একটা মুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে মুনের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল জোসি। পরক্ষণে ঝটকা দিয়ে ঘুরে কেবিনের দিকে ছুটল। পিছনে ছুটল কিশোর ও মুসা। হুড়মুড় করে কেবিনের দরজা দিয়ে ঢুকে থমকে দাঁড়াল।

বিছানায় কুঁকড়ে পড়ে আছেন জেফরি। দুই হাতে পেট চেপে ধরে গোঙাচ্ছেন। পাশে বসা এরিনা। ভিজা কাপড় দিয়ে বার বার জেফরির কপাল মুছে দিচ্ছেন।

এগিয়ে গিয়ে জেফরির কাঁধে হাত রাখল জোসি। চাচীকে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে?

মাথা নাড়লেন এরিনা। জানি না। হঠাৎ করেই বলল পেটে ব্যথা। তারপর থেকে বেড়েই চলেছে। বিছানায় থাকতে পারছে না।

আমার ভয় লাগছে, বলে কিশোর-মুসার দিকে তাকাল মুন। কিছু একটা করা দরকার।

উঠে দাঁড়ালেন এরিনা। জোসি, এ অবস্থায় তোমার চাচাকে আমার একা রেখে যাওয়া উচিত হবে না। বনে যাবে? কী আনতে হবে জানোই তো।

দরজার দিকে পা বাড়াতে গিয়ে ফিরে তাকাল জোসি।

কিশোরদের বলল, তোমরাও এসো। আমাকে সাহায্য করবে।

 

পায়ে চলা পথ ধরে বনের দিকে হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞেস করল কিশোর, কোথায় যাচ্ছ?

বনে, জোসি বলল।

তা তো বুঝলাম, মুসা বলল। কী আছে ওখানে?

ভেষজ ওষুধ। চাচীর মা আর নানী খুব ভাল কবিরাজ ছিলেন। চাচী তাঁদের কাছ থেকেই কবিরাজি শিখেছে।

আর তুমি?

চাচীর কাছে।

ইণ্ডিয়ানদের অসাধারণ কবিরাজি জ্ঞানের কথা শুনেছে কিশোর। শত শত বছর নানারকম গাছ, পাতা আর শিকড়-বাকড় দিয়ে কঠিন কঠিন রোগের সফল চিকিৎসা করে আসছে তারা। ইদানীং বড় বড় ওষুধ কোম্পানিগুলোও ইণ্ডিয়ানদের এ সব ওষুধের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেছে। এ সব ভেষজ সম্পর্কে বিশদভাবে জানতে গবেষক দল পাঠাচ্ছে ইণ্ডিয়ান অঞ্চলে।

বনের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মিনিট বিশেক পরেই কিশোর লক্ষ করল, গাছপালার চেহারা বদলে যাচ্ছে। পিছনে ফেলে এসেছে প্রুস গাছের ঘন জঙ্গল। সামনের জায়গাটা মোটামুটি পাতলা। বার্চ আর অ্যাসপেন গাছ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। স্নান সূর্যালোক চিকচিক করছে পাতাঝরা গাছগুলোর ডালে জমে থাকা বরফে।

বড় একটা ওক গাছ দেখাল জোসি। ওটার গোড়ার তুষার চেঁছে ফেলে দিলে এক ধরনের শ্যাওলা পাবে। তুলে নিয়ে এসো।

দৌড়ে গিয়ে কাজ শুরু করে দিল কিশোর ও মুসা। তুষার ফেলে দিতেই বেরিয়ে পড়ল বিচিত্র চেহারার শ্যাওলা। ভিজা মাটির গন্ধে ভরা। জোসি তখন অন্য জিনিস জোগাড়ে ব্যস্ত। বরফ খুঁড়ে এক জাতের চিরসবুজ উদ্ভিদ খুঁজে বের করল। উপড়ে নিল কয়েকটা গাছ। কালো রঙের চেরি-বার্ডের এক টুকরো বাকল কেটে নিল। এলডার ঝোপের শিকড় নিল। আর নিল দুই ধরনের গাছের দুটো নরম ডাল। এ গাছগুলো কিশোরের অচেনা।

কাজ শেষ করতে দশ মিনিট। দৌড়ে গ্লিটারে ফিরে চলল তিনজনে। ফেরার পথে গতি বেশি, কারণ ঢাল বেয়ে নামছে। কেবিনে ঢুকতে বিচিত্র সুবাস নাকে ঢুকল ওদের। স্টোভের ওপর কালো রঙের একটা কেটলিতে পানি ফুটছে, তাতে কিছু মিশিয়েছেন এরিনা, সেটার গন্ধই বেরোচ্ছে। জোসির হাত থেকে ব্যাগ নিয়ে ডাল-পাতা, শিকড়, বাকল, শ্যাওলাগুলো বের করে কেটলির পানিতে মিশানো শুরু করলেন।

কিশোর জিজ্ঞেস করল, জেফরি আঙ্কেল কীজন্য অসুস্থ হয়েছেন, আপনি বুঝতে পেরেছেন?

মাথা ঝাঁকালেন এরিনা। মনে হয়। আপেলটাতে বোধহয় খারাপ কিছু ছিল। ওটা খাওয়ার পর থেকেই পেটব্যথা শুরু।

আপনারা খাননি? আপনি আর মুন?

না। ও একাই খেয়েছে।

জোসি বলল, ঘরে আপেল আছে তাই তো জানতাম না।

ছিলও না, মুন জানাল। ইলকিস বিগ এক ঝুড়ি তাজা ফল উপহার দিয়ে গেছে।

মুসার দিকে তাকাল কিশোর। চোখে চোখে কথা হয়ে গেল। দুজনের মনে একই ভাবনা। জেফরিকে উপহার পাঠাল কেন বিগস? সে জানে বিরোধী দলের নেতা জেফরি। ফল পাঠানোটা ঘুষ না তো? ঘুষ হোক আর যা-ই হোক, মারাত্মক বিষে ভরা এই উপহার।

আপেলের মধ্যে বিষ ঢুকিয়ে দেয়নি তো বিগস? বিশ্বাস হতে চাইছে না কিশোরের। তবে উদ্দেশ্যটা বোঝা যাচ্ছে। জেফরি সহ তার পরিবারের লোকেরা অসুস্থ হয়ে পড়লে থিম পার্কের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলায় মনোযোগ দিতে পারবেন না তিনি। তাঁর কেবিন পোড়ানো, জো সারটনের নৌকা নষ্ট করা, সব এই পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের অংশ। ধরে নেয়া যায়, পার্কের সপক্ষের কেউ এই অকাজগুলো করেছে।

বছরের এ সময়ে তাজা ফল পেল কোথায় বিগস্? জোসির প্রশ্ন।

কেটলিতে চাপানো ওষুধ নাড়তে নাড়তে ফিরে তাকালেন এরিনা। নিশ্চয় প্লেনে করে এনেছে। আমরা মনে করেছিলাম আমাদের কেবিনের শোক ভোলাতে, আমাদের খুশি করতে ফলগুলো উপহার দিয়েছে বিগস্।

দেয়ার সময় কিছু বলেছে? জানতে চাইল মুসা।

ও নিজে নিয়ে আসেনি, এরিনা জানালেন।

টেডকে দিয়ে পাঠিয়েছে, মুন বলল।

এক মিনিট এক মিনিট, ভুরু কুঁচকে গেছে কিশোরের। টেড সিউল? ও আনতে গেল কেন?

মুন বলল, লুক স্টার্লিঙের অনুরোধে।

এরিনা বললেন, লুকের কাছ থেকে অর্ডার পেলে খাবার আর অন্যান্য জিনিস ফেয়ারব্যাংকস থেকে নিয়ে আসে ডিউক আইকহ্যাম। লুক তখন সেগুলো নিজেই যার যার ঠিকানায় পৌছে দেয় কিংবা টেডের মত কাউকে দিয়ে পাঠানোর ব্যবস্থা করে।

আরও প্রশ্ন করার জন্য মুখ খুলতে যাচ্ছিল কিশোর, হাত তুলে বাধা দিলেন এরিনা। মোটা একজোড়া দস্তানা পরে নিয়ে গরম কেটলিটা ধরে উঁচু করলেন। একটা মাটির পাত্রের মুখে পরিষ্কার এক টুকরো কাপড় রাখল মুন। তাতে কেটলির তরল পদার্থ ঢালতে লাগলেন এরিনা। কাপড়টা ছাঁকনি হিসেবে কাজ করল। মাটির পাত্র থেকে সেই তরল পদার্থ আবার বড় হাতায় করে চিনামাটির মগে নিলেন তিনি। তাতে সামান্য ঝর্নার পানি ঢেলে, অল্প একটু মধু মিশিয়ে ঠাণ্ডা করে নিয়ে গেলেন জেফরির কাছে।

বাবাকে বিছানায় উঁচু করে ধরল মুন। মগটা জেফরির ঠোটের কাছে ধরলেন এরিনা। ওষুধ খেয়ে আবার বিছানায় শুয়ে পড়লেন জেফরি।

এরিনাকে জিজ্ঞেস করল কিশোর, আচ্ছা, আন্টি, ফলের যে ঝুড়িটা দিয়ে গেল, তার মধ্যে কি নাম লেখা কোন কার্ড বা নোট ছিল?

ড্রেসারের ওপর থেকে একটা কার্ড নিয়ে এলেন এরিনা। কিশোরের হাতে দিলেন। দেখার জন্য কাত হয়ে এল মুসা। লেখা রয়েছে ইলকিস বিগস, ফিল্ড রেপ্রেজেনটেটিভ, থিম পার্ক। কার্ডের উল্টো দিকের সাদা অংশে হাতে লেখা কথাটার বাংলা মানে করলে দাঁড়ায়: অনেক শুভেচ্ছা। ইলকিস।

হ্যাঁ, কার্ডটা বিগসেরই, কোন সন্দেহ নেই, কিশোর বলল। কিন্তু জেফরি আঙ্কেলের নাম তো নেই কোথাও। এমনও তো হতে পারে কার্ডটা অন্য কাউকে দিয়েছিল বিগস। বিগসই উপহার পাঠিয়েছে বোঝানোর জন্য সেই লোক কার্ডটা ফলের ঝুড়িতে ভরে দিয়েছে।

টেড সিউলের মত কেউ? মুসার প্রশ্ন।

হতে পারে।

কিশোরের দিকে তাকাল জোসি। তুমি বলতে চাও ফলগুলোতেই গোলমাল?

ল্যাবরেটরি টেস্ট না করে শিওর হওয়া যাবে না। কিন্তু কোন কিছুর বিনিময়েই ওই আপেলে কামড় বসাতে রাজি নই আমি।

রাগে লাল হয়ে গেল জোসির মুখ। টেড যদি ভেবে থাকে আমার পরিবারের ওপর হামলা চালিয়ে, তাদের ক্ষতি করে ইডিরাটোড রেসে আমার অংশ নেয়া বন্ধ করাবে, মস্ত ভুল করছে ও। ওকে আমি ছাড়ব না।

ওর বাহুতে হাত রাখল মুন। জোসি, না জেনে কাউকে দোষারোপ করা ঠিক না। অন্য কেউও তো এ সব শয়তানি করে থাকতে পারে? টেড সিউলকে দোষী বানানোর জন্য।

ওর কথায় যুক্তি আছে, মনে মনে স্বীকার করল কিশোর।

পারলে কিছু একটা করো, এরিনা বললেন। আরও খারাপ কিছু ঘটে যাবার আগেই।

টেবিল থেকে ওষুধের মগটা তুলে নিয়ে আবার জেফরির কাছে গেলেন এরিনা। কেমন লাগছে এখন?

কোলাব্যাঙের স্বর বেরোল জেফরির গলা দিয়ে, ভাল।

আরেকটু দেব?

চোখ-মুখ কুঁচকে জেফরি বললেন, তোমার ওই ভয়াবহ জিনিস!

হাসলেন এরিনা। স্বাদটা খারাপ, তবে ওষুধ হিসেবে খুবই ভাল, অস্বীকার করতে পারবে না।

উঠে বসার চেষ্টা করলেন জেফরি। কাঁধ চেপে ধরে শুইয়ে দিলেন এরিনা। রেস্ট নাও। তোমার এখন বিশ্রাম দরকার।

 

সন্ধ্যার পর এরিনা বললেন, মুজের মাংসের কাবাব বানাব। আনতে পারবে?

উঠে দাঁড়াল মুসা। পারব।

কোথায় রেখেছেন? জানতে চাইল কিশোর।

আমাদের কেবিনের পিছনের ছাউনিতে, এরিনা বললেন। হুকে ঝোলানো আছে, আস্ত একটা রান। ছুরি, করাত সবই পাবে ওখানে।

লণ্ঠন জ্বেলে দিল জোসি। বাতি হাতে বাইরের অন্ধকারে বেরিয়ে এল কিশোর ও মুসা। উজ্জ্বল বড় বড় তারা মেরুর আকাশে ঘন হয়ে ফুটে আছে। কাছেই একটা পেঁচা ডাকল। মানুষের সাড়া পেয়ে ঝোপের মধ্যে ছুটে পালাল ছোট কোন জানোয়ার।

এ রকম সাধারণ একটা ছাউনির মধ্যে মাংস রাখে! মুসা বলল।

হাসল কিশোর। ভয় নেই। শীতকাল। নষ্ট হবে না। ছাউনির ভিতরের তাপমাত্রা এখন ডিপ ফ্রিজের চেয়ে কম নয়।

তারমানে মাংস জমাট বেঁধে বরফের মত শক্ত হয়ে গেছে। করাত ছাড়া কাটা যাবে না।

পোড়া কেবিনটার কাছে পৌঁছল ওরা। এখনও ধােয়ার গন্ধ বেরোচ্ছে। পাশ দিয়ে ঘুরে আসতে ছাউনিটা চোখে পড়ল। দরজা খুলল মুসা। ভিতরে ঢুকল দুজনে।

লণ্ঠন উঁচু করে ঘরের মধ্যে খুঁজতে লাগল কিশোর। বাঁয়ে একটা কাঠের বাক্স। তার ওপর রাখা চামড়ার স্তুপ, ফাঁদ পেতে ধরা হয়েছিল বুনো জানোয়ারগুলোকে। জমে শক্ত হয়ে গেছে। পিছনের দেয়ালে ঝোলানো কাঠ চেরাই করার একটা অনেক বড় করাত। চালাতে দুজন লাগে। বড় একটা বেতের ঝুড়িতে রাখা প্রয়োজনীয় নানারকম যন্ত্রপাতি।

সবই তো আছে দেখছি, কিন্তু মাংস কোথায়? চারপাশে তাকিয়ে খুঁজতে লাগল মুসা।

লণ্ঠনটা আরও উঁচু করে ধরল কিশোর। বিম থেকে বড় একটা হুক ঝুলছে। নিশ্চয় ওটাতেই ঝোলানো ছিল মাংসের টুকরো।

তাহলে এখন গেল কোথায়… কিশোর, দেখো!

মুসার কণ্ঠস্বর চমকে দিল কিশোরকে। চরকির মত পাক খেয়ে ঘুরে দাঁড়াল। ছাউনির কাঠের দেয়ালে কালো রঙ দিয়ে আঁকা একটা হৃৎপিণ্ড। মাঝখানে একটা ছুরি গাঁথা।

<

Super User