হাসপাতালে পৌঁছনোর আগ পর্যন্ত ছুটে চললাম আমি। এখানে কয়েকটা এন্ট্রান্স। একটায় লেখা: ইমার্জেন্সি। অনুভব করলাম এটাও একটা ইমার্জেন্সি, কিন্তু জানি এখন মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হবে।

মেইন এন্ট্রান্স দিয়ে ভিতরে ঢুকলাম। ওয়েটিং এরিয়ায় বেশ কিছু মানুষ-জন বসা। জনাকয় ডাক্তার আর নার্স চলাফেরা করছে। ইনফর্মেশন ডেস্ক দেখে এগিয়ে গেলাম।

এক ইউনিফর্ম পরা নার্স বইতে কী সব টুকছে।

মাফ করবেন, বললাম। রেকর্ড ডিপার্টমেন্টটা কোথায় বলতে পারেন?

পাঁচতলায়, ডান দিকে এলিভেটর, আমার দিকে মুখ তুলে চেয়ে বলল।

এলিভেটরের জন্য অপেক্ষা করছি, নানা চিন্তা ঘুরতে লাগল মাথার মধ্যে।

এলিভেটরের দরজা খুলে গেল। মুখোমুখি পড়ে গেলাম সার্জেন্ট কলিন্সের। এক লোককে সাহায্য করছেন তিনি। লোকটির বাহুতে কাস্ট করা।

আপনাকে ধন্যবাদ, সার্জেন্ট, লোকটি বলল। আপনি না থাকলে কে আমাকে হাসপাতালে আনত আর ওই ছিনতাইকারীগুলোকে শায়েস্তা করত!

এটাই তো আমাদের কাজ, মিস্টার লেন, আইনকে উপরে তুলে ধরা, কলিন্স জবাবে বললেন। লোকটিকে কথাগুলো বললেও পুরোটা সময় তার দৃষ্টি স্থির রইল আমার উপরে।

মাফ করবেন, বলে, তার পাশ ঘেঁষে এলিভেটরে উঠলাম।

শরীর খারাপ? কলিন্স আমাকে প্রশ্ন করলেন। এলিভেটর থেকে ঝটপট বেরিয়ে গেলেন।

না, ঠাণ্ডা স্বরে জবাব দিলাম। এক অসুস্থ বন্ধুকে দেখতে এসেছি।

কলিন্স একদৃষ্টে চেয়ে রইলেন আমার দিকে।

চব্বিশ ঘণ্টা, বললেন তিনি। এলিভেটরের দরজা লেগে গেল। এলিভেটর পাচতলায় উঠে এলে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। রকি বীচ পুলিস ডিপার্টমেন্টকে আমি বন্ধু মনে করতাম। নিজেকে অপরাধী ভাবতে ভাল লাগছে না!

দরজা খুলে গেল। বেরিয়ে এলাম আমি। চারধারে নজর বুলালাম। বড্ড চুপচাপ এখানে। লম্বা হলগুলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন আর উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত। দেয়ালে এক ডিরেক্টরি দেখলাম।

ওতে নির্দেশ করছে হাসপাতাল রেকর্ড, রুম ৪৩৬। কামরাটা খুঁজে না পাওয়া পর্যন্ত হেঁটে চললাম। বন্ধ এক দরজা দেখলাম। নক করতেই ভিতর থেকে শোনা গেল, কাম ইন।

প্রবেশ করলাম। কাউন্টার ডেস্কের পিছনে সাদা কোট পরা এক লোক বসা।

বিরক্তির ছাপ তার চোখে-মুখে। এক স্পোর্টস ম্যাগাজিনের পাতা উল্টাচ্ছে।

হ্যাঁ, তোমার জন্যে কী করতে পারি? প্রশ্ন করল।

আমি কিছু রেকর্ড খুঁজছি, বললাম।

কী ধরনের রেকর্ড?

উম, বার্থ রেকর্ড।

কার? প্রশ্ন করল। এই প্রথম তাকে আগ্রহী মনে হলো। আমার অস্বস্তি লাগছে, কেননা লোকটা গভীর মনোযোগে আমাকে দেখছে।

আমার নিজের, বললাম। আমি আমার বার্থ রেকর্ড জানতে চাই। এই হাসপাতালে আমার জন্ম।

আমার নাম এবং জন্মতারিখ বললাম।

ঠিক আছে, কোন সমস্যা নেই, বলল লোকটা।

স্বস্তির শ্বাস ফেললাম। ভয় হচ্ছিল কোন সমস্যা হবে।

দেখানো যাবে,যোগ করল লোকটা। একুশ বছরের বেশি বয়সী কাউকে নিয়ে এসো আমরা তোমার ফাইল দেখিয়ে দেব। পত্রিকার পাতায় আবারও ডুব দিল সে।

কী? বলে উঠলাম, কেন?

কারণ এটা স্টেট ল, জানাল লোকটা। একুশ বছরের কম বয়সী কেউ অফিশিয়াল বার্থ রেকর্ড দেখতে কিংবা কপি করতে পারে না। কথা শেষ।

লোকটার দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম। লোকটা অহঙ্কারী এবং রূঢ়, এ দুটো স্বভাবই অপছন্দ করি আমি। কিন্তু তারচাইতেও বড় কথা ও আমাকে তথ্য পাওয়া থেকে বঞ্চিত করছে।

ওর নেম ট্যাগ দেখলাম।

বিন, জে, পড়লাম।

আপনার সাহায্যের জন্যে ধন্যবাদ, বললাম। বিন ঘোত করে উঠল। আমার দিকে তাকাল না পর্যন্ত।

আমি ঘুরে দাঁড়িয়ে ঘর ছাড়লাম। এলিভেটরে চড়ে নেমে এলাম রিসেপশন ডেস্কে। অন্য এক নার্স এখন ডিউটিতে। আত্মবিশ্বাসী অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তুলতে চেষ্টা করলাম মুখের চেহারায়। ভিতরে ভিতরে পাতার মতন কাপছি।

মাফ করবেন, বললাম।

ইয়েস, মহিলা বলে আমার দিকে চাইল।

আপনাদের রেকর্ড সেকশনে মিস্টার বিন নামে একজন আছে, তাই না?

এক মিনিট, বলে কম্পিউটার অন করল মহিলা, কটা বাটন টিপে পর্দায় চোখ রাখল। হ্যাঁ, জেমস বিন। রেকর্ডস, পাঁচ তলা। কেন?

এক ডাক্তার আপনাকে বলতে বললেন তাকে এখুনি এক্স-রে রূমে দরকার।

আমার দিকে চেয়ে রইল নার্স।

রেকর্ডের লোককে এক্স-রেতে দরকার? এমন কথা কখনও শুনিনি। কেন দরকার?

জানি না। হয়তো এক্স-রের রেকর্ড নেয়ার জন্যে কাউকে তাদের দরকার, বললাম, নিজেও জানি না কী বলছি।

মহিলা মুহূর্তের জন্য ভ্রূ কুঁচকে শ্রাগ করল। রিসিভার তুলে ডায়াল করল কোন নম্বরে।

হ্যালো, মিস্টার বিন? ফ্রন্ট ডেস্ক থেকে বলছি। আপনাকে এক্সরেতে ডেকেছে। জানি না কেন। মনে হয় গেলেই জানতে পারবেন।

রিসিভার রেখে দিল সে। চারপাশে চোখ বুলিয়ে আমাকে খুঁজল। কিন্তু আমাকে পাবে কোথায়। আমি তখন এলিভেটরে চড়ে পাঁচতলার দিকে উঠে যাচ্ছি।

রেকর্ড রুমের দরজায় তালা মারা নেই, কাজেই ভিতরে ঢুকতে কষ্ট হলো না।

আমার জানা নেই কতক্ষণ সময় পাব। ডিরেক্টরীতে দেখেছি সাততলায় এক্স-রে। বিন এলিভেটরে করে ওখানে যাবে, কাউকে জিজ্ঞেস করবে কে ডেকেছে, জানবে কেউ ডাকেনি, এবং তারপর এলিভেটরে করে নেমে আসবে।

বড়জোর তিন কি চার মিনিট সময় পাব, উপলব্ধি করলাম।

বিনকে রেকর্ডস রুম ত্যাগ করতে দেখে এক দরজার আড়াল নিলাম।

এলিভেটরের জন্য অপেক্ষা করল বিন। সে ভিতরে ঢুকতেই, আমি রেকর্ডস রুমে সেঁধিয়ে পড়লাম। বিনের ডেস্কের পাশ দিয়ে গেলাম। ফাইল ক্যাবিনেটগুলো বছরওয়ারি সাজানো। আমার জন্মসাল খুঁজে নিতে কয়েক সেকেণ্ড মাত্র লাগল। ফাইল হ্যাণ্ডল ধরে টানলাম। খুলল না!

ক্যাবিনেটে এক কি-হোল দেখতে পেলাম। চাবি দরকার! চারধারে নজর বুলিয়ে নিলাম, দস্তুরমত হাঁফাচ্ছি। চাবি, চাবি চাই। চাবি কোথায়? নিশ্চয়ই বিনের কাছে আছে!

ওর ডেস্কের কাছে ফিরে গেলাম। ডেস্কের ড্রয়ারে কয়েকটা কিচেইন। প্রথমটা খপ করে চেপে ধরলাম। প্রতিটা চাবিতে একটা করে বছর।

বুক ধড়ফড় করছে, চাবি হাতড়াতে লাগলাম। অল্প-অল্প কাঁপছে আঙুল। এক ফোঁটা ঘাম টপ করে পড়ল শার্টে। আমার জন্মসাল পাওয়া গেছে! ঘুরেই এক দৌড়ে ফিরে এলাম পিছনের কামরায়।

জ্ঞান হারানো চলবে না-অনুভব করলাম আমি দুবেলা খাইনি-সুটে ঢুকিয়ে দিলাম চাবিটা। ঘুরালাম। ফাইলটা খুলে গেল।

অক্ষর অনুযায়ী সাজানো হয়েছে রেকর্ডগুলো। ঝটপট ফাইলের মাঝখানে চলে গেলাম, খুঁজে পেলাম কে, কিশোর পাব যেখানে।

সামনে একটা শব্দ হলো! গলার কাছে উঠে এল যেন হৃৎপিণ্ড। বিন কি এত তাড়াতাড়ি ফিরে এসেছে? ধীরে ধীরে মাথা ঘুরিয়ে চাইলাম। ডাক্তাররা হলওয়েতে কথা বলার জন্য থেমেছিলেন। এবার আবার হাঁটা ধরেছেন। চেপে রাখা খাসটা ছেড়ে, ফাইলে ফের মন দিলাম।

হুড়োহুড়ি করে কে অক্ষরটা দেখে নিলাম। প্রতিটা ফাইলে বাবামার নাম, এবং শিশুর নাম, ওজন, লিঙ্গ এবং জন্মের সময় দেয়া রয়েছে।

আমার ফাইলটা এখুনি দেখতে পাব। আপন মনে কথা বলতে লাগলাম।

কেনি… কেভিন…কেনেথ…

আমার নাম কোথায়? আবারও প্রথম থেকে দেখলাম। হাত কাঁপছে এখন। বিন যে কোন মুহূর্তে ফিরে আসবে। আমাকে আমার ফাইল খুঁজে পেতে হবে। এবং ওটা এখানেই থাকবে, হাসপাতাল বার্থ রেকর্ড হারিয়ে ফেলে না।

কে অক্ষরের আদ্যোপান্ত আবারও দেখে নিলাম। কোন কিশোরের নাম নেই। কিন্তু আমার তো এই হাসপাতালে জন্ম! রেকর্ড

এখানে থাকতেই হবে। নেই কেন?

তুমি যা খুঁজছ তা মনে হয় এক্স-রেতে পাবে,বলল একটি কণ্ঠ।

মুখ তুলে চাইলাম। দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে বিন। আমার দিকে হেঁটে আসছে।

<

Super User