শুরু হয়নি এখনও, রবিন বললো।

চ্যানেল ঠিক আছে তো? মুসার প্রশ্ন।

মাথা ঝাঁকালো রবিন। পৌনে পাঁচটায় দেখানোর কথা, খবরের আগে। কাগজে তো তাই লিখেছে। কিন্তু এখন তো দেখছি পুরনো এক ওয়েস্টান হবি।

রকি বীচে ফিরেই সোজা এসে হেডকোয়ার্টারে ঢুকেছে তিন গোয়েন্দা।

রকিং চেয়ারে বসে টেবিলে পা তুলে দিয়েছে মুসা। আমার মনে হয়, কাপগুলো হারানোতেই অনুষ্ঠানটা দেখাচ্ছে না। কি বলো, কিশোর?

কিশোর জবাব দিলো না। ডেস্কের ওপাশের চেয়ারে হেলান দিয়ে আনমনে চিমটি কাটছে নিচের ঠোঁটে। গভীর চিন্তায় ডুবে আছে।

টেলিভিশন অফ করে দিলো রবিন। পর্দা থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল কালো হ্যাট পরা দুজন কাউবয়।

এখনও ওখানেই রয়েছে, চিন্তিত ভঙ্গিতে বললো কিশোর।

কারা? টুলে বসে দেয়ালে পিঠ দিয়ে আরাম করে বসলো রবিন।

কারা নয়, কি, শুধরে দিলো কিশোর। ওই কাপগুলো। এখনও ওখানেই আছে।

কোথায়? জিজ্ঞেস করলো মুসা।

স্টেজ নাইন থেকে আমরা চলে আসার আগে আমাদের সবার দেহতল্লাশি করেছে ওরা, কিশোর কললো। তারপর গেটের কাছে আরেকবার খুঁজেছে গাড়ির ভেতর। পায়নি। যারাই চুরি করে থাকুক কাপগুলো, স্টুডিও থেকে সরাতে পারেনি। তারমানে এখনও ওখানেই আছে, সাউন্ড স্টেজের কোথাও, লুকানো।

এই সাউন্ড স্টেজটা আসলে কি জিনিস? জানতে চাইলো মুসা। ওরকম নাম কেন?

কারণ, বুঝিয়ে দিলো কিশোর, বহুদিন আগে যখন কথা বলা সিসটেম চালু হলো সিনেমায়, তখন তাদের সেটকে সাউন্ডপ্রুফ করার প্রয়োজন হতো পরিচালকদের। সাউন্ড স্টেজটা সে-কারণেই দরকার।

ও। তা কাপগুলোর কথা ঠিকই বলেছে। কিন্তু থাকলে আমাদের কি? তোমারটা নিশ্চয় পেতে চাও না? রূপার একটা কাপ দিয়ে কি আর হবে?

তাছাড়া ওটাতে যে নাম লেখা আছে, সেটা তুমি শোনা তো দূরের কথা, মুচকি হেসে বললো রবিন, দেখতেও চাও না।…কিশোর, সত্যিই তুমি ভালো অভিনেতা।

আজ বিকেলে বোকার অভিনয় যা করলে না! হ্যারিস বেকারকে বুদ্ধ বানিয়ে ছেড়ে। দিয়েছে।

ওকে হেনস্তা করার কোনো ইচ্ছেই আমার ছিলো না। আসলে মড়ার খুলি আর শিকারী কুকুরকে বেকুব বানালাম।

কিভাবে? বুঝতে পারলো না মুসা।

তলোয়ার খেলার মতো। প্রতিপক্ষ যদি বোঝে তোমার তলোয়ারটা ভোতা, সামনে এগোতে আর দ্বিধা করবে না। তখন তার পেটে সহজেই তলোয়ার ঢোকাতে পারবে তুমি।

আরে বাবা একটু সহজ করে বলো না। দুই হাত তুলে নাচালো মুসা।

সহজ করেই তো বললাম। আমার শত্রুরা যদি ভেবে বসে আমি এতোই বোকা, নিজের নাম মনে রাখতে পারি না, তাহলে আমাকে পরাজিত করার জন্যে বেশি চেষ্টা করবে না। তখন ওদেরকে হারানো আমার জন্যে সহজ হয়ে যাবে।

বুঝলাম।

মাথ ঝাঁকালো রবিন। সে-ও এখন বুঝতে পেরেছে কিশোরের তখনকার ওই অত আচরণের কারণ।

যাই হোক, আগের কথার খেই ধরলো কিশোর, এই কাপ চুরির ব্যাপারটা পরিস্থিতি পালটে দিয়েছে অনেকখানি।

তারমানে, বলতে চাইছে, রবিন বললো, তদন্ত করার মতো একটা কেস পেয়ে গেছে?

কিন্তু বুঝতে পেরেছো? মুসা জিজ্ঞেস করলো।

কারও কথারই জবাব দিলো না কিশোর। নীরবে হাত বাড়ালো টেলিফোনের দিকে। একটা কার্ড দেখে নম্বর ডায়াল করলো। ওপাশ থেকে সাডা এলে বললো, হলো, ইজি রাইড লিমে? আমি কিশোর পাশা বলছি। আপনাদের একজন ড্রাইভার, অ্যালউড হোপার, তার সঙ্গে কথা বলতে চাই।

কিছুক্ষণ নীরবতার প্র লাইনে এলো হোফার।

হ্যালো, মিস্টার হোফার, কিশোর কললো, আবার রিক্ত করছি। এই মাত্র স্টুডিও থেকে খবর দিলো, আবার যেতে হবে আমাদেরকে। হা হা, এক্ষুণি। যদি চলে আসেনহ্যাঁ, গেটের কাছেই থাকবো।…থ্যাংক ইউ।

আবার যাচ্ছি? উঠে দাঁড়ালো মুসা। কিশোরের ডেস্কে দুহাত রেখে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো, কিন্তু ঢুকবোকিভাবে? ওরা তো তোমাকে ডাকেনি।

না, ডাকেনি, বলতে বলতে পকেট থেকে একটা কাগজ বের করলো কিশোর। কিন্তু আমাকে ঢুকতে দেবে ওরা, কারণ স্টুডিও পাস আছে। লিমুজিনের জানালা থেকে খুলে রেখে দিয়েছিলাম, আমাদেরকে যখন নামিয়ে দিয়ে গেল। তখন অবশ্য ভাবিনি আমাদেরকে আবার ঢুকতে হবে। হোফার আবার ঢুকতে পারে এই ভয়ে খুলে রেখেছিলাম।

আবার কেন যাচ্ছে, জিজ্ঞেস করেও জবাব পেলো না রবিন। চুপ করে থাকাই শ্রেয় মনে করলো। ইচ্ছে করে কিছু না বললে হাজার জিজ্ঞেস করেও কিশোরের কাছ থেকে জবাব পাওয়া যাবে না।

স্টুডিওর গেটে এসে পাস দেখাতেই কোনো প্রশ্ন না করে ওদেরকে ছেড়ে দিলো গার্ড। নয় নম্বর স্টুডিওর সামনে এসে থামলো গাড়ি নেই।

বড় জোর আধ ঘণ্টা লাগবে আমাদের, শোফারকে বললো কিশোর।

আচ্ছা, ঘাড় কাত করলো হোফার।

ছোট দরজাটার সামনে এসে দাঁড়ালো কিশোর। তালা লাগানো নেই। সব সময়ই খোলা থাকে এই স্টেজ, জানা আছে তার। কাজ করার জন্যে আবার সন্ধ্যা আটটার

সময় আসবে এখানে নাইট শিফটের কর্মীরা।

মস্ত ঘরটা এখন অন্ধকার। অনেক ওপরে রয়েছে ধাতব ব্যালকনি। ওখানে, গ্যানট্রিতে কয়েকটা ঝুলন্ত তারের খাঁচার ভেতরে জ্বলছে কয়েকটা বান্ধ।

কিশোরকে অনুসরণ করে রান্নাঘরে এসে ঢুকলো মুসা আর রবিন। টর্চ জ্বেলে দেয়ালগুলো পরীক্ষা করতে আরম্ভ করলো গোয়েন্দা প্রধান।

নরম সুরে নিজের সঙ্গেই কথা বলতে লাগলো সে, টেবিলটা ছিলো এখানে। লাঞ্চের পর নিয়ে যাওয়া হলো ওই দিকে, এখানে এনে পাতা হলো কতগুলো সুইভেল চেয়ার। আর তখন নিশ্চয় সোনালি বাস্কেট ছিলো সেটের বাইরে…।

সেটের দরজার দিকে এগিয়ে গেল সে। এই দরজা দিয়েই বাক্স নিয়ে ঢুকেছিলো লাল চুল মেয়েটা। দরজা খুলে ওপাশে এলো কিশোর, সঙ্গে সঙ্গে এলো দুই সহকারী।

কয়েক ফুট দূরের একটা টেবিলে আলো ফেলে বললো সে, বাক্সটা হয়তো ওটার ওপরেই রাখা ছিলো। কিন্তু আমরা রান্নাঘরে থাকার সময় একবারও ভোলা হয়নি এই দরজা, শুধু বাক্স নিয়ে অ্যানি ঢোকার সময় ছাড়া। ওয়েইটার, ক্যামেরাম্যান সবাই রান্নাঘরে ঢুকেছে সেটের খোলা অংশ দিয়ে, আমরা যেদিক দিয়ে ঢুকেছি। তাছাড়া সারাক্ষণ লোক ছিলো ওখানে, কর্মীরা। সুতরাং, রবিন আর মুসার দিকে ঘুরলো সে, তোমাদের কি মনে হয়?

কাপগুলো যে-ই চুরি করুক, রান্নাঘরে নিয়ে গিয়ে লুকাতে পারেনি, মুসা বললো। তা করতে হলে ওগুলো নিয়ে সবার সামনে এই দরজা দিয়ে বেরোতে হতো, যেটা করা সত্ব ছিলো না।

হ্যাঁ। মাথা ঝাঁকালো কিশোর। ধরা যাক, আমি চোর। ক্যানভাসে তৈরি রান্নাঘরের দেয়াল ঘুরে খোলা জায়গায় চলে এলো সে, যেখানে লাঞ্চের সময় কর্মীরা দাঁড়িয়ে ছিলো। আমি এখানে ছিলাম, এবং আমাকে ঘিরে ছিলো অনেক লোক। কিন্তু যদি বাক্সটা নিয়ে আমি ওদিকে ওই টেবিলের দিকে চলে যাই, আমাকে কেউ দেখবে। সামনের দিকে টর্চের আলো ফেললো সে। তারপর এগিয়ে গেল টেবিলটার দিকে।

রান্নাঘরের দরজা তখন লাগানো। কাজেই এখানে হুট করে কারও চলে আসার। ভানা ছিলো না। কাজেই বাক্স খুলে কাপগুলো বের করে আবার ওটা সোনালি কাগজে মুড়ে রাখার যথেষ্ট সময় আমি পেয়ে যেতাম। সঙ্গে করে একটা চটের বস্তাটস্তা কিছু নিয়ে এলে ওগুলো ভরে ফেলতে পারতাম। কিন্তু সবার চোখের ওপর দিয়ে ওটা বের করে নিয়ে যেতে পারতাম না, কাজেই…

কাজেই এখানেই কোথাও লুকিয়ে রাখতে হতো, কথাটা শেষ করে দিলো রবিন। ওর টর্চ বের করে জ্বাললো। আলো ফেলতে লাগলো কতগুলো তারের কুণ্ডলী, কিছু রঙের টিন, নানারকম মালপত্রের একটা দুই ফুট চওড়া, চার ফুট লম্বা স্তূপের ওপর। সব শেষে আলো ফেললো পাশের একটা ভারি কাঠের বাক্সের ওপর।

ওটার ওপর আলো ধরে রাখলো কিশোর। তার দুই সহকারী এগিয়ে গেল বাক্সের দিকে। ভেতরে ছুতোর মিস্ত্রীর কয়েকটা যন্ত্রপাতি ছাড়া আর কিছু নেই। মালপত্রের স্তূপ আর রঙের টিনের ভেতরেও কিছু পাওয়া গেল না।

ফিরে তাকালো রবিন আর মুসা। কিন্তু কিশোর ওদের দিকে তাকিয়ে নেই। সে গিয়ে দাঁড়িয়েছে একটা আর্ক লাইটের ধাতব স্ট্যান্ডের কাছে। হাত দিয়েই খোলালাগানো যায় এরকম বড় বড় গুলো পরীক্ষা করছে।

হঠাৎ স্থির হয়ে গেল সে। ঝট করে চোখ তুলে তাকালো কয়েক ফুট ওপরের কালো বড় বাক্সটার দিকে, যেটাতে রিফ্লেক্টর ভরা থাকে।

এই এদিকে এসো, সাহায্য করো আমাকে।

তাড়াতাড়ি এগিয়ে এলো দুই সহকারী। ক্রুগুলো ঢিল করে বাক্সটা নিচে নামাতে সাহায্য করলো কিশোরকে। বারের হুড়কো খুলে ভেতরে হাত ঢুকিয়ে দিলো গোয়েন্দাপ্রধান।

হঠাৎ যেন রাতের আকাশে সূর্য উঠলো। দপ করে জ্বলে উঠলো হাজার ভোল্টের অসংখ্য বাতি, অন্ধকারের চিহ্নমাত্র রইলো না সেটের কোথাও। আলোর বন্যায় ভেসে গেল সমস্ত রান্না।

<

Super User