হলিউডের ভাইন স্ট্রীট গেটের সামনে লিমুজিনটাকে থামতেই হলো। শোফারকে চেনে ইউনিফর্ম পরা গার্ড, তবু থামালো। গাড়ির পেছন দিকে এসে পেহুনের সীটে বসা তিন কিশোরকে দেখলো, হাতে একটা লিস্ট। নাম-ঠিকানা মিলিয়ে নেয়ার জন্যে ওদের নাম জিজ্ঞেস করলো।

কিশোর পাশা, বললো কিশোর। মনে মনে ঠিক করে রেখেছে, মোটুরাম শব্দটা শুধু উচ্চারণ করলেই গার্ডের সঙ্গে তর্ক বাধিয়ে দেবে।

কিন্তু তাকে রাগানোর মতো কিছুই বললো না গার্ড। লিস্ট দেখে পড়লো, কিশোর পাশা। পঁয়তাল্লিশ সাইজ রোড, রকি বীচ। ঠিক আছে?

ঠিক আছে, কিশোর বললো।

মাথা ঝাঁকিয়ে অন্য দুজনের দিকে তাকালো গার্ড।

আমি মুসা আমান।

রবিন মিলফোর্ড।

দুজনের নাম-ঠিকানা মিলিয়ে নিয়ে আবার মাথা ঝাঁকালো গার্ড। সামনের জানালার কাঁচে ওয়াইপারের নিচে একটা সাদা কার্ড লাগিয়ে দিলো সে। চিনতে পারলো কিশোর, স্টুডিওতে ঢোকার পাস।

হাত নেড়ে গার্ড বললো, নয় নম্বর স্টেজ।

ধীর গতিতে গাড়ি চালালো শোফার। পেরিয়ে এলো নিউ ইয়র্ক পাবলিক লাইব্রেরি। তারপর পুরনো স্যান ফ্রানসিসকো অপেরা হাউস। ওটার পর পিসার লীনিং টাওয়ার বা হেলানো স্তম্ভ-পৃথিবীর সপ্ত আশ্চর্যের একটা।

এসবই পরিচিত কিশোরের। যেন স্বপ্নের ভেতর থেকে বাস্তব হয়ে ফুটে বেরিয়ে আসহে ধীরে ধীরে বস্তুগুলো। গলা বাড়িয়ে তাজ্জব হয়ে বিল্ডিংগুলো দেখছে রবিন আর মুসা। কিন্তু কিশোর জানে, ওগুলো আসল নয় কোনোটাই। এমনকি বাড়িও নয়। ক্যানভাস আর প্লাস্টার দিয়ে তৈরি, আসল জিনিসের নকল, তাও শুধু সামনের অংশ। যে কোনোটার রজা খুলে ভেতরে তাকালে দেখা যাবে অন্য পাশে কিছু নেই, ফাঁকা।

লম্বা, কালো গাড়িটায় সীটে হেলান দিয়ে বসে আছে সে। বাইরে তাকানোরও প্রয়োজন বোধ করছে না।

কিশোরকে তার বাড়ি থেকে তুলে নিতে এই গাড়ি পাঠিয়েছে হ্যারিস বেকার। যে দুদিন কুইজ হবে, সেই দুদিনের জন্যে গাড়ি আর শোফার দিয়ে দেয়া হয়েছে কিশোরকে।

রাশেদ চাচা আর মেরিচাচীকেও লাঞ্চে দাওয়াত করেছিলো বেকার, কিন্তু তাঁরা আসতে রাজি হননি। বলে দিয়েছেন সময় নেই। কিশোরকে গোপনে বলেছেন মেরিচাচী, মাঝেসাঝে দুএকটা ছবি যে আমার ভাল্লাগে না, তা নয়। কিন্তু যখনই মনে হয় সব বানানো ব্যাপার, আর দেখতে ইচ্ছে করে না।

তার সাথে একমত হলেন রাশেদ পাশা।

তবে রবিন আর মুসা তা হতে পারলো না। ওরা স্টুডিওতে যাওয়ার কথা শুনেই লাফিয়ে উঠলো। আর খুশি হয়েই ওদেরকে সঙ্গী করে নিলো কিশোর।

স্টুডিও এলাকার ভেতরে ঘন্টায় পাঁচ মাইলের বেশি গতিতে গাড়ি চালানোর নিয়ম নেই। কাজেই শামুকের গতিতে অনেকক্ষণ লাগিয়ে এসে হঠাৎ থেমে গেল লিমুজিন। কিশোর ভাবলো, সাউন্ড স্টেজ-এর সামনেই বুঝি গাড়ি থেমেছে, যেখানে লাঞ্চ খাওয়া হবে। কিন্তু না, থেমেছে কতগুলো উত্তর আমেরিকান আদিবাসীদের কুটিরের সামনে। ওগুলোর সামনে দিয়ে হেঁটে গেল দুজন মধ্যযুগীয় রোমান সৈনিক, হাতে ঢাল, কাঁধে বর্শা।

শোফারের নাম অ্যালিউড হোফার, কিশোরদেরকে তা-ই বলেছে। তার পাশের জানালার কাচ নামিয়ে মুখ রে করলো বাইরে। একজন সৈনিককে জিজ্ঞেস করলো, এই যে ভাই, নয় নম্বর স্টেজ কোনটা বলতে পারেন?

কিশোরকে জিজ্ঞেস করলেই হতো, সে-ই বলতে পারতো। কিন্তু আগ বাড়িয়ে কিছু বলতে গেল না। বললো না, ওই নয় নম্বর স্টেজেই পাগল সংঘের শুটিং হতো। দেরি হয় হোক, তাড়াতাড়ি গিয়ে মড়ার খুলি আর ডারিপদের সঙ্গে বেশি সময় কাটানোর কোনো ইচ্ছেই তার নেই।

এই পথের শেষ মাথায়, হাতে তৈরি পুরনো আমলের একটা সিগারের মাথা দিয়ে পথ-নির্দেশ করলো সৈনিক।

গেলেই পেয়ে যাবেন, বললো দ্বিতীয় সৈনিক। অসুবিধে হবেনা।

ওদেরকে ধন্যবাদ জানিয়ে আবার এগিয়ে চললো শোফার। পথের শেষ মাথায় দেখা গেল বিমান রাখার হ্যাঙারের মতো দেখতে সাদা একটা বিরাট বাড়ি। একপাশে বড় করে আঁকা রয়েছে ৯।

গাড়ি থেকে নেমে পেছনের দরজা খুলে ধরলো শোফার।

নেমে ওকে ধন্যবাদ জানালো কিশোর। আরেকবার তাকালো লম্বা, স্বাস্থ্যবান তরুণ লোকটার দিকে। দেখে বোঝার চেষ্টা করলো, চকচকে পালিশ করা জুতো পরা, কালো লম্বা চুল আর কালো চামড়ার এই অ্যালউড হোফার নামের মানুষটা কেমন হতে পারে।

নয় নম্বর স্টেজে ঢোকার দরজাটা বাড়িটার তুলনায় ছোট, ভারি। একপাশে লাগানো ধাতব খিল। ভারি রিঙ থেকে ঝুলছে একটা বড় তালা। মাথার ওপরের দুটো আলোর দিকে তাকালো কিশোর। তার জানা আছে, লাল আলোটা যদি জ্বলে, তাহলে খোলা যাবে না দরজা, অর্থাৎ খোলার নিয়ম নেই। ভেতরে কাজ চলছে।

কিন্তু লালটা জ্বলছে না এখন, জ্বলছে সবৃক্ট। তারমানে ঢোকা যায়। পাল্লা ঠেলে খুলে ভেতরে পা রাখলো কিশোর। পেহনে এলো মুসা আর রবিন।

সব পরিচিত এখানকার। কিশোরের মনে হলো, এই তো সেদিন এসেছিলো এখানে অভিনয় করতে। মাঝখানে এতগুলো বছর যে পেরিয়ে গেছে মনেই হলো না তার। ঠিক আগের মতোই এখনও রয়েহে রঙের তাজা গন্ধ, বড় বড় আর্ক ল্যাম্পের তাপ। আগের মতোই সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠলো কতগুলো কণ্ঠ, এই যে মোটুরাম এসে গেছে! এই ডাকটা জীবনে আর শুনতে হবে কখনও ভাবেনি সে।

প্রেস ফটোগ্রাফাররা ঘিরে ধরলো তাকে। দুই-তিন মিনিট নীরবে ধৈর্য ধরে দাঁড়িয়ে রইলো সে, ওদের ফ্যাশানের আলোর অত্যাচার সহ্য করলো। সহ্য করলো ওদের জ্বালা ধরানো কথাঃ হাসসা, মোটুরাম। এদিকে একটু তাকাও, মোটুরাম। আরেকবার, আরেকবার হাসো, মোটুরাম।

অবশেষে শেষ হলো ছবি তোলা। ওদেরকে ঠেলে হাসিমুখে এগিয়ে এলো হ্যারিস বেকার, তার ভালুক্সে থাবা ফেললো কিশোরের কাঁধে। কিশোর, এসো এসো, ওরা তোমার অপেক্ষা করছে। পাগল সংঘের অভিনেতারা।

বাড়িটার শেষ ধারে উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত বিশাল এক রান্নাঘর। কিশোরের জানা আছে, এটা আসলে রান্নাঘর নয়। সাজানো হয়েছে। স্টোভটা বাতিল, অকেজো। সিঙ্কের ওপরের কল থেকে পানি পড়ে না। শুধু ঘরের মাঝখানে বড় টেবিলটা, যেটায় খাবার সাজাচ্ছে ওয়েইটাররা শুধু সেটাই আসল। অন্যখান থেকে এনে রাখা হয়েছে। ছবি তৈরির সেট সাজানোয় ব্যবহৃত হচ্ছে না এখন ওটা।

তিন গোয়েন্দাকে টেবিলের মাথার কাছে নিয়ে গেল বেকার। ওখানে কালো চুলওয়ালা খুব সুন্দরী এক তরুণীর সঙ্গে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলছে তিনজন তরুণ।

কিশোরকে এগোতে দেখে কথা বন্ধ করে মুখ তুলে তাকালো ওরা।

কিশোরও তাকিয়ে আছে ওদের দিকে। অনেকগুলো বছর ধরে ওদের চেহারা তার মনের পর্দায় ছিলো উজ্জ্বল? মড়ার খুলি-ডিমের মতো সাদা চকচকে মাথা, মুখে বোকা হাসি, সোজা কথায় গর্দভ। ভারিপদের আপেলের মতো টকটকে গোল মুখ, অস্বাভাবিক বড় পায়ের পাতা, হাতের তালুও স্বাভাবিক নয়, রোগা, পাতলা শরীর। শিকারী কুকুরের মুখটা অনেকটা কুকুরের মুখের মতোই লম্বাটে, প্রায় সারাক্ষণ হাঁপায়, জিভ বেরিয়ে পড়ে মাঝে মাঝে, বিষণ্ণ চোখ দুটো দেখে মনে হয় এই বুঝি কেঁদে ফেললো। বটিসুন্দরীর সুন্দর চোখা চেহারা, কপালের ওপরের চুল সমান করে কাটা।

ওই চারজনই দাঁড়িয়ে আছে এখন, কিন্তু একেবারে অন্য মানুষ। কিশোরের মনের পর্দায় যে ছবি আঁকা রয়েছে তার সঙ্গে এখনকার ওদের কোনো মিল নেই।

সুদর্শন এক তরুণ, চামড়ার জ্যাকেট গায়ে, সোনালি চুল কাঁধ পর্যন্ত নেমে এসেছে, কান দেখা যায় না। হাত তুলে হেসে বললো, এইই যে, তোমাকেও গলায় দড়ি দিয়ে টেনে এনেছে তাহলে।

মাথা ঝাঁকালো কিশোর। তাকালো ছেলেটার কাউবয় বুটের দিকে। ছয় ফুট লম্বা শরীরের তুলনায় জুতো ছোটই বলতে হবে, তারমানে সে ভারিপদ নয়। শিকারী কুকুরও নয় সে। তার পাশে দাঁড়ানো তরুণের মুখটা লম্বাটে, যদিও জিভ বের করে নেই, আর চোখেও নেই আগের বিষণ্ণতা

চামড়ার জ্যাকেট আর হাতে-তৈরি বুট পরা বুদ্ধিমান দেখতে হোকরাই তাহলে মড়ার খুলি?

অন্য দুই পাগলের দিকে তাকিয়েও মাথা ঝাঁকালো কিশোর। নীরবে দেখলো পা থেকে মাথা পর্যন্ত। ভারিপদ আর শিকারী কুকুরকে চিনে নিতে অসুবিধে হলো না।

শরীরের তুলনায় এখনও বড়ই রয়েছে ভারিপদের পায়ের পাতা আর হাতের তালু, শরীর আগের মতো রোগাটে না হলেও বেশ পাতলা। বেঁটে। তবে আপেলের মতো গোলগাল মুখটা বদলে অন্যরকম হয়ে গেছে। তার লাল লাল গাল আর হাসি হাসি চোখ দেখে রকি বীচ সুপারমার্কেটের সেলসম্যানগুলোর কথা মনে পড়ে গেল কিশোরের।

শিকারী কুকুরকে লাগছে তরুণ ব্যবসায়ীর মতো। তার বাদামী রঙের চুল ছোট করে হাঁটা। শার্টের গলার কাছ থেকে শুরু করে নিচ পর্যন্ত একটা বোতামও খোলা নেই। শার্টের কাপড়ও বেশ ঝলমলে, উজ্জ্বল রঙের। একে দেখে এখন বিশ্বাস করাই কঠিন একসময় সে ছিলো কাঁদো কাঁদো চেহারার, পাগল সংঘের বোকা শিকারী কুকুর।

সব শেষে সুন্দরী মেয়েটার দিকে ফিরলো কিশোর। চমৎকার ফন স্যুট পরা। পানের মতো মুখ, গভীর নীল চোখ, ভারি পাপড়ি। এই মেয়েটাই ছিলো তার উদ্ধারকারিণী বটিসুন্দরী, কিন্তু স্টুডিওর বাইরে দেখলে তাকে চিনতেই পারতো না। রাস্তায় দেখলে তো নয়ই। বয়েস কতোটা বদলে দেয় মানুষকে!

হাসলো মেয়েটা। তুমি আসায় খুব খুশি হয়েছি, কিশোর। তোমাকে শুধু কিশোর বলে ডাকলাম, কিন্তু মনে কররানি তো?

না, মোটুরাম বলে না ডাকায় খুশি হয়েহে কিশোর। আমাকে শুধু নেলি বলে ডাকবে।

আস্থা। ওদের সঙ্গে রবিন আর মুসার পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্যে ফিরলো কিশোর। বেকার আর টিভি ক্যামেরার পাশে দাঁড়ানো আরেকজন লোকের সাথে কথা বলছে দুজনে। সাদা চুলওলা লোকটাকে চেনা চেনা লাগল কিশোরের। কিন্তু মনে করতে পারলো না, কে।

যাক, আমরা সবাই যখন এলাম, হাত বাড়িয়ে কিশোরের বাহু ধরে তাকে দলের ভেতরে টেনে নিলো মড়ার খুলি, একটা পরামর্শ আছে আমার। আমাদের প্রত্যেকের জন্যেই ব্যাপারটা জরুরী।

কিন্তু সবাই তো আসেনি এখনও, মনে করিয়ে দিলো নেলি। শজারুকাঁটা বাকি আছে।

ও আসবে না, জানালো ভারিপদ।

কেন? কিছুটা হতাশই মনে হলো নেলিকে।

হতাশ কিশোরও হয়েছে। পাগল সংঘের ওই একটিমাত্র ছেলেকে সে পছন্দ করতো, বটিসুন্দরীর চেয়েও বেশি। বাচ্চা পেয়ে তাকে কখনও খেপানোর চেষ্টা করেনি শজারু, কষ্ট দেয়নি।

কি জানি, কাঁধ ঝাঁকালো শিকারী কুকুর। হয়তো খুঁজে পায়নি। কিংবা আসতে রাজি না।

তারমানে বাকি সবাই আছি আমরা, মড়ার খুলি বললো। এবং এসেছি একটা উদ্দেশ্যে। চামড়ার জ্যাকেটের পকেট চাপড়ালো সে। টাকা। তাই না?

হ্যাঁ, দ্বিধা করে বললো শিকারী কুকুর। তার যেন সন্দেহ রয়েছে এ-ব্যাপারে।

হ্যাঁ, বললো ভারিপদ, তার সন্দেহ নেই, টাকার জন্যেই এসেছি আমরা।

নেলিও মাথা ঝাঁকালো।

তাই না? ঠিক বলিনি? কিশোরের দিকে তাকিয়ে ভুরু নাচালো মড়ার খুলি।

দ্বিধা করছে কিশোর। বিশ হাজার ডলার জিতে নিতে পারলে খুবই খুশি হবে সে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তিন গোয়েন্দার ফাণ্ডে জমা রাখবে ওই টাকা। গাড়ি কিনতে পারবে। মোটর সাইকেল কিনতে পারবে। গোয়েন্দাগিরির কাজে লাগে এরকম অনেক জিনিসই কেনা যাবে এতো টাকা পেলে। তবে শুধু টাকার জন্যে টিভির এই কুইজ শোতে যোগ দিতে আসেনি সে। বাচ্চা পেয়ে তাকে নিয়ে যারা মজা করেছে, নির্যাতন করেছে তার ওপর, ওদেরকে আচ্ছামতো একটা শিক্ষা দেয়াটাই তার প্রধান উদ্দেশ্য। শুধু টাকার লোভ দেখিয়ে তাকে এখানে কিছুতেই আনতে পারতো না হ্যারিস বেকার। তবে সেকথা তো আর বলা যায় না শত্রুদেরকে। মাথা ঝাঁকিয়ে শুধু বললো, হ্যাঁ।

গুড। এখানে একটা পুনর্মিলনীর ব্যবস্থা করা হয়েছে, মড়ার খুলি বললো। লাঞ্চের পর আমরা সবাই বসে পুরনো দিনের কথা আলোচনা করবো, কিভাবে কি কি মজা করেছি আরা, এ সমস্ত। তাই তো?

আবার মাথা ঝাঁকালো কিশোর।

তোমাদের কাছে মজার হতে পারে, আমার কাছে ছিলো না, ভাবলো কিশোর। তবে কিছুই বললো না সে।

আর আমাদের ওই প্রিয় পরিচালক, বেকারের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সাদা চুলওয়ালা মানুষটাকে দেখালো মড়ার খুলি, আমাদের এই আলোচনা টেপ করে নেবেন। কুইজ শোর আগে টেলিভিশনে দেখানোর জন্যে।

কারে ওপর দিয়ে ফিরে তাকালো কিশোর। অবাক হয়ে ভাবলো, কেন প্রথমেই মানুষটার নাম মনে করতে পারেনি? নাম আর চেহারা তো সাধারণত সে ভোলে না। একটা কথা অবশ্য ঠিক, অনেক বদলে গেছেন রাফায়েল সাইনাস। পাগল সংঘের সবার চেয়েও বেশি বদলেছেন। লম্বা, ছিপহেপে একজন প্রাণবন্ত মানুষ, কথার চাবুক হেনে যিনি চোখের পলকে ঠাণ্ডা করে ফেলতেন দুর্দান্ত বেয়াড়া ছেলেগুলোকেও, সেই মানুষের এ-কি হাল হয়েছে! বৃদ্ধ, কুঁজো, বিধ্বস্ত!

বেশ, বলে যাচ্ছে মড়ার খুলি, এখন আমাদের ভেবে দেখতে হবে, কেন আমরা টেলিভিশনের সামনে যাবো শুধু শুধু? যদি কিছু না-ই দেয়? বসে যে আলোচনা করবো তার জন্যেও পয়সা দিতে হবে আমাদেরকে। ঠিক আছে?

এক এক করে সবার মুখের দিকে তাকালো সে। সবাই মাথা ঝাঁকালো, কিশোর বাদে।

তুমি কি বলো? ভুরু কুঁচকে কিশোরকে জিজ্ঞেস করলো সে।

দ্বিধা করছে কিশোর। ভাবছে। মড়ার খুলির পরামর্শ মেনে নেয়ার অর্থ তাকে দলের নেতা হিসেবে স্বীকার করে নেয়, যেটা কিছুতেই করতে রাজি নয় কিশোর। কারণ ছোটবেলায় এ ছিলো দুষ্ট ছেলেদের সর্দার, মোটুরামকে কষ্ট দেয়ার বেশির ভাগ শয়তানী বুদ্ধিই তার মাথা থেকে বেরোতো।

কারো কর্তৃত্ব মানতে পারেনা কিশোর, এটা তার স্বভাববিরুদ্ধ। তবে একটা কথা এখন স্বীকার না করেও পারছে না, মড়ার খুলির কথায় যুক্তি আছে। টেলিভিশনে যদি তাদেরকে দর্শকদের সামনে হাজির করতে চায় টিভিওয়ালারা, তাহলে কেন পয়সা দেবে না? বিনে পয়সায় কেন কাজ হাসিল করবে?

মাথা ঝাঁকালো কিশোর।

মুখে আঙুল পুরে জোরে শিস দিয়ে উঠলো মড়ার খুলি। হাত নেড়ে ডাকলো, এই বেকার; এদিকে আসুন।

কিশোর ভেবেছিলো এই আচরণে নিশ্চয় মাইন্ড করবে বিজ্ঞাপন ম্যানেজার, মুখ কালো করে ফেলবে, কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে করলো না। বিন্দুমাত্র মলিন হলো চাঁদের উজ্জ্বলতা। এগিয়ে এলো। পোষা বৃদ্ধ কুকুরের মতো তার পিছে পিছে এলেন সাইনাস।

কি চাও? খুব ভদ্রভাবে জিজ্ঞেস করলো বেকার।

কাটা কাটা বাক্যে পরিষ্কার করে তাকে বললো মড়ার খুলি। আলোচনার জন্যে তাদের প্রত্যেককে একশো ডলার করে সম্মানী দিতে হবে। সেটা করমুক্ত হতে হবে, এবং নগদ।

একটুও মলিন হলো না চাঁদের ঔজ্জ্বল্য, তবে সামান্য একটু কোঁচকালো ভুরু দুটো। তা পারবে না। এমনিতেই লাঞ্চের জন্যে অনেক খরচ করে ফেলেছে স্টুডিও। তাছাড়া প্রত্যেকের জন্যেই একটা করে দামী সুভনিরের ব্যবস্থা করেছি নিজের গাঁটের পয়সা খরচ করে।

কি রে উপহার? জিজ্ঞেস করলো নেলি।

কতো দাম? জানতে চাইলো মড়ার খুলি।

এটা আমি এখন কলবো না, হেসে বললো বেকার, গোপন রাখব। সারপ্রাইজ দেয়ার জন্যে। তবে রেখেছি, এটা ধরে নাও, বলে রান্নাঘরের দরজার দিকে দেখালো সে। আর পেলে খুব খুশি হবে, তা-ও বাজি রেখে বলতে পারি। এক মুহূর্ত দ্বিধা করে বললো, তবে, আলোচনার জন্যে একটা পয়সাও দিতে পারবো না, একথা আবারও বলে দিচ্ছে।

বেশ। টাকা না পেলে আমরাও আলোচনায় বসছি না।

ওদেরকে বোঝানোর চেষ্টা করলো বেকার। কিন্তু কোনো কথা শুনতে রাজি নয় মড়ার খুলি। তার এক কথা, টাকা ছাড়া কিছু করবে না।

হাসি মুছলো না বেকারের মুখ থেকে, তবে তার কণ্ঠের মোলায়েম ভাবটাও আর রইলো না। দেখো, ব্ল্যাকমেল করছো তোমরা! ব্যাকমেল।

বেশ, করছি, হাসিটা ফিরিয়ে দিলো মড়ার খুলি। কিশোর দেখলে নেলি, ভারিপদ, এমনকি শিকারী কুকুরও হাসছে। তবে আলোচনায় বসাতে হলে টাকা আপনাকে দিতেই হবে।

সাথে সাথে কিছু বললো না বেকার। ভাবছে।

কিশোরও ভাবছে। অবাক হয়েছে সে। পাগল সংঘের যে চেহারা এতোদিন ছিলো তার মনের পর্দায়, সেটা দূর হয়ে গেল আজ। এরা সবাই আজ অন্য মানুষ। সবাই বড় হয়েছে, বুঝতে শিখেছে, স্বার্থ ছাড়া কথা বলে না। কঠোর বাস্তবকে বুঝতে শিখেছে, শিখেছে টাকার জন্যে কিভাবে লড়াই করতে হয়।

কিন্তু কথা হলো, একশো ডলারের জন্যেই যদি এভাবে লড়াই করে, বিশ হাজার ডলারের জন্যে কি করবে? হায়নার মতো কামড়া-কামড়ি শুরু করে দেবে না! ওদের কাছ থেকে টাকাটা বুদ্ধির জোরে ছিনিয়ে নিতে হলে কতোটা সর্তক হয়ে এগোতে হবে, বুঝতে পেরে কিছুটা দমেই গেল কিশোর। হারিস বেকারের কথা থেকে মনে হয়েছিলো, কিশোর আসবে, আর টাকাটা নিয়ে বাড়ি চলে যাবে। কিন্তু এখন বুঝতে পারছে, মোটেও ওরকম সহজ নয় ব্যাপারটা।

পাগলদের ওপর আগের সেই ঘৃণাটা আর নেই এখন কিশোরের, এটা বুঝে আরও অবাক হলো। এই মুহূর্তে বিশ্বাসই করতে পারছে না এরাই কয়েক বছর আগে ছিলো একেকটা গর্দভ, বোকার হদ্দ,তাকে জ্বালিয়ে মেরেছে। প্রতিশোধের ইচ্ছেটা ধীরে ধীরে যতোই দূর হয়ে যাচ্ছে কিশোরের, বাড়ছে প্রতিযোগিতায় জেতার ইচ্ছে।

ওর স্বভাবই হলো, কোনো চ্যালেঞ্জ এলে সমস্ত শক্তি আর বুদ্ধি নিয়ে সেটার মুখোমুখি হওয়া। পিছিয়ে আসার ছেলে সে নয়। এখন তার মনে হচ্ছে, জীবনে

এতোবড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি সে খুব কমই হয়েছে।

<

Super User