আর্ক লাইটের আলোয় স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তিন গোয়েন্দা। ধাতব দণ্ডটায় এখনও হাত রয়ে গেছে মুসা আর রবিনের। কিশোরের হাত রিফ্রেক্টর বক্সের ভেতরে।

যেখানে আহো, দাঁড়িয়ে থাকো, আদেশ দিলো একটা কণ্ঠ।

দাঁড়িয়ে রইলো হেলেরা। আলো জ্বালানোর মাস্টার কন্ট্রোল সুইচ বক্সের কাছ থেকে তাদের দিকে এগিয়ে এলেন পাগল সংঘের পরিচালক রাফায়েল সাইনাস। তাকিয়ে আছেন কিশোরের দিকে। বের করে আনার দরকার নেই আর। উজ্জ্বল আলোয় এখন পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে বাক্সের ভেতরে রিফ্রেক্টরের পাশে পাঁচটা রূপার কাপ।

তাহলে ওখানেই লুকিয়েছে, সাইনাস বললেন। বিকেলে দেখা গিয়েছিলো বিধ্বস্ত এক বৃদ্ধ, এখন অন্য রকম হয়ে গেছে কণ্ঠস্বর। বহু বছর আগের সেই ধার

আবার ফিরে এসেছে অনেকখানি।

দুহাজার ডলার খরচা হয়েছে স্টুডিওর ওগুলো কিনতে, বললেন পরিচালক। চুরি করেছে তোমরা। সবাই চলে যাওয়ার পর এখন এসেছে রে করে নিতে।

না, কিশোর বললো। আমরা লুকাইনি। খুঁজে ব্রে করেছি। এক এক করে বাক্সের ভেতর থেকে বের করে তুলে দিতে লাগলো পরিচালকের হাতে।

কে বিশ্বাস করবে তোমার কথা? পরিচালক বললেন। যে লুকিয়েছে, তারই শুধু এতো সহজে ওগুলো খুঁজে পাওয়ার কথা।

আমি চুরি করিনি! গলা সামান্য চড়ালো কিশোর। ভেবে বের করেছি কোথায় ওগুলো লুকিয়ে রাখতে পারে চোর। হেডকোয়ার্টারে বসে আলোচনা করেছি আমরা…

হেডকোয়ার্টার! তীক্ষ্ণ হলো পরিচালকের দৃষ্টি। কি বলতে চাইছো?

আমাদের অফিস। যখন কোনো কেস হাতে পাই, ওখানে বসে আলোচনা করি আমরা। গবেষণা করি।

কিসের কেস? সাইনাসও গলা চড়ালেন। এরপর হয়তো বলে বসবে, তোমরা পুলিশের লোক। গোয়েন্দা।

গোয়েন্দাই আমরা, তবে পুলিশের লোক নই। আম্র শব্বে গোয়েন্দা। পকেট থেকে কার্ড বের করে দিলো কিশোর।

শূন্য দৃষ্টিতে কাউটার দিকে তাকালেন পরিচালক। তাতে কিছু প্রমাণ হয় না, গলার স্বরে বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হলো না তার। যে কেউ ওরকম ছেপে নিতে পারে। যদি ছেপে নাও তুমি এই স্টুডিওর প্রেসিডেন্ট, তাহলেই কি প্রেসিডেন্ট হয়ে যাবে? এটা কোনো প্রমাণ না যে তুমি কাপ চুরি করোনি।

কিন্তু আমরা করিনি, জোর দিয়ে বললো রবিন। এখানে এসে পাওয়ার আগে জানতামই না কোথায় লুকানো আছে।

আমরা শুধু আন্দাজ করেছি,মুসা বললো, এখানেই কোথাও আছে।

তারপর কিশোর বুঝে ফেললো, রবিন কললো আবার, ওই রিফ্লেক্টর বক্সে রয়েহে ওগুলো।

আর এখানে সমস্ত স্ট্যান্ডের মধ্যে সব চেয়ে বেশি তুলে রাখা হয়েছে ওই বাটার স্ট্যান্ড, বললো কিশোর, সে-কারণেই অবাক লাগলো। অস্বাভাবিক। ভাকলাম, কেন তুলে রাখা হয়েছে? নিশ্চয় কোনো ব্যাপার আছে।

কিন্তু এতো কথা বলার পরেও বিশ্বাস করার কোনো লক্ষণ দেখা গেল না পরিচালকের মাঝে।

চুপ করে এক মুহূর্ত ভাবলো কিশোর। তারপর জিজ্ঞেস করলো, আপনি নিশ্চয় মিস্টার ডেভিস ক্রিস্টোফারের নাম শুনেছেন? চিত্রপরিচালক?

তার নাম কে না শুনেছে, শ্রদ্ধার সঙ্গে বললেন সাইনাস। কেন, তিনি তোমাদের সাফাই দেকেন?

নিশ্চয় দেবেন। আপনি ফোন করেই দেখুন না।

হাসলেন সাইনাস। তোমাদের কপাল খারাপ, তিনি এখন নেই। বাইরে গেছেন একটা শুটিঙের কাজে। বেশ কিছুদিন আসবেন না।

আবার চুপ হয়ে গেল কিশোর। দমে গেছে রবিন আর মুসা। সাইনাসকে বোঝানোর আর কোনো উপায় নেই।

কিন্তু কিশোর দমলো না। আবার জিজ্ঞেস করলো, ভিকটর সাইমনের নাম শুনেছেন? রহস্য কাহিনী লেখক?

একের পর এক বিখ্যাত লোকদের নাম বলে যাচ্ছো। ব্যাপারটা কি? তিনিও কি সাফাই দেবেন নাকি?

কেন দেবেন না? দ্বিধা করলেন সাইনাস। তার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়নি। ফোন নম্বর জানি না।

আমি জানি, পরিচালকের হাত থেকে কার্ডটা নিয়ে তার উল্টো পিঠে ফোন নম্বর লিখে দিলো কিশোর।

আরেকবার দ্বিধা এলেন পরিলাচক। তারপর হেঁটে গেলেন স্টেজের দেয়ালে কানো টেলিফোনটার দিকে। তাকে ডায়াল করতে দেখলো তিন গোয়েন্দা। তবে এত দূর থেকে কথা শুনতে পেলো না। অনেক সময় ধরে কথা বললেন। তারপর রিসিভার রেখে দিলেন হাসিমুখে।

ফিরে এসে জানালেন, আমাকে চিনতে পেরেছেন তিনি। আমার নাম জানেন। আশ্চর্যই লেগেছে। তার একটা ছবির শুটিং হয়েছিল, আমাদের এই স্টুডিওতে। তখন নাকি আমার সাথে দেখা হয়েছিলো, অথচ আমি ভুলে বসে আছি। আবার হাসলেন তিনি। কলার সঙ্গে সঙ্গেই নিতে পারলেন।

আমাদের কথা কি বলেছেন? মুসা জিজ্ঞেস করলো।

ও, তোমাদের কথা, জোর করে যেন অতীত থেকে নিজেকে বাস্তবে টেনে আনলেন সাইনাস। যা, তোমাদের কথা বলেছেন। তোমরা চোর নও। তোমরা ইচ্ছে করলে এখন বাড়ি যেতে পারো। কাপগুলো আমি জায়গামতো পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করছি।

তাঁকে ধন্যবাদ দিলো কিশোর।

আশ্চর্য, বিড়বিড় করলেন সাইনাস, কিশোরের কথা যেন শুনতেই পাননি, এই ফিল্ম ব্যবসা! এটা এমন এক জায়গা, এখানে চোখের আড়াল হলেই মানুষ মানুষকে দ্রুত ভুলে যায়। অথচ ভিক্টর সাইমন আমাকে ভোলেননি। আর কাণ্ড দেখো, আমি ভুলে বসে আছি। তিনি বললেন, তার ছবিটা পরিচালনার কথা নাকি প্রথমে আমারই ছিলো। পরে আরেকজনকে নেয়া হয়েছে, আমি সময় দিতে পারিনি বলে। আমার পরিচালিত সমস্ত ভালো হরি নাম মনে আছে তাঁর।

বেরোনোর জন্যে সহকারীদেরকে ইশারা করলো কিশোর। সাইনাসকে তার অতীতের মধ্যেই ডুবে থাকতে দিলো ওরা। এগোলো সাউন্ড স্টেজের প্রজার দিকে।

কি ভাবছো, কিশোর? রাস্তায় পা দিয়েই জিজ্ঞেস করলো মুসা।

জবাব দিলো না গোয়েন্দাপ্রধান। নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটছে।

কে চুরি করেছে বলে মনে হয় তোমার? রবিনের প্রশ্ন। ওই আর্ক লাইট, ওদের কথা যেন কানেই ঢোকেনি কিশোরের, কেউ জানতো, ওগুলো ব্যবহার করা হবে না। থমকে দাঁড়ালো সে। পেছনে দাঁড়িয়ে গেল রবিন আর মুসা, বিশাল স্টেজ-বাড়িটার হায়ায়। বোধহয় সে-কারণেই সে ক্যামেরাগুলো চাল হওয়াতক অপেক্ষা করেছিলো…, ভ্রূকুটি করলো সে। কি জানি, এখনও শিওর হতে পারছি না।

মড়াটা? মুসা বললো। নাকি ভারিপদ?

শিওর না, একই কথা বললো কিশোর। বেশ কিছু রহস্য জট পাকিয়ে আছে এখনও।

যেমন? রবিন জানতে চাইলো।

এক নম্বর, একটা আঙুল তুললো কিশোর, আমাদের শোফার অ্যালউড হোফার।

তার আবার কি রহস্য? জিজ্ঞেস করলো মুসা।

ওর স্মৃতিশক্তি, বুঝিয়ে দিলো কিশোর, এত কম লে? সকালে স্টুডিওর গেট গার্ড তাকে দেখেই চিনতে পারলো, তারমানে এখানে সে অনেকবার এসেছে। তার পরেও নয় নম্বর স্টেজ কোথায় জানার জন্যে অনন্যকে জিজ্ঞেস করতে হলো কেন?

পথের শেষ মাথায় পার্ক করা লিমুজিনের দিকে হাঁটতে আরম্ভ করলো আবার কিশোর। আমাদের সামনে সাউন্ড স্টেজটা না চেনার ভান করছে সে। কেন?

সে-ই কি কাপগুলো চুরি করেছে ভাবছো? রনি বললো।

আবার কুটি এলো কিশোর। এখনও জানি না। তবে, আমাদের আলোচনা অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার ঠিক আগে রান্নাঘরের পেছন ঘুরে ওকে হেঁটে যেতে দেখেছি আমি।

<

Super User