পানি থেকে উঠে পাড়ে দাঁড়িয়ে দু’হাতে লম্বা সোনালী চুল পেঁচিয়ে চিপে পানি ঝরাচ্ছে মেয়েটি। ওর প্রতিটি অঙ্গসঞ্চালন অপূর্ব ছন্দময়। গায়ে কাপড় নেই বলে মোটেই সঙ্কোচ বোধ করছে না। তার শুভ্র সুঠাম দেহ সকালের তাজা পরিবেশে অপূর্ব দেখাচ্ছে।

এমন সুস্থিরতার সাথে আগে তার পরিচয় ছিল না। জলপ্রপাতটাও যেন শব্দ না তুলে সন্তর্পণে জলাশয়ে পড়ে ছোট ছোট ঢেউ তুলে মিলিয়ে যাচ্ছে। সঙ্গীত; হা, সঙ্গীতকেই সবচেয়ে বেশি করে মনে পড়ে তার। এখানে একমাত্র ওটারই অভাব। বহুদূরে তার আগৈকার জীবনের সাথে সঙ্গীত বিসর্জন দিয়ে এসেছে সে। কিন্তু এখন নতুন করে আবার শুনতে শিখেছে সে তার মনের মানুষের কাছে।

শোনো, ডালিয়া, বলেছিল সে। শোনার মত মন থাকলে বাতাসই তোমার জন্যে বাজাবে, গাইবে।

সবচেয়ে ভাল শোনা যায় কোন মালভূমির ওপর-স্কেলিটন মেসা বা টল মাউন্টেনের ধারে। ক্যানিয়নে আছে আর এক ধরনের গীত। বাতাস বইলে সাথে বয়ে নিয়ে আসে সীডার বা সেজ-এর হালকম সুগন্ধ-আবার কখনও বা শুধু একটা গরম ভাপ

ওর মনে হয় এখানকার প্রতিটি আনাচ-কানাচের সাথে অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে। না, তার স্মৃতি নয়-সে তো মাত্র ইদানীং এসেছে এই নগ্ন নির্জন পাথুরে এলাকায়। তার প্রিয়তমের স্মৃতিও নয়। বহুঁকাল আগে এখানে যারা বাস করত তাদেরই স্মৃতি যেন লুকিয়ে আছে ক্যানিয়নের খাড়া দুর্গম দেয়ালগুলোর খাঁজে খাজে। কেমন যেন একটা অজানা টান অনুভব করে সে। আচ্ছা, তার এই অদ্ভুত অনুভূতির কথা জানলে ও কী বলত?

একটা নিছক পাগলামির বশে সে সম্পূর্ণ অচেনা অজানা একজন লোকের হাত ধরে চলে এসেছে এই বিজন মরু এলাকায়। ঝড়ের রাতে ঝড়ের মতই সে এসেছিল তার জীবনে। কামরায় ঢুকে একবার তার দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে চেয়ে তাকে নিজের বলে দাবি করেছিল।

কে তুমি? সেই রাতে প্রশ্ন করেছিল ডালিয়া।

বিন্দুমাত্র কাঁপেনি তার চোখ। ডালিয়ার চোখে চোখ রেখে সে জবাব দিয়েছিল, বোকার মত প্রশ্ন হলো-দু’মিনিট আগেই তুমি জেনেছে আমি কে।

আমি কী করব তাও তুমি জানো।

আর আমি?

আগামীকাল সকালেই বেরিয়ে পড়ব আমরা। বলেছিল সে, প্রথম সুযোগেই ধর্মীয় মতে গির্জায় বিয়ে হবে আমাদের।

ডালিয়ার খুব কাছ ঘেঁষে আগুনটার দিকে এগিয়ে গেল জেকব। ওর বাকস্কিনের জামা থেকে সীডার, পাইন আর ঘোড়ার গায়ের মিশ্র একটা গন্ধ অজানা ডাক দিয়ে এল ডালিয়ার কাছে।

আগুনে শক্তিশালী তামাটে রঙের হাত দুটো গরম করছে জেকব। নিকোলাস লক্ষ করছে ওকে খুদে খুদে সাপের মত ঠাণ্ডা চোখে। ভয়ে ডালিয়ার বুকের ভিতরটা টিপটিপ করছে।

দুশ্চিন্তা তার নিজের জন্য নয়। আগন্তুক নিকোলাসের স্বরূপ দেখিনি বলেই তার এই ভীতি। পশ্চিমে এসে পৌঁছবার আগে সে-ও নিকোলাসকে ঠিক চিতে পারেনি

এগিয়ে গিয়ে নিকোলাসের সাথে বসল ডালিয়া। এই লোকটাকে বিয়ে করবে বলেই সে পশ্চিমে এসেছে। কিন্তু বারবারই তার চোখ ঘুরে ফিরে গিয়ে পড়ছে আগুনের পাশে দাঁড়ানো অপরিচিত আকর্ষণীয় পুরুষটার উপর। দুচোখ ভরে কেবল ওকেই দেখছে ডালিয়া

পিছন থেকে কে যেন কাকে নিচু স্বরে জিজ্ঞেস করল, লোকটা কে?

আগে দেখিনি কোনদিন। ওর ঘোড়ায় দাঁড়িপাল্লার মার্কা রয়েছে। সেটাও এখানে অপরিচিত।

আবার চোখ তুলে লোকটার দিকে চাইল ডালিয়া। মেয়েটির চোখে দম আটকানো পরিবেশ থেকে মুক্তি পাওয়ার আকুল মিনতি দেখতে পেল জেকব

বলিষ্ঠ শক্তি-প্রাচুর্যে ভরা জেকবের গড়ন। নিজের দেশে অনেক সমর্থ পুরুষ দেখেছে ডালিয়া। চিনতে ভুল করেনি সে। নিকোলাসের মত বিশাল না হলেও লোকটার যে পেটা শরীর তাতে সন্দেহ নেই।

কামরায় মোট নয়জন মানুষ। ডালিয়াকে নিয়ে তিনজন মহিলা, আর বাকি সবাই পুরুষ। কিন্তু সবার মনোযোগ কেড়ে নিয়েছে ডালিয়া! অত্যন্ত আকর্ষণীয় চেহারা ও দৈহিক কাঠামোর অধিকারিণী সে। নিজের দেশ হাঙ্গেরিতে ঘোড়া চালিয়ে আর স্কি করে স্বাস্থ্য অটুট রেখেছে মেয়েটা।

নিজেকে সে ভাল করেই জানে; চেনেও। কিন্তু ভাগ্যে যে কী আছে জানা নেই তার। নিজ দেশের সাথে এদেশের রীতি-নীতির আকাশ পাতাল তফাৎ। অত্যন্ত সম্রান্ত পরিবারের মেয়ে ডালিয়া-অথচ এখানে সেটা কত অবান্তর!

তার বাবা ছিলেন একজন রাজনীতিবিদ। পারিবারিক মর্যাদা ছাড়াও নিজের যোগ্যতায় তিনি ছিলেন সম্মানীয়। অথচ আজ ডালিয়ার কারণেই তিনি মৃত।

লোকটার সাথে প্রথম তার দেখা হয় ভিয়েনায়। এবং পরে আবার প্যারিসে। প্রেমে পড়ে যায় ডালিয়া। মানে ক্ষণিকের মোহকেই সে প্রেম বলে ভুল করেছিল। লোকটা যে বিবাহিত তা জানত না সে। ওর সম্পর্কে একটা অপমানকর উক্তি লোকটা করেছিল। সেটা বাবার কানে যেতেই তিনি তাকে ডুয়েলে আহ্বান করেন এবং ওই লোকটার হাতেই নিহত হন।

এরপরেই ডালিয়া ইউরোপ ছাড়ে। আত্মীয়-স্বজন, পরিচিত বন্ধু-বান্ধব, সমাজ সবকিছু ছেড়েই পালিয়ে এসেছিল সে। কিন্তু পালিয়ে আসার আগে শেষবারের মত একবার তার প্রেমিকের সাথে দেখা করেছিল।

খোলা দরজা দিয়ে ঢুকে তাকে ঘরে একাই পেয়েছিল ডালিয়া। কাবার্ড থেকে গ্লাসে মদ ঢালছিল সে। ওকে ঘরে ঢুকতে দেখে অবাক বিস্ময়ে বলে উঠেছিল, ‘ডালিয়া!’ আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল সে, কিন্তু ডালিয়া হাত তুলে তাকে থামিয়ে দরজা বন্ধ করে ঘুরে দাঁড়াল।

তার চোখে চোখ রেখে ডালিয়া বলেছিল, তোমার ভাগ্য ভাল। আমার কোন ভাই থাকলে সে তোমাকে ঘোড়ার চাবুক দিয়ে পিটিয়ে শায়েস্তা করত। বাবার বয়স হয়েছিল হাত কাঁপত তার।

ডালিয়া! বিস্ময়ের ঘোর কাটেনি তার।

কিন্তু আমার হাত কাপবে না, বলে সে ধীরে ধীরে হাতের পিস্তলটা তুলে তাক করে গুলি করল। তারপর তার মৃতদেহের পাশে পিস্তলটা ফেলে দিয়ে বেরিয়ে এল।

পরিচিত এক জেলের নৌকায় ডেনমার্কে পৌঁছে ডালিয়া-সেখান থেকে সোজা আমেরিকায়।

পুবের একটা শহরে নিকোলাসের সাথে পরিচয় হয় তার। হাঙ্গেরিয়ান ভাষা জানে নিকোলাস। অল্প আলাপেই ডালিয়া কেমন ঘরের মেয়ে বুঝতে পেরে তাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল সে। টাকা পয়সা ফুরিয়ে আসছিল ডালিয়ার, তাই বিয়ের প্রস্তাবে সে আপত্তি করেনি। কথা ছিল নিকোলাস পশ্চিমে এসে একটু গুছিয়ে নিয়েই তাকে ডেকে পাঠাবে। সে এলেই ওদের বিয়ে হবে। জেকবের আকস্মিক উপস্থিতি ওদের সব পরিকল্পনা বানচাল করে দল।

.

নিচু আর লম্বা ঘরের শেষ মাথায় ফায়ার-প্লেস। মাঝখানে ছোট একটা বার। সাথেই লাগানো দুটো কামরায় বিছানা পাতা। একটা মেয়েদের অন্যটা পুরুষের

জেকবের পিঠের উপর থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিকোলাসের সাথে চোখাচোখি হলো ডালিয়ার। ওর চোখে এই দৃষ্টি সে আজ দুপুরেই দেখেছে-এখানে সে। পৌঁছবার অল্পক্ষণ পরেই। দুপুরে সে মুঠোয় লোহার আংটা পরে নিজের ঘোড়াটাকে বেঁধে নির্দয় ভাবে পিটিয়েছে। তখনও তার চোখে এই ভাবটাই ফুটে উঠেছিল।

আগুনের পাশ থেকে সরে বারে গিয়ে দাড়াল জেকব। ডালিয়ার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে জেকবের দিকে চাইল নিকোলাস। ডালিয়ার মনে হলো যে সে আগন্তুকের সাথে কথা বলবে।

হুঁ, লোকটাকে তা হলে তোমার মনে ধরেছে? ভেঙচি কেটে বলল নিকোলাস। ঠুনকো লোক, কোন চাল-চুলো নেই।

চুপ করে রইল ডালিয়া। ওর নীরবতায় নিকের রাগ আরও বেড়ে গেল।

তোমাকে ঘরে তোলার পর একটু দুরস্ত করে নিতে হবে দেখছি! যাক, আমার কিছুটা আনন্দের খোরাকই হবে সেটা।

তোমার সাথে আমি নাও যেতে পারি!

হেসে উঠল সে। ঠিকই যাবে। আমাকে বিয়ে করতেই এসেছ তুমি। এখানে এমন কোন লোক নেই যে আমাকে বাধা দেবে। কারও সাধ্যি নেই ঠেকায়

বড় বড় নীল চোখ তুলে স্থির দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ নিকোলাসের দিকে চেয়ে থেকে শান্ত গলায় সে বলল, সাহায্যের দরকার হবে না আমার। নিজেরটা নিজেই সামলাতে জানি আমি।

তুমি? হো হো করে হেসে উঠল নিক। ভাবটা এমন যে ডালিয়া রসিকতা করছে তার সাথে।

নীরবে ওর দিকে একটু চেয়ে থেকে উঠে ফায়ার-প্লেসের দিকে রওনা হলো সে। আসন ছেড়ে লাফিয়ে উঠে পিছন থেকে ডালিয়াকে ধরে ফেলল নিক। ওকে জোর করে নিজের দিকে ঘুরিয়ে চড় তুলল সে।

ছেড়ে দাও ওকে।

শূন্যেই থেমে গেল হাত-ধীরে ধীরে হাতটা নামিয়ে নিল নিক। চোখ দু’টো খুনের নেশায় জ্বলছে। জেকব ওর দিকে ফিরে দাঁড়াল। এতক্ষণে নিকোলাস টের পেল কথাটা জেকব বলেনি-বলেছে স্টেজ স্টেশনের ম্যানেজার।

শুকনো পাতলা চেহারা। বয়স হয়েছে লোকটার। সারা মুখে ওর চোখ দু’টোই কেবল জীবন্ত। বারে রাখা শটগানের উপর রয়েছে ওর একটা হাত।

তুমি আমাকে অর্ডার দিচ্ছ!

হ্যাঁ, তোমাকেই বলছি আমি-এই ঘরে কেউ কোনদিন কোন মহিলার সাথে দুর্ব্যবহার করেনি-তোমাকেও অভদ্র হতে মানা করছি।

অবজ্ঞার সাথে কাঁধ ঝাঁকাল নিক। এখানে সারা রাত থাকবে না মেয়েটা। এখনই ওকে সাথে করে নিয়ে যাচ্ছি আমি।

নিকের উপর সতর্ক নজর রেখেই ডালিয়ার উদ্দেশে ম্যানেজার বলল, স্বেচ্ছায় যেতে না চাইলে জোর করে কেউ তোমাকে কোথাও নিয়ে যেতে পারবে না-ভয় নেই। লোকটা কি তোমার স্বামী?

না।

ওকেই জিজ্ঞেস করো সে এখানে কেন এসেছে, উত্তেজিত কণ্ঠে বলল নিক।

ওকেই বিয়ে করতে এসেছিলাম আমি। তখন জানতাম না সে কেমন। আজ দুপুরে ওকে নির্দয় ভাবে নিজের ঘোড়াকে পেটাতে দেখে বুঝলাম ভবিষ্যতে হয়তো আমার গায়েও হাত তোলার চেষ্টা করতে পারে।

চেষ্টা!

হ্যাঁ, চেষ্টা তুমি করবে জানি। কিন্তু তার আগেই আমার হাতে খুন হয়ে যাবে!

ঘরের সবাই নীরব। কথাটা ডালিয়া যেভাবে বলল তাতে উপস্থিত কারও মনে সন্দেহ রইল না কথাটা অক্ষরে অক্ষরেই পালন করবে সে।

পরের কথাগুলো নিকোলাসের দিকে চেয়ে বললেও আসলে কথাটা বাকস্কিনের জ্যাকেট পরা লোকটার উদ্দেশেই বলা। তোমাদের দেশে আমি নতুন; জীবনে কোনদিন আমাকে দুঃখ কষ্ট পেতে হয়নি, কিন্তু কেউ যদি আমাকে ভালবাসে, আমার সাথে মার্জিত নম্র ব্যবহার করে-তার জন্যে আমি সব রকম কষ্ট সহ্য করতে রাজি আছি। কিন্তু তুমি সেই লোক নও, নিকোলাস।

বারৈ দাড়ানো লোকটা নড়ে উঠল। মাথা থেকে হ্যাটটা নামিয়ে সে শান্ত স্বরে বলল, তুমি আমার সাথে এলে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করব আমি। এখান থেকে ষাট মাইল পশ্চিমে গির্জায় ধর্মীয় মতে আমদের বিয়ে হতে পারে।

পরস্পরের দিকে চেয়ে দু’জনে নীরবে কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে রইল, তারপর জবাব দিল ডালিয়া, আমি যাব তোমার সাথে। সকালেই তোমার সঙ্গে রওনা হব আমি।

মুখ খুলতে গিয়েও আবার চুপ করে গেল নিকোলাস। তারপর হঠাৎ ঘুরে ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেল সে।

স্টেশন ম্যানেজার বন্দুকটা চোখের আড়ালে যথাস্থানে রেখে দিয়ে জেকবকে বলল, যোগ্য সাথী পেয়েছ তুমি। তবে ওকে দেশটাকে জানার কিছু সুযোগ দিয়ো।

একটু অপ্রস্তুত হয়েই তাড়াতাড়ি ডালিয়ার দিকে এগিয়ে গেল জেকব। ঘরের সবাই মুখ ফিরিয়ে অন্যদিকে চেয়ে ওদের জন্য যথাসম্ভব নির্জনতার সুযোগ করে দিল।

অন্য এলাকায় জমির খোঁজে চলেছি আমি, বলল সে। আমার কোন র‍্যাঞ্চ নেই, বাড়িও নেই। অনেক দূরে একটা জায়গা দেখেছি, একজনের পক্ষে ওখানে নতুন করে ঘর বাঁধা সম্ভব।

ঠিক আছে।

জিনিসপত্র সব সাথে আছে তোমার?

হ্যাঁ, হাতের ইশারায় ঘরের কোণে রাখা মালপত্র দেখাল ডালিয়া। অনেক জিনিস। অসুবিধা হবে? স্বভাবজাত কৌতূহলবশেই ঘরে উপস্থিত মেয়ে দুটো ওদিকে চাইল। ঘরের এক কোণে রাখা রয়েছে অত্যন্ত দামী ছোট একটা ট্রাঙ্ক, সাথে আরও জিনিসপত্র রযেছে-প্রত্যেকটাই মূল্যবান।

ব্যবস্থা হয়ে যাবে, জবাব দিল জেকব।

.

স্টেশন ম্যানেজার এই দেশটাকে ভালমত বুঝে দেখার জন্যে, তোমাকে কিছুটা সময় দিতে বলেছিল-উপদেশটা খারাপ নয়।

সময় সে দিয়েছে। অবশ্য এতটা অপরিচিত নতুন পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার জন্য সময়ের দরকারও ছিল ডালিয়ার। এখানকার সবকিছুই নতুন। এমনকী এখানকার নগ্ন পাহাড়গুলোও তার দেশের পাহাড়ের মত নয়।

ওদেরও কিছুটা সময় দাও, বলেছিল জেকব। দেখবে ধীরে ধীরে ওরাও তোমারই একটা অংশ হয়ে উঠেছে।

কেবল ওর জিনিসপত্র বইবার জন্যই জেকবকে তিনটে গাধা কিনতে হয়েছে তবে এজন্য তার মধ্যে কোন বিরক্তি দেখা যায়নি। বরং খুব সাবধানতার সাথেই এক এক করে গাধার পিঠে সব মাল তুলেছে সে।

ইচ্ছা করলে ওগুলো ফেলে দিতে পারো তুমি, বলেছিল ডালিয়া। ওর প্রতি আমার কোন মোহ নেই। ওই জীবনটা পিছনে ফেলে এসেছি আমি।

ওগুলো তোমারই, নরম কণ্ঠে জবাব দিয়েছিল জেকব। কিছু কিছু স্মৃতি সাথে থাকা ভাল।

কোন বিশেষ আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই একটা ছোট শহরে বিয়ে হলো ওদের। একজন স্বল্পভাষী নিষ্ঠাবান ধর্মযাজক তাদের বিয়ে পড়ালেন। একত্রে নয়, পাশাপাশি শুয়ে রাতটা কাটাল ওরা।

পরদিন সকালে ওরা আবার রওনা হলো। ডালিয়া খেয়াল করল জেকব বারবার পিছন ফিরে চাইছে।

কাউকে আশা করছ নাকি তুমি? প্রশ্ন করল সে।

এই দেশে যে-কোন সময়েই অপ্রত্যাশিত অতিথি কেউ আসতে পারে বা কোন ঘটনা ঘটতে পারে। এতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই।

লম্বা যাত্রা ক্লান্তিকর হলেও ডালিয়ার উদ্যম কমেনি। তৃতীয় দিনের পর ক্লান্তিও আর অনুভব করছে না সে।

ক্যাম্পিং সম্পর্কে যথেষ্ট অভিজ্ঞতা আছে ওর। তবু জেকবের প্রতিটি কাজে সে বুঝতে পারছে ক্যাম্পিং-এ কীরকম অসাধারণ পটু সে। সুচিন্তিত পরিকল্পনা প্রকাশ পাচ্ছে ওর প্রতিটি কাজে-অথচ যেন দৈনন্দিন রুটিন, এমনি সহজভাবে সে তা করে চলেছে।

চতুর্থ দিন আগুন জ্বেলে ওপাশে,ডালিয়ার দিকে চেয়ে সে বলল, একদিন আমাদের খোঁজে কেউ আসবে বলে আশা করছি আমি।

অপেক্ষা করে রইল ডালিয়া। বাড়তি কথা বলার শিক্ষা সে পায়নি।

নিকোলাস আসবে, বলল সে।

নিকোলাসের কথা প্রায় ভুলেই গিয়েছিল ডালিয়া। হঠাৎ বুকের ভিতরটা ঘঁাৎ করে উঠল ওর। ভয়টা মোটেও অহেতুক নয়। ইদানীং নতুন দেশ আর জেকবকে ঘিরেই কেবল চিন্তার জাল বুনেছে। লোকটাকে কিছুটা যেন বুঝতে পারে সে এখন-হয়তো কিছুটা ভালও বেসে ফেলেছে।

তুমি জানতে চাইলে না কোথায় যাচ্ছি আমরা?

তোমার সাথেই তো যাচ্ছি আমি?

কয়েকটা কাঠ আগুনে চাপিয়ে দিয়ে সে বলল, নাভাজোরা ছাড়া আর কেউ কখনও যায় না ওখানে।

ওরা ইন্ডিয়ান না?

মাথা ঝাঁকাল সে। অনেক আগে, হয়তো কয়েকশো বছর আগে ওখানে অন্যান্য আরও ইন্ডিয়ানদের বাস ছিল। ক্লিফের ওপর ওদের বাড়িঘর এখনও দেখা যায়। কিন্তু কেন জানি না-ওই এলাকা ছেড়ে সবাই ওরা চলেছে গেছে।

ওখানে তুমি কী করবে?

যখন সঙ্গতি হবে কিছু গরু-মহিষ পালব। একটা ঘর বানাব; আমাদের দু’জনের জন্যে।

অনেক জ্ঞানীগুণী শিক্ষিত লোকের সাথে মেশার সুযোগ হয়েছে ডালিয়ার, কিন্তু জেকবের মত সহজে গুছিয়ে সুন্দর করে কথা বলতে আর কাউকে দেখেনি।

কী করে যেন সে বুঝে ফেলল ডালিয়া কী ভাবছে। কিন্তু নিজের মনোভাব বুঝতে না দিয়ে বলল, এই দেশে যাদের সাথে তোমার পরিচয় হবে, তাদের ভুল বুঝো না। তারা তোমার নিক্তিতে না হলেও এখানে বাঁচার জন্যে যে সব শিক্ষা দরকার তা তাদের আছে। কেউ কেউ আবার প্রচুর ঘুরে অনেক অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছে। আমি একজন লোকের সাথে মহিষ শিকার করেছি-সে ছিল গটিংগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। একজন সোবোনের গ্র্যাজুয়েটের সাথে পাশাপাশি যুদ্ধও করেছি আমি-কিন্তু মজার কথা কি জানো? ওরা দুজনেই পশ্চিমা লোকের মত কাউবয়দের ঢঙেই কথা বলত।

ট্রেইল ছেড়ে আরও দুর্গম, নির্জন মরু এলাকা আর ক্যানিয়নের ভিতর দিয়ে যাবার পথে ডালিয়া জিজ্ঞেস করেছিল, আচ্ছা, তোমার কি মনে হয় সে আমাদের আর খোঁজ পাবে?

আজ হোক, কাল হোক, পাবেই, জবাব দিয়েছিল ও।

কতদিন আগের কথা সেটা? বেশ কয়েক সপ্তাহ কেটে গেছে-সময়ের হিসাব আর রাখে না সে। এখানে সেটা যেন অর্থহীন।

.

পানির ধারে দাঁড়িয়ে গা মুছে এক এক করে জামা কাপড় পরে নিল ডালিয়া। জেকবের দেওয়া উইনচেস্টারটা তার পাশেই রাখা।

তুমি গুলি ছুড়তে জানো? প্রশ্ন করেছিল সে।

‘হ্যাঁ,’ জবাব দিয়েছিল ডালিয়া। তারপর একটু চুপ করে থেকে বলেছিল, ভয় কোরো না, কোথায় লাগাতে হবে না দেখে আমি গুলি করি না-যখন করি তখন সেটা জায়গা মতই লাগে।

দুদিন পরে সে ঘোড়ায় চেপে চলে গিয়েছিল।

যাবার আগের মুহূর্তে সে বলেছিল, যদি আমার কিছু হয়, ফিরতে না পারি, এখান থেকে বেরিয়ে সোজা পশ্চিমে চলে যেয়ো। অনেক পথ যেতে হবে, কিন্তু ট্রেইল ধরে গেলে প্রেসকটের সাইনপোস্ট দেখতে পাবে।

ঠিক আছে, বলেছিল সে। তারপর তার বড় বড় নীল চোখ ওর চোখে রেখে জিজ্ঞেস করেছিল, কতদিন অপেক্ষা করব?

অন্তত দুই সপ্তাহ। ওই সময়ের মধ্যে বেঁচে থাকলে আমি হামাগুড়ি দিয়ে হলেও এসে হাজির হব।

আজ পনেরো দিন হলো সে গিয়েছে। দেখা যাচ্ছে মাঝেমাঝে এখানেও সময়ের হিসাব রাখার দরকার পড়ে।

<

Super User