হাতের তালুতে হারটা রেখে আঙুল বুলিয়ে দেখছেন মিসেস পারকার। খুব অবাক হয়েছেন। হালকা গোলাপী রঙ মুক্তাগুলোর।

আসলই মনে হয়, বললেন তিনি। এক্সপার্টকে দেখাতে হবে।

আসল হলে অনেক দাম, তাই না, মা?

হ্যাঁ।

ওটার মালিক এখন কে? নিশ্চয় তুমি?

তাই তো হওয়ার কথা, জবাবটা দিল কিশোর। চেয়ারটা তিনি কিনে এনেছেন। ওটার ভেতরে বাইরে যা থাকবে, সব কিছুর মালিকই তিনি হবেন। তাছাড়ামিস মেয়ারবালের কোন আত্মীয়ও নেই যে ফিরিয়ে দেয়ার কথা ভাবা যাবে।

বাহ, তাহলে তো খুব ভাল! হাততালি দিয়ে বাচ্চা মেয়ের মত লাফিয়ে উঠল জিনা। আমি ওটা পরব, মা!

দেখি, চিন্তিত ভঙ্গিতে মা বললেন, তোর বাবা আসুক, আলাপ করে দেখি। পুলিশকে জানাতে হতে পারে। চোরাই মাল কিনা কে জানে!

আসলই হবে, কিশোর বলল। ম্যাকি সেটা জানে। আর জানে বলেই চেয়ারটা কেনার জন্যে পাগল হয়ে আছে সে। তবে চেয়ারের ভেতরেই ছিল এটা, জানা ছিল না তার, শুধু সন্দেহ ছিল। জানা থাকলে কিছুতেই আমরা কিনতে পারতাম না, অনেক বেশি দাম হেঁকে প্রথমেই নিয়ে যেত ওটা।

তা ঠিক, একমত হল রবিন। লোকটা অসৎ, মুসা মন্তব্য করল। চেহারা দেখেই বোঝা যায়।

শুধু চেহারা দেখে কারও সম্পর্কে ওরকম মন্তব্য করা ঠিক না, আন্টি বললেন। লোকটার ব্যবহার খারাপ নয়। তবে এটা ঠিক, আমারও ভাল লাগেনি ওকে …এহহে, আলু পুড়ে যাচ্ছে…

রান্নায় মন দিলেন আবার আন্টি। ছেলেমেয়েরা ফিরে এল সিটিং রুমে। চেয়ার আর ডেক মোছা শেষ হয়নি, কাজটা সেরে ফেলতে লাগল। তবে এখন ওই গোলাপী মুক্তার কল্লা ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারছে না।

চেয়ারের মধ্যে মুক্তা লুকিয়েছে,মুসা বলল, অত কাণ্ড!

হ্যাঁ, মাথা দোলাল রবিন।

চেয়ারটার প্রতিটি ইঞ্চি পরীক্ষা করে দেখছে কিশোর। যদি আর কিছু পাওয়া যায়? কাছে দাঁড়িয়ে আছে জিনা।

কিন্তু আর কিছু পাওয়া গেল না।

ইতিমধ্যে আরেকটা আবিষ্কার করে বসল মুসা। বলে উঠল, এই দেখ দেখ, ডেস্কটার ড্রয়ার দেখিয়ে বলল সে। হোট একটা নব। কালো। সহজে চোখে পড়ে না। বলতে বলতেই টিপে দিল ওটা। কিট করে একটা শব্দ হল। তারপর যেন পিছলে সরে গেল একটা ছোট পান্না, বেরিয়ে পড়ল গোপন খোপ।

খাইছে! চেঁচিয়ে উঠল সে। চেয়ারের ফাঁকে মুক্তা..এই গোপন খোপে টাকার তোড়া কিংবা মোহর পেলে অবাক হব না!

সবাই কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে রয়েছে পোপটার দিকে।

খোপটায় খুঁজতে শুরু করেছে মুসা। কিন্তু নিরাশ হতে হল তাকে। টাকাও নেই, মোহরও নেই, আর কোন গহনাও নেই। শুধু একটা সাধারণ হলদেটে খাম।

মুসার হাত থেকে ওটা প্রায় ছিনিয়ে নিল কিশোর। ভেতর থেকে বেরোল একপাতা কাগজ। লেখাটা জোরে জোরে পড়ল সে, আমি মিস আরনিকা মেয়ারবাল, ২৮, অ্যালমণ্ড রোড, আমার একটা মুক্তার নেকলেস আমার বান্ধবী মনিকা ডিকেনসকে উপহার হিসেবে দিয়ে যাচ্ছি, আমার স্মৃতি হিসেবে। এটা আমি পেয়েছিলাম আমার খালার কাছ থেকে। দুই ছড়ায় মোট আটানববইটা মুক্তা আছে এতে…

আটানব্বই! বলে উঠল জিনা। আমরা যেটা পেয়েছি সেটার কথাই বলেছে। আটানব্বইটাই আছে। গুনে দেখেছি।

দুই ছড়া। হাঁ, ঠিকই আছে, মুসা বলল।

বিশ বছর আগে লেখা হয়েছে এই দলিল, কাগজটায় আরেকবার চোখ বলিয়ে বলল কিশোর। অথচ মিস মেয়ারবাল মারা গেছেন মাত্র কয়েকদিন আগে।

রবিন বলল, নেকলেসটার মালিক এখন তাহলে মনিকা ডিকেনস। কি করে খুঁজে বের করব তাকে?

বের করতেই হবে, যেভাবেই হোক, জিনা বলল। যেহেতু দলিল করে রেখে গেছেন মিস মেয়ারবাল, মনিকা ডিকেনসই এখন এটার আসল মালিক। বিশ বছর আগেই তিনি উইল করেছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর নেকলেসটা পাকেন তাঁর বান্ধবী। এতদিন ওটা টেবিলের গোপন ড্রয়ারে থেকে থেকে পুরানো হয়েছে। তিনি নিশ্চয় ভাবেননি এতদিন বাঁচবেন।

চিঠিটা আন্টিকে দেখানো দরকার, মুসা বলল।

দলিলটা পড়ে অবাক হলেন না মিসেস পারকার। তাহলে ঠিকই আন্দাজ করেছি আমি, আসল মুক্তাই। অনেক দামি জিনিস। এক মুহূর্ত ভাবলেন তিনি। আজ বিকেলেই গিয়ে একজন উকিলের সাথে দেখা করব। ওই মহিলাকে খুঁজে বের করে তার জিনিস ফিরিয়ে দেয়ার জন্যে।

উকিলের কাছে যাবেন? কিছুটা হতাশ মনে হল যেন কিশোরকে। আরেক কাজ করলেই তো পারি। ওই মহিলাকে আমরাও খুঁজে বের করার চেষ্টা করতে পারি।

তার মানে গোয়েন্দাগিরি? হাসলেন কেরি আন্টি। কোন কাজ না পেয়ে বিরক্ত হয়ে গেছ নিশ্চয়।

হ্যাঁ, মা, অনুরোধ করল জিনা। উকিলের কাছে তো যে-কোন সময় যেতে পার। তারচে আমরা একবার চেষ্টা করে দেখি না। সময় কাটবে ভাল।

হ্যাঁ, আমারও তাই মত, রবিন বলল।

বেশ, তিন গোয়েন্দার ওপর ভরসা আছে আন্টির। দেখ চেষ্টা করে। তবে ঘরে রাখা ঠিক হচ্ছে কিনা বুঝতে পারছি না। এত দামি একটা জিনিস।

কেউ তো আর জানছে না ওটা আমাদের কাছে আছে, কিশোর বলল। -তা ঠিক।

উত্তেজনার মাঝে খুব দ্রুত দুপুরের খাবার শেষ হলসেদিন ছেলেময়েদের। তারপর আলোচনায় বসল ওরা। অবশ্যই তাদের সঙ্গে রইল রাফিয়ান।

প্রথমেই, কিশোর বলল, মনিকা ডিকেনসের নাম খুঁজতে হবে টেলিফোন বুকে।

ঠিক, বলতে বলতে মোটা ডিরেকটরিটা টেনে নিল রবিন। দেখি।

দ্রুত পাতা উল্টে চলল সে। তার কাঁধের ওপর দিয়ে বুকে এল অন্য তিনজন। ডিকেনস কয়েকটাই পেল, কিন্তু মনিকা ডিকেনস একজনও নেই।

আরেকবার দেখা যাক, মুসা পরামর্শ দিল।

দরকার নেই, কিশোর বলল। এতগুলো চোখকে ফাঁকি দিয়ে নিশ্চয় লুকিয়ে থাকেনি নামটা।

হয়ত মহিলার টেলিফোন নেই, রবিন বলল।

হতে পারে, জিনা বলল।

কিংবা এ-শহর থেকে চলে গেছে,বলল মুসা।

বিয়েও হয়ে গিয়ে থাকতে পারে, অনুমান করল রবিন। স্বামীর নাম হয়ত ডিকেনস নয়।

অথবা মিস মেয়ারবালের মত মরেও গিয়ে থাকতে পারে, ঘোষণা করল যেন কিশোর।

তাই তো, এটা তো ভেবে দেখিনি, জিনা বলল। বিশ বছর আগে উইলটা করা হয়েছে। আর এত ঘনিষ্ঠ বান্ধবী যখন, মিস মেয়ারবালের সমবয়সীও হতে পারে। তাহলে মরে যাবারই কথা।

কিন্তু সেটা জানব কিভাবে আমরা? মুসার জিজ্ঞাসা।

হুফ! রাফিয়ানও যেন একই প্রশ্ন করল।

গম্ভীর হয়ে গেল সবাই। কিশোর বাদে। কাজ জটিল হলেই তার আনন্দ। হাসিমুখে বলল, সহজেই সেরে ফেলব ভেবেছিলাম আমরা, শুধু টেলিফোন বুক দেখেই। হল না।

ইস, ঠিকানাটাও যদি লিখে রেখে যেতেন মিস মেয়ারবাল! জিনা আফসোস করল।।

নিজের কপালে টোকা দিল কিশোর। একটা বুদ্ধি এসেছে মাথায়। মিস মেয়ারবালের বাড়িতে গিয়ে দেখা যাক। খুঁজলে কিছু বেরিয়েও পড়তে পারে। তার ঠিকানা আছে দলিলে।

ঠিক বলেছ! তুড়ি বাজালমুসা। কিন্তু গিয়ে কি খুঁজব ওখানে?

মিস মেয়ারবালের পড়শী থাকতে পারে। তাকে বা তাদেরকে জিজ্ঞেস করব। ওরা হত এমন কোন সূত্র জানাতে পারে, যাতে মনিকা ডিকেনসকে খুঁজতে সুবিধে হয়।

হ্যাঁ, ভাল বলেছ, একমত হল রবিন। তা-ই করা উচিত।

জিনা খুশি হতে পারছে না। মাথা ঝাঁকিয়ে কিশোরের কথায় সায় জানাল, হ্যাঁ, বুদ্ধিটা ভাল। কিন্তু যাব কিভাবে?

কেন, বাসে, রবিন বলল। ট্রেনেও যেতে পারি। লণ্ডনের মত এই শহরেও পাতালরেল রয়েছে। ট্রেনে করে যেতে অসুবিধে কি?

আমাদের অসুবিধে নেই, জিনা বলল। কিন্তু রাফি যাবে কিভাবে? বাক্সে ভরে নেব নাকি? ওকে বাড়িতে রেখে যেতে পারব না।

তাই তো, চোয়াল স্কুলে পড়ল রবিনের। ঋড়িতে করে ছাড়া পাতালরেলে কোন জানোয়ার নেবার অনুমতি নেই। না হয় ভরলাম। কিন্তু যা ভারি ও। কতক্ষণ বয়ে নিতে পারব? কি করা যায় বলতো?

সঙ্গে সঙ্গে জবাব মিলল না। ভাবছে সবাই। বার দুই নীরবে নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটল কিশোর। উজ্জ্বল হল মুখ। ঝুড়িতে করেই যাবে। কিন্তু আমাদের বয়ে নিতে হবে না ওকে। ওর বোঝা ও-ই বইবে।

ধাঁধা বললে নাকি? মুসা ভুরু নাচাল।

মোটেও না,মাথা ঝাঁকাল কিশোর। ওঠো। রওনা হই।

কিশোরের পিছে পিছে চলল সবাই। অবাক হয়ে ভাবছে, কি করবে গোয়েন্দাপ্রধান?

রান্নাঘরে ঢুকল কিশোর। বেতের বড় একটা বাজার করার ঝুড়ি বের করল। চলো, বাই, বলল সে।

কাছের টিউব-রেল স্টেশনটায় চলে এল ওরা। শহরের একটা ম্যাপ জোগাড় করে নিতে কষ্ট হল না। অ্যালমণ্ড রোডটা কোথায় খোঁজ করল তাতে। …

ছুরি বের করে ঝুড়ির নিচের দিকে চারটে গোল ফোকর কাটল কিশোর। তারপর ঝুড়ির মুখ খুলে ইশারা করল রাফিয়ানকে। একান্ত বাধ্য ছেলের মত ঋড়িতে ঢুকে পড়ল বুদ্ধিমান রাফিয়ান। বুড়ির আঙটা ধরল কিশোর, আরেকটা মুসা। দুজনে মিলে কুকুরটাকে বয়ে নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগল প্ল্যাটফর্মে।

টিকেট ক্লার্কের চোখে পড়বে না এমন একটা জায়গায় এসে নামিয়ে রাখল ঝুড়িটা। কিশোর আদেশ দিল, এবার হাঁট রাফি। দেখ চেষ্টা করে পারিস কিনা।

চার ফোকরে চার পা ঢুকিয়ে ঝুড়ি নিয়ে উঠে দাঁড়াল রাফিয়ান। হাঁটতে শুরু করল। এই অদ্ভুত দৃশ্য দেখে হো হো করে হেসে উঠল মুসা। তার হাসিতে যোগ দিল রবিন আর জিনা।

এই, অত হেসো না, হুঁশিয়ার করল কিশোর। স্টেশনের কেউ দেখে ফেললে মুশকিল হবে।

কুকুরের পা নিয়ে হাঁটছে একটা বুড়ি। ওই অদ্ভুত দৃশ্য দেখে হাঁ করে তাকিয়ে রইল প্ল্যাটফর্মের যাত্রীরা। মুচকি হাসল কেউ কেউ।

প্ল্যাটফর্মের একধারে এসে রাফিয়ানকে বলল কিশোর, বসে থাক!

বাধ্য ছেলের মত ঝুড়ি নিয়ে বসে পড়ল কুকুরটা।

রবিন গিয়ে টিকেট কেটে আনল। এরপর ট্রেনের অপেক্ষা।

ট্রেন এল। ধরাধরি করে ঝুড়িটা তোলা হল। মুখোমুখি দুটো সিটে বসল ছেলেময়েরা, একেক সিটে দুজন করে।

খুব লক্ষ্মী ছেলে, রাফিয়ানের প্রশংসা করল জিনা। ওর মত কুকুরই হয় না। কেমন চুপচাপ রয়েছে। অবশ্যই লক্ষ্মী রাফিয়ান, অনেক কুকুরের চেয়ে বুদ্ধিও ধরে বেশি। তবে জাতে সে কুকুর। আর কুকুরের যা স্বভাব, বেড়াল দেখতে পারে না।

জিনা যখন তার প্রশংসা করছে, ঠিক ওই সময় বাতাসে না-পছন্দের জিনিসের গন্ধ পেয়েছে রাফিয়ান। ওই কামরারই একধারে এক মহিলা বসেছে, পায়ের কাছে একটা বেতের ঝুড়ি, মুখ বন্ধ। নড়াচড়া টের পাওয়া যাচ্ছে ওটার ভেতর। বেড়াল!

ঘাউ করে উঠল রাফিয়ান। বিকট চিৎকার। ঝুড়িতে ওকে চুপচাপ থাকতে হবে একথা আর মনে রইল না। লাফ দিয়ে উঠে বুড়ি নিয়েই ছুটল।

তুমুল কাণ্ড শুরু হয়ে গেল কামরার ভেতরে। যাত্রীরা অবাক। বুড়ি হাঁটে কি করে! তারপর ওটার ভেতর থেকে বেরিয়ে এল বিশাল এক কুকুরের মুখ। ভয়ে কুঁকড়ে গেল কেউ। তবে বেশির ভাগই উপভোগ করল ব্যাপারটা। হাসিতে ফেটে পড়ল ওরা।

রাফিয়ানের কোনদিকে কান নেই। চেঁচিয়ে ডাকছে জিনা, শুনতেই পেল না। চোখের পলকে পৌঁছে গেল বেড়ালের ঝুড়ির কাছে।

ঘাউ! ঘাউ! প্রচণ্ড চিৎকার করছে নাক দিয়ে ঠেলে খোলার চেষ্টা করছে বেড়ালের বুড়ির মুখ।

মিয়াঁওও! ভেতর থেকে এল রাগতঃ প্রতিবাদ। ছিটিক হিটিক করে জোরে জোরে থুথু ছেটানোর শব্দ, তারপর তীক্ষ্ণ হিসহিস। ঝট করে বেরিয়ে এল একটা রোমশ কালো থাবা, বেরিয়ে পড়েছে ধারালো নখগুলো। আঘাত হানল রাফিয়ানের নাকে।

আঁউও! করে আর্তনাদ করে উঠল রাফিয়ান। পিছিয়ে এল। বদমেজাজী কুকুর নয় সে, বেড়াল তাড়া করে স্বভাবের কারণে, মজা করার জন্যে, মারার জন্যে নয়। কিন্তু খুড়ির ভেতরে বোকা গাধাটা তার মতলব বুঝতে পারেনি, ভয়ঙ্কর হয়ে রুখে দাঁড়িয়েছে। আরে বাবা, অন্য সময় যেমন গাছে উঠে পালিয়ে যাস, তেমনি পালিয়ে গেলেই পারতিস! যত্তোসব!

হতভম্ব হয়ে গেল রাফিয়ান। তার পিঠের ওপরে ঝুড়ির দুটো হ্যাণ্ডেল বাড়ি খাচ্ছে। নাক থেকে গড়িয়ে পড়ল দুই ফোঁটা রক্ত।

দারুণ দেখিয়েছিস, ম্যাগি! বলল বেড়ালের মনিব। খুব ভাল করেছিস। আচ্ছা শিক্ষা হয়েছে বেয়াদব কুকুরটার।

জবাবে আরেকবার হিসিয়ে উঠল ম্যাগি। যেন কুকুরটাকে ডেকে বলল, আর লাগতে আসবি আমার সাথে, কুকুর কোথাকার!

হতবাক হয়ে পড়েছে জিনাও। রাফিয়ানেরই দোষ। তাই মহিলাকে কিছু বলল না, শুধু চোখের আগুনে একবার ভ করার চেষ্টা চালাল। রাফিয়ানের কলার চেপে ধরল একহাতে, আরেকহাতে ঝুড়ির আঙটা আরেকটা আঙটা ধরতে বলল মুসাকে। বয়ে নিয়ে এল কুকুরটাকে। যার যার সিটে এসে বসল। কামরায় প্রচণ্ড হাসাহাসি চলছে। কুকুরটাকে বসতে বলার কথা পর্যন্ত ভুলে গেছে জিনা। ঝুড়ি পিঠে নিয়ে দাঁড়িয়েই আছে রাফিয়ান। বিচিত্র দৃশ্য। তাতে হাসি আরও বাড়ছে লোকের।

ছেলেমেয়েরা হাসল না। এত গোলমাল কিসের, বুঝতে পারল না রাফিয়ান।

অবশেষে যাত্রা শেষ হল।

খোলা বাতাসে বেরিয়ে এল আবার ওরা। রাফিয়ানকে ঝুড়ি থেকে বের করে স্বস্তির নিঃস্বাস ফেলল।

নিশ্চয় সামনের ওই চওড়া রাস্তাটাই অ্যালমণ্ড রোড, রবিন বলল।

২৮ নাম্বার খুঁজে বের করতে অসুবিধে হল না। অনেক পুরানো একটা বাড়ি। তবে বেশ সুরক্ষিত, নতুন রঙ করা হয়েছে। ধনী একজন ইংরেজ ভদ্রমহিলা এরকম জায়গায়ই বাস করবেন আশা করেছিল ছেলেমেয়েরা।

ঘন্টা বাজাল কিশোর। দরজা খুলে দিল এক মহিলা, বাড়ির কেয়ারটেকার, ওদের সঙ্গে হাসি মুখেই কথা বলল।

হ্যাঁ হ্যাঁ, মহিলা বলল, অত্যন্ত ভাল মানুষ ছিলেন মিস মেয়ারবাল। একাই থাকতেন। বিশেষ কেউ আসতও না তার কাছে, শুধু একজন ছাড়া। তার মতই বৃদ্ধা, মিসেস ডিকেনস। হ্যাঁ, মিস মেয়ারবালকে যেদিন কবর দেয়া হল সেদিনও এসেছিলেন মহিলা, শেষ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে…

একনাগাড়ে বলে চলেছে মহিলা, কথা যেন আর ফুরায়ই না। খানিকক্ষণ উসখুস করে শেষে তাকে থামানোর জন্যে কিশোর বলল, মিসেস ডিকেনস-এর প্রথম নামটা জানেন? মনিকা, তাই না?

মনিকা? হ্যাঁ, বোধহয়। হ্যাঁ হ্যাঁ, একবার শুনেছি বলেও মনে পড়ছে…

কোথায় থাকে জানেন? উত্তেজিত হয়ে উঠেছে মুসা।

নিশ্চয় জান। একদিন মিসেস মেয়ারবাল আমাকে বললেন, একটা জিনিস নিয়ে গিয়ে মিসেস ডিকেনসকে দিয়ে আসতে…

ঠিকানাটা বলুন, জলদি! আর ধৈর্য রাখতে পারছে না জিনা। চেঁচিয়ে উঠল।

তার কথায় থমকে গেল মহিলা। ভুরু কুঁচকে তাকাল। এখুনি যেন নিজেকে গুটিয়ে নেবে শামুকের মত। তাড়াতাড়ি সামাল দেয়ার জন্যে হাসল রবিন। ব্যাপারটা খুব জরুরি, ম্যাম, প্লীজ! মিসেস ডিকেনসকে আমাদের খুব দরকার। একমাত্র আপনিই জানাতে পারবেন তাঁর ঠিকানা।

আবার হাসি ফুটল কেয়ারটেকারের মুখে। তবে জিনার দিকে আর ফিরেও তাকাল না। বলল, দরকার, না? বেশ। লিখে নেবে নাকি? হিরনু স্ট্রীটে থাকেন তিনি। এখান থেকে বেশি দূরে নয়।

হেঁটেই যাবার সিদ্ধান্ত নিল ওরা।

 

ঠিকানামত আরেকটা মস্ত বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল ওরা। ওটারই একটা ফ্ল্যাটে থাকেন মিসেস ডিকেনস। কিশোর বেল বাজালে দরজা খুলে দিল এক তরুণী, কোলে বাচ্চা। হেসে বলল, হাল্লো, কি করতে পারি?

কেন এসেছে জানাল কিশোর। বিষণ্ণ হয়ে গেল মেয়েটা। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল, দেরি করে ফেলেছ। গত হপ্তায় মারা গেছেন তিনি। মিস মেয়ারবালের শেষ অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন, বেশি রাত করে ফেলেছিলেন। ঠাণ্ডা লেগে নিউমোনিয়ায় ধরল। আটচল্লিশ ঘন্টার মধ্যেই শেষ।

নীররে একে অন্যের দিকে তাকাতে লাগল ছেলেমেয়েরা। তদন্ত এখানেই শেষ। যার নামে নেকলেসটা উইল করে দিয়ে গেছেন মিস মেয়ারবাল, তিনিও আর বেঁচে নেই।

দ্রুত ভাবনা চলেছে কিশোরের মাথায়। জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা, মিসেস ডিকেনসের কোন আত্মীয় স্বজন আছে, জানেন? স্বামী, কিংবা ছেলেমেয়ে?

স্বামী মারা গেছেন অনেকদিন আগেই। তবে শুনেছি, এক মেয়ে আছে।

কোথায় থাকে বলতে পারবেন?

না। এখানে মাত্র দুমাস হল এসেছি। তবে আরও ফ্ল্যাট আছে, পুরানো লোকও আছে, তারা হয়ত কিছু বলতে পারবে। একজন থাকেন মিসেস ডিকেনসের পাশের ফ্ল্যাটে, বৃদ্ধা। তিনি জানতে পারেন।

ভাবল কিশোর। সবার দরজায় টোকা দিয়ে লাভ নেই। বরং ওই বৃদ্ধাকেই জিজ্ঞেস করা যাক।

ঠিক জায়গাতেই এল সে। প্রশ্নের জবাবে বৃদ্ধা বললেন, হ্যাঁ, জানি। মনিকার মেয়ের নাম মিলি। অনেক আগে বিয়ে হয়েছে। দাওয়াতে আমিও গিয়েছিলাম।

ওখানেই আছে এখনও?

ওটা ওর শ্বশুরের বাড়ি, ভাড়া বাড়ি নয়, থাকারই তো কথা।

ঠিকানাটা জানেন? –

মনে নেই, তবে লিখে রেখেছি কোথাও। দেখি। উঠে গিয়ে একটা আলমারি খুললেন তিনি। একটা নোটবুক বের করলেন। পাতা উল্টে উল্টে একজায়গায় এসে থামলেন। হ্যাঁ, আছে। তার স্বামীর নাম রিচার্ড ব্যানার। সাত নাম্বার পার্ক অ্যাভেন্য। এখনও আছে কিনা কে জানে…অনেকদিন মিলির কোন খবর জানি না। মায়ের সঙ্গে ঝগড়া করে সেই যে চলে গিয়েছিল, আর আসেনি। বড্ড জেদী মেয়ে।

নোটবুকে দ্রুত ঠিকানাটা টুকে নিল রবিন।

বৃদ্ধাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বেরিয়ে এল ওরা।

ঠিকই আছে, বাইরে বেরিয়ে জিনা বলল। মায়ের জিনিস মেয়েই পাবে। এখন পার্ক অ্যাভেনুটা খুঁজে বের করতে হবে আমাদের। কোথায় ওটা, কিশোর?

ম্যাপ দেখল কিশোর। বোট্যানিক গার্ডেনস-এর কাছে বাসে যেতে হবে।

ঝট করে রাফিয়ানের দিকে তাকাল মুসা, তারপর হাতের ঝুড়ির দিকে। হেসে বলল, রাফি, আবার ঢুকতে হবে এটাতে। খবরদার, এবার বেড়াল এসে নাকের কাছে দাঁড়ালেও কিছু করতে পারবি না।

আর কোন গোলমাল হল না। বিশ মিনিট পর নিরাপদেই বাস থেকে নামল ওরা। এসে দাঁড়াল আরেকটা বাড়ির সামনে। যেখানে বাস করে মিলি ব্যানার। এখনও করে, নাকি করত?

<

Super User