পাওয়া গেল টনিকে। কিশোরকে ঘিরে এল সবাই।
টনি, কিলোর বলল, আমি কিশোর পাশা, তোমার দাদার বাসায় দেখা হয়েছিল, মনে আছে? শোনো, তোমার সাহায্য দরকার। গাড়িটা নিয়ে আসতে পারবে? দশ মিনিটের মধ্যে?…গুড। খুব জরুরি।…এলে সব বলব। ঠিকানা বলে রিসিভার নামিয়ে রাখল সে। বন্ধুদেরকে জানাল, আসছে। হয়ত ধরতে পারব এরিনাকে। মলিকে কারও কাছে রেখে আসতে হবে তার, তাতে সময় লাগবে। ব্যাংকে গিয়ে জিনিসটা বের করতেও কিছু সময় লাগবে। আশা করছি, ততোক্ষণে চলে যেতে পারব আমরা।
রাস্তায় বেরিয়ে এল ওরা। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। ঠিক দশ মিনিটের মাথায় পৌঁছে গেল টনি। ওঠো ওঠো, জলদি!
গাড়িটা বড় না, কিন্তু জায়গা হয়ে গেল সকলের।
কোথায় যেতে হবে? জানতে চাইল টনি।
বলল কিশোর।
দ্রুত ফুটল গাড়ি। ভাল চালায় টনি। রাস্তাও সব চেনা। শর্টকাটে চলল সে।
তবুও গোয়েন্দাদের মনে হল, বড় আয়ে চলছে গাড়ি। লাফ দিয়ে দিয়ে এগোচ্ছে যেন ঘড়ির কাঁটা। টনিকে সব খুলে বলল কিশোর।
ব্যাংক থেকে বেরিয়েই গেল কিনা, পেছনের সিট থেকে বলল উদ্বিগ্ন জিনা, কে জানে!
সময়মতই পৌঁছল ওরা। সবে ব্যাংকের দরজার বাইরে পা রেখেছে এরিনা। হাতে সেই ব্যাগটা, নিশ্চয় ওটার ভেতরেই রেখেছে হারের বাক্স।
সিঁড়ি বেয়ে নেমে এসে চত্বর পেরোল সে। রাস্তায় উঠে হনহন করে হাঁটতে লাগল। একবারও পেছনে তাকাল না
আমি ভেবেছিলাম ট্যাক্সি নেবে,মুসা বলল।
নেয়নি যখন, কিশোর বলল, বোঝাই যাচ্ছে, বেশি দূরে যাবে না। নামো নামো, হেঁটে যাব আমরাও।
গাড়ি থেকে বেরোল গোয়েন্দারা। টনিও নামল।
একসাথে থাকা ঠিক হবে না, কিশোর বলল। চোখে পড়ার ভয় আছে। টনি, তুমি আগে আগে থাক। তোমাকে চেনে না এরিনা। দেখে ফেললেও সন্দেহ করবে না।
ডানে মোড় নিয়ে বড় রাস্তায় পৌঁছে গেল এরিনা। দ্বিধা করল একমুহূর্ত। তারপর ফিরে তাকাল। তবে টনিকে ছাড়া আর কাউকে দেখতে পেল না সে। কিশোরের অনুমান ঠিক, টনিকে চিনতে পারল না সে।
নিশ্চিন্ত হয়েই যেন আবার দ্রুত হাঁটতে লাগল এরিনা। তারপর একসময় গতি কমিয়ে দিল। সময় এসে গেছে, বুঝল গোয়েন্দারা।
বেশ দূরে রয়েছে ওরা। তবু দেখতে পাচ্ছে, রাস্তার লোকের নজর নেই এরিনার দিকে। যে যার পথে চলেছে। তারমানে, ম্যাকি ওদের মাঝে নেই।
চলার গতি আরও কমালো এরিনা। এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। লোকটাকে খুঁজছে? নাকি অন্য কিছু?
হঠাৎ যেন মনস্থির করে ফেলল এরিনা। বা বগলের তলায় ছিল ব্যাগটা, ডান হাতে নিল। তারপর ছুঁড়ে দিল পথের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একটা গাড়ির দিকে।
গাড়ির সামনের জানালা দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল ব্যাগটা।
মুহূর্তে ঘটে গেল ঘটনাটা।
ব্যাগটা ছুঁড়ে দিয়েই চলার গতি আবার বাড়িয়ে দিল এরিনা।
সবাইকে আসতে বলে দৌড় দিল কিশোর। টনি আগেই দৌড়াতে শুরু করেছে। চোখের পলকে তার পাশে চলে গেল রাফিয়ান। অবাক হয়ে পথচারীরা তাকিয়ে আছে ওদের দিকে।
এত তাড়াহুড়ো করেও লাভ হল না।
ইঞ্জিন চালই ছিল গাড়িটার। রাস্তায় উঠেই হটতে শুরু করল।
থমকে দাঁড়াল কিশোর আর টনি দুজনেই। রাফিয়ান দাঁড়াল না। লাফ দিয়ে গিয়ে পড়ল গাড়িটার ওপর। লাভ কিছুই হল না, শুধু তার নখের সামান্য আঁচড় লাগল গাড়ির বডিতে।
দেখতে দেখতে হারিয়ে গেল গাড়িটা।
চেঁচামেচি শুনতে পেয়েছে এরিনা। ফিরে তাকিয়ে গোয়েন্দাদের দেখে অবাক। চোখ কপালে তুলে জিজ্ঞেস করল, আমাকে খুঁজে বের করলে কিভাবে?
জানাল কিশোর।
চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে গেছে এরিনার। সর্বনাশ! ও তোমাদেরকে নিশ্চয় দেখেছে…
দেখুক, দাঁতে দাঁত চাপল মুসা। ধরতে পারলে হত আজ! ব্যাটাকে…
মলিকে না আবার ধরে নিয়ে যায়…
হারটা তো দিয়েই দিয়েছেন, বেশ একটু ঝাঝের সঙ্গেই বলল জিনা। তাহলে আর নেবে কেন? অযথাই কষ্ট করলাম আমরা, মিসেস কলিনস। জিনিসটা দিলাম আপনাকে, কিন্তু রাখতে পারলেন না।
হার গেছে যাক। আমার মলির কিছু না হলেই হয়।
ব্যাটা পালাল। নিচের ঠোঁটে চিমটি কেটে আনমনে বলল কিশোর। ও-ই জিতল শেষ পর্যন্ত! দীর্ঘশ্বাস ফেলল রবিন।
ভূল হয়ে গেছে, মুখ কালো করে বলল টনি। ট্যাক্সিতে করে পিছু নিতাম, সেটাই ভাল হত।
টনির সঙ্গে এরিনার পরিচয় করিয়ে দিল কিশোর।
সামলে নিয়েছে এরিনা। সবাইকে ধন্যবাদ দিল। মাথা চাপড়ে দিল রাফিয়ানের। বলল, দেখ, কিছু মনে কোরো না তোমরা। অনেক কষ্ট করেছ আমার জন্যে। কপাল খারাপ, রাখতে পারলাম না জিনিসটা।
এত সহজে হাল ছাড়ার পাত্র নয়, কিশোর পাশা। ড্রাইভারের চেহারা দেখেছেন?
না। অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে ছিল। তাছাড়া এত তাড়াতাড়ি…
হুঁ, আমরাই দেরি করে ফেলেছি! মুঠো শক্ত হয়ে গেল মুসার।
আর কিশোর মনে মনে নিজেকে গালমন্দ করছে। কেন একবারও ভাবেনি, গাড়িতে করে আসতে পারে লোকটা?
আবার ফিরে এসে টনির গাড়িতে উঠল ওরা। এরিনারও জায়গা হয়ে গেল।
তাকে বাড়ি পৌঁছে দেয়ার প্রস্তাবটা টনিই দিয়েছে।
এক পড়শীর কাছে মলিকে রেখে এসেছে এরিনা। বাসার সামনে গাড়ি থামলে আরেকবার সবাইকে ধন্যবাদ জানাল সে। নামল। বলল, হারটা গেছে, যাক, কিন্তু ওটার বদৌলতে তোমাদের মত বন্ধু পেয়েছি। এটাই আমার অনেক বড় পাওয়া।
এরিনা চলে গেলে টনি বলল, চল, তোমাদেরকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসি। গাড়ি চলছে। খানিক পর আবার বলল, চোরটা তাহলে পালালই শেষতক।
পালিয়ে যাবে কোথায়? দৃঢ়কণ্ঠে বলল কিশোর। আমি এর শেষ দেখে ছাড়ব। একটা বুদ্ধি এসেছে আমার মাথায়। চোরটা যদি ম্যাকি হয়ে থাকে, ধরা তাকে পড়তেই হবে।
যদি না হয়? রবিন বলল।
ওই ব্যাটাই, ফুঁসে উঠল জিনা। এরিনার কাছে হার আছে, এই খবর একমাত্র ওই শয়তানটাই জানে। হারটা ফিরিয়ে আনতেই হবে।
কিভাবে? প্রশ্ন রাখল মুসা।
হ্যাঁ, কিভাবে? টনিও জানতে চাইল। ম্যাকির বাড়িতে গিয়ে খুঁজবে নাকি? অনেকটা সেরকমই, জবাব দিল কিশোর।
তোমার সাহস আছে, কিশোর পাশা, টনি বলল। বাঘের গুহায় গিয়ে ঢুকতে চাইছ। লোকটা ভারি বদ, তাতে কোন সন্দেহ নেই। যে লোক কিডন্যাপ করার হুমকি দিতে পারে…যাকগে। যখন যাও, আমাকে ডেকো.ওই যে, তোমাদের বাসায় এসে গেছি।
লাঞ্চের পর হইতে বেরোল গোয়েন্দারা। চলে এল স্কোয়্যারটার পাশের পার্কে। চমৎকার রোদ। এক কোণে একটা ঝাড়ের কাছে বসে আলোচনা শুরু করল ওরা।
ম্যাকির দোকানের ওপর চোখ রাখতে হবে, কিশোর বলল। খদ্দের ছাড়া আর কে কে আসে দোকানে, জানতে হবে। দরকার হলে ওর পিছু নেব। হারটা নিয়ে গিয়ে তো আর বসে থাকবে না, বিক্রি করতে হবে।
যদি টাকা চায়, রবিন বলল।
হ্যাঁ, যদি টাকা চায়, বলল মুসা। কিশোর, শুধু দোকানের ওপর চোখ রেখে যে লাভ হবে না, সেটা ভাল করেই জানো তুমি। অন্য কোন মতলব করেছ। সেটা কি, বলবে?
দোকানে ঢোকার চেষ্টা করব।
মানে?
ভেতরে ঢুকে না খুঁজেলে কিভাবে জানব কোথায় রেখেছে হারটা?
কিন্তু আমাদেরকে এখন চেনে সে। দরজা থেকেই তাড়াবে।
সেজন্যেই তো না দেখিয়ে চুকব। চুরি করে। মুচকি হাসল কিশোর। চুরি করে আমাদের বাড়িতে ঢুকতে পেরেছে সে, আমরা কেন পারব না? তেমন বুঝলে রাতের বেলাই ঢুকব।
ভ্রূকুটি করল জিনা। না, কিশোর, মা রাতে বেরোতে দেবে না। আর যদি দেয়ও–জানতে চাইবে কোথায় যাচ্ছি।
তা তো চাইবেনই। সেজন্যেই তো কাজে নামার আগে আলোচনা করতে চাইছি ভালমত। রাতে গিয়ে সুবিধে হবে কিনা সেকথাও ভাবতে হবে। কারণ, রাতের বেলা দোকান তালা দেয়া থাকবে। নিচের ঠোঁটে একবার চিমটি কাটল কিশোর। ম্যাকি কোথায় থাকে জানি না। দোকান কথন বন্ধ করে তাও জানি না। আসলে, ওর সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানি না আমরা। জানতে হলে নজর রাখতে হবে ওর ওপর।
নজর রাখার ব্যাপারে কারোই অমত নেই।
পরের তিন দিন তা-ই করল ওরা। পালা করে। চোখ রাখল ম্যাকির দোকানের ওপর। জানা হয়ে গেল অনেক তথ্য।
পাঁচটায় দোকান বন্ধ করে, রবিন জানান।
বিক্রি বন্ধ করে আরকি, মুসা বলল। বেরোয় ছটার সময়।
ওই এক ঘন্টা হিসেব-নিকেশ করে, বলল জিনা। এখানে ওখানে ফোন করে। জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখোচ্ছ।
তারপর ছটার সময় বেরিয়ে, একটা রেস্টুরেন্টে যায়, কিশোর বলল, খাওয়ার জন্যে। থাকে একটা ফ্ল্যাটবাড়ির দোতলায়। অনেক কিছুই জানলাম। এখন কাজ শুরু করা যেতে পারে…
পরিকল্পনার কথা বন্ধুদের জল সে। দোকান বন্ধ হওয়ার আগেই ঢুকে পড়তে চায় ওখানে, লুকিয়ে বসে থাকতে চায় কোথাও। তারপর ম্যাকি বেরিয়ে গেলে জিবে হারটা। মুখ খুলতে যাচ্ছিল মুসা, হাত তুলে তাকে থামাল গোয়েন্দাপ্রধান। না না, ভয় নেই, বিপদে পড়ব না। তোমরা বাইরেই থাকবে। দরকার পড়লে সাহায্য করতে পারবে আমাকে। আর যদি ম্যাকি ধরেই ফেলে, আমাকে, সোজা গিয়ে পুলিশকে জানাবে। ঠিক আছে?
অমত করে লাভ হবে না, বুঝতে পারল সহকারীরা। একবার যখন মনস্থির করে ফেলেছে কিশোর পাশা, আর তাকে ফেরানো যাবে না। যা ভাল বুঝবে, করবেই। কাজেই অহেতুক তর্ক করল না কেউ।
ঠিক হল, সেদিন সন্ধ্যায়ই দোকানে ঢুকবে কিশোর।
<