ইতিহাস থেকে যারা শিক্ষা নিয়েছেন তারা জানেন আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সবসময় সমঝোতা হয় না, এমন, একটা সময় আসে যখন কামানের গর্জনই বিবাদ মীমাংসার একমাত্র উপায়। বেনন যদিও ইতিহাসের ইতিবৃত্তে কখনও নাক গলায়নি, তবুও এই মুহূর্তে বুঝতে ওর দেরি হলো না যে এখনই সেই কামান গর্জে ওঠার মুহূর্ত। এই মেয়ে দুই আর দুইয়ে চার মিলিয়ে বসেছে, যুক্তি-তর্কে কোন কাজ হবে না; তিন আর একেও যে চার হয় তা কে বোঝাবে একে।

অন্তরের গভীর থেকে চামড়া বাঁচানোর তাগিদ অনুভব করল বেনন। মেয়েটাকে একবার দেখে নিয়ে চোখে চোখে ব্যাগলের সঙ্গে কথা সেরেই ব্যুরোর ওপর রাখা লণ্ঠনটা নিভিয়ে দিতে ঝাপিয়ে পড়ল সে। শপাং করে ওর শার্টের পিঠ থেকে ধুলো ওড়াল ডেইজির চাবুক। দাঁতে দাঁত চেপে, জ্বলুনি সহ্য করে ফু দিয়ে ল্যাম্পটা নিভিয়ে দিল বেনন। ঘর অন্ধকার হয়ে যেতেই গড়িয়ে সরে গেল ব্যুরোর কাছ থেকে। ধুপধাপ আওয়াজে বুঝল ব্যাগলেও পৈত্রিক প্রাণটা বাঁচাতে অতিমাত্রায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। বাতাসে শিস কেটে এখানে ওখানে ছোবল মারছে ডেইজির চাবুক।

শব্দ লক্ষ্য করে লাফ দিল বেনন; মেয়েটার দু’পা আঁকড়ে ধরে হ্যাচকা টানে ফেলে দিল ছালবাকলা ওঠা কার্পেটের ওপর। এক হাতে পতনের গতি কমাল সে। খেয়াল রাখল যাতে মুখ থুবড়ে পড়ে ব্যথা না পায়। মুঠোর মধ্যে ডেইজির দু’হাত আটকে ফেলে কেড়ে নিল চাবুক। তারপর মেয়েটাকে দাঁড় করিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, বাতিটা জ্বালো, ব্যাগলে!

তুমি ঠিক জানো, বিপদ হবে না তো? অন্ধকার থেকে ব্যাগলের সাবধানী প্রশ্ন ভেসে এলো। আমার কিন্তু কয়েকটা গোঁফ কেটে নিয়েছে ওই মেয়ে!

জ্বালো।

বাতি জ্বলে ওঠার পর এলোচুল ডেইজির দিকে তাকাল বেনন। শক্ত হাতে মেয়েটাকে ধরে রেখেছে যাতে নড়াচড়া করতে না পারে।

দেখো, তোমার খালার স্পার আমরা নিইনি। কোচে আরও একজন ছিল, কাজটা তার হতে পারে। আঁধার নামার পর হয়তো ব্যাগ হাতড়ে জিনিসটা নিয়ে নিয়েছে। ব্যাগলে মেঝে থেকে চাবুকটা তুলে হাতে নেয়ার পর মেয়েটাকে ছেড়ে দিল বেনন। পিঠ জ্বলছে এখনও, তবু যতটা সম্ভব নরম গলায় বলল, মিস ডেইজি, আশা করি তুমি আমাদের সমস্যা বুঝতে পেরেছ; যে জিনিস নেই তা আমরা দেব কোত্থেকে। তুমি চাইলে আমার স্পার তোমাকে দিতে পারি, কিন্তু তাতে তোমার কোন কাজ হবে বলে মনে হয় না। জানোই তো অনেক দূর থেকে এসেছি, আমাদের বিশ্রাম প্রয়োজন, তুমি বিদায় না নিলে আমরা ঘুমাতে পারছি না…তুমি কি স্বেচ্ছায় যাবে, না হোটেল কর্তৃপক্ষকে ডাকতে হবে?

বেশ, এবার তোমরা জিতলে, চোরের দল, হিসহিস করে বলল ডেইজি। অপমানে জল চলে এসেছে দু’চোখে।

ব্যাগলে, চাবুকটা জানালা দিয়ে নিচে ফেলে দাও, নির্দেশ দিল বেনন। আমাদের ভদ্রমহিলা বাড়ি যাওয়ার পথে ওটা কুড়িয়ে নিতে পারবে।

বিনা বাক্যব্যয়ে নির্দেশ পালন করল ব্যাগলে। জ্বলন্ত চোখে ওদের দুজনকে একবার দেখে নিয়ে বাতাসে ঝড় তুলে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল ডেইজি হ্যাটার।

আমাদের উইটিগোতে আসা উচিৎ হয়নি, বেনন। গোঁফে হাত বুলিয়ে আফসোস করে বলল ব্যাগলে। এশহরে মহিলা জাতিও হিংস্র হয়ে উঠেছে।

কিছুক্ষণ চিন্তা শেষে ব্যাগলের দিকে তাকাল বেনন। আমি একটু বাইরে থেকে আসছি। তুমি ঘুমোবার চেষ্টা করো, বুড়ো শেয়াল।

আমি সাংঘাতিক দুঃখ পাব পরে যদি জানি আমাকে না জানিয়ে গোপনে তুমি মেয়েটার পিছু নিয়েছ। তেমন কিছু করার কথা তোমার মাথায় নেই তো, বেনন? আমার কেন যেন মনে হলো মেয়েটাকে তুমি দরকারের চেয়ে বেশি সময় ধরে রেখেছিলে।

অত সাহস নেই আমার, ওই মেয়েকে দশ ফুটের মধ্যে দেখলেও দৌড়ে গিয়ে সবচেয়ে উঁচু কটনউড গাছের মাথায় উঠব। নির্বিকার চেহারায় মিথ্যে বলে দরজার দিকে পা বাড়াল বেনন। আসলে ডেইজিকে দেখার সুযোগ পেলে দু’চোখ ভরে দেখে নেবে ও। ঘুমাও তুমি। আমি যাচ্ছি স্টেজ স্টেশনে; দেখি স্পার রহস্যের সমাধান করা যায় কিনা।

আধঘণ্টা পর ঘরে ফিরল বেনন। ডাকছে ব্যাগলের নাক। অর্ধেকের বেশি বিছানা জুড়ে হাত-পা ছড়িয়ে পড়ে আছে ঘুমে বিভোর হয়ে। জাগাল না ওকে বেনন। বাতি নিভিয়ে নিঃশব্দে শুয়ে পড়ল।

পরদিন সকালে হাত-মুখ ধুয়ে নাস্তা সারার পর ব্যাগলেকে বলল ও কোথায় গিয়েছিল কাল রাতে।

তাহলে স্টেজ স্টেশনে গিয়ে স্টেজটা পেলে তুমি; জানালার চৌকাঠে একটা ফাঁক ছিল, সেখানে পাওয়া গেল সাদা সিল্কের রুমাল, তো কি হলো? বেনন থামার পর জানতে চাইল ব্যাগলে।

মনে নেই ডক্টর ওয়াঙের হাতে একটা সাদা রুমাল ছিল?

তারমানে জানালা দিয়ে হাত বের করে ডাকাতদের ইশারা করছিল লোকটা?

অবশ্যই। ওয়াং এত বোকা নয় যে যার-তার কথা বিশ্বাস করে মাইলের পর মাইল হাঁটবে। আমার ধারণা কোচে মিস হ্যাটার আছে নিশ্চিত হতে বদমাশগুলোর সঙ্গেই ঘোড়ায় চড়ে এগিয়ে এসেছে সে, তারপর কোচ থামিয়ে ভান করেছে যে ঠকিয়ে দেয়া হয়েছে তাকে। ওয়াঙের সঙ্গীরা আরও সামনে অপেক্ষা করছিল, সে ইশারা করতেই এসে হাজির হয়েছে তারা।

তারপর আমরা যখন ওদের তাড়িয়ে দিলাম বাধ্য হয়ে ঝুঁকি নিয়ে স্পারটা গায়েব করে দিল ওয়াং।

সায় দিল বেনন। একটা ব্যাপার খেয়াল করেছ, কোচের দিকে কোন গুলি ছোড়েনি ওরা। আমার কাছে খটকা লাগলেও তখন গোলমালের মধ্যে ঠাহর করতে পারিনি। এখন বুঝতে পারছি কোচের মধ্যে ওয়াং ছিল বলেই ওরা পাল্টা আক্রমণ করেনি।

ওয়াং এখন কোথায় বলে তোমার ধারণা? ছেড়া গোঁফের প্রান্তে আলতো করে আঙুল বোলাল ব্যাগলে। ওর দু’চারটা যা দাড়ি আছে মুঠো করে ছিঁড়ে ফেলব আমি।

জানি না, খোঁজ নিয়ে দেখেছি, অন্তত এই হোটেলে ওঠেনি। কাঁধ চাপড়ে ব্যাগলেকে সান্ত্বনা দিয়ে দরজার দিকে পা বাড়াল বেনন। ওয়াংকে হাতে পাবার চিন্তা বাদ দিয়ে চলে এসো রেল অফিসে যেতে হবে আমাদের।

পাঁচ মিনিটের মাথায় কাঠের বিল্ডিঙের দোতলায় উঠে এলো ওরা। সিঁড়ির গোড়াতেই অ্যান্টিরূম। সেখানে একটা ডেস্ক ফেলে নিজের চেয়ে বেশি ওজনের চশমা নাকে চাপিয়ে বসে আছে রুগ্ন এক ফ্যাকাসে ক্লার্ক। চেহারায় তার রাজ্যের উদাসীনতা; মশা মাছি দেখছে এমন অবহেলার ভঙ্গিতে ওদের দেখল লোকটা।

মার্লোন ব্র্যান্ডন অফিসে আছে? জানতে চাইল বেনন। কনফারেন্স চলছে, পরে আসতে হবে তোমাদের।

ধন্যবাদ। ক্লার্ককে পাত্তা না দিয়ে ঘরের ভেতর দিকের দরজা লক্ষ্য করে পা চালাল বেনন। লোকটা চমক সামলে বাধা দেয়ার আগেই ব্যাগলেকে পাশে নিয়ে পৌঁছে গেল সে দরজার কাছে। দরজা খুলে ঢুকে পড়ল ভেতরে।

চল্লিশ বাই বিশ ফুট একটা ঘর। মাঝখানে লম্বা একটা কনফারেন্স টেবিল। চলছে কনফারেন্স; টেবিলের এক মাথায় বসেছে কালো মখমলের লর্ড ফন্টলরয় স্যুট পরা দেবতার মত সুন্দর একটা বাচ্চা ছেলে; আরেক মাথায় পেটমোটা এক টাকমাথা মাঝবয়সী লোক নতুন চেয়ারটার বারোটা বাজাচ্ছে। টেবিলের দু’পাশে বসেছে আরও দু’জন লোক। তাদের একজন। যুবক; গায়ের রং রোদে পোড়া বাদামী, পরনে চমৎকার স্যুট, দেখতেও সুদর্শন; অপরজন চোয়ালের হাড় বের হওয়া লম্বাটে চেহারার রোগা এক লোক। কাঁধ দুটো ঝুঁকে পড়েছে সামনের দিকে, চুলগুলো পাতলা হয়ে আসায় দেখতে তাকে প্রায় কুৎসিত দেখাচ্ছে।

যুবকের ওপর স্থির হলো বেননের দৃষ্টি। এই মুহূর্তে বিরক্ত হয়ে ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে থাকলেও যুবকের আচরণে একটা সহজ স্বাভাবিকতা আছে, লোকটাকে ভাল লাগল ওর। আগে কখনও দেখেনি, আন্দাজ করল এই লোকই মার্লোন ব্র্যান্ডন।

আমি রক বেনন, তার সামনে দাড়িয়ে নিজের পরিচয় দিল বেনন। ব্যাগলেকে দেখিয়ে বলল, এ আমার বন্ধু হিরাম ব্যাগলে।

কালকের পোশাকটাই আজও পরে আছে ব্যাগলে। সেই হ্যাট-কোট-প্যান্ট আর হলুদ বোতাম লাগানো সাদা বুট জুতো। জুতোর ফাঁকটা আজ আরও বড় হয়েছে; শার্টটা খানিক ময়লা।

অসম্ভব! এ লোক হিরাম ব্যাগলে হতে পারে না, বিস্ময় কাটিয়ে উঠে বলল মার্লোন।

আমি নিজেই কি আর বিশ্বাস করতে পারছি? দীর্ঘশ্বাস ফেলল ব্যাগলে। বাধ্য হয়ে আমাকে এই বেশ ধরতে হয়েছে, নইলে পেছনে মেয়েদের মিছিল দেখতে পেতেন।

স্যার, দরজার কাছ থেকে ব্র্যান্ডনকে ডাক দিল ক্লার্ক। এখন তার গলায় মধু ঝরছে। স্যার, এরা আপনার পরিচিত? আমি নিষেধ করার পরও জোর করে ঢুকে পড়েছে।

হ্যাঁ, পরিচিত। হাতের ইশারায় ক্লার্ককে বিদায় করে ব্যাগলের দিকে তাকাল ব্র্যান্ডন। ব্যাপার কি?

জবাব দিল বেনন, ওরা ছদ্মবেশে আসতে বলেছিল, তাই ছদ্মবেশ নিয়েছে ব্যাগলে।

অমানুষিক…মানে অবিশ্বাস্য, সশব্দে শ্বাস ছেড়ে মার্লোনের দিকে তাকাল টাকমাথা। কারা এরা, ব্র্যান্ডন?

উঠে দাঁড়াল যুবক। এতক্ষণে বোঝা গেল সুঠাম দেহ তার। লম্বায় প্রায় বেননের সমান। পরিচয়ের পালাটা সেরে ফেলা যাক। হাত বাড়িয়ে বেনন আর ব্যাগলের সঙ্গে করমর্দন করল সে। আমি মার্লোন ব্র্যান্ডন। টাকমাথাকে দেখিয়ে বলল, ইনি হচ্ছেন ভাউবয়েস সি. ভাউবয়েস নোয়াক; মন্ট্যানা সেন্ট্রালের তৃতীয় ভাইস প্রেসিডেন্ট। তাঁর বিশেষ দয়া, আমাদের সমস্যা বুঝতে নিজেই চলে এসেছেন। এবার টাকমাথার দিকে তাকাল মার্লোন। মিস্টার ভাউবয়েস, গোয়েন্দাগিরি করার জন্যে লোক দরকার। আমরা আলোচনা করেছিলাম; আপনি সম্মতি দিয়েছিলেন; এরাই সেই লোক।

ভাউবয়েসের উল্টোদিকে বসে থাকা ছেলেটার বয়স খুব বেশি হলে বারো। এতক্ষণ চুপ করে ছিল, এবার নাক সিঁটকে তাকাল; চেহারা থেকে খসে পড়ল দেবতা সুলভ পবিত্রতা। বলল, নাহ, এদের গোয়েন্দা হবার উপযুক্ত বলে মনে হচ্ছে না!

ছিহ্, ফ্র্যাঙ্ক! ভদ্রতার খাতিরে ছেলেকে ধমক দিল ভাউবয়েস, তারপর বেননের দিকে মোটা গর্দানটা ফেরাল। ফ্র্যাঙ্কের ব্যবহারে আমি দুঃখিত, জেন্টেলমেন।

আপনার ছেলে বুঝি? জানতে চাইল ব্যাগলে।

হ্যাঁ, রেলওয়ের কাজ দেখাতে ওকে নিয়ে এসেছি; একদিন আমার চেয়ারে বসে মন্ট্যানা সেন্ট্রালকে এগিয়ে নিয়ে যাবে ও।

তার আগেই ওকে ভদ্রতা শেখানো দরকার, মন্তব্য করল গম্ভীর ব্যাগলে।

অস্বস্তির ছাপ পড়ল ভাইস প্রেসিডেন্টের চেহারায়। মিস্টার ব্যাগলে, আমি আর আমার স্ত্রী বিশ্বাস করি বাচ্চাদের মানসিক বিকাশে বাধা দেয়া উচিত নয়।

এই দুই ভদ্রলোক আসলেই আমাদের কাজে আসবেন কিনা বিবেচনা করার প্রয়োজন রয়েছে বলে আমি মনে করি, এই প্রথম মুখ খুলল রোগা ভদ্রলোক।

ইনি হচ্ছেন হ্যারি হুলাহান; টেইলহল্টের ব্যাঙ্কার, তাড়াতাড়ি করে বলল ব্র্যান্ডন, ইনি সাহায্য না করলে স্পার তৈরির কথা চিন্তাও করতে পারতাম না আমরা। আর মিস্টার হুলাহান, আপনি বোধহয় নাম শুনেছেন; আমাদের সামনে দাঁড়ানো এই ভদ্রলোক স্বনামখ্যাত রক বেনন। আর তার সঙ্গী ভদ্রলোক হিরাম ব্যাগলে, একসঙ্গে কাজ করেন তাঁরা।

হ্যাঁ, নাম শুনেছি; ছবিও দেখেছি ডাকঘরে, ধীরে ধীরে বলল ব্যাঙ্কার। ওয়ান্টেড পোস্টার ছিল রক বেননের নামে। হিরাম ব্যাগলের পোস্টার যদিও দেখিনি, আমার ধারণা সে-ও একই পথের পথিক। কেউ যদি আমার ব্যক্তিগত অভিমত চায়, আমি বলব গভর্নর ক্ষমা করলেও আউট-লদের কাজে নেয়াটা আমার মোটেই পছন্দ হচ্ছে না।

আউট-ল? কৌতূহলে চকচক করে উঠল কিশোর ফ্র্যাঙ্কের চোখ। তাই যদি হবে তাহলে ওদের মুখোশ কোথায়?

দেখো, ব্র্যান্ডন, এখানে আমরা মানুষের সমালোচনা শুনতে আসিনি, খানিকটা অধৈর্য হয়ে বলল বেনন। এদের মনোভাব মোটেই পছন্দ হচ্ছে না ওর; এসেছিল খাতির করে কাজে নেয়া হবে আশা করে, এখন দেখা যাচ্ছে ওদের যোগ্যতা নিয়েই সন্দেহ দেখা দিয়েছে, খাতির করা দূরের কথা। ব্র্যান্ডন হাঁ করতেই হাত তুলে খামিয়ে দিল বেনন। ল্যাটিগো বেসিনে আমাদের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল মন্ট্যানা রেলের কর্মকর্তা ম্যাকমিলানের; তার অনুরোধেই আমরা এসেছি; তোমাদের যদি ধারণা হয়ে থাকে ঠেকায় পড়ে চাকরি খুঁজছি, তাহলে ভুল ভেবেছ। ঘুরে দাঁড়াল বেনন। চলো, ব্যাগলে, আমাদেরকে এদের দরকার নেই।

দাঁড়াও! পেছন থেকে চেঁচাল ব্র্যান্ডন। চট করে একবার দেখে নিল ব্যাঙ্কারকে। বলল, আমরা আপনার কাছে কৃতজ্ঞ, মিস্টার হুলাহান; বিশেষ করে পাগলা হ্যাটারকে জমির ব্যাপারে রাজি করানো আপনাকে ছাড়া ছিল অসম্ভব, আমি আপনার সহায়তা থেকে বঞ্চিত হতে চাই না; তবে…

আমি সাহায্য করছি কারণ রেল চললে উইটিগোর উন্নতি হবে, সেই সঙ্গে বাড়বে আমার ব্যাঙ্ক ব্যবসা, বলল হ্যারি হুলাহান। আপনাদের নিজস্ব সিদ্ধান্তে নাক গলাতে চাই না, শুধু এটুকু বলব, মাত্র ক’দিন আগেও যারা বেআইনী কুকীর্তি করে বেড়াত, তাদেরকে বিশ্বাস করে কাজে নেয়া উচিৎ হবে কিনা এব্যাপারে আমি নিশ্চিত নই।

আমরা এখানে আইন বিরোধী একদল বদমাশের মোকাবিলা করছি, শান্ত স্বরে বলল ব্র্যান্ডন। ম্যাকমিলানের কাছে আমি কৃতজ্ঞ যে ও বেনন আর ব্যাগলেকে পাঠিয়েছে। ওদের যদি এখন আমরা চলে যেতে দিই পরে পস্তাতে হবে এ আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি। মজুরদের বেতন কেড়ে নিচ্ছে ডাকাতের দল, রাত বিরাতে হামলা করে ভয় দেখাচ্ছে, বিনা বাধায় নষ্ট করছে আমাদের সম্পত্তি-এসব বন্ধ করতে হবে। কে করবে বন্ধ? ডাকাতদের হটিয়ে দেয়া কোন দুধে ধোয়া তুলসী পাতার কাজ নয়; বেনন আর ব্যাগলের এধরনের কাজে অভিজ্ঞতা আছে, ওদের মত মানুষই আমাদের প্রয়োজন। বেননের দিকে তাকাল ব্র্যান্ডন। একটানা কথা বলার পরিশ্রমে হাঁপাচ্ছে মৃদু মৃদু। একটু থেমে বলল, ম্যাকমিলানের কাছে আমি কৃতজ্ঞ কারণ সে তোমাদের পাঠিয়েছে; তোমাদের কাছে কৃতজ্ঞ কারণ তোমরা দয়া করে এসেছ। এখন যদি কাজটা তোমরা দয়া করে নাও আমি ঋণী হয়ে থাকব।

কাশি দিয়ে গলা পরিষ্কার করল ভাউবয়েস। আমি বুঝতে পারছি না কি করা উচিত। মিস্টার হুলাহানের কথায় কিন্তু যুক্তি আছে।

এবার সত্যিই রেগে গেল মার্লোন ব্র্যান্ডন। থমথমে গলায় বলল, দেখুন মিস্টার ভাউবয়েস, এটা আপনার শিকাগোর অফিস নয় যে ডেস্কে বসে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। আপনি আমাকে একটা দায়িত্ব দিয়েছেন, সেই দায়িত্বের অংশ হিসেবে ওদের আমি নিয়োগ দিতে চাই… অবশ্য ওরা যদি চাকরি নিতে রাজি থাকে।

সিদ্ধান্ত নিতে কোনদিনই দেরি করে না বেনন, এবারও দেরি হলো না। ব্যাগলে ভ্রূ কুঁচকে চেহারায় অসম্মতি নিয়ে চেয়ে আছে দেখেও বলল, আমি রাজি। আজ থেকেই কাজে লেগে পড়ব আমরা।

ব্যাঙ্কারের চেহারায় কোন পরিবর্তন আসে কিনা লক্ষ করে দেখল বেনন। এ কাজটা নিত না ও কিছুতেই, নিয়েছে শুধু ব্যাঙ্কারের বিরোধিতা, করার জন্যে। লোকটা ওদের অপমান করেছে, কাজেই পাত্তা না দিয়ে পাল্টা অপমান করার অদম্য ইচ্ছে চাপতে পারেনি বেনন। এখন একটু হতাশই লাগল ওর; হ্যারি হুলাহানের লম্বাটে চেহারায় কোনরকমের কোন অভিব্যক্তি নেই।

তাহলে আমরা এখন একই নৌকার যাত্রী, নীরবতা ভাঙল ব্যাঙ্কার। মিস্টার ব্র্যান্ডন চাকরি দিলে আমার কাছ থেকে সহায়তা পাবে তোমরা।

তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ, শুকনো গলায় বলল বেনন।

ব্যাটার লম্বা নাকটা মেঝেতে ঘষে দেয়ার জন্যে কাজ নেয়ার কোন দরকার ছিল না, নিচু গলায় জানাল ব্যাগলে।

ব্র্যান্ডনের উদ্দেশে বলল বেনন, এখানে কি ধরনের গোলমাল চলছে তার মোটামুটি একটা ধারণা দিয়েছেন আপনি; বুঝতে পারছি কাজ এগিয়ে নিতে বাধা দেয়া হচ্ছে। আমাদের সুবিধা হবে তেমন আর কোন তথ্য আছে আপনাদের কাছে?

একটা ব্যাপার… শুরু করেও থেমে গেল ব্র্যান্ডন।

কি?

‘ডায়নোসর।’ হঠাৎ খুব ক্লান্ত দেখাল যুবককে। চেয়ারে বসে পড়ল ধপ করে। বেননের চোখে বিস্ময় দেখে ধীরে ধীরে মাথা দোলাল। হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন, না; পাগল হয়ে যাইনি, সত্যি একপাল ডায়নোসর আমাদের পাগল করে ফেলার জোগাড় করেছে। কি করব কেউ কিছু বুঝতে পারছি না…এই যুগে ডায়নোসর…

<

Super User