গত রাতে, খুলে বলল সব জিম, একা ছিলাম। আমি দ্বীপে। মিস্টার আমানের দিকে চেয়ে বলল, আপনারা সব চলে গেলেন ছেলেদেরকে খুঁজতে। পাহারা দিচ্ছিলাম। হঠাৎ কানো এল মোটরবোটের শব্দ। চোরটোর এল মনে করে দেখতে চললাম। পার্কের কাছ দিয়ে চলেছি, হঠাৎ মনে হল নাগরদোলাটার কাছে কে যেন দাঁড়িয়ে আছে। এগোলাম। দৌড়ে চলে গেল একটা মূর্তি। তাড়া করলাম, কিন্তু ধরতে পারলাম না। কোথায় জানি লুকিয়ে পড়ল। অবাক হলাম! ব্যাটা নাগরদোলার কাছে কি করছিল? নতুন বসানো মোটরটা চুরি করতে আসেনি তো? পরীক্ষা করে দেখলাম মোটরটা। দুটো স্কু খোলা। হ্যাঁ মোটর চুরি করতেই এসেছিল। আবার স্কু টাইট দিয়ে সব ঠিক আছে কিনা দেখার জন্যে সুইচ টিপলাম। চালু হয়ে গেল মোটর, আলো জ্বলে উঠল, ঘুরতে লাগল। নাগরদোলা। ঠিক আছে সব। আবার অফ করে দিলাম মোটর। এটাই দেখেছিল লোকে।

কিন্তু ভূত বলে উঠলেন মিস্টার আমান। সাদা পোশাক পরা ভূত দেখেছে লোকে। এর কি ব্যাখ্যা?

রেনকোট পরেছিলাম, স্যার, বলল, গার্ড। হলুদ রঙের। হুডও ছিল মাথায়। দূর থেকে অন্ধকারে সাদা ধরে নিয়েছে লোকে।

হুঁ। মাথা ঝোঁকালেন মুসার বাবা। বুঝেছি। কিন্তু একটা কাজ ভুল হয়ে গেছে, জিম। সকালেই শহরে যাওয়া উচিত ছিল, তোমার। তুমিই গতরাতে নাগরদোলা ঘুরিয়েছ, জানিয়ে এলে ভাল করতে।

ঠিকই বলেছেন, স্যার, মাথা নিচু করে বলল জিম। ভুলই হয়ে গেছে।

এক কাজ কর, বললেন মিস্টার আমান। আরও দুজন গার্ড নিয়ে এসো ফিশিংপোর্টে গিয়ে। বুঝতে পারছি, একা কুলাতে পারবে না। চোর আবার আসবে। কয়েকজন যদি আসে, একা পারবে না। ওদের সঙ্গে। হ্যাঁ, জেলেফেলেদের কাউকে এনে না। ওগুলোকে বিশ্বাস নেই। নিজেরাই চুরি করে বসতে পারে। ভাল লোক আনবে।

চেষ্টা করে দেখব, স্যার।

চোরের ওপর চোখ রাখার জন্যে এনেছিলাম ছেলেদেরকে, পরিচালককে বললেন মুসার বাবা। কিন্তু হল না। সারা শহর জেনে গেছে, ওরা গোয়েন্দা। কি করে জানল, বুঝতে পারছি না।

মনে হয় আমি পারছি, স্যার, বলল জিম। ছোট্ট শহর ফিশিংপোর্ট। ঘটনা খুব বেশি ঘটে না। ওখানে। ছোটখাট কিছু ঘটলেই সেটা নিয়ে হৈচৈ পড়ে যায়। আপনি আর মিস্টার নেবার ফোনে আলাপ করেছেন। প্ৰযোজকের সঙ্গে। শুনেছে অপারেটর। ওই মেয়েগুলো কেমন হয়, জানেনই তো! কোন কথাই পেটে রাখতে পারে না। আর এত বড় একটা খবর, চুরি হচ্ছে সিনেমা কোম্পানির জিনিসপত্র। হলিউড থেকে গোয়েন্দা আসছে। তদন্ত করতে। কি করে চেপে রাখবে? আপনার ফোন ছেড়েছেন একদিকে, অন্যদিকে রঙ চড়িয়ে বন্ধু-বান্ধবদের কাছে খবর পরিবেশন সারা হয়ে গেছে অপারেটরদের। দেখতে দেখতে ছড়িয়ে পড়েছে মুখরোচক খবর।

প্ৰায় গুঙিয়ে উঠলেন চীফ টেকনিশিয়ান। এসব হতচ্ছাড়া এলাকায় কাজ করাই মুশকিল! শেষ পর্যন্ত হলিউডেই বুঝি ফিরে যেতে হবে!

থাকতে পারলেই ভাল হত, রাফাত, বললেন পরিচালক। চেষ্টা করে দেখুন, নাগরদোলাটা ঠিক করতে পারেন কিনা। আমাকে এখুনি ফিরে যেতে হচ্ছে। এদিকটা সামলান, যেভাবে পারেন। জোসেফ, প্লীজ ফিশিংপোটে পৌঁছে দেবে আমাকে?

চলুন, বল সহকারী-পরিচালক। ঘুরে হাঁটতে শুরু করল জেটির দিকে।

ছেলেদের দিকে ফিরলেন মুসার বাবা। চল, পার্কটা দেখিয়ে আনি তোমাদের। জোসেফ ফিরে এলে ডাইভিং করাতে নিয়ে যাবে।

খুব ভাল হবে, বাবা, চল, বলল মুসা।

খুব বেশি হাটতে হল না। ধসে পড়া একটা বেড়া ডিঙিয়ে পার্কে ঢুকাল ওরা। পরিত্যক্ত পার্ক। এককালে সাইনবোর্ডে নাম ছিলঃ প্লেজার পার্ক। এখন আর সাইনবোর্ড নেই, অনেক আগেই নষ্ট হয়ে গেছে। দুটো খুঁটির একটা আছে, তা-ও হেলে রয়েছে। সিমেন্টে তৈরি বিশ্রাম নেবার আসনগুলো বেশিরভাগই ভেঙেচুরে নষ্ট হয়ে গেছে। বেঁকেচুরে মরচে অংশ খুলে ভেঙে পড়ে আছে কাঠামোর কাছেই। খুব শক্ত করে তৈরি নাগরদোলাটাকে। দাঁড়িয়ে আছে এখনও, তবে শরীরের বেশিরভাগই ক্ষতবিক্ষত। একই অবস্থা হয়েছিল হয়ত নাগরদোলাটারিও, কিন্তু এখন মেরামত হয়েছে। জায়গায় জায়গায় নতুন কাঠ। সিরিষা দিয়ে ঘষে তুলে ফেলা হয়েছে রঙ, নতুন করে লাগানো হবে। কেমন যেন ভূতুড়ে চেহারা। এই দিনের বেলায়ও গা ছমছম করে উঠল মুসার।

এই পার্ক আর এর প্রমোদ্যযন্ত্রগুলো কি কাজে লাগবে, খুলে বললেন মিস্টার আমানঃ একটা লোককে ভুল করে খুনের দায়ে দণ্ডিত করা হয়েছে, সে-ই নায়ক। আসল খুনী অন্য লোক। পুলিশের হাত থেকে পালিয়ে গেল দণ্ডিত লোকটা। খোঁজখবর নিয়ে বের করে ফেলল। কে খুনী। পিছু নিল। টের পেয়ে পালাতে চাইল খুনী। কিন্তু পারল না। তার পেছনে লেগে রইল নায়ক। শেষে স্কেলিটন আইল্যান্ডে এসে লুকাল খুনী। শেষ দৃশ্যটা এরকমঃ একদল লোক আসবে এই পুরানো পার্কে পিকনিক করতে। তাদের সঙ্গে মিশে গিয়ে গা ঢাকা দিতে চাইবে খুনী। কিন্তু নায়কের চোখ এড়াতে পারবে না। নাগরদোলায় চড়ার সময় ঠিক তাকে চিনে ফেলবে। তাড়া করবে। মারপিট গোলাগুলি শুরু হবে। ভয় পেয়ে হুড়াহুড়ি ছুটাছুটি শুরু করবে পিকনিকে আসা দলটা। কিছুতেই নায়কের সঙ্গে পেরে উঠবে না খুনী। শেষে গিয়ে উঠবে নাগরদোলায়। দোলাটা চলতেই থাকবে, ওই অবস্থায়ই নায়কের সঙ্গে মারপিট হবে তার। দোলা থেকে পড়ে গিয়ে মরবে খুনী।

খাইছে! দারুণ কাহিনী প্ৰায় চেঁচিয়ে উঠল মুসা। ছবিটা দেখতেই হবে!

এখানে শুটিং করা গেলে, দৃশ্যটা আরও আগেই দেখতে পারবে, হেসে বললেন মিস্টার আমান। তো আমি যাই। কিছু কাজ করি গিয়ে। তোমরা ঘুরেফিরে দেখ। আধঘণ্টার ভেতরেই ফিরে আসব জোসেফ। পা বাড়াতে গিয়েও থেমে পড়লেন। আর হ্যাঁ, খবরদার, গুপ্তধনের খোঁজখবর বেশি কোরো না! লোকে ঘুণাক্ষরেও যদি ভেবে বসে মোহরের খোঁজ পেয়ে গেছ তোমরা, তাহলে সর্বনাশ হবো দলে দলে লোক ছুটে আসবে। মোহর খুঁজতে শুরু করবে। বারোটা বাজবে শুটিঙের। গত পঞ্চাশ বছরে খুব একটা খোঁজাখুঁজি হয়নি, মোহর পাওয়া যায়নি সৈকতে। লোকে ভুলেই গেছে ব্যাপারটা। ভুলেই থাকতে দাও।

পাহাড়ের ওদিকে গেলে কোন ক্ষতি আছে? জিজ্ঞেস করল কিশোর। ওতে নাকি একটা গুহা আছে। কথিত আছে, জলদস্যুরা বন্দীকে ধরে এনে ওখানে পুরে রাখত।

আমিও শুনেছি, বললেন মিস্টার আমান। যেতে চাইলে যাও। কিন্তু আধঘণ্টার ভেতর ফিরবে। ঘুরে হাটতে শুরু করলেন তিনি।

ঘুরে ঘুরে পার্কটা দেখতে লাগল তিন কিশোর।

জায়গাটা কেমন যেন ভূতুড়ো বিড়বিড় করে বলল মুসা। গা ছমছম করছে আমার।

কিশোর, তুমি চুপ করে আছ কেন? জিজ্ঞেস করল রবিন। কিছু ভাবছ মনে হচ্ছে?

অ্যাঁ…হ্যাঁ, নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটা থামাল কিশোর। রাফাত চাচার ধারণা, চুরি করছে জেলেরা। সিনেমা কোম্পানির আর সবারও তাই ধারণা, তোমরা দুজনও হয়ত এটাই ভাবছ।

ভাবছি তো। জেলে ব্যাটাদেরই কাজ, বলল মুসা। ব্যবসা খারাপ। খেতে পায় না। সেজন্যেই চুরি করছে।

আমার কিন্তু তা মনে হয় না, বলল কিশোর।

অপেক্ষা করে রইল রবিন আর মুসা।

যন্ত্রপাতি চুরি করার পেছনে অন্য কারণও থাকতে পারে, বলল গোয়েন্দাপ্রধান। কঙ্কাল দ্বীপ থেকে সিনেমা কোম্পানিকে তাড়াতে চাইছে হয়ত কেউ। বাইশ বছর ধরে নির্জন পড়ে আছে দ্বীপটা। তা-ই থাকুক, এটাই হয়ত চায় ওই লোক।

টেরর ক্যাসলের ওপর জন ফিলবির যেমন মায়া বসে গিয়েছিল, হাসল মুসা। কঙ্কাল দ্বীপের ওপরও তেমনি কারও আকর্ষণ আছে বলতে চাইছ? নইলে সিনেমা কোম্পানিকে তাড়াতে চাইবে কেন?

সেটাই রহস্য, মাথা ঝোঁকাল কিশোর। চল, গুহাটা দেখে আসি।

পার্ক থেকে বেরিয়ে এল ওরা। গাছপালার ভেতর দিয়ে পাহাড়ের দিকে উঠে গেছে একটা পায়ে চলা পথ। আগের রাতের ঝড়ে ভেঙে পড়েছে অনেক গাছপালা। পথের ওপর ডালপাতা বিছিয়ে আছে। ওসবের মধ্যে দিয়ে চলতে অসুবিধে হচ্ছে, বিশেষ করে রবিনের। তার ভাঙা পা সারেনি পুরোপুরি।

দশ মিনিট পর পাহাড়ের মাথার কাছে উঠে এলো ওরা। পাহাড় না। বলে বড় টিলা বলাই উচিত। কিন্তু নাম পাহাড়, জলদসু্যুর পাহাড়। ঠিক চুড়ার কাছে গুহামুখ, খুদে একটা আগ্নেয়গিরি যেন। ভেতরে উঁকি দিল তিন গোয়েন্দা। অন্ধকার।

ভেতরে পা রাখল ওরা। তেরছা হয়ে নেমে গেছে। সুড়ঙ্গ। সুড়ঙ্গ পেরিয়ে একটা গুহায় এসে ঢুকল তিন কিশোর। বেশ বড় হলরুমের মত গুহা। লম্বাটে। শেষ প্রান্তটা সরু। সুড়ঙ্গ দিয়ে আলো এসে পড়ছে, গুহার ভেতরে আবছা অন্ধকার।

গুহার মাটি আলগা, হাঁটতে গেলে পা দেবে যায়। অসংখ্যবার খোঁড়া হয়েছে প্রতিটি ইঞ্চি, তার প্রমাণ।

নিচু হয়ে একমুঠো মাটি তুলে নিলো কিশোর। আঙুলের ফাঁক দিয়ে ছাড়তে ছাড়তে বলল, গুপ্তধন খুঁজেছে লোকে। গত সোয়াশো বছরে কয় সোয়াশো বার খোঁড়া হয়েছে। এখানকার মাটি, আল্লাই জানে! সব গাধা! এমন একটা খোলা জায়গায় এনে গুপ্তধন লুকিয়ে রাখবে, জলদস্যুদের এত বোকা ভাবল কি করে!

ঠিক, মাথা ঝাঁকাল মুসা। আঙুল তুলে সরু প্ৰান্তটা দেখিয়ে বলল, ভেতরে আরও গুহা আছে মনে হচ্ছে টর্চ আনলে ঢুকতে পারতাম।

গোয়েন্দাগিরি করছ, গুহায় ঢুকতে এসেছ, টর্চ আননি কেন? হাসল কিশোর। রবিনের দিকে ফিরল, তুমি এনেছ?

গুহায় ঢুকব, ভাবিনি।

আমিও ভাবিনি, বলল রবিন।

গোয়েন্দাদের জন্যে টর্চ একটা অতি দরকারি জিনিস, সব সময় সঙ্গে রাখা উচিত, আবার হাসল কিশোর। তবে, আমিও রাখতে ভুলে যাই। আজ গুহায় ঢুকব, জানি, তাই মনে করে সঙ্গে নিয়ে এসেছি!

গুহার সরু প্ৰান্তে এসে দাঁড়াল ওরা। টর্চ জ্বালল কিশোর। পাথুরে দেয়াল। দেয়ালে অসংখ্য তাক, প্রাকৃতিক। মসৃণ। এখানেই ঘুমাত হয়ত জলদস্যুরা, ঘষায় ঘষায় মসৃণ হয়ে গেছে। কে জানে, বন্দিদেরকে হয়ত হাত-পা বেঁধে এখানেই ফেলে রাখা হত। অসংখ্য ফাটল, খাঁজ দেখা গেল। দেয়ালের এখানে ওখানে। একপাশে, মাটি থেকে ফুট ছয়েক উচুতে একটা খাঁজে এসে স্থির হয়ে গেল টর্চের আলো। সাদা একটা বস্তু। ওপরের দিকটা গোল।

খাইছে রে! চেঁচিয়ে উঠল মুসা। ঘুরে দাঁড়িয়েই ছুটি লাগাতে গেল। তারপরেই ঘটল অদ্ভুত একটা কান্ড চমকে থেমে গেল সে।

তাকের ওপর বসে আছে যেন মানুষের মাথার খুলিটা। চক্ষু কোটির দুটো এদিকে ফেরানো। দাঁতগুলো বীভৎস ভঙ্গিতে হাসছে নীরব হাসি, দুই পাটি দাঁতের মাঝে সামান্য ফাঁক। ওই ফাঁক দিয়েই এলো যেন কথাগুলোঃ ভাগ, ভোগে যাও জলদি। দীর্ঘশ্বাস পড়ল। আমাকে শান্তিতে একা থাকতে দাও! এখানে কোন গুপ্তধন নেই।

<

Super User