনেই তখন ওই বাড়িতে পাহারায় ছিলো। ডগলাসের লেখা রিপোর্টটাও আছে এই ফাইলে, বলে ফাইলে টোকা দিলো রবিন। একথাও বলা হয়েছে, ডনের হাতে তখন একটা তলোয়ার ছিলো।

ভুরু কুঁচকে গেল কিশোরের। মুসার চোখে নিরাশা।

সার্জেন্টের ধারণা, বলে চললো রবিন, তলোয়ারটা লুকিয়ে ডনের কাছে নিয়ে এসেছিলো তার কোনো সহচর, তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসতো যারা, তাদেরই কেউ। মুখ তুললো রবিন। তারমানে, তলোয়ার হাতে নিয়েই সাগরে পড়েছিলেন ডন পিউটো।

বাইরে জোর বৃষ্টি হচ্ছে। জানালা দিয়ে সেদিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগলো কিশোর। কিছুক্ষণ পর জিজ্ঞেস করলো, মুসা, তুমি কিছু পেয়েছো?

তেমন কিছু না, জবাব দিলো মুসা হতাশ কণ্ঠে। আমিও একটা চিঠি পেয়েছি। ২৩ সেপ্টেম্বর লস অ্যাঞ্জেলেস গ্যারিসনের ওপর মেকসিকান হামলার বিব্রণ চেয়ে কমাণ্ডিং অফিসারের কাছে চিঠিটা লিখেছেন একজন ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তা। কয়েকজন সৈন্যের নাম উল্লেখ করেছেন, যারা দুটি না নিয়েই নিরুদ্দেশ হয়েছে। ষোল সেপ্টেম্বরের পর থেকে তাদের আর কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না বলে জানানো হয়েছে। সামরিক নিয়মে পলাতক ঘোষণা করা হয়েছে ওদেরকে। ডন পিউটো কিংবা তলোয়ারটার কথা কিছু লেখা নেই…

মুসার কথা শেষ হওয়ার আগেই কিশোর জানতে চাইলো, পলাতকদের নাম কি?

সার্জেন্ট রবার্ট ডগলাস, করপোরাল হ্যানসন, এবং করপোরাল…

ডি. ফাইবার! মুসার কথা শেষ হওয়ার আগেই চেঁচিয়ে উঠলো রবিন। এদের কথাই লেখা আছে আমার চিঠিটাতেও! ডন পিউটোকে পাহারা দিয়ে রেখেছিলো!

চিৎকার শুনে অবাক হয়ে যে ওদের দিকে তাকিয়ে আছেন হিসটোরিয়ান খেয়ালই করলো না ওরা।

ডগলাস, হ্যানসন এবং ফাইবার, খুশি খুশি মনে হলো কিশোরকে। আঠারোশো ছেচল্লিশের মোল সেপ্টেম্বর থেকে নিখোঁজ!

হ্যাঁ, কিন্তু… হঠাৎ চোখ বড় বড় হয়ে গেল মুসার। খাইছে! ওরাই ডনকে গুলি করেনি তো?

ওরা রিপোর্ট করেছে যে গুলি খেয়েছেন ডন, কিশোর বললো। কে করেছে, তা বলেনি।

ওরাই গুলি করেছে, তাই না কিশোর? জিজ্ঞাসু চোখে গোয়েন্দাপ্রধানের দিকে তাকালো রবিন।

তাই তো মনে হয়, গম্ভীর হয়ে গেল কিশোর। ব্যাপারটা খুবই রহস্যজনক। যারা ডনকে আগের দিন গুলি করে মারলো, প্রদিন থেকেই নিখোঁজ হয়ে গেল তারা, পলাতক ঘোষিত হয়ে গেল। তারপর আর কোনো খবরই নেই তাদের।

তলোয়ারটা চুরি করে পালায়নি তো? মুসা জিজ্ঞেস করলো।

পালাতেও পারে। কিন্তু তাহলে ওই খোলসটা মূর্তির ভেতরে লুকালো কে, এবং কেন? অবাক লাগছে আমার। নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটলো কিশোর। রিগোর সঙ্গে কথা বলতে হবে। এহহে, অনেক দেরি হয়ে গেছে, ঘড়ির দিকে চোখ পড়তে বলে উঠলো মুসা। তাই তো বলি, পেটের মধ্যে এমন মোচড় দেয় কেন? খুব খিদে পেয়েছে, বুঝলে, আমি বাড়ি যাবো।

আমিও, রবিন কালো।

কিশোর বললো, তাহলে কাল সকালেই রিগার সঙ্গে দেখা করতে যাবো।

সোসাইটির ডুপ্লিকেটিং মেশিনে চিঠি আর দলিলের কপি করে নিলো ওরা। তারপর হিসটোরিয়ানকে তাঁর সাহায্যের জন্যে ধন্যবাদ দিয়ে বেরিয়ে এলো। তখনও বৃষ্টি পড়ছে। বোরিস আসেনি। দাঁড়িয়ে থাকতে চাইলো না আর মুসা। তাছাড়া বাড়ি যাচ্ছে, ভিজে গেলেই বা কি। বাড়ি গিয়ে কাপড় পাল্টে নেবে।

ভিজে চপচপে হয়ে স্যালভিজ ইয়ার্ডে পৌঁছলো তিনজনে। রবিন আর মুসা সাইকেল ফেলে গিয়েছিলো এখানে, নিয়ে রওনা হলো বাড়ির দিকে। গেট দিয়ে বেরোতেই দেখা শুঁটকি টেরির সঙ্গে। টিটকারি দিয়ে বললো, আহারে, ইস্, একেবারে গোসল করে ফেলেছে! এসো, গাড়িতে ওঠো, পৌঁছে দি।

শুঁটকির গন্ধে বমি করার চেয়ে ভিজে যাওয়া অনেক ভালো, জবাব দিলো মুসা।

চকিতের জন্যে রাগ ঝিলিক দিয়ে উঠলো টেরিয়ারের চোখে। চিবিয়ে চিবিয়ে, বললো, দেখো, আলভারেজ র‍্যাঞ্চের ধারেকাছে যাবেনা আর। সাবধান!

টেরিয়ারের গাড়ি দেখে এগিয়ে এসেছে কিশোর। তার কথা কানে গেছে। জিজ্ঞেস করলো, ধমক দিচ্ছো?

ওদের র‍্যাঞ্চটার লোভ, না? কড়া গলায় বললো মুসা। ছুঁতেও দেয়া হবে না তোমার বাপকে, মনে রেখো!

দাঁত বের করে হাসলো টেরি। কি করে ঠেকাবে?

আমরা তলো…, প্রায় বলে দিয়েছিলো মুসা। তাড়াতাড়ি বাধা দিয়ে বলে উঠলো কিশোর, দেখতেই পাবে, কি করে ঠেকাই।

যা করার তাড়াতাড়ি করো, খিকখিক করে হাসলো টেরি, সময় বেশি পাবে না। হপ্তাখানেকের মধ্যেই দখল করে নেবো ওটা। আলভারেজদের কপালে শনি আছে। ওদের সঙ্গে খাতির লাগিয়ে কিছু করতে গেলে তোমাদেরও ভালো হবে না।

তিন গোয়েন্দাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে গাড়ি হাঁকিয়ে চলে গেল টেরি। অঝোর বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে সেদিকে তাকিয়ে রয়েছে তিন গোয়েন্দা। ভাবছে, বড় বেশি আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে কথাগুলো বলে গেল শুঁটকি!

<

Super User