মাঝারি মানের হোটেল, তবে নতুন। ছোকরা ঘাবড়ে যেতে পারে ভেবে গিলটি মিয়া আর ক্যাভিন হাওয়ার্ডকে নীচের ফয়ে- তে অপেক্ষা করতে বলে উঠে এসেছে রানা তেতলায়। টোকা দিতেই খুলে গেল ২৩২ নম্বর কামরার দরজা। জিন্সের প্যাণ্ট আর হালকা নীল, বুক-খোলা শার্ট পরা লম্বা এক লোককে দেখা গেল দরজার ওপাশে। চেহারা হুবহু মিলে যায় নার্সদের বর্ণনার সঙ্গে। অপরিচিত লোক দেখে কুঁচকে গেল ভুরু। বলল, ‘সিধে রাস্তা মাপো, মিস্টার। কিছু কেনার মুডে নেই আমি এখন।’ কথাগুলোর সঙ্গে ভেসে এল সস্তা হুইস্কির গন্ধ। দরজাটা বন্ধ করে দেবার আগেই জুতো পরা পা ঢুকিয়ে দিল রানা কপাটের ফাঁকে, তারপর বের করে দেখাল রানা এজেন্সির ইনভেস্টিগেশন লাইসেন্স।

‘আপনার সঙ্গে কথা আছে, মিস্টার স্ট্যানলি।’

নামটা শুনে একটু বড় হলো চোখ, কার্ডটা খুঁটিয়ে দেখে নাক কোঁচকাল স্ট্যানলি। ‘ও, প্রাইভেট টিকটিকি! ভাল চান তো কেটে পড়ুন, নইলে পুলিশ ডাকতে বাধ্য হব।’

‘ডাকুন না,’ অমায়িক হাসি হাসল রানা। ‘আপনি কিন্তু আমার উদ্দেশ্য সম্পর্কে কিছু না জেনেই বিরূপ আচরণ করছেন। আমি এসেছি আপনাকে ত্রিশ হাজার ডলার পাইয়ে দিতে। এ ব্যাপারে কিছু শুনতে কি আপনি বিরক্তি বোধ করবেন? নিশ্চয়ই না?’

‘ঠিক আছে, বলুন কী বলার আছে আপনার।’ রানার জুতোটা লক্ষ করছে সে বাঁকা চোখে।

‘করিডোরে দাঁড়িয়ে?’

‘হ্যাঁ। যা বলবার এখানে দাঁড়িয়েই বলুন। বেশি সময় দিতে পারব না। আপনাকে উকিল ক্লিপটন আমার পেছনে লাগিয়েছে, তাই না?’

‘ঠিক ধরেছেন। ওঁর সঙ্গে যোগাযোগ করছেন না কেন? উইল মোতাবেক বণ্টন-নিষ্পত্তির জন্যে খুঁজছেন তিনি আপনাকে, ধরে খেয়ে নেবার জন্যে নয়।’

‘যখন ইচ্ছে হবে, আমি নিজেই দেখা করব। আপনি গিয়ে ওকে বলুন, পেছনে টিকটিকি লাগিয়ে আমাকে উত্ত্যক্ত করার কোনও দরকার নেই। ওর আচরণ মোটেই পছন্দ হচ্ছে না আমার।’

এক হাত উঁচু করে চুল ঠিক করল স্ট্যানলি। আঙুলের ফোলা গিঁঠগুলো দেখে ওটাকে শিল্পীর হাত মনে হলো না রানার, মনে হলো কোনও বক্সারের হাত। নরম গলায় বলল, ‘টাকাগুলো নিতেই আটলাণ্টিক পাড়ি দিয়ে এসেছেন আপনি আমেরিকায়। তা হলে কি ধরে নেব, আপনার প্রাপ্য ত্রিশ হাজার ডলারে আপনার আর আগ্রহ নেই?’

‘ঠিক জানি না,’ যেন খুব চিন্তায় পড়ে গেছে এমনি ভঙ্গিতে বলল স্ট্যানলি। ‘এ-টাকা পাওয়া মাত্র একলাফে আমার ইনকাম চলে যাবে উঁচু ট্যাক্স-ব্র্যাকেটে। ট্যাক্স বেড়ে যাবে অনেক। কে জানে, আখেরে হয়তো ক্ষতিই হবে। ভাবছি, নিসে ফেরত যাওয়াই হয়তো আমার জন্যে ভাল হবে।’

‘ক্লিপটনকে ফোন করে একথা জানিয়ে দেননি কেন?’

‘ইচ্ছে হয়নি, তাই।’ বলেই সিধে হয়ে বুক ফুলিয়ে দাঁড়াল স্ট্যানলি। ‘এবার পা-টা সরিয়ে নিয়ে কেটে পড়ুন, মিস্টার। আর একটা কথা বললে এক ঘুসিতে নাকটা ফাটিয়ে দেব!’ হাসল রানা। ‘ঠিক আছে, ঠিক আছে, ভাই। অত চটে যাওয়ার মত কিছু হয়নি।’ হাত বাড়িয়ে দিল সামনে। ‘আমরা হাসিমুখেই বিদায় নিতে পারি।’

সুযোগটা হাতছাড়া করল না বদমেজাজি যুবক। খপ্‌ করে ধরল রানার হাত। ধরেই গায়ের জোরে চাপ দিল, মুখে শায়েস্তা করার হাসি। হাসল রানাও। তারপর ও যখন পাল্টা চাপ দিতে শুরু করল, প্র মে বিস্ময় ফুটল শিল্পীর চোখে, তারপর মলিন হয়ে গেল হাসি। রানা আর একটু চাপ বাড়াতেই ফ্যাকাসে হয়ে গেল মুখটা, ঘাম দেখা দিল কপালে। ফরসা মুখটা যখন ব্যথায় নীল হয়ে যাচ্ছে, তখন ওর হাত একটু ঝাঁকিয়ে দিয়ে পা সরিয়ে নিল রানা দরজার ফাঁক থেকে। নিজের হাতটা চিত করে দেখল স্ট্যানলি আঙুল পাঁচটাই আছে কি না, তারপর দড়াম করে লাগিয়ে দিল দরজা।

নীচে নেমে ফয়ে থেকে অ্যাডাম ক্লিপটনকে টেলিফোন করল রানা। স্ট্যানলির ছদ্মনাম ও ঠিকানাটা জানাল তাকে, তারপর বলল, ‘মনে হচ্ছে, টাকাটার ব্যাপারে তেমন কোনও আগ্রহ নেই ওর মধ্যে। নিসে ফিরে যাওয়ার কথাও একবার উচ্চারণ করল।’ ‘তা হলে এখানে এসেছে কী করতে?’

‘সেটা আপনিই জিজ্ঞেস করুন ওকে। আমাদেরকে ওর পেছনে লাগানোয় রেগে গেছে লোকটা। আমার মনে হচ্ছে, কী এক কারণে যেন পালাই পালাই করছে, ওকে ধরতে হলে উড়ে চলে আসতে হবে আপনার এখানে।’

‘আচ্ছা,’ বলল ক্লিপটন। ‘আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, মিস্টার রানা। চমৎকার কাজ দেখিয়েছেন। আপনাদের কাজ শেষ, আর কোনও সাহায্য দরকার হবে না আমার। …রাখলাম।’

‘দাঁড়ান, এক সেকেণ্ড,’ বলল রানা। ‘আমাদের ধারণা, স্ট্যানলি এখন হোটেল বদলাবে। এক্ষুনি না এলে ওর দেখা পাবেন না।’

‘ঠিক আছে। আপনাদের পছন্দ করছে না যখন, এখন থেকে যা করার আমি নিজে করব, আপনাদের দায়িত্ব শেষ। ধন্যবাদ।’ কানেকশন কেটে দিল অ্যাডাম ক্লিপটন। চিন্তিত ভঙ্গিতে জুলফির নীচটা চুলকাল রানা। তারপর গিলটি মিয়া ও ক্যাভিনকে নিয়ে গাড়িতে উঠে তেতলায় যা-যা ঘটেছে সব বলল।

‘আমার সন্দো হচ্চে, সার, সব একোনও শেষ হোইনিকো।’ ‘ঠিক বলেছ,’ বলল রানা। ‘তোমাদের এখন ওই ট্র্যান্সমিটারটা উদ্ধার করতে হবে শেফার্সদের টেলিফোন থেকে। তা নইলে ওটা পুলিশ বা টেলিফোন কোম্পানির কারও চোখে পড়লে আজ হোক বা কাল, মস্ত ঝামেলায় জড়িয়ে যাবে রানা এজেন্সি।’

‘মেয়েটা বেরিয়ে গেলেই ওটা খুলে লিয়ে আসব, সার।’

মাথা নাড়ল রানা। ‘দিনে-দুপুরে ও-বাড়িতে ঢোকা খুবই রিস্কি হবে। চারপাশে অনেক লোক, অনেক বাড়িঘর। আবার একবার টেলিফোন মিস্ত্রীও সাজা যাবে না। কাজটা সারতে হবে তোমাদের সন্ধের পর।’

তবে অফিসে ফেরার পথে পিজিয়ন লেন হয়ে এলো ওরা। ক্যাভিনের তোবড়ানো টয়োটা সিপ্রণ্টার সামান্য কাত হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে রাস্তার ধারে। মোড় ঘুরেই দাঁড় করালো রানা গাড়ি, একটা কাগজে লিখল: গাড়িটা বিকল, মেকানিকের অপেক্ষায় দাঁড়ানো, তারপর ক্যাভিনকে বলল, ‘এটা সাঁটিয়ে দিয়ে এসো ওটার উইণ্ডশিল্ডে।’

অফিসে ফিরে গিলটি মিয়া তার লোকজন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল কাজে। রানা ঢুকল গিয়ে নিজের অফিস কামরায়। পিওন ছুটল সবার জন্য লাঞ্চ আনতে।

প্রথমেই ফোন করল রানা ক্রেডিট রেটিং অফিসে ওর বন্ধুর কাছে। বন্ধু জানাল: শেফার্সরা দুজন মিলে বছরে আয় করে এগারো হাজার দুইশ’ ডলার। বিশ হাজার দিয়ে কিনেছে ওরা বাড়িটা চার বছর আগে, পনেরো হাজার ডলার শোধ হবে ইন্সটলমেণ্টে আগামী পনেরো বছরে। বাড়ির আসবাবও কেনা হয়েছে ইন্সটলমেণ্টে। টাকা পরিশোধে কোনও গড়িমসি বা অনিয়ম নেই। মেয়েটা টাইপিস্টের কাজ করে একটা রিয়েল এস্টেট কোম্পানিতে, ফিলিপ শেফার্স ট্রান্স-আটলাণ্টিক এয়ারলাইন্সের রিজার্ভেশন ক্লার্ক।’

‘এদেরই একটা প্লেন কদিন আগে ক্রাশ করেছে না?’

‘হ্যাঁ। ফিলিপ শেফার্স মারা গেছে ওই প্লেনক্রাশে। আর কিছু জানতে চাস, দোস্ত?’

‘না রে, তোকে ধন্যবাদ,’ খুব ধীরে উচ্চারণ করল রানা শব্দ ক’টা।

Super User