সরু একটা পাহাড়ী পথ ধরে ওদেরকে নিয়ে চললেন ডাউসন। এতো জঙ্গল হয়ে আছে, পথটা প্রায় চোখেই পড়ে না। মাঝামাঝি আসতেই শোনা গেল একটা ভেড়ার বাচ্চার ডাক, পরক্ষণেই কথা বলে উঠলো একটা কচিকণ্ঠ, ভাইয়া, ভাইয়া, আমি এখানে। আমাকে নিয়ে যাবি?

ল্যারি আর টোগো। প্রায় একই রকম করে লাফাতে লাফাতে এলো। ছুটে গিয়ে ভেড়ার বাচ্চাটার গা শুকলো রাফি, যেন ওটা কোনো ধরনের আজব কুকুরের বাচ্চা।

এখানে কি? কড়া গলায় বললো জনি। বাড়ি থেকে এতোদূর এসেছে! কতোদিন না মানা করা হয়েছে? দেখো, একদিন ঠিক হারিয়ে যাবে।

আমি আসতে চাইনি তো, বড় বড় বাদামী চোখ দুটো ভাইয়ের দিকে মেলে কৈফিয়তের সুরে বললো ল্যারি। টোগো আসতে চাইলো, তাই।

তুমিই এসেছে ওকে নিয়ে। আমি কোথায় যাই দেখার জন্যে।

না না, টোগোই আসতে চাইলো! কেঁদে ফেলবে যেন ল্যারি। আমি মানা করেছিলাম, পালিয়ে চলে এলো।

বেশি মিথ্যে কথা শিখে গেছে। কিছু হলেই টোগোর ওপর সব দোষ চাপিয়ে দিয়ে নিজে বেঁচে যেতে চাও। বাবা শুনলে দেখো কি করে। এখন এসেই যখন পড়েছে, চলো। প্রজাপতির খামারে যাচ্ছি আমরা। এরপর যদি কোথাও যেতে চায় টোগো, ওকে একাই যেতে দেবে। গিয়ে মরুকগে। জ্বালিয়ে মারলো ওই ভেড়ার বাচ্চাটা!

না না, আর যেতে চাইবে না, বলতে বলতে বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নিলো ল্যারি। আর নামতেই দেবো না। কিন্তু খানিক পরেই আবার নামিয়ে দিতে বাধ্য হলো। এই মুহূর্তে কোল পছন্দ না হওয়ায় এতো জোরে আচমকা চেঁচিয়ে উঠলো, চমকে গিয়ে লাফ দিয়ে উঠলো রাফি আর ডবি। এরপর থেকে না নামানো পর্যন্ত চেঁচিয়েই চললো বাচ্চাটা।

হুঁমম, ফিরে চেয়ে বললেন ডাউসন, ভালো দর্শক জোগাড় হয়েছে আজকে।

ককুর-ভেড়া দেখলে কি ভয় পায় আপনার প্রজাপতিরা? তাড় পাশে চলে গেল শারি। বলেন তো ওগুলোকে এখানেই রেখে যাই?

গাধার মতো কথা বলে, পেছন থেকে বললো তার ভাই। প্রজাপতির কি…। কথা শেষ না করেই হঠাৎ চিৎকার করে উঠলো জনি। হ্যাঁচকা টান মারলো ডাউসনের হাত ধরে। ওই যে, স্যার, একটা প্রজাপতি! ধরবেন না!

না, শান্তকণ্ঠে বললো ডাউসন। ওটা মিডো-ব্রাউন। অতি সাধারণ। কি ব্যাপার, ইস্কুলে কিছু শেখায় না নাকি? এরকম একটা প্রজাপতিও চিনতে পারো না।

না, শেখায় তো না, হেসে বললো জনি। আপনি আমাদের ইস্কুলের টীচার হলে খুব ভালো হতো। অনেক কিছু শিখতে পারতাম। তবে জেনারেল নলেজ বইতে দেখেছি অনেক রকম প্রজাপতির নাম। ক্যাবেজ বাটারফ্লাই, কলিফ্লাওয়ার মথ, রেড অ্যাডমিরাল,বু ক্যাপটেন, অসট্রিচ মথ…

তাকে থামিয়ে দিয়ে কিশোর জিজ্ঞেস করলো, মিস্টার ডাউসন, এখানে দুর্লভ প্রজাপতি আছে কিছু?

নিশ্চয়ই আছে, বললেন প্রজাপতি বিশেষজ্ঞ। আর সাধারণ প্রজাপতিও আছে প্রচুর। যতো খুশি ধরে নিয়ে গিয়ে বংশ বাড়াই। একটা প্রজাপতি মানেই শত শত ডিম। ডিম থেকে বাচ্চা ফুটিয়ে বিক্রি করি আমরা।

হঠাৎ একদিকে ছুটলেন তিনি। আরেকটু হলেই ধাক্কা দিয়ে ফেলে। দিয়েছিলেন জিনাকে। সরি! বললেন বটে, কিন্তু ফিরেও তাকালেন না তার দিকে। ওই যে একটা ব্রাউন অ্যারগাস। চমৎকার নমুনা। এ-বছর এই প্রথম দেখলাম। সরো, সরো তোমরা, সরে যাও। কথা বলবে না।

চুপ করে আছে ছেলেমেয়েরা। এমনকি জানোয়ারগুলোও নীরব। পা টিপে টিপে এগিয়ে যাচ্ছেন ডাউসন একটা গাছের দিকে। ফুলের ওপর বসা ছোট কালচে বাদামী রঙের একটা প্রজাপতির ওপর চোখ। কাছে গিয়ে হঠাৎ ওপর থেকে নিচের দিকে নামিয়ে আনলেন জালটা। ধরা পড়লো ব্রাউন অ্যারগাস। ডানা নেড়ে ফড়ফড় করতে থাকা প্রজাপতিটার পাখা দুআঙুলে টিপে ধরে সবাইকে দেখিয়ে বললেন, এটা মাদী প্রজাপতি। গরমের সময় সচরাচর যেসব নীল প্রজাপতি দেখো, এটা তাদেরই একটা প্রজাপতি। অনেক ডিম পাড়বে এই প্রজাপতিটা, অনেক ঝুঁয়াপোকার জন্ম দেবে, নাদুস-নুদুস পোকা…

নীল প্রজাপতি বললেন, আগ্রহী চোখে ব্রাউন অ্যারগাসের দিকে তাকিয়ে আছে রবিন। কিন্তু এটা তো নীল নয়। কালচে বাদামী। ডানায় কমলা রঙের ফোঁটা…

তাতে কি? রঙে কি এসে যায়? আমি বলছি এটা নীল প্রজাপতির বংশধর। কাঁধে ঝোলানো একটা টিনের বাক্সে প্রজাপতিটা ভরে রাখলেন ডাউসন। বোধহয় ওদিক থেকে এসেছে, তৃণভূমির দিক থেকে, হাত তুলে উপত্যকা দেখালেন তিনি।

মিস্টার ডাউসন, জরুরী গলায় বললো মুসা। সামনের ডানা কালচে সবুজ, তাতে লাল ফোঁটা। আর পেছনের ডানা লাল, তাতে সবুজ বর্ডার। জলদি আসুন। ধরতে পারলে লাভ হবে আপনার।

ওটা প্রজাপতি নয়, রবিন বললো।

ঠিকই বলেছো, প্রশংসার দৃষ্টিতে রবিনের দিকে তাকালেন ডাউসন। জাল তুললেন পতঙ্গটাকে ধরার জন্যে। এটা মথ। আটকে ফেললেন ওটাকে।

কিন্তু মথ তো দিনের বেলা ওড়ে না, তর্ক শুরু করলো মুসা। শুধু রাতে ওড়ে।

কিছু জানে না! ভারি লেন্সের ভেতর দিয়ে মুসার দিকে তাকালেন ডাউসন। আজকালকার ছেলেমেয়েগুলোর হলো কি? অথচ আমাদের সময়ে প্রতিটি ছেলেমেয়েই জানতাম কোনটা দিনের মথ, আর কোনটা রাতের।

কিন্তু, বলতে গিয়ে ডাউসনের কড়া চাহনির দিকে তাকিয়ে থেমে গেল মুসা।

এটার নাম সিক্স-স্পট বারনেট ডে-ফ্লাইং মথ, বাচ্চা ছেলেকে যেন বোঝাচ্ছেন, এমনিভাবে ধীরে, থেমে থেমে প্রতিটি শব্দ উচ্চারণ করলেন ডাউসন। রোদের মধ্যে উড়ে বেড়াতে খুব ভালোবাসে এরা। আর তর্ক করবে না আমার সঙ্গে। মূখ ছেলেকে ভালো লাগে না আমার।

মুসার কাঁচুমাচু মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললো অন্যেরা। তবে অবশ্যই নীরবে, এবং ডাউসনের অলক্ষ্যে।

তবে তাদের দিকে চোখ নেই তার। মথটাকে বাক্সে ভরতে ব্যস্ত। বললেন, এরকম মথ আরও দরকার আমার। দেখলেই বলবে। মনে রেখো, এগুলো আরও বড় হয়। বড় দেখলেও বলবে।

ব্যস, আর কিছু বলতে হলো না। সবাই মথ খুঁজতে আরম্ভ করলো ঝোপেঝাড়ে। প্রজাপতি ধরা খুব ভালো লাগছে ওদের। রাফি আর ডবিও বেশ আগ্রহী। এখানে ওখানে ওকে বেড়াতে লাগলো। কিছুই না পেয়ে আবার আগের জায়গায় এসে জমায়েত হলো সকলে। তারপর আবার এগোনোর পালা।

এমনি করে পথে পথে থেমে, প্রজাপতি ধরে এগোতে অনেক সময় লাগলো। যতোটা লাগার কথা, তার চেয়ে অনেক বেশি সময় লাগিয়ে, অনেক দেরিতে এসে প্রজাপতির খামারে পৌঁছলো দলটা।

এই কাচের ঘরেই আপনার প্রজাপতি রাখেন? জানতে চাইলো কিশোর।

হ্যাঁ, মাথা ঝাঁকালেন ডাউসন। এসো। সব দেখাচ্ছি। কিভাবে কি করি আমি আর আমার বন্ধু ডরি। আজ অবশ্য ওর দেখা পাবে না, নেই এখানে।

জায়গাটা অদ্ভুত লাগলো দর্শকদের কাছে। কটেজটা দেখে মনে হয় যে কোনো সময় ধসে পড়তে পারে। দুটো জানালা ভাঙা, ছাতের কয়েকটা টালি গায়েব। কিন্তু কাঁচের ঘরগুলো বেশ সুন্দর, সুরক্ষিত অবস্থায় রাখা হয়েছে। প্রতিটি কাঁচ ঝকঝকে পরিষ্কার। নিজেদের চেয়ে প্রজাপতি আর মথের যত্ন অনেক বেশি নেন প্রজাপতি মানবেরা, বোঝা গেল।

এখানে কি শুধু আপনারা দুজনই থাকেন? জিজ্ঞেস করলো রবিন। এরকম একটা জায়গায় দুজন মানুষ কি করে থাকে ভাবতে অবাক লাগছে তার। একা লাগে না?

না, একা লাগবে কেন? রবিনের প্রশ্নটাই যেন অবাক করলো ডাউনকে। তাছাড়া মিসেস ডেনভার আছে, আমাদের কাজকর্ম করে দেয়। তার ছেলে এসে মেরামত-টেরামত কিছু লাগলে করে দেয়। প্রজাপতির ঘরগুলো পরিষ্কার রাখে। মিসেস ডেনভার কীট-পতঙ্গ একদম পছন্দ করে না, ঘরগুলোর কাছেই আসে না সে। কাজেই তার ছেলেকেই সব করতে হয়।

কটেজের জানালা দিয়ে উঁকি দিলো এক বৃদ্ধা। জিনার মনে হলো, বুড়ি তো নয়, রূপকথার বইয়ের পাতা থেকে নেমে আসা ডাইনী। ভুরু কুঁচকে তার দিকে তাকালো মুসা। ভূত আর ডাইনী-পেত্নীকে যে সে ভয় পায়, একথা জানা আছে জনির। হেসে বললো, ভয় নেই, মানুষই, ভূতপ্রেত নয়। মহিলা ভালো। আমাদের রাঁধুনী মেয়েটা প্রায়ই দুধ আর ডিম দিতে আসে এখানে। সে গিয়ে সব বলে। একটা দাঁতও নেই মহিলার। ফলে চেহারাটা ওরকম বিকট লাগে। ডাইনী মনে হয়।

তোমার ভূতের ভয়টা আর দূর করতে পারলে না, রবিন বললো মুসাকে। তোমরা ডাইনীর আলোচনা নিয়েই থাকো, আমি প্রজাপতি দেখতে গেলাম।

ছোট ছোট কাচের বাক্সের ভেতরে শত শত প্রজাপতি উড়ছে। কাঁচের ঘরের মধ্যে নানা রকম গাছ লাগিয়ে ঝোপঝাড় তৈরি করা হয়েছে, বাইরে যেরকম ঝোপে ঝাড়ে থাকে প্রজাপতি, ঠিক সেরকম পরিবেশ।

খাইছে! বলে উঠলো মুসা। কতো খুঁয়াপোকা দেখেছো? পাতা খেয়ে তো সব সাফ করে ফেললো।

হ্যাঁ, রাক্ষসের মতো খায় ওরা, ডাউসন বললেন।

অনেক ধরনের শুঁয়াপোকা দেখা গেল। কোনোেটা ভীষণ কুৎসিত, দেখলেই গায়ে কাঁটা দেয়, কোনোটা খুব সুন্দর, সারা শরীরে রঙের বাহার। যেমন, গাঢ় সবুজ পোকা, লাল আর হলুদ ফোঁটা। আরেক ধরনের আছে, বেশ বড়, সবুজের ওপর লাল আর কালো ডোরা, লেজের কাছে বাঁকা শিঙের মতো। দেখতে যেন বিকট, তেমনি সুন্দর।

প্রাইভেট-হক মথের য়াপোকা, ডাউসন জানালেন।

এর নাম প্রাইভেট-হক কেন? রবিন জিজ্ঞেস করলো ভয়ে ভয়ে। কিছু জানো না বলে যদি আবার গাল দিয়ে ওঠেন ডাউসন?

কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে হাসলেন প্রজাপতি মানব। বোধহয় তিনি মনে করেছেন, খুব বুদ্ধিমান ছেলেটা। কেন, হক মথ উড়তে দেখোনি কখনও? ও, দেখোনি। অদ্ভুত ভঙ্গিতে ওড়ে। অনেকটা ওই হকহক চেনো তো?

চিনি। বাজপাখি।

গুড। ওই বাজপাখির মতো।

কিন্তু প্রাইভেট কেন? একা একা থাকতে পছন্দ করে বুঝি?

ঠিক ধরেছো। বুদ্ধিমান ছেলে। তবে এখানে একা থাকার সুযোগ পায় না। অন্যদের সঙ্গে একসাথেই বেড়ে উঠতে হয়।

প্রজাপতির খামার দেখতে ভালোই লাগছে ওদের।

গুটি কেটে প্রজাপতি বেরিয়ে আসতে দেখে বিস্ময়ে চোখ কপালে উঠলো মুসার। আশ্চর্য! এ-কি যাদু নাকি!

আমার কাছেও অনেক সময় যাদুই মনে হয়, হেসে বললেন ডাউসন। ডিম থেকে কিলবিলে ওয়াপোকা বেরোনো, সেই পোকার গুটিতে আশ্রয় নেয়া, তারপর সেই শুটি কেটে ডানাওয়ালা চমৎকার রঙিন প্রজাপতি বেরিয়ে আসতে দেখলে অবাক না হয়ে উপায় নেই।

কিন্তু ভীষণ গরম এখানে, মিস্টার ডাউসন, একজিনিস আর বেশিক্ষণ দেখতে ভালো লাগছে না কিশোরের। ওদিকে বোধহয় কিছুটা ঠাণ্ডা হবে। ওদিকে গিয়ে বসি।

হ্যাঁ হ্যাঁ, যাও, বললেন ডাউসন। আমার কাজ আছে। দেখতে ইচ্ছে করলে আবার এসো।

ওখান থেকে সরে একটা ছায়ামতো জায়গায় চলে এলো ওরা। হঠাৎ পেছনে ভাঙা গলায় কথা বলে উঠলো কেউ, যাও, এখানে কি? চলে যাও।

<

Super User