কিন্তু তাতেও নিরাশ হলো না গোয়েন্দাপ্রধান। সে আশাও করেনি টেলিফোনটা কাজ করবে। যে লোক তাকে এখানে আটকে রেখে গেছে, সে টেলিফোন চালু রেখে যাবে এতো বোকা নিয়ে নয়।

তিন নম্বর কাজ, ফোনটা ঠিক করা, সম্ভব হলে।

কোথায় লাইনটা কাটা হয়েছে, সহজেই খুঁজে পাওয়া গেল। মেঝের কাছাকাছি জায়গায়। তবে যে কেটেছে সে ভালোমতোই জানে কিভাবে কি করতে হবে। শুধু কেটেই ক্ষান্ত হয়নি, অনেকখানি জায়গার তার টেনে তুলে ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছে।

রান্নাঘরের পেছনে এখনও আছে হুতোর মিস্ত্রীর যন্ত্রপাতিগুলো। ভালো শক্ত একটা প্লয়ার্স পাওয়া গেল ওখানে। আর সাউন্ড স্টেজ-ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি নিয়ে যেখানে কারবার, সেখানে খানিকটা ভালো তার জোগাড় করাও এমন কোনো কঠিন কাজ নয়। একটা স্পটলাইট থেকেই সেটুকু তার কেটে নিয়ে এলো সে।

দ্রুত হাত চালিয়ে ফোনের লাইনের সঙ্গে তারটা জোড়া দিয়ে ফেললো। রিসিভার তুলতে গিয়ে দুপ দুপ করছে বুক। কাজ হবে তো? বলা যায় না, বিন্ডিঙের বাইরেও কাটা হয়ে থাকতে পারে তার। তাহলে সর্বনাশ।

কিন্তু রিসিভার কানে ঠেকাতেই একটা মিষ্টি শব্দ কানে এলো তার। টেলিফোনে শব্দ সাধারণত বিরক্ত করে তাকে, কিন্তু এখন ডায়াল টোনের আওয়াজ শুনে মনে হলো জীবনে যতগুলো মধুরতম আওয়াজ শুনেহে এটা তার মধ্যে একটা।

স্টুডিওর সুইচবোর্ডে ফোন করে কাউকে আসতে বলতে পারে, নিশ্চয় বাড়তি চাবি আছে ওদের কাছে। কিন্তু ওরা এলে হাজারটা কৈফিয়ত দিতে হবে, প্রশ্নের জবাব দিতে হবে। এখনই সব কিছু ফাঁস করে দিতে চায় না সে। নিজেদের মধ্যে, অর্থাৎ তিন গোয়েন্দার মধ্যেই আপাতত সীমাবদ্ধ রাখতে চায় ব্যাপারটা।

নিশ্চয় এতোক্ষণে সৈকত থেকে বাড়িতে চলে এসেছে মুসা। তাকেই ফোন করলো কিশোর। দ্বিতীয়বার রিং হতেই রিসিভার তুললো স্বয়ং মু। সংক্ষেপে তাকে বুঝিয়ে বললো কিশোর, কি ঘটেছে।

তারপর বললো, এখুনি অ্যালউড হোফারকে ফোন করে বলো তোমাকে এখানে নিয়ে আসতে। আমি দরজার নিচের দিকে একটা ফুটো করার চেষ্টা করছি, ওখান দিয়ে চাবি কে করে দেবো।

কিশোর রিসিভার রাখার পর আর একটা সেকেন্ড দেরি করলো না মুসা। হোফারকে ফোন করলো। তিরিশ মিনিটের মধ্যে ওদের বাড়িতে পৌঁছে গেল শোফার। রবিনকে ফোন করে আগেই আনিয়ে রেখেছে মুসা। তাড়াহুড়ো করে দুজনে উঠে বসলো গাড়িতে।

আর কিছু করার নেই দুজনের। এখন সব দায়দায়িত্ব ফোরের, লিজিন নিয়ে কতো তাড়াতাড়ি পৌঁছতে পারবে স্টুডিওতে। কিন্তু সে-ও যেন কিছু করতে পারছে না। শনিবারের হলিউডের রাস্তা, সাংঘাতিক ভিড়। যাই হোক, অবশেষে ভাইন স্ট্রীটে পৌঁছলো গাড়ি। দেখা গেল স্টুডিওর গেট।

গার্ড-বুদ থেকে বেরিয়ে এলো গার্ড, গাড়ির পাশে এসে দাঁড়ালো। হাত বাড়ালো, পাস দেখি?

পরস্পর মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগলো দুই সহকারী গোয়েন্দা। এই কথাটা তো একবারও মনে পড়েনি! পাস রয়েছে কিশোর পাশার কাছে।

 

বাটালির মাথায় হাতুড়ির শেষ আঘাতটা দিয়ে থামলো কিশোর। মেঝেতে নামিয়ে রাখলো যন্ত্র দুটো, তারপর পরিষ্কার করে ফেলতে লাগলো দরজার নিচ থেকে কাঠের কাটা চিলতেওলো। ওয়ে পড়ে চোখ রাখলো কাটা জায়গার কাছে, বাইরে তাকালো।

ঠিকই আছে। চাবি বের করে দেয়া যাবে। চতুর্থ কাজটাও সমাপ্ত। এখন মুসা এসে হাজির হলেই চাবিটা ঠেলে দেবে বাইরে।

ঘড়ি দেখলো কিশোর। দুটো বাজতে সতেরো মিনিট বাকি। এতো দেরি করছে কেন মুসা? এততক্ষণে পৌঁছে যাওয়ার কথা। শোফারের সঙ্গে কোনো গোলমাল হলো? নাকি অন্য কোনো কারণে আটকে গেছে?

অ্যালউড হোফারের রহস্যজনক আচরণের কথা পড়তেই অস্বস্তি বোধ করতে শুরু করলো কিশোর।

 

গেটের কাছে দাঁড়িয়ে আছে লিমুজিন।

পাস আছে আমাদের বোঝানোর চেষ্টা করছে মুসা, কিন্তু ভুলে বাড়িতে ফেলে এসেছি। আমাদের চিনতে পারছেন না? গতকালও আমরা এসেছিলাম, পাগল সংঘের অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার জন্যে। আমাদের বন্ধু কিশোর পাশাকে তুলে নিতে এসেছি।

গম্ভীর মুখে মাথা নাড়লো গার্ড। আমি ওসব শুনতে চাই না। তাছাড়া আজকে বাইরের কারও আসারও কথা নয়, আমাকে ইনফর্ম রা হয়নি। পাস ছাড়া ঢুকতে দেবো না।

কি-কিন্তু, তোতলাতে শুরু করলো রবিন, আমরা…

তার কথা শেষ হওয়ার আগেই দরজা খুলে নেমে পড়লো হোফার। পেছনের রজা খুলে দিয়ে বললো, নামুন আপনারা।

ওরা নামতে আবার গার্ডের দিকে ফিরলো হোফার। এই গাড়িটা মিস্টার হ্যারিস বেকার ভাড়া নিয়েছেন, স্টুড়িওর বিজ্ঞাপন ম্যানেজার। তিনিই এদেরকে অনুমতি দিয়েছেন স্টুডিওটা ঘুরে দেখার জন্যে। আমাকে পাঠিয়েছেন দেখিয়ে নিয়ে যেতে।

কিন্তু মিস্টার বেকার তার অফিসে আছেন বলে তোর মনে হয় না…।

না, তিনি নেই। তাঁর সেক্রেটারি আমাদের কোম্পানিতে ফোন করেছিলো গাড়ি নিয়ে আসার জন্যে। দড়াম করে পেছনের ভোলা দরজাটা লাগিয়ে দিলো হোফার। তিনি কোথায় আছেন? দরজা লাগানোর সময় ফিসফিসিয়ে মুসাকে জিজ্ঞেস করলো সে।

নয় নম্বর। বাইরে তালা, ভেতরে আটকে আছে। দরজার নিচ দিয়ে চাবিটা রে করে দেবে বলেছে।

ফিরে এসে গার্ডের সামনে দাঁড়ালো হোফার। বললো, আমার যেতে তো কোনো বাধা নেই? আমি সেক্রিটারির কাছে যাচ্ছি। বলে আবার উঠে পড়লো গাড়িতে। তাকে আটকালো না গার্ড। হাত নেড়ে যাওয়ার ইশারা করলো।

গাড়িটাকে নয় নম্বর স্টেজের দিকে এগিয়ে যেতে দেখলো রবিন আর মুসা।

কিশোর ঠিকই আন্দাজ করেছে, রবিন ভাবলো, অ্যালউড হোফার লোকটা রহস্যময়।

তখনও দরজার নিচ দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে কিশোর। আলো আসছিলো রজার নিচ দিয়ে, হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল সেটা।

মুসা? ডেকে জিজ্ঞেস করলো সে।

না, আমি অ্যালউড হোফার। চাবিটা দিন। দ্বিধা করলো কিশোর। এতোগুলো কাজ নির্বিঘ্নে সারার পর, এখন তীরে এসে তরী ডোবাতে চায় না ভুল লোকের হাতে চাবি দিয়ে। চাবিটা নিয়ে যে সরে পড়বে না হোর, তাকে সোমবার এখানে আটকে রেখে যাবে না তার বিশ্বাস কি? এমনও হতে পারে হোফারই তার পিছু নিয়ে এখানে এসেছিলো, তাকে আটকে রেখে গিয়েছিলো।

ঘড়ি দেখলো আবার কিশোর। দুটো বাজতে বারো মিনিট আছে আর। দ্বিধা করার সময় এখন নয়। ঝুঁকিটা নিতেই হবে। মনে মনে আশা করলো, হোফার যেন তার শক্ত না হয়।

দরজার নিচ দিয়ে চাবিটা ঠেলে দিলো, কিশোর। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো।

খুলে গেল দরজা।

ফোঁস করে চেপে রাখা নিঃশ্বাস ছেড়ে উজ্জ্বল দিবালোকে বেরিয়ে এলো কিশোর।

বললো, থ্যাংক ইউ, মিস্টার হোফার।

জলদি চলুন, শোফার কললো। আপনার বন্ধুরা গেট দাঁড়িয়ে আছে। আশা করি দুটো নাগাদ পৌঁছে যেতে পারবো।

ঠিক দুটোয় পৌঁছতে পারলো না। এক মিনিট দেরি হয়ে গেল। গাড়ি থেকে নেমে টেলিভিশন নেটওয়ার্ক বিল্ডিংটার দিকে দৌড় দিলো কিশোর। দুর্টে এসে লিফটে উঠলো।

যে রুমে কুইজ শো শুটিঙের ব্যবস্থা হয়েছে, সেটার দরজা খোলা রয়েছে তখনও। একজন ইউনির্ফম পরা অ্যাটেনডেন্টকে বলতেই তাড়াতাড়ি কিশোরকে একটা ঘোরানো গলি পার করে স্টেজে পৌঁছে দিলো।

আদালতে জুরিরা যেরকম জায়গায় বসে, অনেকটা ওরকম একটা লম্বা কাঠের স্ট্যান্ডের কাছের চেয়ারে এনে কিশোরকে বসিয়ে দেয়া হলো। টাইয়ের সঙ্গে মাইক বেঁধে দেয়া হলো। বোকা বোকা ভঙ্গি করে ভারিপদের দিকে তাকালো সে, ওর চোখ দেখে বোঝার চেষ্টা করলো চমকে গেছে কিনা।

এসেছো,ভারিপদ বললো। দেরি করে ফেললে।

ভারিপদর মুখ দেখে কিছু বোঝা গেল না। একটুও অবাক মনে হলো না তাকে। দ্রুত অন্যদের মুখের ওপর চোখ বোলালো কিশোর। নেলিকেও অবাক লাগলো না। বরং কিশোর যে শেষ পর্যন্ত সময় মতো আসতে পেরেছে, তাতে যেন হাঁপ ছেড়েছে। এমনকি তাকে একটা বন্ধুত্বপূর্ণ হাসিও উপহার দিলো।

শিকারী কুকুরকেও খুশি মনে হলো। খুশি মনে হলো হ্যারিস বেকারকে, যে এই শো- উদ্যোক্তা।

শুধু যে একটিমাত্র লোক তাকে দেখে সন্তুষ্ট হতে পারলো না, চোখাচোখি হতেও চোখ সরিয়ে নিলো আরেক দিকে, তার মাথাভর্তি লম্বা সোনালি চুল নেমে এসেছে করে ওপর।

মড়ার খুলি।

<

Super User