চোরটা কি চায়? ভারি গলায় জিজ্ঞেস করল জিম। তোমাদেরকে এখানে নিয়ে এসেছে কেন?

কিছুই চায় না, গম্ভীর হয়ে বলল কিশোর। ও আনেনি আমাদেরকে, নিজেরাই এসেছি। গুহাটা দেখতে।

কিশোরের দিকে চাইল একবার জিম। নরম হল গলার স্বর, ছেলেটা ভাল না। পাকা চোর, হাতেনাতে কেউ ধরতে পারেনি। আজ পর্যন্ত। ওর কাছ থেকে দূরে থাকার পরামর্শই দেব আমি। এখন এসো। জোসেফ গ্র্যাহাম ফিরে এসেছে। তোমাদেরকে যেতে বলেছে।

ক্যাম্পের দিকে রওনা হল ওরা। রাগ পড়ে গেছে জিমের, অন্তরঙ্গ হয়ে উঠছে ছেলেদের সঙ্গে।

গুহায় কেন গিয়েছিলে? এক সময় জিজ্ঞেস করল জিম। গুপ্তধন খুঁজতে? কিছু নেই। সাগরের তলায় ছড়িয়ে গেছে মোহর। কোনদিনই আর পাওয়া যাবে না। তন্ন তন্ন করে খুঁজেছে লোকে, পায়নি। কচিত কখনও এক-আধটা মোহর সৈকতে পড়ে থাকতে দেখা যেত আগে। আজকাল আর তা-ও দেখা যায় না। হাসল গার্ড। সাগরদেবতা কোন জিনিস নিলে আর ফেরত দেয় না। এই তো, বছর দুই আগে, দশ লাখ ডলার নিল…

দশ লাখ ডলার! ভুরু কুঁচকে গেছে কিশোরের।

হ্যাঁ, অকেজো বাঁ হাত দেখিয়ে বলল জিম। ওই টাকার জন্যেই আমার হাতটা গেল…

কৌতূহলী হয়ে পড়ল তিন গোয়েন্দা। কাহিনীটা শোনাতে অনুরোধ করল জিমকে।

এক পরিবহন কোম্পানিতে চাকরি করতাম। সে সময়। টাকা-পয়সা কিংবা মূল্যবান জিনিসপত্র এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব নিত কোম্পানি। আমি ছিলাম একটা আমার কারের গার্ড। ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে পৌঁছে দিতে হত বিভিন্ন জায়গায়। কিছু নিয়মিত কাজ ছিল। তার মধ্যে একটাঃ প্রাইভেট ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিয়ে মেলভিলের ন্যাশনাল ব্যাংকে জমা দিয়ে আসা। দিয়ে আসতাম। ঠিকঠাক মতই চলছিল সব। নির্দিষ্ট কোন একটা পথে চলাচল করতাম না আমরা।

আজ এ পথে গেলে পরের বার অন্য পথে, তারপরের বার আরেক পথে। নির্দিষ্ট কোন সময়ও মেনে চলতাম না। ডাকাত লুটেরাকে ফাঁকি দেবার জন্যেই এই সাবধানতা। কিন্তু তারপরেও একদিন ঘটে গেল। অঘটন…

জিমের কথা থেকে জানা গেল, ঘটনার দিন, ফিশিংপোটের এক ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে মেলভিলে চলেছিল আর্মর কার। গাড়িতে দুজন লোক। ড্রাইভার আর জিম। পথে এক জায়গায় গাড়ি থামিয়ে দুপুরের খাবার খেতে নামল দুজনে। গাড়িটা পথের পাশে পার্ক করে তালা লাগাল সিন্দুকে। তারপর ঢুকল রেস্টুরেন্টে। বসল গিয়ে জানালার কাছে, ওখান থেকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল গাড়িটা।

খাওয়া শেষ করে বেরোল দুজনে। হঠাৎ পাশের একটা পুরানো সিডান গাড়ি থেকে বেড়িয়ে এলো মুখোশপরা দুজন লোক। হাতে রভলভার। ড্রাইভারের পায়ে গুলি করল। একজন। আরেকজন বাড়ি মোরল জিমের কাঁধে, মাথায়। সঙ্গে সঙ্গে বেহুশ হয়ে পড়ল জিম।

গার্ডের পকেট থেকে সিন্দুকের চাবি বের করে নিলো ডাকাতেরা। আমার কারে উঠে বসল। গুলির শব্দ কানে গিয়েছিল একজন কনস্টেবলের। ছুটে এলো সে। গুলি করল দুই ডাকাতকে লক্ষ্য করে। একজনের হাতে গুলি লাগল। গাড়ি নিয়ে পালিয়ে গেল। ডাকাতেরা।

পুলিশ স্টেশনে ফোন করে দিল কনস্টেবল। সাড়া পড়ে গেল। রোড ব্লক করে দিল পুলিশ। কড়া পাহারা বসে গেল রাস্তায় রাস্তায়।

সাঁঝের একটু পরে পাওয়া গেল গাড়িটা, রক্তাক্ত। খালি। একটা পরিত্যক্ত বোট হাউসের কয়েক মাইল দূরে। বোঝা গেল, জলপথে পালিয়েছে ডাকাতেরা।

মাঝরাতে কোস্ট গার্ডদের পেট্রল বোট একটা সাধারণ বোটিকে ভাসতে দেখল উপসাগরে, কঙ্কাল দ্বীপের কাছাকাছি। বোটের একজন কি যেন ফেলছে পানিতে। তাড়াতাড়ি কাছে চলে এলো কোস্ট গার্ডের বোট। দুজন লোক অন্য বোটটাতে। দুই ভাই, ডিক এবং বার্ড ফিশার। দুজনেই খুব ক্লান্ত, হাল ছেড়ে দিয়েছে। বাডের বাহুতে গুলির ক্ষত, রক্ত ঝরছে। লুট করা টাকার একটি নোটও পাওয়া গেল না বোটে।

ব্যাপারটা বুঝেছ তো? নোটের বাণ্ডিল পানিতে ফেলে দিয়েছিল দুই ডাকাত। অনেক খোঁজাখুঁজি করা হয়েছে। পরে, কিন্তু একটা নোটও আর পাওয়া যায়নি। পানিতে ভিজে নিশ্চয় গলে—ছিড়ে গিয়েছিল কাগজের নোট।

টাকা ফেরত দিল না। তা ব্যাটাদের জেল হয়েছিল তো?

হয়েছিল। হোভারসনের রিভলভারের বুলেটে আহত হয়েছে বাড। কিন্তু বিমল ধরা যায়নি, তাই মাত্র চার বছর করে জেল হয়ে গেল দুই ভাইয়ের। জেলখানায় ভাল ব্যাবহারের জন্যে অর্ধেক শান্তি মওকুফ করে। দেয়া হয়েছে ওদের। ছাড়া পেয়েছে হপ্ত দুয়েক আগে। কিন্তু আমার হাত আর ফিরে পেলাম না, জিমের কণ্ঠে ক্ষোভ। কাজও গেল কোম্পানি থেকে। এরপর আর ভাল কোন কাজ পাইনি আজ পর্যন্ত। ইচ্ছে করে, ব্যাটাদেরও হাত ভেঙে দিই…

মুসার বাবা দাঁড়িয়ে আছেন জেটিতে। মোটর বোটে ডুবুরির পোশাক আর অন্যান্য যন্ত্রপাতি তুলছে জোসেফ গ্র্যাহাম।

এই যে, তিন গোয়েন্দাকে দেখে বলে উঠলেন মিস্টার আমান। যাও, বোটে উঠে পড়। চোখ বুজে নির্ভর করতে পার জোসেফের ওপর। খুব ভাল ডুবুরি।

ছেলেদেরকে বোটে তুলে দিয়ে চলে গেলেন মুসার বাবা।

বোট ছাড়ল জোসেফ গ্র্যাহাম। বেশ বড়সড় বোট। এক জায়গায় স্তুপ করে রাখা ডুবুরির সাজ-সরঞ্জাম। ওগুলো দেখিয়ে বলল জোসেফ, আধুনিক জিনিস। খুব ভাল। তো, ডুবুরির কাজ কেমন জান-টান?

মুসা জানাল, প্রাথমিক পরীক্ষায় পাশ করেছে ওরা। সুরকেল ব্যবহার করতে জানে ভালই।

গুড, খুশি হয়ে বলল জোসেফ। এ-বি-সি-ডি থেকে আর শুরু করতে হল না।

দ্রুত এগিয়ে চলেছে বোট। হলুদ একটা বিয়ার কাছে এসে থামিয়ে দিল জোসেফ। নোঙর ফেলল। বলল, আমাদের নিচে একটা ভাঙা জাহাজ আছে। না না, কোন গুপ্তধন নেই। ড়ুবে যাওয়া বেশ কয়েকটা জাহাজ আছে। এদিককার পানিতে। সব কটাই তন্ন তন্ন করে খুঁজেছে ডুবুরিরা। আমাদের নিচে আছে একটা স্প্যানিশ ইয়ট, অনেক বছর আগে ড়ুবেছে। এখানে মাত্র পঁচিশ ফুট গভীর পানি। নিশ্চিন্তে ডুব দিতে পাের। ডিকম্প্রেশনের ভয় নেই।

ফেস মাস্ক আর ফ্লিপার পরে নিলো ছেলেরা। টেনেন্টুনে পরীক্ষা করে দেখল জোসেফ। ঠিকমতই পরা হয়েছে। একটা আলমারি খুলে গ্যাস ট্যাংক, হোস কানেকশন আর ভারি ডাইভিং বেল্ট বের করল সে। বলল, এখানকার পানি খুব ভাল। পরিষ্কার, গরম। ওয়েটসুট পরার দরকার নেই। রবিন, প্রথমে তুমি চল আমার সঙ্গে। সব সময় কাছাকাছি থাকবে, আলাদা হবে না। মুহূর্তের জন্যেও। বুঝেছ?

মাথা কাত করে সায় দিল রবিন।

গ্যাস ট্যাংক, বেল্ট বাড়িয়ে দিল জোসেফ। এগুলো পরে নাও।

পরে নিতে লাগল রবিন। তীক্ষ্ম চোখে তার দিকে চেয়ে রইল জোসেফ। নাহ, পরতে জানে ছেলেটা। ভালই শিক্ষা দিয়েছে ইনস্ট্রাকটর, ভাবল সে।

বোটের পাশ থেকে ঝুলে আছে দড়ির সিঁড়ি। সিঁড়ি বেয়ে পানিতে নামল জোসেফ। সাগরের দিকে পিঠি দিয়ে হাত ছেড়ে দিল সিড়ি থেকে। ঝুপ করে পড়ল চিত হয়ে। ড়ুবে গেল। তার পর পরই একই কায়দায় ডুবল রবিন।

ফ্লিপার নেড়ে দ্রুত ড়ুবে চলল। জোড়া লেগে গেছে পায়ের ভাঙা হাড়। কোন অসুবিধে হচ্ছে না। সাঁতরাতে। কুসুম গরম পানি। স্বচ্ছ। খুব ভাল লাগছে তার।

নতুন এক পৃথিবীতে এসে প্রবেশ করেছে যেন। নিচে একটা বিশাল কালো ছায়া! ড়ুবে যাওয়া ইয়ট। জোসেফের পাশাপাশি জাহাজটার দিকে নেমে চলল রবিন।

কাত হয়ে পড়ে আছে। ইয়ট। সামনের দিকে বিরাট এক ফাটল হাঁ করে আছে। আরও কাছে গিয়ে দেখা গেল, শ্যাওলায় ঢেকে আছে জাহাজের গা। আশেপাশে সাঁতরে বেড়াচ্ছে ছোট ছোট মাছ।

রবিনের আগে আগে সাঁতরাচ্ছে এখন জোসেফ। ফ্লিপার নেড়ে চলে গেল জাহাজের ওপর দিয়ে, পেছন দিকে।

দুটো বড় গলদা চিংড়ির ওপর নজর আটকে গেল। রবিনের। আরও কাছ থেকে দেখার জন্যে এগিয়ে গেল। হঠাৎ জোরে ঝাঁকুনি লাগল পায়ে। থেমে যেতে হল।

কিছু একটা শক্ত করে চেপে ধরেছে তার ডান পা।

<

Super User