বাড়িতে ঢোকার মুখে একটা হলঘর। ঝাট দিচ্ছে একজন লোক। ছেলেমেয়েদের পথ আটকাল। কর্কশ গলায় জিজ্ঞেস করল, কি চাই?

এখানকার কেয়ারটেকার কে? জানতে চাইল কিশোর।

আমি। বল। লোকটা মোটেই আন্তরিক নয়।

আচ্ছা, মিসেস ব্যানার কোন ফ্ল্যাটে থাকেন, বলতে পারবেন?

মিসেস ব্যানার? তিনি তো নেই। কয়েক বছর হল অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছেন। তার স্বামী আর মেয়ের জামাইটাও মরেছে। ওই ছোকরাই গাড়ি চালাচ্ছিল। বেপরোয়া চালাত। আজকালকার ছেলেছোকরাগুলোর স্বভাবই ওরকম। সব কিছুতেই তাড়া। আমার গাড়ি থাকলে…

কেয়ারটেকারকে থামিয়ে দিল জিনা, তার মেয়ে বেঁচে আছেন? আবার বাধা দিল জিনা।

আছে। কপাল খারাপ…

কোথায় থাকেন? ঠিকানাটা বলবেন? আবার বিয়ে করেছেন?

বার বার বাধা পেয়ে মেজাজ বিগড়ে গেল কেয়ারটেকারের। কড়া গলায় বলল, আচ্ছা ছেলে তো! জিনাকে ছেলে বলে ভুল করল সে। কোন কথাই শুনতে চায় না! এই, এত তাড়া থাকলে নিজেই গিয়ে খুঁজে বের কর না। আমাকে জিজ্ঞেস করছ কেন? যাও এখন। কুত্তা ঢুকিয়েছ কেন? পায়ের ময়লা দিয়ে সারা ঘর তো দিলে নোংরা করে…

রেগে উঠতে যাচ্ছিল জিনা, তাকে থামিয়ে দেয়ার জন্যে তাড়াতাড়ি বলল কিশোর, যাচ্ছি। ওপরে গিয়ে দেখি আর কেউ কিছু জানে কিনা…

খবরদার, ওপরে যাবে না বলে দিচ্ছি! গর্জে উঠল কেয়ারটেকার। মাত্র পরিষ্কার করলাম। ময়লা করতে দেব না।

কুকুরটাকে বয়ে নিয়ে যাব আমরা, বলল মুসা।

ভালমত পা মুছে যাব, রবিন বলল।

হবে না! কেয়ারটেকার বলল। বেরোও। কোত্থেকে এক কুত্তা নিয়ে ঢুকেছে! তোমাদের সঙ্গে বকবক করে সময় নষ্ট করতে পারব না।

আর সামলানো গেল না জিনাকে। বকবক তো আপনি করলেন। সেটাই মাতে চাইছিলাম।

রেগে লাল হয়ে গেল কেয়ারটেকার। পারলে ঝাড় দিয়ে বাড়ি মারে। এটা বোধহয় আন্দাজ করে ফেলল রাফিয়ান। দাঁত খিঁচিয়ে লাফ দিয়ে সামনে এগোল। এমন জোরে ঘেউ ঘেউ করে উঠল, ভীষণ চমকে গিয়ে হাত থেকে ঝাড়ু ছেড়ে দিল কেয়ারটেকার।

রাফিয়ানের কলার টেনে ধরে থামাল জিনা। আমাদেরকে আটকানোর কোন অধিকার নেই আপনার। কার সঙ্গে দেখা করতে যাব, না যাব, সেটা আপনার ব্যাপার নয়। আর এত ধমকাচ্ছেন কেন? কি করেছি আমরা? কয়েকটা কথাই শুধু জানতে চেয়েছি।

আমি…তোমরা…, রাগ এবং একই সাথে কুকুরটার ভয়ে কথা আটকে যাচ্ছে কেয়ারটেকারের।

দেখুন, মুসা বলল, ভাল চাইলে পথ ছাড়ুন। নইলে আবার ছেড়ে দেয়া হবে ওকে, রাফিয়ানকে দেখাল সে।

আর আমার বিশ্বাস, সহজে রাগে না কিশোর, কিন্তু এই লোকটার ওপর রেগে গেছে, ওটা আপনাকে কামড়াতে পারলে খুশি হবে। কামড় খেতে চান। নাকি?

খেতে চাইল না কেয়ারটেকার। রাগে গটমট করে চলে গেল একটা দরজার দিকে। টান দিয়ে খুলে ভেতরে ঢুকল, তারপর দড়াম করে বন্ধ করে দিল পাল্লা।

হাসতে শুরু করল জিনা। যাক, ভয় তাহলে পেয়েছে। রাফিয়ানের মাথায় আলতো চাপড় দিয়ে বলল, খুব ভাল করেছিস।

এসো, বলে সিঁড়ির দিকে রওনা হল কিশোর।

দোতলায় উঠে প্রথম যে দরজাটা পড়ল, ওটার বেল বাজাল কিশোর। খুলে দিল এক অল্প বয়সী মহিলা।

গুড আফটারনুন, বিনীত কণ্ঠে বলল কিশোর। বিরক্ত করলাম আপনাকে, সরি। মিসেস ব্যানারের মেয়ের খোজে এসেছি আমরা। তিনি কি এখানে থাকেন?

ব্যানার? নাহ্, এই বুকে ওই নামে কেউ আছে বলে জানি না। তবে আমি এসেছি নতুন, এই কদিন হল।…আচ্ছা, এক কাজ কর না। পাঁচতলায় চলে যাও। একজন বুড়ো ভদ্রলোক থাকেন ওখানে, নাম মিস্টার উইলিয়ামস। গানের শিক্ষক। তিরিশ বছর ধরে আছেন ওই ফ্ল্যাটে। তিনি কিছু বলতে পারবেন।  মহিলাকে ধন্যবাদ জানিয়ে আবার সিঁড়ির দিকে এগোল ওরা। পাঁচতলায় উঠে দেখতে পেল, একটা দরজায় পেতলের নেমপ্লেট লাগানো রয়েছেঃ ডেভিড উইলিয়ামস-পিয়ানো টীচার।

বেল বাজাল কিশোর। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই খুলে গেল দরজা। লম্বা এক বৃদ্ধ দাঁড়িয়ে আছেন। মাথাভর্তি ঝাঁকড়া চুল, সব সাদা। হাসলেন। গুড আফটারনুন, ইয়াং ফ্রেণ্ডস, বললেন তিনি। পিয়ানো শিখতে চাও?

জ্বী না, দ্রলোকের হাসিটা ফিরিয়ে দিল কিশোর। আপনার সঙ্গে কয়েকটা কথা আছে। সময় হবে?

এসো, বলে সরে দাঁড়ালেন তিনি। রাফিয়ানকে নিয়ে ঢুকবে কিনা দ্বিধা করছে জিনা, দেখে তিনি বললেন, না না, অসুবিধে নেই। নিয়েই এসো। কুকুরটা তোমার,, ইয়াং ম্যান? কেয়ারটেকারের মতই জিনাকে ছেলে বলে ভুল করেছেন মিস্টার উইলিয়ামসও। – হাসল জিনা। নিতান্তই ভদ্রলোক এই মানুষটি, তাঁকে ফাঁকি দিতে চাইল না সে। বলল, হ্যাঁ, স্যার, আমারই। আর আমি ছেলে নই, মেয়ে, জরজিনা। ওর নাম রাফিয়ান।

একে একে সকলের সঙ্গে হাত মেলালেন উইলিয়ামস। দেখাদেখি রাফিয়ানও একটা পা তুলে দিল। ভুরু কুঁচকে এক মুহূর্ত ওটার দিকে তাকিয়ে রইলেন তিনি। তারপর হেসে পা ধরে ঝাঁকিয়ে দিলেন।

আসার কারণ জানাল কিশোর।

হ্যাঁ, বললেন মিস্টার উইলিয়ামস, কেয়ারটেকার ঠিকই বলেছে। ভাবলে খারাপই লাগে। খুব ভাল লোক ছিল ওরা। মিলিও মারা গেছে, তার স্বামীও। জামাইটাও বাঁচেনি। তবে মিলির মেয়ে এরিনা বেঁচে আছে। ওই গাড়িতে তখন ছিল না সে। এখানেই ওর জন্ম। ওকে পিয়ানো বাজানো শিখিয়েছিলাম আমি। খুব ভাল হাত ওর, আমার ছাত্রদের মধ্যে ওর মত কমই পেয়েছি। এখন তার বয়েস সাতাশ। আর বিয়ে-থা করেনি। আমার মতই এখন পিয়ানো বাজানো শিখিয়ে পেট চালায়। একটা মেয়ে আছে। নাম মলি।

পুরো নাম কি তার? জিজ্ঞেস করল কিশোর। মানে, স্বামীর নাম কি ছিল?

কোথায় থাকে? যোগ করল মুসা।

স্বামীর নাম ছিল কলিনস। দুই কামরার একটা ফ্ল্যাটে থাকে এরিনা, কাছেই,  সাইক্যামোর রোডে।

আনন্দে উজ্জ্বল হল কিশোর গোয়েন্দাদের মুখ।

থ্যাঙ্ক ইউ ভেরিমাচ, স্যার, কিশোর বলল। আপনাকে বলতে অসুবিধে নেই, জরুরি একটা ব্যাপারে তাকে খুঁজছি। একটা খুব দামি জিনিস আছে আমাদের কাছে, ওটার মালিক এখন মিসেস কলিনস।

জিনিসটা কি জানতে চাইলেন না মিস্টার উইলিয়ামস। সত্যিই তিনি দ্রলোক। বললেন, শুনে খুশি হলাম। অনেক কষ্ট করে মেয়েটা। জিনিসটা পেলে সাহায্য হবে।

সাইক্যামোররোডটা কোথায়, স্যার? মুসা জিজ্ঞেস করল।

এই সময় ঝটকা দিয়ে দরজা খুলে ঘরে ঢুকল এক তরুণ। বয়েস আঠারো মত হবে। চমকে গিয়ে ঘেউ ঘেউ শুরু করল রাফিয়ান।

আরে আরে, এত রাগ করার কিছুই নেই, রাফিয়ানকে শান্ত করার জন্যে হাসলেন উইলিয়ামস।ও আমার নাতি, টনি। তোকে মারবে না।

সবার সঙ্গে টনির পরিচয় করিয়ে দিলেন মিস্টার উইলিয়ামস। ওদেরকে সাইক্যামোর রোড দেখিয়ে দেয়ার প্রস্তাব দিল টনি। বলল, কাছেই। চলো, দেখিয়ে দিই।

মিস্টার উইলিয়ামসকে আরেকবার ধন্যবাদ জানিয়ে বেরিয়ে এল ওরা। টনির সাথে চলল। ছেলেটাকে ভালই মনে হল ওদের, প্রচুর কথা বলে। বলল, তোমাদের কথা আমি শুনেছি। আমেরিকায় গিয়েছিলাম একবার, লস, অ্যাঞ্জেলেসে। তোমরা তিন গোয়েন্দা, অনেক জটিল রহস্যের সমাধান করেছ। পত্রিকায়ও অনেকবার উঠেছে, তোমাদের নাম। শেষবার বোধহয় কয়েকটা জটিল ধাঁধার সমাধান করেছিলে, এক বুড়ো লোকের লুকিয়ে রেখে যাওয়া গুপ্তধন বের করেছিলে।

হ্যাঁ, হেসে বলল মুসা। তোমার স্মৃতিশক্তি খুব ভাল।

অনেক নাম তোমাদের লস অ্যাঞ্জেলেসে। তোমাদের নাম আরও ছড়িয়েছেন বিখ্যাত ফিল্ম প্রডিউসার ডেভিস ক্রিস্টোফার। তাই না? তা, আমাদের শহরে বেড়াতে এসেছ বুঝি? ভাল। তোমাদেরকে সব রকমের সাহায্য করব আমি। যেকোন দরকার হলেই আমাকে ডেকো। আমার বাবার গাড়ি আছে, আমাকেও চালাতে দেয়। কাগজ আছে? আমাদের টেলিফোন নাম্বার লিখে রাখো। বলতে বলতে নিজেই মানিব্যাগ থেকে একটুকরো কাগজ বের করে ফোন নাম্বার লিখে দিল টনি।

কাগজটা পকেটে রাখল কিশোর।

এরিনা কলিনসের বাড়ি দেখিয়ে দিল টনি! নতুন বন্ধুকে ধন্যবাদ এবং গুডবাই জানিয়ে বাড়িটার দিকে এগোল ওরা। টনি ফিরে চলল তার দাদার বাসায়।

মিস মেয়ারবাল বা মিসেস ডিকেনসের বাড়ির মত জমকালো নয় এই বাড়িটা। সাধারণ। সিঁড়ির গোড়ায় কাঠের বোর্ডে নামের তালিকা টাঙানো রয়েছে। তাতে দেখা গেল এরিনা কলিনস থাকে তিনতলায়। সিঁড়ি বেয়ে উঠে এল ওরা। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বেল বাজাল।

জবাব এল না।

কয়েক সেকেণ্ড অপেক্ষা করে আবার বোম টিপল কিশোর। এবারও সাড়া নেই। আরেকবার টিপে নিশ্চিত হল সে, এরিনা বাড়িতে নেই।

দূর! নাকমুখ কুঁচকে মুসা বলল, আবার কাল আসতে হবে! মাথা আঁকাল কিশোর।

একটা ব্যাপারে একমত হল, সবাই, বিকেলটা মন্দ কাটেনি। বেশ উত্তেজনা গেছে। খুঁজতে হয়েছে বটে অনেক, তবে নেকলেসের আসল মালিককে শেষ পর্যন্ত পাওয়া গেছে।

বাসায় ফিরে এল ওরা। কেরিআন্টিকে জানাল সব। শুনে তিনিও খুশি হলেন।

সেরাতে সকাল সকাল শুতে গেল ছেলেমেয়েরা। সারাটা বিকেল অনেক পরিশ্রম করেছে, ক্লান্ত হয়ে পড়েছে ওরা।

মাঝরাতে রাফিয়ানের চাপা ঘড়ঘড় শব্দে ঘুম ভেঙে গেল জিনার। তার বিছানার পাশেই শুয়ে ছিল কুকুরটা, উঠে দাঁড়িয়েছে।

কি হয়েছে রে, রাফি! ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করল জিনা।

সিটিং রুমের দরজার দিকে মুখ করে আছে রাফিয়ান। কান খাড়া।

মৃদু শব্দটা এবার জিনার কানেও এল। সিটিং রুমে নড়াচড়া করছে কেউ।

<

Super User