ঘুম ভাঙল রবিনের। চোখে পড়ল ঢালু হয়ে নেমে যাওয়া চাল। মনে পড়ল, বাড়িতে নেই সে। রকি বীচ থেকে তিন হাজার মাইল দূরে ফিশিংপোটের এক বোডিং হাউসে শুয়ে আছে।

উঠে বসে চারদিকে তাকাল রবিন। একটা ডাবল-বাংকের ওপরের তাকে রয়েছে। নিচের তাকে ঘুমাচ্ছে মুসা। কয়েক ফুট দূরে আরেকটা বাংকে কিশোর।

আবার শুয়ে পড়ল রবিন। আগের রাতে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো ছবির মত খেলতে লাগল। মনের পর্দায়।

দরজায় টোকা দেবার শব্দ হল। খুলে গেল পাল্লা। ঘরে এসে ঢুকল হাসিখুশি, বেঁটে-মোটা এক প্রৌঢ়া। মিসেস ওয়েলটন, বাড়িওয়ালি। রবিনকে জেগে থাকতে দেখে বলল, এই যে, ওঠ, উঠে পড়। নাস্তা তৈরি। নিচে দুজন লোক দেখা করতে এসেছেন তোমাদের সঙ্গে। পাঁচ মিনিটের মধ্যে এসো।

বেরিয়ে গেল মিসেস ওয়েলটন।

লাফ দিয়ে বাংক থেকে নেমে এল রবিন। মুসা কিংবা কিশোরকে ডাকতে হল না। বাড়িওয়ালির গলা শুনে জেগে উঠেছে দুজনেই।

দ্রুত তৈরি হয়ে নিচে নেমে এল ওরা। উজ্জ্বল হলুদ রঙ করা ডাইনিং রুমের দেয়াল, ছাত। সামুদ্রিক জীবজন্তুর খোলস দিয়ে সাজানো হয়েছে। টেবিলে নাস্তা তৈরি। এক ধারে দুটো চেয়ারে বসে কফি খাচ্ছে দুজন লোক। কথা বলছেন নিচু গলায়।

ছেলেদেরকে ঢুকতে দেখেই উঠে দাঁড়াল একজন। বিশালদেহী! কুচকুচে কালো গায়ের রঙ। কোঁকড়া চুল। হাসলেন। ঝিকি করে উঠল। ঝকঝকে সাদা দাঁত। কেমন আছ তোমরা, মুসা ঠিক প্রশ্ন নয়। জবাবের অপেক্ষা না করেই বললেন মিস্টার রাফাত আমান, গতরাতেই এসেছিলাম। ঘুমিয়ে পড়েছিলে। আর জাগালাম না। তাড়াতাড়ি ফিরে যেতে হয়েছে আবার দ্বীপে। উফফ, যা ভাবনায় পড়েছি না প্রতিটি মিনিটই পাহারা দিয়ে রাখতে হয় জিনিসপত্র। কাঁহাতক আর পারা যায়। থামলেন তিনি। তিন কিশোরের ওপর চোখ বুলিয়ে আনলেন একবার। তারপর বললেন, তারপর? তোমাদের কাহিনী বল। গতরাতে কি হয়েছিল?

চেয়ারে বসা দ্বিতীয় লোকটির ওপর চোখ মুসার।

পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি, বললেন মিস্টার আমান। ইনি মিস্টার হোভারসন। এখানকার পুলিশ-চীফ।

পরিচয়ের পালা শেষ হল। চেয়ারে এসে বসল। তিন গোয়েন্দা। নাস্তার ফাঁকে ফাঁকে জানাল তাদের কাহিনী।

পাইপ দাঁতে কামড়ে ধরে চুপচাপ সব শুনলেন হোভারসন। হান্টের কথা আসতেই হাত তুললেন। হান্টা চেহারা কেমন?

জানাল ছেলেরা।

হুমম। চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথা দোলালেন পুলিশ-চীফ। হান্ট গিল্ডার মনে হচ্ছে!

চেনেন নাকি? জিজ্ঞেস করলেন মিস্টার আমান।

ভালমত। কয়েকবার জেল খেটেছে। টাকার জন্যে পারে না, এমন কোন কাজ নেই। ধরতে পারলে কয়েকটা কথা জিজ্ঞেস করতাম!

আমারও কয়েকটা প্রশ্ন ছিল, গম্ভীর হয়ে বললেন মিস্টার আমান। জিজ্ঞেস করতাম, কি করে জানল, ছেলেরা আসছে? কি করে জানল, ওরা গোয়েন্দা? আর গতরাতে কেন নির্জন দ্বীপে ফেলে রেখে এল ওদের? ভাগ্যিস, পাপু খুঁজে পেয়েছিল! নইলে জানতেই পারতাম না আমরা!

ঠিক, সায় দিলেন চীফ। প্লেন থেকে নেমেছে ওরা, শুধু এটুকুই জেনেছিলাম। এরপর কি হয়েছিল, কিছুই বুঝতে পারিনি। রোড ব্যারিকেন্ড দিয়ে গাড়ি থামিয়ে কত লোককে যে জিজ্ঞেস করেছিলাম…।

পাপু কি করে জানল, তোমরা দ্য হ্যান্ডে আছ? মুসার দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করলেন মিস্টার আমান। কি বলেছে?

মুসা জানাল, একবার জিজ্ঞেস করেছিল, উত্তরটা এড়িয়ে গেছে পাপালো। পরে আর জিজ্ঞেস করার কথা মনে ছিল না। তারপর উঠল ভূতের কথা।

ভূত দেখেছিলো ভুরু কোঁচকালেন মিস্টার আমান। অসম্ভব! ঝড়ের রাতে নাগরদোলা চড়তে আসে। ভূত, এটা এ এলাকার একটা গুজব।

গুজবই বা বলি কি করে? বললেন হোভারসন। গত দুবছরে অনেকবার দেখা গেছে। ওই ভূত। ঝড়ের রাতে। জেলেরা দেখেছে। স্কেলিটন আইল্যান্ডের ধারে কাছে যেতে চায় না। এখন আর লোকে। থামলেন চীফ। হাসলেন। বিশ্বাস হচ্ছে না। আমার কথা? বেরিয়ে জিজ্ঞেস করে দেখুন লোককে। গতরাতেও দেখা গেছে ভূত, খবরটা ছড়িয়ে পড়েছে। সারা গাঁয়ে। অনেকেই শুনেছে নাগরদোলা ঘোরার শব্দ। আলো দেখেছে স্পাইগ্লাস লাগানো টেলিস্কোপ দিয়ে, কেউ কেউ ভূতকেও দেখেছে। নাগরদোলার একটা ঘোড়ায় চেপে বসেছিল নাকি একটা সাদা মূর্তি। এই শেষ কথাটা অবশ্য বিশ্বাস করিনি। আমি…

কুসংস্কারে খুব বেশি বিশ্বাসী এ গাঁয়ের লোক, বললেন মিস্টার আমান। মাথা দোলালেন। বুঝতে পারছি, আজ আর কেউ যাবে না দ্বীপে কাজ করতে। বিপদেই পড়ে গেলাম দেখছি!

আগামীকালও কাউকে নিতে পারবেন বলে মনে হয় না, বললেন। হোভারসন। তো, মিস্টার আমান, আমি উঠি।। দেখি, হান্টকে ধরতে পারি। কিনা। কিন্তু একটা প্রশ্ন বেশি খচখচ করছে মনে, পাপু কি করে। জানল ছেলেরা দ্য হ্যান্ডে আছে?

সন্দেহের কথা? বললেন মিস্টার আমান। আমার কাছে চাকরির জন্যে এসেছিল একদিন। এখানকার লোকে ভাল চোখে দেখে না। ছেলেটাকে। ও নাকি চোর। এটা জেনে কাজ দিইনি। আমাদের জিনিসপত্র হয়ত ওই চুরি করে, কে জানে!

না, বাবা, জোরে মাথা নাড়ল মুসা, পাপু চোর না! গতরাতে অনেক কথা বলেছি। ওকে ভাল ছেলে বলেই মনে হল। অসুস্থ বাপের দেখাশোনা করে। সময় পেলেই উপসাগরে বেরিয়ে পড়ে নৌকা নিয়ে। মোহর খুঁজে বেড়ায়। না, পাপু খারাপ ছেলে না।

মুসা ঠিকই বলছে, সায় দিলেন পুলিশ-চীফ। ছেলেটাকে দেখতে পারে না লোকে, সেটা অন্য কারণে। এখানকার লোক বিদেশী পছন্দ করে না। ওদের ধারণা, যত কুকাজ, সব বিদেশীরা করে।

যা-ই বলুন, ছেলেটাকে সন্দেহ করি আমি, বললেন মিস্টার আমান। অসুস্থ বাপকে খাওয়ানোর জন্যেই হয়ত চুরি করে। একটা সৎ কাজ করতে গিয়ে আরেকটা অসৎ কাজের সাহায্য নেয়াকে ভাল বলা যায় না। উঠে দাঁড়ালেন তিনি। ছেলেরা, এসো যাই। এতক্ষণে হয়ত দ্বীপে গিয়ে বসে আছেন মিস্টার নেবার। চীফ, পরে আবার দেখা করব। আপনার সঙ্গে। আশা করি, হান্টকে ধরে জেলে পুরতে পারবেন।

কয়েক মিনিট পর। দ্রুতগতি একটা স্পীডবোটে বসে আছে তিন গোয়েন্দা। কঙ্কাল দ্বীপের দিকে ছুটে চলেছে বোট। ফিশিংপোর্টকে গ্রাম বলা হয়, আসলে ছোটখাটো শহর ওটা। ঘুরে দেখার ইচ্ছে ছিল ওদের, কিন্তু সময় মেলেনি।

রাতের বেলা অন্ধকারে কিছুই দেখেনি ছেলেরা। এখন দেখল, অসংখ্য ডক আর জেটি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। এদিক ওদিক। সেই তুলনায় নৌকা-জাহাজ অনেক কম। বুঝতে পারল, ওগুলো সব চলে গেছে উপসাগরের দক্ষিণে। ফিশিংপোটের সীমানা খুব বেশি বড় না। লোকসংখ্যা আগে অনেক ছিল, ইদানীং নাকি কমে গেছে। ব্যবসা ভাল না, থেকে কি করবে। লোকে?

কৌতূহলী চোখে কঙ্কাল দ্বীপের দিকে তাকিয়ে আছে ওরা। মাইলখানেক দূরে আছে এখনও। প্রচুর গাছপালা দ্বীপে। উত্তরপ্রান্তে একটা ছোট পাহাড়।

কঙ্কাল দ্বীপের দক্ষিণে একটা পুরানো জেটির গায়ে এসে ভিড়ল বোট। পাশেই খুঁটিতে বাঁধা আরেকটা মোটরবোট। একপাশ থেকে বুলিছে বিশেষ সিঁড়ি। স্কুবা ডাইভিঙের সময় খুব কাজে লাগে।

জেটির ধার থেকে পথ চলে গেছে। আগে আগে চললেন মিস্টার আমান। পেছনে তিন কিশোর। শিগগিরই একটা খোলা জায়গায় এসে পৌঁছুল ওরা। ঝোপঝাড় কেটে পরিষ্কার করে ফেলা হয়ে জায়গাটা। একপাশে দুটো ট্রেলার দাঁড়িয়ে আছে। বড় বড় কয়েকটা তাঁবু খাটানো হয়েছে মাঝখানে।

ওই যে, মিস্টার জন নেবার, ডিরেক্টর, বললেন মুসার বাবা। গতকাল এসে পৌঁছেছেন ফিলাডেলফিয়া থেকে। জরুরি কাজ সেরে আজই ফিরে যাবেন আবার।

হর্ন-রিমি চশমা পরা একজন লোক এগিয়ে আসছেন। বয়েস চল্লিশের কাছাকাছি। পেছনে তিনজন লোক। একজনের চুল ধূসর। সে গোয়েন্দা। আরেকজনের চুল সোনালি, নাবিকদের মত ছোট ছোট করে। ছাঁটা। যুবক। জোসেফ গ্র্যাহাম। তার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে বিশালদেহী এক লোক। চওড়া বুকের ছাতি। বাঁ হাতটা বুলছে বেকায়দা ভঙ্গিতে, বোঝাই যায়। অকেজো। কোমরে বুলছে রিভলভার। জিম রিভান, গার্ড।

আমাদের ক্যাম্প, তাঁবুগুলো দেখিয়ে বললেন মিস্টার আমান। বার্জে করে আনা হয়েছে ভারি মালপত্র। আমরা এখন লোক কম। কয়েকদিন পরে শুটিঙের কাজ শুরু হলেই আসবে। আরও অনেকে। আসবে দামি যন্ত্রপাতি। তখন আর ওই তাঁবুতে কুলাবে না। আরও কয়েকটা ট্রেলার দরকার পড়বে।

কাছে এসে গেলেন পরিচালক।

সরি, মিস্টার নেবার, বললেন রাফাত আমান, দেরিই হয়ে গেল।

না না, ঠিক আছে, হাত তুললেন পরিচালক। ছেলেদের দিকে একবার তাকালেন। আবার ফিরলেন মিস্টার আমানের দিকে। কিন্তু এখানকার অবস্থা তো বিশেষ সুবিধের মনে হচ্ছে না। সবই বলেছে। পিটার। আর হস্তখানেকের ভেতর নাগরদোলাটা ঠিক না করা গেলে, স্কেলিটন আইল্যান্ডের আশা বাদই দেব। ক্যালিফোনিয়ায় ফিরে গিয়ে স্টুডিওতেই একটা পার্ক সাজিয়ে নেব। নাগরদোলা আনা যাবে ভাড়া করে। তবে এখানে করতে পারলেই ভাল হত। সবকিছু আসল। তাছাড়া দ্বীপের দৃশ্য, উপসাগরের দৃশ্য, খুবই চমৎকার।

আশা করছি, ঠিক করে ফেলতে পারব, বললেন মিস্টার আমান। কাঠমিস্ত্রিকে খবর দিয়ে পাঠিয়েছি।

তা পাঠিয়েছেন, কিন্তু আসবে কিনা যথেষ্ট সন্দেহ আছে, গম্ভীর গলায় বললেন পরিচালক। সারা শহর জেনে গেছে, গতরাতে ভূত দেখা গিয়েছে। নাগরদোলা ঘুরেছে।

ভূত ভূত ভূত! মুঠো হয়ে গেল মিস্টার আমানের হাত। চেহারা কঠোর। ওই ভূতের শেষ দেখে ছাড়ব আমি।

পায়ে পায়ে এসে পরিচালকের পেছনে দাঁড়িয়েছে জিম রিভান। আস্তে করে কেশে উঠল। মাফ করবেন, স্যার, গতরাতের ভূতটা বোধহয় আমিই।

<

Super User