পুব আকাশে ভোরের রঙ ধরতে শুরু করেছে, হিমেল বাতাস বইছে প্ৰেয়ারিতে। নিভু নিভু হয়ে গেছে ক্যাম্পের আগুন, তবে দিনের আলো ফুটতে শুরু করায় দেখতে সমস্যা হচ্ছে না। তিক্ত এবং প্রায় নিঘুম একটা রাত কাটানোর পর ভোরের উন্মেষে ঘুমানোর চেষ্টা করার মানে হয় না, ভাবল বেন স্লেজেল। বেডরোল গুটিয়ে যাত্রার আয়োজন করল ও। সবকিছু গুছিয়ে বাকস্কিনের স্যাডলে চেপে বসল।

সরাসরি উত্তরে পাহাড়শ্রেণীর দিকে এগোল বেন। হিমেল বাতাস সঙ্গী হলো ওর। সামনে কটনউড আর উইলোর ঘন সারি চোখে পড়ছে, কিছুটা নিচুতে ঢেউ খেলানো জমির বুকে সরু ফিতের মত বয়ে যাচ্ছে নদীটারিও ফ্রিয়ো। একটা রীজের চূড়ায় এসে ক্ষণিকের জন্যে থামল ও, সিগারেট রোল করার ফাঁকে রিও ফ্রিয়ো উপত্যকায় নজর চালাল।

চির সবুজ এ উপত্যকায় সোনা ফলতে বহু রক্ত ঝরেছে। রিও ফ্রিয়ো যেন অপূর্ব সুন্দরী এক রমণী-কে পাওয়ার নেশায় বেপরোয়া হয়ে পড়েছে কিছু মানুষ, সংঘাত আর খুনোখুনি করতেও কুণ্ঠা বোধ করছে না কেউ। আসলেই কি এই উপত্যকার ততটা মূল্য আছে? আনমনে ভাবল বেন। কিন্তু অস্বীকার করার উপায় নেই নিজস্ব সৌন্দর্য আছে উপত্যকাটার, আছে অবারিত সবুজ তৃণভূমি আর। পাইনের গন্ধ মাখা সুবাসিত বাতাস। স্বপ্ন দেখতে পারে যে কেউ-বসতির স্বপ্ন, ভবিষ্যতের স্বপ্ন।

এই উপত্যকার ইতিহাস রক্তাক্ত সংঘাতে ভরা। স্পেনিয়ার্ডরা আসার আগে এর দখল নিয়ে লড়েছে ইন্ডিয়ানরা, আর মেক্সিকান যুদ্ধের পর লড়েছে আমেরিকানরা। এখনও লড়ছে, মাঝে মধ্যেই তাদের প্রতিহিংসার আগুনে বুলি হয়েছে হতভাগ্য কিছু মানুষ; শত্রুতা আর ঘৃণার দীর্ঘস্থায়ী পথ তৈরি করেছে।

পুব আকাশে গোলাপী আভা ছড়িয়ে দিল সূর্য, উষ্ণ কোমল আলোয় ডুবে গেল প্ৰেয়ারি। রিও ফ্রিয়োর পশ্চিম আর দক্ষিণে ডাবল-বির জমি, বাপের কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া ডলোরেস ক্যাস্টানের সম্পত্তি ছিল একসময়। টেক্সান কার্ল ব্রেনেলকে বিয়ে করে স্প্যানিশ এই মহিলা। পাঁচ সন্তানের জন্ম দেয় সে, যাদের মাত্র তিনজন বেঁচে আছে এখন সবার বড় বিল ব্রেনেল, বাপের। লালচে চুল আর মা-র কালো চোখ পেয়েছে সে; বাপের নীল চোখ আর মা-র ঘন কালো চুল এবং সৌন্দর্য পেয়েছে মিরিয়াম; সবার ছোট জেফরি ব্রেনেল মা-র কোমল স্বভাব পেলেও শারীরিক ভাবে বাপের হুবহু সংস্করণ।

ডলোরেসের সৎ বোন নূয বিয়ে করেছিল টম নোলানকে। লেযি-এনের যে কোন সম্পত্তি যেমন দৃঢ় হাতে, আগলে রাখে নোলান, তেমন করেই মহিলাকে ভালবেসেছিল সে, কিন্তু তাতে দুজনের কেউই সন্তুষ্ট হতে পারেনি। প্রথম বাচ্চার জন্মের পরপরই টম নোলানকে ছেড়ে চলে যায় মহিলা, পেছনে রেখে গেছে তিনটা জিনিস: বাচ্চা এক মেয়ে-অ্যাগনেস, স্বামীর প্রতি অপরিসীম ঘৃণা এবং রিও ফ্রিয়ো উপত্যকার অস্পষ্ট, সামঞ্জস্যহীন একটা দলিল।

কার্ল ব্রেনেল আর ডলোরেসের বিয়ের যৌতুক হিসেবে পাওয়া ডাবল-বির সম্পত্তির দলিলের ঠিক উল্টো এটা। দুই ক্যাস্টানে বোন পরস্পারকে যথেষ্ট ভালবাসত, কিন্তু নিজেদের অজান্তে ঘৃণা আর প্রতিহিংসার বীজ বপন করেছে ওরা। কার্ল ব্রেনেল আর টম নোলানকে তারই জের টানতে হচ্ছে, নিজের বা অধীন ক্রুদের রক্তের তেতো স্বাদ নিয়ে। ল্য নোলান এই উপত্যকা ছেড়ে যাওয়ার পর দীর্ঘ সাতাশ বছর পেরিয়ে গেছে, কিন্তু সম্পত্তির নিস্পত্তি যেমন হয়নি, তেমনি দুটো বাগানের মধ্যে শক্রতারও শেষ হয়নি।

রীজ ছেড়ে উপত্যকা ধরে এগোল বেন। মিনিট ত্রিশের মধ্যে আরেক রীজে উঠে এল, থেমে নিচের উপত্যকায় ডাবল-বি র‍্যাঞ্চ হাউসের দিকে তাকাল। এটাই ওর বাড়ি, সত্যিকার বাড়ি। কয়েকদিন বয়সে রাস্তা থেকে তুলে আনার পর নিজের সন্তানের মত ওকে মানুষ করেছে কার্ল ব্রেনেল। বেন সম্পর্কে কেবল একটা কথাই জানত ব্রেনেলরা–ওর নাম স্লেজেল, রিও ফ্রিয়োর কিনারে পড়ে ছিল বাচ্চাটা, গায়ে জড়ানো কাপড়ে সুতো দিয়ে নাম লেখা ছিল। স্লেজেলের সঙ্গে নিজের মৃত ছেলের নাম জুড়ে দেয় কার্ল ব্রেনেলবেন স্লেজেল নাম নিয়ে বড় হয় ও।

বেন স্নেজেল, আনমনে স্বগতোক্তি করল ও, স্যাডল হর্নে একটা হাত রেখে র‍্যাঞ্চ হাউস জরিপ করছে। ভাবছি আসলে তুমি কে!

আলো আর উষ্ণতা দিয়ে রিও ফ্রিয়ো উপত্যকা ভরিয়ে তুলেছে সূর্য। র‍্যাঞ্চ হাউসের পেছনে বিশাল উইন্ডমিলটা নড়তে শুরু করেছে। কোথাও ডেকে উঠল একটা মোরগ।

আনমনে হাসল বেন, কিন্তু মুখের পেশীতে টান পড়তে ব্যথায় কুঁচকে গেল, মুখ। ক্যাম্প ত্যাগ করার পর প্রচণ্ড ঠাণ্ডার মধ্যে দুই মাইল পথ পাড়ি দিয়েছে, ব্যথা প্রশমন হয়নি এতটুকু কিংবা গরম কফিও কাজে আসেনি। সান্তুনার ব্যাপার একটাই-ফ্রেড মোরিস বা তার দুই সঙ্গীও নিশ্চয়ই ওর চেয়ে ভাল বোধ করছে না। এখন।

ঢাল ধরে নিচে নামার সময় স্টিভ হারকারকে মনে পড়ল ওর। হ্যামার টানা পিস্তল ছিল বেনের হাতে, আর লেযি-এন র্যামরডের জোড়া কোল্ট ছিল। হোলস্টারে; কিন্তু গ্রাহ্য করেনি সে। হারকার কি সত্যিই ততটা ফাস্ট, ও গুলি করার আগেই ড্র করতে পারত?

বেনকে চেনে সে, জানে ওর সম্পর্কে। সিরেনোর রাস্তায় সেই গানফাইটের। কথা ছড়িয়ে পড়েছে চতুর্দিকে। লড়াইটা এত দ্রুত ঘটেছিল যে আসলে কি থেকে কি হয়েছে এই এতদিন পরও পরিষ্কার জানে না বেন। পিস্তলের মুহুর্মুহু গর্জন, গান পাউডারের তীব্র ঝাঁঝ আর প্রবল উত্তেজনায় কিছুই আঁচ করা সম্ভব ছিল না। দুজন মারা গেছে, একজন আহত হয়েছে এবং আজীবনের জন্যে একটা কনুই হারিয়েছে আরেকজন-সবাই লেযি-এন ক্রু। কিন্তু বিপক্ষে ছিল মাত্র দু’জন-বিল আর বেন, উঠতি বয়সের দুই তরুণ; লড়াইয়ের পর দেখা গেল কারও গায়ে। একটা আঁচড়ও লাগেনি।

জনশ্রুতি আছে হীথ পাওয়েলকে আহত করেছিল বিল, আর লাশ দুটো ফেলেছে বেন স্লেজেল এবং ফ্রেড মোরিসকে বিকলাঙ্গ করেছে। সত্যি কথা বলতে কি মদে চুর হয়ে ছিল তখন বিল, ওকে সেলুন থেকে বের করে নিয়ে আসে বেন; সেলুনের সামনের রাস্তায় লেযি-এন ক্রুদের তোপের মুখে পড়ে যায় দুজন। বিলের পক্ষে ঠিকমত নিশানা করাও সম্ভব ছিল না তখন, কিন্তু এমনিতে বেনের চেয়েও ক্ষিপ্র সে। রাইফেলেও অসাধারণ।

এটাই আসল কারণ। এ জন্যেই বেসিন ছেড়েছে বেন। কার্ল ব্রেনেলের সঙ্গে রক্তের সম্পর্ক নেই, এটা বিবেচ্য বিষয় ছিল না। সিরেনোর ওই গানফাইটের পর ও নিজেও কিছুটা অস্থির হয়ে উঠেছিল, চাইছিল অন্তত কিছু দিনের জন্যে হলেও অন্য কোথাও চলে যাবে। আর যাই হোক, মানুষ খুন করা মোটেও আনন্দের কাজ নয়। তাছাড়া শোধ নিতে মরিয়া হয়ে উঠেছিল লেযি-এন ক্রুরা। ভয় পায়নি বেন, বরং অনর্থক রক্তক্ষয় এড়াতেই দূরে সরে গেছে।

স্যাডল থেকে নামল ও, তারপর লাগাম হাতে এগোল বিশাল স্টেবলের দিকে। নিজের জন্যে স্থায়ী বাড়ি তৈরির আগেই স্টেবল তৈরি করেছিল কার্ল ব্রেনেল, জানে ও, বিভিন্ন জাতের শক্তিশালী ঘোড়ায় ভরা থাকত সবকটা স্টল। কার্ল ব্রেনেল আসলে যতটা না ক্যাটলম্যান, তারচেয়ে বরং হর্স-ব্রীডার হিসেবে বেশি পরিচিত ছিল। ছয় বছরে যথেষ্ট পরিবর্তন হয়েছে ডাবল-বির, এবং পরিবর্তনের প্রথম নমুনা শূন্য স্টলের সংখ্যা দেখেই জেনে গেল বেন। রিও ফ্রিয়োর চৌহদ্দিতে সবচেয়ে সমৃদ্ধ স্টেবল ছিল এটা, অথচ এখন যে কটা আছে এত কম ঘোড়া কখনোই দেখেনি ও।

বাকস্কিনের যত্ন করে ওয়ারব্যাগ, উইনচেস্টার আর বেডরোল নিয়ে স্টেবল ছাড়ল ও। অস্বাভাবিক নীরব মনে হচ্ছে বাড়িটাকে, যদিও রান্নাঘরের চিমনি দিয়ে ধোঁয়া উঠছে। রাতাসে পাক খাচ্ছে ঘোলাটে ধোয়া। পোর্চে এসে একটা খুঁটিতে গিয়ার আর রাইফেল রাখল বেন, তারপর হ্যাট দিয়ে বাড়ি মেরে গায়ের ধুলো ঝাড়ল। রান্নাঘরের দরজা খুলে ভেতরে উঁকি দিল। হ্যালো, টেকোস, ব্যস্ত কূকের উদ্দেশে শুধাল ও।

ঘুরে তাকাল শীর্ণদেহী কুক। খোদা! এ যে বেন! বেন স্লেজেল! এক হাতে সরু গোঁফে তা দিল সে, চোখ পিটপিট করে দেখছে ওকে। শুনলাম আসছ তুমি, কিন্তু ভাবিনি এত জলদি পৌঁছে যাবে!

বয়স্ক লোকটির সঙ্গে হাত মেলাল বেন। চলার মধ্যে ছিলাম আমি, টেকোস। এই ঠাণ্ডায় খোলা জায়গায় রাত কাটানো সত্যিই কঠিন, তাই রাতেও রাইড করেছি।

বুঝেছি, বাড়ি ফেরার জন্যে তাড়া বোধ করেছ, সেটা প্রকাশ করতে চাইছ না।

এখনও রান্নাই করছ, প্রসঙ্গ পাল্টাল বেন। ক’বছর হলো?

তোমার জন্মের আগ থেকে, সান। এখন কিন্তু এই কিচেনে রান্না করছি না।

তাহলে চলছে কিভাবে?

দৃষ্টি ফিরিয়ে অন্য দিকে তাকাল টেকোস। স্রেফ আগুনটা জ্বালিয়ে দিচ্ছিক্কশ্যাকে রান্না করার দায়িত্বই শুধু আমার।

কুকের দিকে তাকিয়ে থাকল বেন। একসময় কাউহ্যান্ড ছিল সে, কিন্তু ঘোড়া থেকে পড়ে একটা পা ভেঙে যাওয়ার পর থেকে কুক হিসেবে কাজ করছে ডাবল বিতে। তাও অন্তত দশ বছর হবে।

নিতান্ত অবহেলায় একটা হাত নাড়ল টেকোস ফারমিন। সময়ে অনেক কিছুই বদলে যায়, বেন। এখানেও পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছে। একজন মহিলা রান্নার কাজ করে এখন। ওর নাম কেষ্ট। চমৎকার রাঁধে। মি. ব্রেনেল নয়, বরং মিসেস ব্রেনেলের আইডিয়া এটা। বিল যদিও আমার রান্না খুব পছন্দ করত, কিন্তু মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় কি! সত্যি কথা বলতে কি মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না ওর।

সময়ে অনেক কিছুই বদলে যায়, স্বগতোক্তি করল বেন। বিয়ে করেছে ও। কিন্তু প্রায়ই বলত ওর গলায় দড়ি ঝোলাবে এমন কোন মেয়ের নাকি জন্ম হয়নি।

চুলোয় আগুন ধরেছে। হাতের চেটো দিয়ে কপালের ঘাম মুছল টেকোস। হ্যাঁ, মৃদু স্বরে বলল সে। কিন্তু ঠিকই সেধে গলায় দড়ি পরেছে ও।

বেসিনের মেয়ে?

স্থির হয়ে গেল কূকের হাত, শূন্য দৃষ্টিতে দেখল বেনকে। হ্যাঁ, বলা যায়…কেন?

স্রেফ কৌতূহল।

হাতে কিছু কাজ আছে, বেন। পরে তোমার সঙ্গে আলাপ করব। তুমি বরং এই ফাঁকে কফিতে চুমুক দাও। ছয় বছর কেমন কাটল তোমার? জবর গল্প করা যাবে! বলেই কিচেন থেকে বেরিয়ে গেল সে।

শ্রাগ করল বেন। কিচেন থেকে বেরিয়ে হলওয়ে ধরে বাড়ির সামনের দিকে এগোল। পুরো বাড়িই নীরব হয়ে আছে। কার্ল ব্রেনেলের প্রিয় বিশাল লিভিংরূমে ঢুকল ও, মাথা থেকে হ্যাট সরিয়ে হাতে তুলে নিয়েছে।

দরজার উল্টোদিকে বিশাল ফায়ারপ্লেসে আগুন জ্বলছে, কামরায় উষ্ণ আরামদায়ক আমেজ। প্রবল বিস্ময় নিয়ে দেখল বেন, আশাতীত পরিবর্তন হয়েছে। কামরাটার। শিকার করা পশুর মাথা, হরিণের চামড়ার ওপর বসানো রাইফেল আর শটগান ছিল দেয়ালে, বেশিরভাগই উধাও হয়ে গেছে এখন। পুরু চামড়ায়। মোড়া চেয়ারগুলোর একটাও নেই, মেহগনির টেবিল কিংবা সুদৃশ্য নাভাজো কার্পেটও নেই মেঝেয়।

ঐতিহ্যকে সরিয়ে আধুনিকতা তার জায়গা দখল করে নিয়েছে। দেয়ালে চুনকাম করা হয়েছে, ওয়ালপেপার মোড়া। আসবাবপত্র সবই হাল ফ্যাশনের, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে সারা ঘরে। মেঝেয় কার্পেট। বিশাল টেবিলটাকে মাঝখানে রাখা হয়েছে, সুদৃশ্য কাপড় দিয়ে ঢাকা এবং তাতে সুদৃশ্য ঝাড়বাতিদানি; মেক্সিকোর বড়বড় চার্চে এত দামী জিনিস দেখেছে বেন।

দেয়ালে পেইন্টিং আর কিছু স্কেচ শোভা পাচ্ছে এখন। কামরাটা, যেন রিও ফ্রিয়ো উপত্যকার কোন র‍্যাঞ্চারের নয়, বরং প্রথম শ্রেণীর অভিজাত কোন হোটেলের সীটিংরূম। ফায়ারপ্লেসের সামনে বিশাল উইং চেয়ারে বসে আছে। কেউ। লোকটার বুট জোড়া দেখা যাচ্ছে-দামী সুতী কাপড়ের ট্রাউজার আর মেক্সিকান চামড়ার বুট, এতটাই পালিশ করা যে ম্লান আলোয়ও চকচক করছে। অজান্তে নিজের পায়ের কাছে নেমে গেল বেনের দৃষ্টি, ধুলোমলিন জীর্ণ বুটের দিকে তাকাল; স্বভাবতই কার্পেটের ওপর স্থির হলো ওর দৃষ্টি।

কার্পেটটা নষ্ট হয়ে গেলে কেউ বকবে না তো?

ফায়ারপ্লেসের দিকে এগোল ও, পাশ থেকে দেখল বসে থাকা লোকটাকে। লালচে চুল দেখা যাচ্ছে। চেয়ারের হাতলের পাশে ঝুলে আছে একটা হাত, শূন্য গ্লাস ধরে রেখেছে লোকটা। চেয়ারের পাশেই ছোট্ট টেবিল, টেবিলে রূপালী ট্রে-র ওপর প্রায় শূন্য একটা বোতল।

ঝুঁকে এল বেন। বিল? মৃদু স্বরে ডাকল ও।

নড়ল না বিল ব্রেনেল।

বিলের কাঁধে একটা হাত রাখল ও। বিল? খানিকটা চড়া স্বরে ডাকল আবার।

মাথা তুলল কার্ল ব্রেনেলের বড় ছেলে, আধ-বোজা চোখে তাকাল ওর দিকে। টেকোস? জড়ানো কণ্ঠে জানতে চাইল সে।

আমি বেন।

জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিল বিল, চোখ পিটপিট করে দৃষ্টি পরিষ্কার করে নেওয়ার প্রয়াস পাচ্ছে। ওহ, বেন! মাথা নাড়ল সে, দৃষ্টি বিভ্রম কাটাতে নাকি সত্যিই বেনের উপস্থিতি অবিশ্বাস্য লাগছে বোঝা গেল না। তাড়াতাড়িই চলে এসেছ, তাই না? চেয়ারের হাতল ধরে উঠে দাঁড়াল সে। ডিনারের সময় থাক তো, বেন?

বিলকে দেখল ও। কিছু লিকার উপচে পড়েছে কাপড়ে, কার্পেটের একটা জায়গা ভেজা। মিসেস ব্রেনেল, সে যেই হোক, কার্পেটের অযত্ন বা দুর্গতি দেখে নিশ্চয়ই খেপে যাবে।

বিলের হাত থেকে গ্লাসটা নিয়ে ছোট্ট টেবিলে নামিয়ে রাখল বেন।

স্মিত হাসল বিল। তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে এইমাত্র একটা ক্যাটল ড্রাইভ শেষ করে এসেছ। যাকগে, আমাদের গড়ন প্রায় একই রকম। কেটকে গিয়ে বলো আমার ওয়ার্ডরোবটা যেন দেখিয়ে দেয়। বিয়ের সুটটা ছাড়া যে কোন কিছু পরতে পারো। ফের হাসল সে। ভাবছি গ্লাসের একটা কেসে ভরে সুটটা সান্তা ফের যাদুঘরে পাঠাব কিনা।

বোতলটা তুলে নিয়ে গন্ধ শুকল বেন। ব্র্যান্ডি, একেবারে খাঁটি জিনিস। কর্ক খুলে তলানিটুকু গলায় ঢালল ও। মুখ মুছে বোতল নামিয়ে রাখল, অনুভব করল গলা বেয়ে নেমে যাচ্ছে উষ্ণ পানীয়। গতরাতে এরকম ড্রিঙ্ক দরকার ছিল ওর।

চারপাশে তাকাল ও। পাশের দেয়ালে লিকার কেবিনেট দেখতে পেল, দরজার পাল্লা খোলা। অসংখ্য বোতল সারি করে রাখা, সবই সেরা জিনিস। কন্যাক ব্র্যান্ডি, লিকার, স্কচ। সগ্রহটা সত্যি অসাধারণ। দক্ষিণ-পশ্চিমের দামী হোটেলেও এত ভাল সংগ্রহ দেখা যায় না। সময়ে অনেক কিছুই বদলে যায়, ভাবল বেন, ডাবল-বির মালিকপক্ষ এখন আর বীয়ার, বুরবন বা রাই পান করে ।

ডিনারের জন্যে ওকে, থেকে যেতে বলেছে বিল, কিন্তু নিজে হয়তো সারা বিকেলই এখানে কাটিয়ে দেবে। কে জানে, রাতটাও বোধহয় এখানে কাটিয়েছে!

জানালার কাছে এল বেন, ভারী মখমলের পর্দা টেনে সরিয়ে দিল। উজ্জ্বল আলোয় ভরে গেল সারা ঘর।

দিনের আলো? সন্দিগ্ধ স্বরে জানতে চাইল বিল, চোখ কুঁচকে রেখেছে।

কিচেন থেকে বাসন-কোসন ধোয়ার শব্দ আসছে, আচমকা বেনের মনে পড়ল গতকাল দুপুরের পর ভাল করে কিছুই খাওয়া হয়নি। কূকের কাছ থেকে, কিছু একটা মুখে দেওয়ার জন্যে নিয়ে আসছি আমি, বিল, বলল ও।

উঠে দাঁড়াল বিল, চেয়ারের ব্যাকরেস্ট চেপে ধরেছে এক হাতে। ভঙ্গিটা আড়ষ্ট, অথচ বরাবরই স্বতঃস্ফূর্ত ছিল সে। বয়সের চেয়ে তরুণ মনে হত ওকে–সবাই ওকে “রিও ফ্রিগো কিড” বলে ডাকত এবং ব্যাপারটা পছন্দও করত সে-অথচ এখন দেখে মনে হচ্ছে চল্লিশের ঘরে পা পড়েছে।

তুমি বরং অপেক্ষা করো, মৃদু স্বরে বলল সে। টেবিলে বসার আগে কিছু খাওয়ার নিয়ম নেই এ বাড়িতে। শুনলেই খেপে যাবে আমার বউ। কেটের কাছে অনুরোধ করেও কিছু পাবে না তুমি। এভাবেই চলছে এ বাড়ির সবকিছু।

তুমি কখনও বলোনি যে বিয়ে করেছ, বিল।

রক্তলাল চোখ জোড়া ঝিকিয়ে উঠল। মনে হয় না অতে কিছু আসত-যেত।

নিশ্চয়ই আসত-যেত, তুমি ভাল করেই জানো।

খানিকটা দ্বিধা করল বিল। ঠিক আছে, এক্ষেত্রে খানিকটা ব্যতিক্রম না হয় হয়েছে। কিন্তু মনে করে দেখো পরিস্থিতিটা আমাদের দুজনের জন্যেই সমান ছিল–হয় আমি, নয়তো তুমি। বেসিন ছাড়ার ইচ্ছে আমারও ছিল, কিন্তু তুমিই চলে গেলে। জিতি বা হারি–সব দায়িত্ব আমাকেই নিতে হলো! শুকনো হাসি দেখা গেল বিলের ঠোঁটে।

কি বলতে চাচ্ছ, বিল?

মিষ্টি একটা কণ্ঠ বাধা দিল ওদের। সত্যি বলার জন্যে সাহস সঞ্চয় করছে–বলবে আমাকে বিয়ে করেছে ও, বেন।

হলওয়ের দরজার দিকে ফিরল বেন স্লেজেল। দরজায় দাঁড়িয়ে আছে অ্যাগনেস নোলান, একটা ফ্রক পরনে; দেখে মনে হচ্ছে ফ্যাশন ম্যাগাজিনের কোন সুন্দরী মডেল। হালকা বাদামী চুল খোঁপা করে তুলে রেখেছে মাথার পেছনে, অপূর্ব একটা মুখ, গাঢ় নীল চোখে নিরীখ করছে বেনকে।

হৃদয়ের গভীরে একটা আলোড়ন আবিষ্কার করল বেন। খোদা, আগের চেয়ে অনেক বেশি সুন্দর ও পরিণত লাগছে অ্যাগনেসকে। ক্যাম্পের আগুনের পটভূমিতে প্রায়ই এই মেয়ের ছবি কল্পনা করেছে ও, কিন্তু ঠকিয়েছে নোলান কন্যাকে–বাস্তবের ধারে-কাছেও কল্পনা করতে পারেনি!

কি ব্যাপার, বেন, উইশ করবে না আমাকে? ক্ষীণ হেসে জানতে চাইল অ্যাগনেস, একটা হাত বাড়িয়ে দিয়েছে ওর দিকে।

হ্যালো, অ্যাগনেস, এগিয়ে গিয়ে অ্যাগনেসের সাথে হাত মেলাল বেন। মেয়েটির উজ্জ্বল স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতি, সৌন্দর্য প্রায় মাদকতা সৃষ্টি করছে মনে।

বেশ তাড়াতাড়ি চলে এসেছ, মন্তব্যের সুরে বলল অ্যাগনেস, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে বেনের মুখের ক্ষতগুলো দেখছে। স্যাডল থেকে পড়ে গেছ নাকি?

হাত দিয়ে মুখ স্পর্শ করল ও। ঠিক তা নয়।

একটা হাত তুলে আলতো ভাবে ফেটে যাওয়া ফোলা ঠোঁট স্পর্শ করল অ্যাগনেস। আমার ওপর ছেড়ে দাও, দেখি কি করা যায়, হালকা সুরে বলল ও।

গ্রেসিয়াস, অ্যাগনেস।

খানিকটা ঝুঁকে বো করল বিল ব্রেনেল। রিও ফ্রিয়োর ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল। শুকনো স্বরে বিদ্রূপ করল সে।

ঝটিতি ঘুরে তাকাল বেন, দেখল বিলের চোখের চাহনি কঠিন হয়ে গেছে। এক ট্যাংক ব্র্যান্ডি পেটে পড়েছে তার, সুস্থির ভাবে চিন্তা করতে পারছে না-অনর্থক ঈর্ষা আর সন্দেহের শিকার।

ভুলে যাও, বেন! মৃদু স্বরে বলল অ্যাগনেস।

অচেনা একটা কামরায় ওকে নিয়ে এল মেয়েটি। বহু দিন আগে একটা বাথটাব ছিল এখানে, আর ছিল র‍্যাঞ্চ হাউসের পরিত্যক্ত সব জিনিস। শীতল অন্ধকার থাকত সবসময়, ব্যবহার করা হত না বললেই চলে। আবর্জনা তো সরানো হয়েছেই, উপরন্তু বাসযোগ্য করা হয়েছে ঘরটাকে-একেবারে সাজানো গোছানো, দামী আসবাবপত্রে ভরা।

পছন্দ হয়েছে? ঘাড়ের ওপর দিয়ে ওর দিকে ফিরে জানতে চাইল অ্যাগনেস।

স্মিত হাসল বেন। ডাবল-বিতে একটা বাথটাবই ব্যবহার করতাম। আমরা-ঘোড়ার ট্রাফ। মাঝে মধ্যে অবশ্য রিও ফ্রিয়োয় চলে যেতাম।

নড করল মেয়েটি। ঘুরে-ফিরে দেখে নাও, বেন, সন্তুষ্টি ওর কণ্ঠে। দেখবে এখানকার সবকিছু কেমন বদলে দিয়েছি আমি।

হ্যাঁ, কেবল জড় পদার্থগুলোই নয়।

ঝটিতি ঘুরে দাঁড়াল অ্যাগনেস। বিলের কথা বলতে চাইছ তুমি?

হয়তো।

এছাড়া উপায় ছিল না আমার।

সত্যি বলছ, অ্যাগনেস? শত্রুর ছেলেকে বিয়ে করতে দিল তোমার বাবা? বেসিনে আর কোন যোগ্য পুরুষ ছিল না?

মর্যাদা, প্রতিপত্তি বা আভিজাত্যের বিচারে নোলানদের সমকক্ষ শুধু ব্রেনেলরাই। হ্যাঁ, ব্রেনেলদেরই বেছে নিয়েছিলাম আমি। বাবা আপত্তি করেছিল বটে, কিন্তু পাত্তা দেইনি।

কিন্তু আমি তো জানতাম লেযি-এনের মত একই পরিবেশ ছিল এখানে-শত্রুর মেয়ে ছেলের বউ হয়ে আসবে, চিন্তাটাই হাস্যকর ছিল ডাবলবিতে। যদূর মনে পড়ে বিলই এ ব্যাপারে বেশি সোচ্চার ছিল, রীতিমত লেকচার দিয়ে বেড়াত সবসময়!

দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল মেয়েটি। কখনোই দৃঢ়চেতা ছিল না ও।

কিন্তু দৃঢ়, কঠিন চরিত্রের পুরুষ তোমার পছন্দ, তাই না?

উত্তর দিল না অ্যাগনেস, বেনের ক্ষতের শুশ্রূষায় ব্যস্ত।

তো?

দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরল অ্যাগনেস, তারপর শ্রাগ করল অসহায় ভঙ্গিতে। ছয়টা বছর, বেন! বড় দীর্ঘ সময়, একবারও ফিরে আসোনি তুমি, কিংবা একটা চিঠিও লেখোনি!

কিন্তু মোটামুটি স্থায়ী একটা ঠিকানা ছিল আমার, বিল সেটা জানত।

কি আশা করেছ আমার কাছে, তোমার খোঁজে চলে যাব?

না। কিন্তু মাত্র একটা শব্দে ফিরে আসতাম আমি।

বাবার কথা ভুলে গেছ বোধহয়?

না হেসে পারল না বেন। তোমার বাবাকে? গাট-হুক নোলান, রিও ফ্রিয়োর। আতঙ্ককে কেউ ভুলতে পারে? তারপরও, তুমি যদি খবর পাঠাতে নির্ঘাত গাট-হক। দুর্গে হানা দিতাম আমি, বুড়োর সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদটা ছিনিয়ে নিয়ে বলতাম: গোল্লায় যাও তুমি! দৃষ্টি নামিয়ে অ্যাগনেসের দিকে তাকাল ও, দেখল ওর মুখ। থেকে শুকনো রক্ত পরিষ্কার করছে মেয়েটি। তুমিও জানো সেটা, অ্যাগনেস। স্বীকার করো!

বেশি কথা বলছ তুমি!

কিন্তু এটাই সত্যি। মেয়ে হয়ে বাপের নিষেধ মানোনি তুমি, আমি মানতাম? আমার বা বিলের মধ্যে পার্থক্যটা কোথায়-যোগ্যতায়, নাকি আমি ব্রেনেলদের রক্তের নই বলে?

আচমকা আঙুল দিয়ে ওর ক্ষতে চাপ দিল অ্যাগনেস, অস্ফুট স্বরে গুঙিয়ে উঠল বেন। ভুরু কুঁচকে উঠেছে। মুহূর্তের জন্যে মেয়েটির মায়াবী চোখে নিষ্ঠুরতা দেখতে পেল, যেন সুদৃশ্য ফুলের বাগানে ওত পেতে আছে হিংস্র কোন শিকারী পশু। এ ধরনের নীচতা সবসময়ই ছিল মেয়েটির মধ্যে, মনে পড়ল বেনের, হয়তো নিষ্ঠুর বাবার পক্ষ থেকে পেয়েছে।

কাজ শেষে ওর দিকে ফিরে তাকাল অ্যাগনেস, হাত দুটো দেহের পেছনে। কমোডের কিনারা চেপে ধরেছে। মেয়েটির চোখের দৃষ্টি দেখে সবই ভুলে গেল বেন–অ্যাগনেসের প্রতি ক্ষণিকের জন্যে জেগে ওঠা অসন্তোষ কিংবা এ-ও মনে থাকল না যে অ্যাগনেস এখন আর ধনীর দুলালী নয়, বরং ওর ভাইয়ের বউ। ছয় বছরের তীব্র আকাঙ্ক্ষা জেগে উঠল বুকে। কিন্তু নিজেকে সামলে নিল ও, চোখ ফিরিয়ে নিল।

বেন? ডাকল অ্যাগনেস।

বেন জানে কি চাইছে মেয়েটা। কিন্তু ওর ইচ্ছে অন্যরকম, অবচেতন মন বলছে শিগগিরই এ কামরা ছেড়ে চলে যাওয়া উচিত এবং অ্যাগনেস ব্রেনেলের কাছ থেকে যতটা সম্ভব দূরে থাকা উচিত।

বেন!

ঘুরে দরজার দিকে এগোল বেন, কিন্তু টম নোলানের মেয়েকে চেনে দাবি করলেও আসলে ঠিক ততটা চেনা হয়নি ওর। পেছন থেকে ওর বাম বাহু চেপে ধরল মেয়েটি, জোর করে ফেরাল নিজের দিকে। দ্রুত ওর গলায় উঠে এল মৃণাল দুই বাহু, ঘাড় ধরে টেনে নিচু করল ওর মুখ। ফোলা ক্ষত-বিক্ষত ঠোঁটে পুরুষ্ট পেলব এক জোড়া ঠোঁটের অস্তিত্ব অনুভব করল বেন। কোমল স্পর্শ, তবু ব্যথা পেয়ে আড়ষ্ট হয়ে গেল ওর শরীর; কিন্তু মেনে নিল শেষে। অজান্তে সাড়া দিল ও।

মিনিট খানেক, তারপর ওকে ছেড়ে দিয়ে পিছিয়ে গেল অ্যাগনেস ব্রেনেল। রক্ত ঝরছে তোমার ঠোঁট থেকে, প্রায় নিরুত্তাপ স্বরে বলল মেয়েটি। ওর ঠোঁটেও রক্ত লেগে আছে। পাতলা এক খণ্ড কাপড় দিয়ে ঠোঁট মুছল, তারপর বেনের ঠোঁটও মুছে দিল। মুহূর্তের জন্যেও বেনের চোখ থেকে দৃষ্টি সরায়নি।

রিও ফ্রিয়োয় ফিরে আসা ঠিক হয়নি, তিক্ত মনে ভাবল বেন স্লেজেল।

<

Super User