আগের দিনের চেয়ে বিচিত্র দৃশ্য কারমলের বাড়িতে। পুলিশের লোক দাঁড়িয়ে আছে হাত গুটিয়ে, কিছুই করার নেই ওদের। জিনিসপত্র ছড়াচ্ছে, লাথি মেরে বোতল ভাঙছে রত্নশিকারিরা। রেগে গেছে। যেন বুঝতে পারছে ঠকানো হয়েছে ওদেরকে।

কটেজের লিভিংরুমে ঢুকল তিন গোয়েন্দা। ওদের জন্যে নরিকে ফলের রস আনতে বলল এলসা। ওদের দিকে চেয়ে হাসল রস উড।

বোকা বনে তো, উকিল বলল। সবাই বনেছে। যা রাগা রেগেছে না ওরা। – এমন ভাব দেখাচ্ছে যেন আমরা ওদের পাওনা জিনিস কেড়ে নিয়েছি।

মুসা বলে ফেলল, কিশোর বোকা বনেনি।

বলেছিলাম না। চেঁচিয়ে উঠল নরি, ফিরে এসেছে। বলেছিলাম, বুঝে ফেলবে।

পাথরগুলো কোথায়, জেনেছ? উড জিজ্ঞেস করল।

না, জবাব দিল কিশোর। তবে ধাঁধার সমাধানের চাবিকাঠি বোধহয় পেয়েছি। খানিকটার সমাধান করেও ফেলেছি। মিসেস কামল, বিশেষ কোন পুলিশম্যানকে কি চিনতেন আপনার শ্বশুর?

পুলিশ, মাথা খারাপ। পুলিশকে দুচোখে দেখতে পারত না।

পুলিশ? উড বলল, কেন, বোতল, বিলাবং আর নাশপাতি গাছের সঙ্গে পুলিশ খাপ খাচ্ছে নাকি?

ফলের রস খেতে খেতে রাইমিং ম্যাঙের ব্যাপারটা জানাল কিশোর।

এরকম আশ্চর্য কথা কখনও শুনিনি, উকিল বলল। এলসা, তুমি শুনেছ?

। আমি অস্ট্রেলিয়ানও নই, ইংলিশও নই, এলসা বলল। তবে জেনি আর মাইক জানতে পারে, কারণ ওরা ইংরেজ।

সন্দেহ আছে, বলল কিশোর। ককনিদের সঙ্গে ওদের সম্পর্ক থাকার কথা নয়।

আগ্রহের সঙ্গে বলল নরি, মিস্টার সান আর দাদা মাঝে মাঝেই অদ্ভুত ভাষায় কথা বলত। কিশোর, সমাধান করে ফেলছি আমরা, তাই না?

তাই তো মনে হয়, বলে নকলটা বের করে মেলল কিশোর। দেখি আলোচনা করে। প্রথমে, হোয়্যার দ্য ওয়াইল্ড ডগস লিভস, দ্য বটল অ্যান্ড স্টপার; শোজ দ্য ওয়ে টু দ্য বিলাবং হোয়্যার দ্য ওয়াইল্ড ডগস লিভস রাইমিং স্ল্যাং নয়। এটা বোঝায় কারমলের বাড়ি। বই বলছে, বটল অ্যান্ড স্টপার মানে কপার, অর্থাৎ পুলিশ। বিলাবঙের মানে পুকুর কিংবা ডোবা কিংবা ঝর্না। তারমানে বলা হয়েছে, এখানে এসে একজন পুলিশম্যানকে খুঁজে বের করতে যে একটা বিশেষ জলাশয় চেনে।

চেঁচিয়ে বলল উকিল, সেই পুলিশম্যানকে নিশ্চয় চেনার কথা তোমার!

কিন্তু চিনি না। তুমিও জানো পুলিশ দেখতে পারত না কারমল।

আছে নিশ্চয় একজন, কিশোর বলল। থাক, সেটা পরে দেখা যাবে। পরের ধাঁধাটা দেখা যাক এবার। অ্যাবাভ দ্য অ্যাপলস অ্যাণ্ড পেয়ারস অল অ্যালোন; দ্য লেডি ফ্রম ব্রিস্টল রাইডস ফ্রম আ ফ্রেণ্ড। অ্যাপল অ্যাণ্ড পেয়ারস হল গিয়ে সিঁড়ি। তবে লেডি ফ্রম ব্রিস্টলের মানে কি জানি না আমরা এখনও। আর রাইডস ফ্রম আ ফ্রেণ্ডও রাইম মনে হচ্ছে না। এটা অন্য কোন ধরনের কোড।

তারমানে দাঁড়াল, রবিন বলল, বিশেষ জলাশয়টার কাছে কোন সিঁড়ি পাব আমরা। এবং তার ওপরে ব্রিস্টলের মহিলা কোন একটা সূত্র দেবে একজন বন্ধুকে।

নাহ, গুঙিয়ে উঠল মুসা, এখন আর সহজ লাগছে না।

ধাপে ধাপে, ধীরে ধীরে এগোতে হবে, বলল কিশোর। ফ্রেণ্ড বলেছেন বটে, কিন্তু বন্ধুর কথা হয়ত বোঝননি। সে পরে দেখা যাবে। পরের ধাঁধাটা বলছেঃ অ্যাট দ্য টেনথ বল অভ টোয়াইন, ইউ অ্যাণ্ড মি; সী আওয়ার; ও হ্যান্ডসাম মাগ অ্যাহেড। ভুরু কোঁচকাল সে। কঠিন হচ্ছে আস্তে আস্তে। ইউ অ্যাণ্ড মি-এর মানে, আ কাপ অভ টি, বা এক পেয়ালা চা। কিন্তু বল অভ টোয়াইনের মানে বুঝতে পারছি না। আর, সী আওয়ার হ্যাণ্ডসাম মাগ অ্যাহেডও রাইম নয়। এই তিনটের তো কিছু কিছু মানে করতে পেরেছি, চার নাম্বারটা একেবারে দুর্বোধ্য। ওয়ান ম্যানস ভিকটিম ইজ অ্যানাদারস ডারলিন, ফলো দ্য নোজ টু দ্য প্লেস। এটাতে রাইম আছে কিনা সেটাই বুঝতে পারছি না।

ইউ অ্যাণ্ড মি যদি এক কাপ অভ টি হয়, এলসা বলল, হ্যাণ্ডসাম মাগ বলে হয়ত বিশেষ কোন চায়ের পাত্রের কথা বুঝিয়েছে।

হ্যাঁ, তা হতে পারে, একমত হল কিশোর।

কিন্তু, রবিন প্রশ্ন তুলল, কারমল বলছেন, আওয়ার মাগ! দ্য মাগ কিংবা হিজ মাগ বলেননি। আর চতুর্থ ধাঁধায় তোমার নাক বা আমার নাক না বলে কেন দ্য নোজ বা নাকটি বললেন?

এখনও বুঝিনি, স্বীকার করল কিশোর। তবে আমি শিওর, কারণ একটা নিশ্চয় আছে, যাই হোক, পঞ্চম ধাঁধা বলছে, হোয়্যার মেন বাই দেয়ারট্রাবল অ্যাণ্ড স্ট্রাইফ, গেট আউট ইফ ইউ ক্যান। ট্রাবল অ্যান্ড স্ট্রাইফের মানে ওয়াইফ। কারমলের কথার মানে দাঁড়াচ্ছে, একজন স্ত্রী কিন। এর কোন অস্ট্রেলিয়ান মানে আছে, মিসেস কারমল? সেটেলাররা ইংল্যাণ্ড থেকে স্ত্রী কিনে নিয়ে যেত, না?

তা অনেকটা এরকমই, এলসা বলল। সেটেলারদের জন্যে জাহাজ বোঝাই করে মেয়েমানুষ পাঠানো হত। ওখান থেকে যার যার পছন্দমত স্ত্রী বাছাই করে মিত ওরা।

মাথা ঝাঁকাল কিশোর। হুঁ, খাপ খাবে মনে হচ্ছে। গেট আউট ইফ ইউ ক্যান বলে হয়ত বিয়ে ফাঁকি দিয়ে বেরিয়ে আসতে বলেছে। যদিও মাথামুণ্ড কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। এবার আসা যাক ছয় নম্বর ধাঁধায়। ইন দ্য পশ কুইনস ওল্ড নেড, বি ব্রাইট; অ্যাণ্ড নেচারাল অ্যাণ্ড দ্য প্রাইজ ইজ ইওরস। ওল্ড নেড মানে বিছানা। পশ হলোগে ফিটফাট। তারমানে পাথরগুলো পাওয়া যাবে ফিটফাট কোন রানীর বিছানায়।

আনমনে মাথা নেড়ে নিজেকেই যেন প্রশ্ন করল উকিল, কোন্ রানী? কিসের বিছানা? কোন্ মিউজিয়মে আছে?

থাকতে পারে। তবে শেষ ধাঁধা নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় হয়নি। আগেরগুলোর সমাধান করতে না পারলে এটা বোঝা যাবে না।

এখন তাহলে প্রথম কাজ, রবিন বলল, বটল অ্যান্ড স্টপার খুঁজে বের করা, যে জানে জলাশয়টা কোথায়।

হতে পারে, ওই জায়গাটা পছন্দ ছিল কারমলের, অনুমান করল মুসা।  সাঁতার কাটতে যেতেন, কিংবা পানি আনতে, কিংবা মাছ ধরতে…

মাছ ধরতে! চেঁচিয়ে উঠল নরি। মা, আমাদের বাড়ির পাশের কাউন্টি পার্কে মাছ ধরতে যেত দাদা! ডেপুটি গ্যারেটকে নিয়ে যেত!

ডেপুটি শেরিফ! কথাটা ধরল রবিন। তারমানে পুলিশম্যান! কাউন্টি পুলিশম্যান!

তাই তো, উকিল বলল। পার্কের পুলিশ অফিসার। হঠাৎ ফিসফিসিয়ে মুসা বলল, কিশোর, রাস্তায়!

সবাই দেখল, গাছের নিচে পার্ক করা একটা নীল গাড়ির গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে বিশালদেহী একজন লোক।

আরেকজন গুপ্তধন শিকারি হবে হয়ত,আন্দাজ করল উকিল।

হয়ত, কিশোরের কণ্ঠে অস্বস্তি। ইয়ার্ড থেকে বেরিয়েও লোকটাকে দেখেছে, সেকথা জানাল।

দরজার দিকে রওনা দিল উড। জিজ্ঞেস করা দরকার।

ছেলেরা দেখল, উকিল, রাস্তায় নামতেই গাড়িতে উঠে বসল লোকটা। চলে গেল। ফিরে এল উড।

ওই মজা দেখতেই.এসেছে, বলল সে। অনেক আসছে ওরকম।

উঠে দরজার দিকে চলল তিন গোয়েন্দা। পেছনে এল নরি। আমিও তোমাদের সঙ্গে কাজ করছি, মনে আছে?

তোমার কাজের দরকার নেই, নরম্যান, পেছন থেকে কড়া গলায় বলল তার মা।

হ্যাঁ, তোমার মা ঠিকই বলেছেন, মুসা বলল। তুমি এখনও নেহায়েতই শিশু।

শিশু! চিৎকার করে বলল নরি। ফিরিয়ে নাও বলছি! ফিরিয়ে নাও কথাটা!

আসলে, বোঝানোর চেষ্টা করল কিশোর, তুমি আমাদের সঙ্গে এলে কাজের চেয়ে বাধাই সৃষ্টি করবে বেশি, নিশ্চয় বুঝতে পারছ।

রাগে গাল ফুলিয়ে ফেলল নরি। আমি, আমি তোমাদের সবাইকে দেখিয়ে দেব দাঁড়াও…! বলতে বলতে ছুটে বেরিয়ে গেল সে।

বাইরে বেরিয়ে সাইকেলে চাপল গোয়েন্দারা। পকেটে চাপড় দিয়ে নিশ্চিত হয়ে নিল কিশোর যে, ওয়াকিটকি আছে! বলল, চল।

রাস্তায় পড়ে, বাঁয়ে মোড় নিল ওরা, মুখ ঘোড়াল কাউন্টি পার্কের দিকে। জায়গাটা শহরের বাইরে। পথের ডানে গাছপালায় ছাওয়া প্রায় বুনো এলাকা। খানিক দূরে একটা বড় শপিং সেন্টার। বাঁয়ে গড়ে উঠেছে বোটানিক্যাল গার্ডেন, সুন্দর, দুর্লভ অনেক গাছও রয়েছে ওখানে। বাগানের পেছনে পাহাড়। কারমলের বাড়ি থেকে বেরিয়ে বাগানের ভেতর দিয়ে একেবেঁকে চলে গেছে একটা পথ, উঠে গেছে পাহাড়ী আবাসিক এলাকায়।

পার্কে ঢুকে পড়ল তিন গোয়েন্দা। জোরে জোরে প্যাডাল ঘুরিয়ে উঠে চলল পাহাড়ী পথ বেয়ে। পেছনে একটা গাড়ি মোড় নেয়ার শব্দ হল, তারপর এগিয়ে। আসতে লাগল। পেছনে তাকিয়ে অস্ফুট শব্দ করে উঠল মুসা। গাড়িটা সোজা এগিয়ে আসছে, থামার বা পাশ কাটানোর কোন লক্ষণ নেই।

নাম, সরো রাস্তা থেকে! চেঁচিয়ে উঠেই নিজের সাইকেলের হ্যাণ্ডেল ঘুরিয়ে দিল মুসা। নেমে পড়ল পাশের খাদে। শাঁ করে ছুটে গেল একটা লাল স্পোর্টস কার, সময়মত সরতে না পেরে লেগে গেল রবিনের সাইকেলের সঙ্গে, ফেলে দিল ওটাকে। সাইকেল পড়ার আগেই লাফ দিয়ে খাদে পড়ল রবিন। গাড়িতে বসা হাসি হাসি মুখটার দিকে মুঠো চাল মুসা। চিৎকার করে বলল, শুঁটকি, রাখ, ধরতে পারলে মজা দেখার! বন্ধুদের দিকে ফিরে বলল, কাল সন্ধ্যায় ওকে বোকা বানানোর প্রতিশোধ নিল ব্যাটা।

ওটার শিক্ষা আর হবে না কোনদিন, আফসোসের ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল কিশোর। রবিনকে টেনে তোলার জন্যে হাত বাড়াল। সব গড়বড় করে দিতে পারে। নজর রাখতে হবে ওর ওপর। বিপদেও ফেলে দিতে পারে।

আর অল্প কিছুদূর উঠেই ডেপুটির অফিস চোখে পড়ল ওদের। কেউ নেই। বোটানিক্যাল গার্ডেনে ঢুকে এদিক ওদিক তাকাল।

হাত তুলে দেখাল রবিন, ওই দেখ, কতগুলো গাছ। আর ওই যে পুকুর।

ঝড় বয়ে গেছে যেন পুকুর পাড়ের বাগানে। হাঁসের পুকুরের চারপাশে যত আপেল আর নাশপাতি গাছ আছে সবগুলোর সর্বনাশ করে ফেলা হয়েছে। ডালপালা একটারও নেই, সব ভাঙা। অসংখ্য হাঁস থাকার কথা পানিতে, অথচ আজ একটাও নেই।

শুধু গাছই নষ্ট করেনি, পুকুর পাড়ের মাটি খুঁড়ে ফেলা হয়েছে। ছোট-বড় অনেক গর্ত। ওখানে এসে দাঁড়াল তিন গোয়েন্দা।

কে জানি আসছে, বলতে বলতে একটা ডাল তুলে নিল মুসা। গুপ্তধন খুঁজতেই আসছে বোধহয়…

এই, চুপ করে দাঁড়িয়ে থাক! ধমক দিয়ে বলল একটা কণ্ঠ।

পাই করে ঘুরল ওরা। হোটখাট একজন মানুষ জ্বলন্ত চোখে তাকিয়ে আছে ওদের দিকে। পরনে শেরিফের পোশাক। আবার বলল, অ্যারেস্ট করা হল তোমাদের।

<

Super User