সুন্দর দিন। আবহাওয়া ঠাণ্ডা। কিন্তু সাইকেল চালিয়ে পর্বতের পাশের রাস্তায় যখন পৌঁছল তিন গোয়েন্দা। তেতে উঠেছে সূর্য।
ওই যে,। কপালের ঘাম মুছল মুসা। ফ্যান্টম লেক রোড। দেখ, সোজা পর্বতের ভেতরে ঢুকে গেছে।
আর কি খাড়া, গুঙিয়ে উঠল কিশোর চালাতে তো পারবই না, ঠেলে নিতে হবে সাইকেল। চল, কি আর করা যাবে।
ঠেলে নিয়ে উঠতে লাগল ছেলেরা। লম্বা গাছপালার ভেতর দিয়ে এঁকেবেঁকে গেছে পাহাড়ী পথ। পথের ধারে একটা খাড়ি,
ঝাপঝাড়ে বোঝাই, আশপাশে শুকনো, রুক্ষ মরূদ্যান।
এই নাম পেল কোথায়? ধূসর পর্বতের দিকে তাকিয়ে বলল রবিন। ফ্যান্টম লেক। অবাকই লাগছে। এখানকার পর্বতের মাঝে হ্রদ আছে বলে তো কখনও শুনিনি!
ভ্রূকুটি করল কিশোর। হ্যাঁ। অবাক করার মতই।
ওদিকে কয়েকটা পুকুর দেখা যাচ্ছে, মুসা বলল।
আছে। কিন্তু ওগুলোর একটার নামও ফ্যান্টম লেক নয়, বলল রবিন। আমি…।
ইঞ্জিনের শব্দ শোনা গেল। সামনে, ওপর থেকে ফ্যান্টম লেক রোড ধরে নেমে আসছে গাড়িটা। মোড় নেয়ার সময় তীক্ষ্ণ প্রতিবাদ জানাচ্ছে টায়ার, শোনা যাচ্ছে, গাড়ি চোখে পড়ছে না এখনও। দেখা গেল অবশেষে। ছুটে আসছে ওদের দিকেই।
আরি! সবুজ ফোক্সওয়াগেন! চেঁচিয়ে উঠল মুসা।
টিক বানাউ! বলল রবিন।
লুকাতে হবে! কিশোর বলে উঠল। কুইক!
সাইকেল তিনটে পথের পাশে প্রায় ছুঁড়ে ফেলে হুড়মুড় করে ঝোপে ঢুকে পড়ল ওরা। পাশ দিয়ে শাঁ করে বেরিয়ে গেল গাড়িটা, কয়েক গজ এগিয়েই ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষল। এক ঝটকায় দরজা খুলে লাফিয়ে রাস্তায় নেমে ছুটে এল চালক। এই, এই ছেলেরা, থাম!
লোকটা টিক বানাউ নয়। রোগাটে এক যুবক, পুরু গোঁফ, কালো উদাসী চুল। পরনে কালো পোশাক। এই, কি হচ্ছে? আবার চিৎকার করে বলল সে। কি করছ ওখানে…?
পিছিয়ে গেল ছেলেরা। দৌড় দাও! চেঁচিয়ে উঠল মুসা।
পথের ধার দিয়ে ছুটতে শুরু করল ওরা। পেছনে আবার চিৎকার ব পিছু নিল লোকটা।
সামনে একটা ঘন ঝোপ, পথের পাশে। আর কোন উপায় না দেখে তাতেই ঢুকে পড়ল ছেলেরা।
কে…? হাঁপাচ্ছে রবিন। কে লোকটা?
আগে পালানো দরকার, মুসা বলল। তারপর প্রশ্ন।
দাঁড়াও, বলল কিশোর। দেখি ওকে জিজ্ঞেস করে…।
এই সময় আরেকটা শব্দ শোনা গেল। ছুটন্ত ঘোড়ার খুরের খটাখট। পথের ডানে বনের ভেতর থেকে বেরিয়ে এল একজন ঘোড়সওয়ার। হাতে লম্বা চকচকে কি যেন।
কে…ক্কে…! কথা জড়িয়ে গেল মুসার।
দেখ, দেখ! কিশোর বলল।
ওদের পাশ দিয়ে গাড়ির দিকে ঘোড়া ছুটিয়ে গেল লোকটা। ততক্ষণে ঘুরে গাড়ির দিকে ছুট দিয়েছে যুবক। গাড়িতে উঠে, স্টার্ট দিয়ে, একরাশ ধুলো উড়িয়ে চলে গেল ঢালু পথ ধরে। গাড়ির পিছে পিছে কিছুদূর ছুটে গেল ঘোড়সওয়ার। ধরা যাবে না বুঝে থামল, তারপর ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে এগিয়ে আসতে লাগল ছেলেদের দিকে।
রাশে হ্যাঁচকা টান খেয়ে পেছনের পায়ের ওপর দাঁড়িয়ে গেল ঘোড়াটা। বেঁটে, গাট্টাগোট্টা আরোহী কড়া চোখে তাকাল ছেলেদের দিকে। নীল চোখ, লাল মুখ। গায়ে টুইড জ্যাকেট, পরনে আঁটো পায়জামা। হাতের জিনিসটা তলোয়ার।
চুপ! ধমক দিল সে। একদম নড়বে না!
কিন্তু…! প্রতিবাদ জানাতে গেল কিশোর
চুইপ! গর্জে উঠল লোকটা। ওই চোরটার সঙ্গে তোমাদের কি সম্পর্ক?
গরম হয়ে বলল মুসা, ওর সঙ্গে আমাদের কোন সম্পক…
মিথ্যে কথাগুলো পুলিশের কাছে বল। নাও, হাঁট।
কিন্তু, স্যার, আবার শুরু করল কিশোর। আমরা…।
হাঁটতে বললাম না!
শাই করে বাতাসে তলোয়ার চালাল লোকটা। ভয়ে মাথা নিচু করে ফেলল ছেলেরা, না করলেও অবশ্য লাগত না, অনেক ওপর দিয়ে গেছে। আর প্রতিবাদ করল না। পা বাড়াল নীরবে।
দশ মিনিট পর। একটা শৈলশিরা পেরিয়ে হঠাৎ নিচে নেমে গেল আবার পাহাড়ী পথ, উপত্যকায়। ঘন গাছপালা জন্মেছে ওখানে। একেবারে তলায় ছোট একটা পুকুর, দুটো ফুটবল মাঠের সমান। পুকুরের মাঝে উঁচু দ্বীপ, তাতে কিছু পাইন গাছ, আর লম্বা খুঁটির মাথায় একটা লণ্ঠন-একধরনের বীকন বলা যেতে পারে, আলোক-সঙ্কেত দেয়ার জন্যেই তৈরি হয়েছে বোধহয়। দ্বীপের কিনার থেকে শুরু করে খালের মধ্য দিয়ে এসে হ্রদের প্রান্ত ছুঁয়েছে এক সারি পাথর।
থমকে গেল মুসা। এ-কি? এই সেই হ্রদ?
এই, কোন কথা না, পেছনে ধমক দিল অশ্বারোহী। এগোও।
পাহাড়ী পথ ধরে নেমে চলল ছেলেরা। কড়া রোদ। ফিসফিসিয়ে মুসা বলল, হল না ছাই। ডোবাও এরচে বড়।
পথের একটা মোড় ঘুরতে নিচে একটা বাড়ি দেখা গেল। পাথরের বাড়ি, তিনতলা, উঁচু জায়গায় তৈরি করা হয়েছে। চারকোণা একটা পাথরের টাওয়ারের ওপর ব্যাটলমেন্ট, তাতে বড় বড় ছিদ্র। তীর ছুঁড়তে, কিংবা ছিদ্র দিয়ে বন্দুকের নল বের করে গুলি ছোড়ার জন্যে আগের দিনে বানানো হত ওধরনের ব্যাটলমেন্ট। দুধারে দুটো বিশেষ ধরনের জানালাও আছে, ডরমার উইনডো বলে ওগুলোকে। ঘন হয়ে জন্মানো পুরানো আঙুরলতাও বাড়ির দেয়ালের রুক্ষতা ঢাকতে পারছে না।
বাপরে! বিস্ময়ে চিৎকার করে উঠেও স্বর নামিয়ে ফেলল মুসা। বাড়ি না দুর্গ রে, বাবা! ওই টাওয়ারে উঠে বহুদূরের শত্রুকেও দেখা যাবে।
হ্যাঁ, অদ্ভুতই, একমত হল কিশোর।
বাড়ির সামনে পৌঁছে ঘোড়া থেকে নামল লোকটা। আদেশ দিল, যাও, ঢোক।
বিরাট এক ঘরে ঢুকল ওরা, বাইরের হলরুম। দেয়ালের ওপর সুদৃশ্য কাঠের আস্তরণ। কারুকাজ করা পর্দা। পুরানো অস্ত্রশস্ত্র ঝোলানো। বড় একটা এল্ক হরিণের মাথাও রয়েছে। কাঠের মেঝেতে বিছানো রঙচটা কার্পেট। একসময় হয়ত দামি ছিল জিনিসগুলো, এখন পুরানো, মলিন। তলোয়ার দেখিয়ে ওদেরকে আরেকটা বড় ঘরে নিয়ে এল লোকটা, লিভিংরুম, ভারি ভারি পুরানো আসবাবপত্র আছে এটাতে। এককোণে পাথরের মস্ত ফায়ারপ্লেসে আগুন জ্বলছে, তাতেও ঘরের ঠাণ্ডা কাটছে না। শীত শীত একটা ভাব রয়েই গেছে।
ফায়ারপ্লেসের সামনে চেয়ারে বসে আছেন হালকাপাতলা এক মহিলা। সুন্দরী। পাশে দাঁড়ানো রবিনের বয়েসী লাল-চুল এক কিশোর। লোকটার মতই তার পরনেও আঁটো পাজামা।
ধরা পড়েছে? বলে উঠল ছেলেটা।
না, চোরটাকে ধরতে পারিনি, লালমুখো লোকটা জানাল। পালিয়েছে। এগুলোকে ধরেছি।
কাদের নিয়ে এসেছ? মহিলা বলল। কয়েকটা ছেলে…ডিনো, এরা…
ইবলিস হতে কি বয়স্ক হওয়া লাগে নাকি, ডোরিনা ডাই, ডিনো বলল। লাল-চুল ছেলেটার দিকে চেয়ে মাথা নাড়ল, পুলিশকে ফোন কর, এড। সব
শয়তানি আজই বন্ধ করব।
সতর্ক হয়ে উঠল কিশোর। ফোক্সওয়াগেনের লোকটা চুরি করে ঢুকেছিল নাকি এখানে, স্যার? কি নিয়েছে?
হেসে উঠল ডিনো। এহ্, যেন ভাজা মাছটি উল্টে খেতে জানে না।
সত্যি আমরা কিছু জানি না, রেগে উঠল মুসা। লোকটাকেও আগে আর দেখিনি। গাড়িটা অবশ্য দেখেছি, আমাদের পিছু নিয়েছিল।
শান্তকণ্ঠে কিশোর বলল, আমরা আপনার কাছেই আসছিলাম, মিসেস ডাই। এই সময় গাড়িটা আসতে দেখলাম। গাড়ি থামিয়ে আমাদের তাড়া করল লোকটা।… আমি কিশোর পাশা, ও মুসা আমান, আর ও রবিন মিলফোর্ড। তিনজনেই রকি বীচে থাকি। আমাদের সাইকেল রাস্তায় ফেলে এসেছি। এতেই প্রমাণ হয়, আমরা ফোক্সওয়াগেনে লোকটার সঙ্গে আসিনি।
ডোরিনা! কড়া গলায় বলল ডিনো। পুলিশকে জানানো উচিত…।
থাম, ডিনো, ছেলেদের দিকে চেয়ে বললেন মহিলা। এ আমার ছেলে, এডবার ডাই। আর ও ডিনাম্যান হ্যাঙবার, আমাদের আত্মীয়। তো, কেন আসছিলে আমার কাছে?
বাক্সটার জন্যে, ম্যাডাম, জানাল রবিন।।
একটা স্যালভিজ ইয়ার্ড আছে আমাদের, বুঝিয়ে বলল কিশোর। এক মিউজিয়মে গিয়েছিলাম পুরানো মাল কিনতে। সেখানে একটা রাক্স পেয়েছি, তাতে লিটল মারমেইড জাহাজের নাম লেখা। আমরা জেনেছি, বাক্সটা আপনাদের কোন পূর্বপুরুষের ছিল। ওটা হাতে আসার পর থেকেই রহস্যময় কতগুলো ঘটনা ঘটেছে। ফোক্সওয়াগেনের লোকটা আপনার বাড়ি থেকে কি নিয়েছে, জানলে হয়ত ঘটনাগুলোর কারণ বুঝতে পারব।
দ্বিধা করলেন মিসেস ডাই। না, সে কিছু নেয়নি। এরকমই হয়, হয়ে আসছে প্রতিটি বার। চুরি করে ঢোকে, বাওরাড ডাইয়ের জিনিসপত্র ঘাটে। কখনোই কিছু নেয়নি।
কিছুই নেয়নি? হতাশ মনে হল মুসাকে।
কিশোর জিজ্ঞেস করল, ইদানীং কবার ঢুকেছে, মিসেস ডাই?
গত ছয় মাসে পাঁচবার।
সব সময় বাওরাডের জিনিসই খালি ঘাটে। বোধহয়…,এড বলল। বাওরাড আমার দাদার দাদা।
গুপ্তধন খোঁজে! এডের কথাটা শেষ করল রবিন। : মা, দেখলে! ওরাও ভাবছে, গুপ্তধনের খোজে আসে চোর। আমার কথা তো বিশ্বাস কর না।
হাসলেন মহিলা। অনেক আগেই প্রমাণ হয়ে গেছে, গুপ্তধন নেই। শুধুই গুজব।
না-ও হতে পারে, মিসেস ডাই, কিশোর বলল। টিক বানাউ আর বাক্সটার প্রতি তার আগ্রহের কথা জানাল। বাক্সে পাওয়া আঙটিটা দেখাল মহিলাকে।
হাতে নিয়ে জিনিসটা দেখলেন মিসেস ডাই। বললেন, তোমরা পেয়েছ?
দেখি তো, বোনের হাত থেকে আঙটিটা নিল ডিনো। বাহ, খুব দামি জিনিস, মুখ বাঁকাল সে। লাল কাচ আর তামা। বুড়ো ডাই এসব ফালতু জিনিস নিয়েই বাণিজ্য করতে যেত, পুবদেশের গাধাগুলোকে গিয়ে ঠকাত। তোমরাও হদা। লোকে কি আর খোঁজা বাদ রেখেছে নাকি। বুড়োর জার্নাল ঘাঁটতে ঘাঁটতে ছিঁড়ে ফেলেছে, পাতি পাতি করে খুঁজেছে জাহাজটা। কিছু পায়নি।
ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেললেন মিসেস ডাই। ডিনো ঠিকই বলেছে। গুপ্তধনের সামান্যতম ইঙ্গিত থাকলেও ওই জার্নালেই থাকত। নেই বলেই পায়নি লোকে অযথাই গুজব ছড়িয়েছে।
সবাই হয়ত ভুল জার্নালটা পড়েছে, সে-জন্যেই পায়নি। জ্যাকেটের ভেতর থেকে পাতলা জার্নালটা টেনে বের করল কিশোর।
<