লাঞ্চ টেবিলটা পরিষ্কার করে সরিয়ে নেয়া হলো। তার জায়গায় এনে অর্ধচন্দ্রের আকারে গোল করে রাখা হলো সুইভেল চেয়ার।
মাঝখানের চেয়ারটায় বসলো হ্যারিস বেকার, অনেকটা উপস্থাপকের ভূমিকা নেবে সে। কিংবা বলা যায় গৃহকর্তার। তার একপাশে নেলি, আরেক পাশে মড়ার খুলি। কিশোর বসেছে একমাথায়, শিকারী কুকুরের পাশে। অন্য মাথায় ভারিপদ।
জ্বলে উঠলো আর্কলাইট। কিশোরের মনে হলো, তার ওপর এসে পড়লো আধ ডজন খুদে সূর্যের রোদ। খুব কমই খেয়েছে সে। মাত্র একটুকরো মুরগীর মাংস আর একচামচ পট্যাটো সালাদ। নার্ভাস হয়ে গিয়েছে বলে খায়নি তা নয়। অন্য চিন্তায় ব্যস্ত তার মন, খাবারের কথা ভাবার সময় নেই যেন। ভ্রাম্যমাণ নিয়ন্ত্রণ কক্ষে বসে যখন শুটিঙের নির্দেশ দিলেন সাইনাস, তখনও গভীর চিন্তায় ডুবে রইলো সে। যে করেই হোক কুইজ শোতে জিততে হবে তাকে। প্রায় কথাই বলছে না কারো সাথে।
অন্যেরা সবাই গল্প করছে। কিন্তু কিশোর তাতে যোগ দিলো না। সে শুধু শুনছে। মড়ার খুলি, ভারিপদ, আর শিকারী কুকুরের ব্যাপারে অনেক কথাই জেনে ফেলেছে, ওদের আলোচনা থেকে। কিন্তু ওরা তার ব্যাপারে কিছুই জানতে পারেনি এখনও।
গুড ইভনিং, হাসি হাসি গলায় কললো বেকার। শো শুরু হলো।
নড়েচড়ে বেড়াতে লাগলো তিনটে টেলিভিশন ক্যামেরা। ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন সাইনাস। নানারকম কাজ করতে হচ্ছে প্রায় একই সঙ্গে।
কয়েকজন পুরনো বন্ধুর সঙ্গে নতুন করে আবার পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি আপনাদের, ক্যামেরার চোখের দিকে তাকিয়ে বললো বেকার। কয়েক হপ্তা ধরেই এদের ছোটবেলার অভিনীত ছবি দেখছেন আপনারা। হাজার হাজার চিঠি লিখেছেন আমাদের কাছে। জানতে চেয়েছেন ওরা কে কোথায় কেমন আছে। আপনাদের অনুরোধেই আজ ওদেরকে আমাদের স্টুডিওতে হাজির করেছি।
এক মুহূর্ত থামলো বেকার। রোদেপোড়া মুখে বিদ্যুতের মতো ঝিলিক দিয়ে উঠলো তার দাঁতের সারি। পাগল সংঘের পাগল এরা সবাই।
বলে যেতে লাগলো সে, পাগলদের একজনকে, যাকে শজারুকাঁটা বলে চেনেন দর্শকরা, তাকে হাজির করতে পারেনি বলে কতোখানি দুঃখিত। দুঃখটা অবশ্যই হাসিমুখে প্রকাশ করলো সে। টেলিভিশনের ঘোষক তাদের অনুষ্ঠান যান্ত্রিক গোলযোগের কারণে কয়েক মিনিট দর্শকরা দেখতে পাননি বলে যেমন দরাজ হাসি হেসে আন্তরিক দুঃখ প্রকাশ করে অনেকটা সে-রকম ভাবে। শজারুকাঁটাকে খুঁজে রে করতে সাধ্যমতো চেষ্টা করা হয়েছে, কলহে বেকার, কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় ক্যালিফোর্নিয়ায় নেই সে। কোথায় গেছে খুঁজেও ব্বে করা যায়নি।
হয়তো জেলে গেছে, মড়ার খুলি বললো।
মৃদু হেসে তার কথা এড়িয়ে গেল বেকার। এক এক করে দর্শকদের সামনে নিজেদের পরিচয় দিতে অনুরোধ করলো পাগলদের।
নেলি বললে প্রথমে, আমি ছিলাম বটিসুন্দরী। কিন্তু সেটা অনেক দিন আগে। এখনও আমি শুধুই নেলি।
কি যে বলো, তার দিকে তাকিয়ে হাসলো বেকার। এতে বিনয়ের দরকার নেই। এখনও তুমি সুন্দরী, রং আগের চেয়ে বেশি। হরি মতো সুন্দর।
নেলি হাসলো না। এখন আর আগের মতো বোকামি করি না আমি। বরং বুদ্ধিমত্তার জন্যে প্রশংসাই পাই।
বেকারের ফিকফিক হাসিটা কেমন শূন্য শোনালো কিশোরের কানে। চেয়ারে হেলান দিলো সে। ক্যামেরার চোখ ছাড়িয়ে তাকালো ইলেকট্রিশিয়ানদের দিকে, যারা কিছু জটিল ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি নিয়ন্ত্রণ করছে। এদের মাঝেই রয়েছে রবিন আর মুস। কিশোর জানে, কোনো ক্যামেরাই এখনও তার দিকে তাকায়নি। কারণ নেলির পর পরিচয় দেয়ার পালা আসবে মড়ার খুলির। দুই সহকারীর দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে, চোখ টিপলো সে।
ওদেরকে বোঝানোর চেষ্টা করলো, ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে সে যা-ই বলুক, যাই করুক, ওরা যেন অবাক না হয়। রবিনের দৃষ্টিই বুঝিয়ে দিলো, সে ইশারাটা ধরতে পেরেছে।
সামান্য ডানে সরলো কিশোরের নজর। আরেকটা পরিচিত মুখ চোখে পড়লো। অ্যালউড হোফার। সাউন্ড স্টেজের ওপর দিয়ে নিঃশব্দে হেঁটে যাচ্ছে লম্বা দণ্ডের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকটা আর্ক লাইটের দিকে। আলোগুলো এখন ব্যবহার হচ্ছে না।
আমি ছিলাম মাথা কামানো, পরিচয় দিচ্ছে মড়ার খুলি। বোকার ভাণকরতাম। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে বেকারের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, খুব একটা বদলেহি বলে কি মনে হয় আপনার?
প্রশ্নের জবাব না দিয়ে হাসিমুখে পাল্টা প্রশ্ন করলো বেকার, তোমার নামই ছিলো মড়ার খুলি, তাই না?
হ্যাঁ। তবে আপনি নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন, বোকর ভাণ করে থাকতাম বলেই আমি বোকা নই। আসলে ভালো অভিনেতা। বুদ্ধি বেশি।
তার পর পরিচয় দিলো শিকারী কুকুর, এবং তারও পরে ভারিপদ। এমন শুকনো গলায় নিজেদের উপাধি বললো, যেন বহুবার এক কথা বলতে বলতে বিরক্ত হয়ে গেছে।
শিকারী কুকুর।
ভারিপদ।
ভারিপদকে নাড়া দিয়ে কিছুটা ভেজানোর চেষ্টা করলো যেন বেকার, কেন, তোমাকে ভারিপদ বলা হতো কেন?
কারণ ওই নামেই আমাকে ডাকতো সবাই।
তাতো ডাকতো। কিন্তু কেন?
কারণ ক্রিষ্টে তাই লেখা ছিলো, ডাকতে বলা হয়েছে।
মুহূর্তের জন্যে বেকারের দাঁতের বা অর্ধেক নিভে গিয়ে আবার জ্বলে উঠলো। কিশোরের দিকে ফিরলো। তুমি কে?
হাসিটা ফিরিয়ে দিলো কিশোর। তোতলাতে লাগলো, কি-কি-কি-কি-কিশোর পাশা!
হ্যাঁ। এখন তা-ই। তখন কি ছিলে?
কি-কি-কি-কি-কিশোর পাশা। সব সময়ই আমি কি-কি-কি-কিশোর পাশা। কুঁচকে গেছে তার কপাল। একেবারে বুদ্ধ বনে গেছে যেন। গোয়েন্দাগিরি করতে গিয়ে বহুবার দেখছে, বোকার ভাণ করে থাকলে অনেক ফল পাওয়া যায়।
বেকার যখন আবার জিজ্ঞেস করলো, পাগল সংঘে কিসের অভিনয় করতো, জবাবে কিশোর জানালো, বাবা-বাচ্চার। কথা আমার খুব বেশি ম-ম-ম-মনে থাকে না।
অবশেষে বেকারকেই কিশোরের পরিচয় করিয়ে দিতে হলো দর্শকদের কাছে। কিশোর পাশাই ছিলো মোটুরাম। অনেক দর্শকই স্বীকার করবেন, পাগল সংঘের প্রাণ ছিলো সে-ই। খুব বড় অভিনেতা।
পরিচয়ের পালা শেষ হলে বেকার জিজ্ঞেস করতে লাগলো, কে কি কাজ করছে এখন।
আমি রিসিপশনিস্ট, নেলি জানালো। স্যান ফ্রানসিসকোর এক অফিসে।
নিশ্চয় খুব ভালো রিসিপশনিস্ট তুমি। লোকে অফিসে ঢুকে ওরকম সুন্দর একটা মুখ দেখে নিশ্চয় খুশি হয়। অনেক মিষ্টি হাসি নিশ্চয় উপহার পাও তুমি।
না, মাথা নাড়লো নেলি। দাঁত তোলার আগে রোগীর মুখের অবস্থা দেখেছেন? ওরকম করে রাখেমুখ।
কথার খেই হারিয়ে ফেললো বেকার। শুরু করার আগেই কথা থামিয়ে দিলো মেয়েটা। অন্য ভাবে চেষ্টা করে দেখলো সে, অভিনয় তো ভালোই করতে। একেবারে ছেড়ে দিয়েছো নাকি?
আমি অভিনয় ছাড়িনি, বরং অভিনয়ই আমাকে ছেড়েছে। দশবহুর বয়েসের পর থেকে নতুন আর কোনো ছবিতে অভিনয়ের অনুরোধ আসেনি আমার কাছে।
তারমানে তোমার মা-বাবা চেয়েছেন ইস্কুলে গিয়ে লেখাপড়া শিখে তুমি সাধারণ জীবন যাপন করো…
আবার মাথা নাড়লো নেলি। না, তা তারা চায়নি। চাপ দিয়ে বার বার আমাকে ওরা অভিনয়ের দিকেই ঠেলে দিতে চেয়েছে। সাধারণ জীবন যাপন করার উপায় ছিলো না আমার।
কেন? সেকথা জিজ্ঞেস করার আগেই নেলি জবাব দিয়ে দিলো, লোকে আমাকে দেখলেই টিটকারি দিয়ে তো বটিসুন্দরী, বটিসুন্দরী। বহু বছর ওদের জ্বালায় রাস্তায় বেরোতে পারিনি আমি, ইস্কুলে তো আরও খারাপ অবস্থা। কি করতো, বলবো?
হাসিমুখে মাথা ঝাঁকালো বটে বেকার, কিন্তু তার চোখ দেখেই কিশোর বুঝলো, নেলি খুলে বলুক সেটা মোটেও চায় না সে।
নেলিও কললো না। বললো, যদি কখনও আমার বাচ্চা হয়, তাকে কর খোঁড়ার কাজ শিখতে বলবো রং, তবু অভিনেতা হতে দেবো না। কবর খোঁড়ার মাঝেও অন্তত কিছুটা শান্তি আর ভবিষ্যৎ আছে।
ভবিষ্যতের কথাই যখন বলছে, প্রসঙ্গ থেকে সরে যাওয়ার সুযোগটা হাতছাড়া করলো না বেকার, তখন তোমার নিজের কথাই বলো। কি করবে ভাবছো?
এই প্রথম তার দিকে তাকিয়ে হাসলো নেলি। টাকা জোগাড় করতে পারলে কলেজে ভর্তি হবো। এই সুন্দর চেহারা নিয়ে মহা অশান্তিতে আছি আমি। চেহারার চেয়ে মন আর মগজটা সন্দর হলে সেটা বরং আমার অনেক কাজে লাগবে।
তা লাগবে।
নেলির সঙ্গে আলোচনা শেষ করতে পেরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো বেকার। মড়ার খুলির দিকে ফিরলো। সে যদি ভেবে থাকে তার সাথে আলোচনাটা নেলির চেয়ে সহজ হবে, তাহলে ভুল করেছে। জানা গেল একটা মোটর গ্যারেজে মেকানিকের চাকরি
কিভাবে কি করে জানতে চেয়ে বেকার পড়লো বিপদে। মড়ার খুলি ঝাঁঝালো গলায় বললো, অন্যের গাড়ির নিচে সারাদিন চিত হয়ে পড়ে থাকি আমি। আমার নাকেমুখে টপ টপ করে ঝরে পড়ে পোড়া তেল। সারা গায়ে তেলকালি লেগে যায়। আঙুল, এমনকি নখের ভেতরে গ্রীজ ঢোকে। ওই আঙুল দিয়ে যখন র্যাঞ্চ ধরার চেষ্টা করি।
তাড়াতাড়ি অন্য প্রসঙ্গে চলে গেল বেকার। আবার কি অভিনয়ের জগতে ফিরে আসতে চাও? তুমিই বললে তুমি খুব ভালো অভিনেতা।
অভিনয়? ফুহ! আপনি জানেন, এই শহরে কতোজন অভিনেতা না খেয়ে মরতে বসেছে?
জানে না বেকার। আর জানলেও সেটা নিয়ে আলোচনা করতে চায় না। আচ্ছা, তুমি কি কখনও নেলির মতো বিপদে পড়েছো? মানে, রাস্তায় জ্বালাতন করেছে লোকে?
ওরকম জ্বালায় পড়েনি একথা স্বীকার করতে বাধ্য হলো মড়ার খুলি। বললো, অভিনয় ছেড়ে দেয়ার পর আর মাথা কামালাম না। চুল গজিয়ে গেল। আমার বিখ্যাত কানদুটোও ঢেকে গেল চুলে। চেহারা এমন বদলে গেল, তখন হঠাৎ আমার নিজের মাও দেখলে চিনতে পারতো কিনা সন্দেহ। লোকে চিনতেও পারলো না, যন্ত্রণা থেকেও বাঁচলাম।
ভবিষ্যতে কি করার ইচ্ছে প্রশ্ন করে অহেতুক বিপদে পড়তে গেল না বেকার। ভারিপদের দিকে ফিরলো। সে জানালো, বেশির ভাগ সময়ই বেকার থেকেছে সে, কাজ পায়নি। তবে শিকারী কুকুর অবাক করলো বেকারকে। সে জানালো হাই স্কুল থেকে গ্র্যাজুয়েশন নিয়ে কলেজের ফার্স্ট ইয়ারে পড়ছে।
বেকারের প্রশ্ন ছাড়াই সে বলে গেল, আমি একদিক থেকে ভাগ্যবান। আমার বাবা উকিল। তিনি কখনোই আমাকে অভিনেতা বানাতে চাননি। তার এক শাসালো মক্কেলের চাপাচাপিতেই ছেলেকেলায় আমাকে অভিনয় করতে দিতে রাজি হয়েছিলেন। কিন্তু কিছুদিন পর যখন বুঝলেন, এসব করে আমার ভবিষ্যৎই শুধু ঝরঝরে হবে, লাভ কিছু হবে না, আমাকে অভিনয়ের জগত থেকে ছাড়িয়ে এনে ইস্কুলে ভর্তি করে দিলেন।
বেকার জানতে চাইলো, অভিনয় ছেড়ে দেয়ার পর রাস্তায় বিপদে পড়েছে কিনা শিকারী কুকুর।
পড়েছি, জানালো সে, তবে বেশি দিন না। পাগল সংঘে আমি বোধহয় খুব একটা চোখে পড়ার মতো চরিত্র ছিলাম না। লোকে শীঘ্রি ভুলে গেল আমার কথা।
এরপর এলো কিশোরের জবাব দেয়ার পালা।
তুমি কি করছো? বেকার জিজ্ঞেস করলো।
শূন্য দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইলো কিশোর, যেন প্রশ্নটা বুঝতে পারছি না। বোকার মতো কললো, কই, কিছুই তো করছি না। চুপচাপ বসে রয়েছি।
এখানে বসে থাকার কথা বলছি না। জীবনে কি করছো?
র-র-রকি বীচে বাস করছি।
ওখানে থেকে কি করো?
প্রশ্নটা যেন খুব অবাক করলো কিশোরকে। মাথা চুলকালো, চেয়ারে নড়েচড়ে বসলো। অবশেষে স্বীকার করলো বাড়ি থেকে বেরিয়ে মাঝে মাঝে স-স-স-সৈকতে সা-সঁ-আঁ তার কাটতে যায়।
ইস্কুলে যাও না? কোনো কিছুই যেন হ্যারিস বেকারে হাসিতে চির ধরাতে পারে। তবে গলায় সামান্য অধৈর্য ভাব ফুটলো।
গ-গ-গরমের ছুটিতে যাই না।
ভবিষ্যতে কিশোরের কি করার ইচ্ছে জিজ্ঞেস করে বিপদে পড়তে চাইলো না বেকার। আর কিছু আপাতত জিজ্ঞেস করলো না তাকে।
তবে এখনও নির্দিষ্ট সময় শেষ হতে বারো মিনিট বাকি। ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে হাসলো বেকার। এখন ওদের অতীত সম্পর্কে আমি কিছু জিজ্ঞেস করবো, ঘোষণা করলো সে। আমার বিশ্বাস, পাগল সংঘে অভিনয় করার সময়কার মজার কোনো ঘটনার কথা ওরা বলতে পারবে।
আবার নেলিকে দিয়ে শুরু হলো।
আমার শুধু মনে আছে নাপিতের কথা, নেলি বললো। এতো জোরে ব্রাশ ঘষতো আমার মাথায়, মনে হতো চামড়া ছিলে ফেলবে।
মড়ার খুলির মনে পড়লো সম্মানী দেয়ার দিনের কথা। প্রতি শুক্রবার রাতে পেতাম আমরা। চেক নয়, নগদ টাকা। বাদামী খামে ভরা থাকতো, লাল সুতো দিয়ে বাঁধা।
নিশ্চয়ই সেটা তোমার জন্যে খুব আনন্দের দিন ছিলো? বেকার বললো হেসে।
মোটেও না। আনন্দের ছিলো আমার বাবার জন্যে। সারা হপ্তায় ওই একবারই স্টুডিওতে আসতো, আমার কাছ থেকে খামটা কেড়ে নেয়ার জন্যে।
ভারিপদর মনে পড়লো বড় জুতোর কথা। এতে বড় জুতো পরতে দেয়া হতো আমাকে, ঢলঢল করতো। পায়ে আটকে রাখার জন্যে ভেতরে কাপড় পুরে দিতে ওরা। একজোড়া জুতো এখনও আছে, এখনও পায়ে ঢিলে হয়।
শিকারী কুকুরের মনে পড়লো, যেদিন স্টুডিওতে কোনো কাজ থাকতো না, সেদিন তার বাবা তাকে বেড়াতে নিয়ে যেতেন সৈকতে। কিংবা খেলতেন ছেলের সঙ্গে। তার যদি সেদিন কোনো কাজও থাকতো, সেটা করতেন না, ছুটি নিতেন। শেষের দিকে তো দিন গুনতে আরম্ভ করেছিলাম আমরা দুজনেই, কবে অভিনয়ের কন্ট্রাক্ট শেষ হবে, বললো সে।
কিশোর কিছুই মনে করতে পারলো না। বললো, আমি তখন খুব বা-বাবাবাচ্চা। তোতলাতে তোতলাতে আরও জানালো, তার স্মৃতিশক্তি খুবই দুর্বল, কিছুই মনে রাখতে পারে না। কয়েক হপ্তা আগে টিভিতে পাগল সংঘ দেখানোর আগে নাকি জানতোই না সে, কখনও তার নাম মোটুরাম ছিলো। তা-ও টেলিভিশনে সে দেখেনি। কে জানি একজন এসে-কে সেটাও মনে করতে পারছে না-তাকে বললো, তার নাম মো-মো-মো মোটুরাম।
শুনে নিশ্চয় অবাক লেগেছিলো তোমার, শূন্য হাসি হেসে বললো বেকার। হঠাৎ এক বিস্ময়কর তথ্য উদঘাটিত হওয়ায়?
বিস্ময়কর তথ্য উদ্ঘাটিত বলে একটা নাটকীয় আবহ আনতে চেয়েছিলো কোর, কিন্তু বলেই বুঝলো মস্ত ভুল করে ফেলছে। শুব্দগুলোর মানে যখন বোঝেতে পারলো সে অনেক চেষ্টার পর, তখন আর মাত্র তিন মিনিট বাকি আছে আলোচনা শেষ হতে।
উঠে দাঁড়িয়ে ক্যামেরার দিকে তাকালো বেকার।
এখন সবাইকে একটা সারপ্রাইজ দেবো, চওড়া হাসি হাসলো সে। আমাদের এই অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার জন্যে পাগলদের সবাইকে অনেক অনেক ধন্যবাদ। প্রত্যেককে একটা করে সুতনির উপহার দেবো, দেখে এই অনুষ্ঠানের কথা মনে করার জন্যে। অ্যানি, নিয়ে এসো প্লীজ।
মাথা সামান্য কাত করে তাকালো সে। রান্নাঘরের দরজা দিয়ে ঢুকলো একটা সুন্দরী মেয়ে, মাথায় লাল চুল, পরনে খাটো স্কার্ট। হাতে একটা চারকোণা বড় বাক্স, সোনালি কাগজে মোড়া।
বাক্সের ডালাতোলার আগে এক সেকেন্ড দ্বিধা করলো বেকার। তোমাদের প্রত্যেককে একটা করে খুব দামী উপহার দেয়া হবে, তার সব চেয়ে উষ্ণ আর চওড়া হাসিটা উপহার দিয়ে নিলো আগে সবাইকে। সারা জীবন ওটাকে রত্ন মনে করে রেখে দিতে পারবে তোমরা।
উপহারটা কী, বলার আগে আবার এক সেকেন্ডের জন্যে থামলো বেকার। তারপর বললো, রূপার একটা করে চমৎকার কাপ, তার ওপর তোমাদের নাম খোদাই করা, অবশ্যই পাগল সংঘের দেয়া নাম। যখনই দেখবে, মনে মনে হাসবে, আর মনে করবে একসময় কি প্রচণ্ড খ্যাতিই না পেয়েছিলো সিরিজটা।
বাক্সটা অ্যানির হাতে রেখেই ভেতরে হাত ঢুকিয়ে দিলো বেকার। প্রায় থাবা দিয়ে ছিনিয়ে নিলো বাক্সটা। এপাশ-ওপাশ নাড়া দিলো জোরে জোরে। হাত থেকে পড়ে গেল ওটা, মাটিতে পড়ে কাত হয়ে খোলা মুখ করে রইলো ক্যমেরার দিকে।
শূন্য বাক্স। দামী রূপার কাজ তো দূরের কথা, কোনো জিনিসই নেই বাক্সের ভেতরে।
বেকারের মুখের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো কিশোর। লোকটার সঙ্গে সাক্ষাৎ হওয়ার পর এই প্রথম দেখতে পেলো সে, তার মুখে হাসি নেই।
হাসছে না হ্যারিস বেকার।
<