সমস্ত জিনিসপত্র নিয়ে গিয়ে গোলাঘরে রেখেছে জনি। দুটো তাঁবু, দুটোই ভালো। আবহাওয়া এখন যেরকম, তেমন থাকলে এই ভাবুরও দরকার নেই। খোলা আকাশের নিচেই ঘুমাতে পারবে অভিযাত্রীরা।

জিনিসগুলোর প্রশংসা করলো তিন গোয়েন্দা আর জিনা।

একটা ঠেলাগাড়ি বের করে তাতে জিনিসগুলো তুলতে আরম্ভ করলো জনি। তার সঙ্গে হাত লাগালো তিন গোয়েন্দা আর জিনা। ল্যারিও যতোটা পারলো সাহায্য করলো ওদেরকে। চামচ থেকে শুরু করে, ফ্রাইং-প্যান, কেটলি, মোটকথা ক্যাম্পিলের যতো জিনিস দরকার, সব জোগাড় করে রেখেছে জনি।

সে বললো, ঠেলাগাড়ি পরেও নিতে পারবে। আগে জায়গা পছন্দ করো।

তার চেয়ে আরেক কাজ করা যাক, কিশোর বললো। জিনা, তুমি আর রবিন চলে যাও। জায়গা পছন্দ করো গিয়ে আমরা মালপত্র নিয়ে আসছি।

জায়গা বাছতে বেশিক্ষণ লাগলো না। ঠেলে বেরিয়ে থাকা একটা পাথরের নিচ থেকে দেখা গেল ঝর্না বইছে। স্বচ্ছ টলটলে পানি। পানি যেখানে গিয়ে পড়ে ছোট একটা ডোবামতো তৈরি করেছে, সেখানে গজিয়ে উঠেছে ঘন সবুজ গাছপালা। ওই ঝর্নার পাড়েই ক্যাম্প করার সিদ্ধান্ত নিলো ওরা।

মালপত্র সব এনে রাখা হলো জায়গামতো। কিন্তু সেরাতে আর তাঁবু ফেলার ঝামেলায় যেতে চাইলো না কেউ। আকাশ ঝকঝকে পরিষ্কার। তারা থাকবে। বাতাসও বেশ উষ্ণ। রাতে খোলা আকাশের নিচে ঘুমালেও অসুবিধে হবে না।

খাবারের প্যাকেটগুলো খুলতে বসলো রবিন আর জিনা। রবিন ভাবছে, ভাঁড়ার করা যায় কোন জায়গাটাকে। মনে পড়লো, ঝর্নাটা যে পাথরের নিচ থেকে বেরিয়েছে, সেখানে একটা গুহা আছে। ভেতরটা বেশ ঠাণ্ডা। খাবার রাখলে সহজে নষ্ট হবে না। অন্যদেরকে বলতে তারাও একমত হলো তার সাথে।

ওদেরকে কাজেকর্মে সাহায্য করলো জনি। তার যাবার সময় হলো। বললো, রাতের খাবারের দেরি হয়ে গেছে এমনিতেই। আমি যাই। কাল দেখা হবে। ইস্, তোমাদের সঙ্গে থাকতে পারলে ভালোই হতো!…আচ্ছা, চলি।

ডবিকে নিয়ে রওনা হয়ে গেল সে। নেমে যাচ্ছে ঢাল বেয়ে। সেদিকে তাকিয়ে একবার নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটলো শুধু কিশোর। কিছু বললো না।

ও তোমাদের খুব ভালো বন্ধু, জিনা মন্তব্য করলো।

একমত হয়ে মাথা ঝাঁকালো তিন গোয়েন্দা।

 

কটা বাজে? বলে ঘড়ি দেখলো কিশোর। আরিব্বাপরে! আটটা বাজে! বুঝতেই পারিনি। তা ঘুমটুম পেয়েছে কারো?

পেয়েছে,হাই তুললো মুসা।

রবিন আর জিনা জানালো, তাদেরও ঘুম পেয়েছে। এমনকি কিছুই না বুঝে রাফিয়ানও হুফ বলে মাথা ঝাঁকালো।

ঘুমের আর দোষ কি? মুসা বললো। সারাটা দিন কি কম কষ্ট গেছে? তা ঘুমের আগে হালকা কিছু খেয়ে নিলে কেমন হয়?

আমিও একথাই ভাবছি, কিশোর বললো।

ভাঁড়ারের দায়িত্ব নিয়েছে রবিন। বললো, রুটি, মাখন আর সামান্য পনির হলেই চলবে। কি বলো? আর গোটা দুই টম্যাটো। কিছু জাম, আর, সেই সাথে এক গ্লাস করে বরফ দেয়া দুধ হলে…

চমৎকার হয়। রবিনের কথাটা শেষ করে দিলো মুসা। হাত তালি দিয়ে বললো, জবাব নেই!

বরফ পাবে কোথায়? কিশোর জিজ্ঞেস করলো।

তাই তো, একমুহূর্ত ভাবলো রবিন। চিন্তা নেই, তুড়ি বাজালো সে। ঝর্নার পানি যেরকম ঠাণ্ডা, তাতে বোতল চুবিয়ে রাখলেই বরফের মতো ঠাণ্ডা হয়ে যাবে দুধ। পানি এমন ঠাণ্ডার ঠাণ্ডা, মনে হয় ফ্রিজ থেকে বের করা হয়েছে।

হালকা খাওয়া। তাড়াতাড়িই সেরে ফেললো ওরা। তার পর হলুদ ফুল ফুটে থাকা একটা বড় ঝোপ বেছে নিয়ে তার পাশে কম্বল বিছিয়ে শুয়ে পড়লো।

শোয়র সাথে সাথে ঘুমিয়ে পড়লো মুসা। কিশোর ঘুমালো তারপর। রবিন আর জিনা শুয়ে শুয়ে কথা বললো কিছুক্ষণ, ওদেরকে সঙ্গ দিলো রাফিয়ান।

জিনা ঘুমালো। সারাদিন এতো পথ দৌড়ে এসে রাফিয়ান খুব ক্লান্ত। সেও ঘুমালো। রবিন জেগে রইলো আরও কিছুক্ষণ। অনেক তারাই ফুটেছে আকাশে। তবে তার মাঝে ঝকঝক করছে মস্ত একটা তারা, চট করে চোখে পড়ে। দেখছে আর ভাবছে রবিন, আহা, পৃথিবীটা কি সুন্দর এখানে! এরকম একটা জায়গায় যদি চিরটাকাল বাস করা যেতে

আকাশে তারার মেলা, নিচে নিঝুম ধরণী। সব কিছু নীরব, শুধু ঝর্নার একটানা বয়ে চলার কুলকুল ছাড়া। মাঝে মাঝে দূরের খামারবাড়ি থেকে ভেসে আসছে কুকুরের ডাক, বোধহয় ডবি। তারপর বাতাস যখন স্তব্ধ হয়ে গেল, সেই ডাকও শোনা গেল না আর।

কিছুক্ষণ ঘুমানোর পরই জেগে গেল রাফি। একটা কান খাড়া করলো। মৃদু একটা শব্দ শুনতে পাচ্ছে, মাথার ওপরে। একটা চোখ মেললো। কালো একটা বাদুড়। শূন্যে পাক খেয়ে খেয়ে নিশাচর পোকা খুঁজে বেড়াচ্ছে। আবার ঘুমিয়ে পড়লো সে।

হঠাৎ জোরালো একটা আওয়াজে সবারই ঘুম ভেঙে গেল। লাফিয়ে উঠে বসলো সবাই। নীরবতার মাঝে আওয়াজটা বড় বেশি হয়ে কানে বাজছে।

কী? জিনার প্রশ্ন।

এরোপ্লেন, জবাব দিলো কিশোর। তাকিয়ে রয়েছে পাহাড়ের ওপর দিয়ে উড়ে যাওয়া ছোট বিমানটার দিকে। নিশ্চয় ওদিকের এয়ারী থেকে এসেছে।…কটা বাজে? আরিব্বাবা, নটা পাচ! বারো ঘণ্টা ঘুমালাম।

বাজুকগে, বলে আবার শুটিসুটি হয়ে শুয়ে পড়লো মুসা। চোখ বন্ধ করে বললো, আমি আরো ঘুমাবো।

এই ওঠো, ওঠো, জোরে জোরে ঠেলা দিলো তাকে কিশোর। এলাকাটা ঘুরে দেখা দরকার। প্রজাপতির খামার দেখবে না?

ভুলেই গিয়েছিলাম, উঠে বসলো আবার মুসা।

ঝর্না থেকে হাতমুখ ধুয়ে এলো সবাই। নাস্তা তৈরি করতে বসলো রবিন। তাকে সাহায্য করলো জিনা।

পরিষ্কার নীল আকাশ, ঝলমলে রোদ। ফুরফুরে হাওয়া বইছে। ঝোপের পাশে বসে বাতাস বাঁচিয়ে আগুন জ্বাললো রবিন। ডিম সেদ্ধ করলো। রুটি কেটে তাতে মাখন মাথালো জিনা। টুকরো করে টম্যাটো কেটে তাতে লবণ আর মশলা মাথালো। ঝর্নার পানিতে চুবিয়ে রাখা কয়েকটা দুধের বোতল গিয়ে নিয়ে এলো কিশোর আর মুসা।

সাধারণ খাবার। কিন্তু এই পরিবেশে বসে এসবই অমৃতের মতো লাগলো ওদের।

খাওয়ার মাঝামাঝি সময়ে ঘেউ ঘেউ শুরু করলো রাফি। ঘনঘন লেজ নাড়ছে। সবাই আন্দাজ করলো, বোধহয় জনি আসছে। হ্যাঁ, সে-ই, কারণ রাফিয়ানের ডাকের জবাবে সাড়া দিলো ডবি। একটু পরেই দেখা গেল তাকে। পাহাড়ের মোড় ঘুরে বেরিয়ে এলো। কাছে এসে লম্বা জিভ বের করে বসলো।

স্বাগত জানাতে তার গা চেটে দিলো রাফিয়ান।

জনি এলো। ও, নাস্তা করছে। এতোক্ষণে? ওদিকে কতো কাজ করে এলাম আমি। সেই ছটা থেকে শুরু করেছি। গরু দোয়ালাম, গোয়াল সাফ করলাম, হাঁসমুরগীগুলোকে খাবার দিলাম, খুপরী থেকে ডিম বের করলাম।

এখানে এসেই পুরোদস্তুর খামারওয়ালা বনে গেছো দেখছি, হেসে ঠাট্টা করলো মুসা।

হাতের ঝুড়িটা নামিয়ে রাখলে জনি। দুধ, রুটি আর ডিম পাঠিয়ে দিলো মা। বাসায় বানানো কেকও দিয়েছে।

অনেক ধন্যবাদ তাকে। তোমাকেও। কিশোর বললো। কিন্তু জনি, তাঁবু আর জিনিসপত্র ধার দিয়ে এমনিতেই অনেক সাহায্য করেছে, ঋণী করে ফেলেছো। ভাই, কিছু মনে করো না, খাবারের দামটা অন্তত দিতে দাও।

মা নেবে না। বললেই রাগ করবে।

কিন্তু আমরাই বা তোমাদের কাছ থেকে পয়সা ছাড়া কতো নেবো? রবিন বললো।

নিতে খারাপ লাগবে, বললো মুসা। বুঝতে পারছে না…

পারছি। কিন্তু মাকে আমি বলতে পারবো না, জনি হাতজোড় করলো। আমি মাপ চাই। পারলে তোমরা দাও গিয়ে।

মুশকিলই হলো দেখছি, চিন্তিত ভঙ্গিতে বললো কিশোর।

এক কাজ করা যায়, প্রস্তাব দিলো জিনা। যতোবার খাবার আনবে, ততোবার কিছু কিছু করে পয়সা দেবো আমরা তোমার হাতে। তুমি সেগুলো নিয়ে রেখে দেবে একটা বাক্সে। তারপর আমরা চলে যাবার দিন, কিংবা পরে উপহার কিনে তাকে দেবে। আমাদের তরফ থেকে। তাহলে আর তিনি মাইন্ড করতে পারবেন না। কি, ঠিক আছে?

অনিচ্ছা সত্ত্বেও রাজি হলো জনি। হুঁ, তা দেয়া যায়। তবে তোমরা পয়সা না দিলেই আমরা খুশি হতাম। যাকগে, এখন এগুলো তোমাদের ভাঁড়ারে তুলে রাখো তো।

খাবার রেখে আসা হলে কিছু টাকা বের করে জনির হাতে দিয়ে কিশোর বললো, কালকের আর আজকের খাবারের দাম।

টাকাটা পকেটে রেখে দিয়ে জনি বললো, তা আজ কি করবে ঠিক করেছে কিছু? প্রজাপতির খামার দেখতে যাবে, না আমাদের খামার?

তোমাদের খামারে তো গেছিই কাল একবার, পরে যেতে পারবো যখন খুশি, কিশোর বললো। অন্যদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, এই, আজ কি করা যায় বলো তো? এমন ঝলমলে রোদ ফেলে কালো গুহাগুলোতে ঢুকতে ইচ্ছে করছে না। গুহায় নাহয় আরেকদিন ঢোকা যাবে, কি বলো?

কেউ জবাব দেয়ার আগেই হঠাৎ সমস্বরে চেঁচাতে শুরু করলো রাফি আর ডবি। একই দিকে তাকিয়ে রয়েছে। বড় একটা ঝোপের দিকে।

কে এলো? জিনা বললো। এই রাফি, দেখ তো কে?

ছুটে গেল রাফিয়ান আর ডবি। একটা বিস্মিত কণ্ঠ কানে এলো। এই যে ডবি? এখানে এসে উঠেছিস কেন? তোর বন্ধুটি কে?

মিস্টার ডাউসন, জনি জানালো। প্রজাপতির খামারের এক মালিক। জাল নিয়ে প্রায়ই আসে এখানে, প্রজাপতি ধরতে।

ঝোপ ঘুরে বেরিয়ে এলেন একজন মানুষ। আলুথালু পোশাক, চশমাটা বারবার নাকের ওপর থেকে পিছলে পড়তে চায়। চুল-দাড়িতে কতোদিন নাপিতের কাঁচি লাগেনি কে জানে। হাতে একটা প্রজাপতি ধরার জাল। ছেলেমেয়েদের দেখে থমকে দাঁড়ালেন। হাল্লো! জনি, ওরা কারা?

আমার বন্ধু, মিস্টার ডাউসন। পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি, এ-হলো জর্জিনা পারকার, বিখ্যাত বিজ্ঞানী মিস্টার জোনাথন পারকারের মেয়ে। ও কিশোর পাশা, বাংলাদেশী। ওর চাছা রকি বীচের বিরাট এক স্যালভিজ ইয়ার্ডের মালিক। ওর নাম মুসা আমান, আফ্রিকান অরিজিন, এখন রকি বীচে থাকে। বাবা উঁচুদরের সিনেমা টেকনিশিয়ান। আর এ-হলোগে রবিন মিলফোর্ড, আইরিশ, বাবা বড় সাংবাদিক। আর এই মিয়া হলো আমাদের রাফিয়ান, ওরফে রাফি, জিনার প্রিয় কুকুর।

হ্যাঁ। বোঝা যাচ্ছে, আমাদেরও প্রিয় হয়ে উঠবে, মাথা নেড়ে এগিয়ে এলেন মিস্টার ডাউসন। কাঁধের ওপর তুলে রেখেছেন লাঠিতে বাঁধা প্রজাপতির জাল। চশমার কাঁচের ওপাশে চোখ দুটো উজ্জ্বল। তিন কিশোর, এক কিশোরী। চমৎকার। তা বাপুরা নোংরা করে দিয়ে যাবে না তো এলাকাটাকে? দাবানল লাগিয়ে দেবে না তো?

কল্পনাই করতে পারি না ওকথা, হেসে বললো জিনা। মিস্টার ডাউসন, আপনার প্রজাপতির খামারটা দেখাতে নিয়ে যাবেন আমাদের? খুব দেখতে ইচ্ছে করছে।

নিশ্চয়ই নেবো, আরও উজ্জ্বল হলো ডাউসনের চোখ। দেখানোর সুযোগই পাই না কাউকে। এদিকে বড় একটা আসে না কেউ। এসো, এদিক দিয়ে।

<

Super User