বেনন বসেছে মিস হ্যাটারের খানিকটা পেছনে। বাইরে দাঁড়ানো ডাকাতকে দেখতে পাচ্ছে না ও, তারমানে ওই লোকটাও ওকে দেখতে পাচ্ছে না। সুযোগটা নিল বেনন। একলাফে পৌঁছে গেল কোচের শেষ প্রান্তের দরজার কাছে। হ্যাচকা টানে দরজাটা খুলেই লাফিয়ে পড়ল নিচে। গড়ান দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে বলল, ব্যাগলে, ভেতরে চোখ রাখো!

কথা শেষ হওয়ার আগেই কোচের কোনা ঘুরল ও, পথ আটকে রাখা অশ্বারোহী দুই ডাকাতকে ভড়কে দেয়ার জন্যে গুলি পাঠাল।

ঘোড়াগুলোর নাকের সামনে ধুলো ছিটিয়ে মাটিতে গাঁথল বুলেট। চমকে উঠে উন্মত্ত লাফঝাপ শুরু করল জন্তুগুলো, বেসামাল করে তুলল আরোহীদের।

লোকগুলোকে এক পলক দেখে নিয়ে কোচের আরেক পাশে উঁকি দিল বেনন। আচমকা আক্রমণে হুমকি-ধামকি বন্ধ করে হতচকিত হয়ে পিছু হটছে তৃতীয় আউট-ল। সঙ্গীদের সহায়তা পাবে না বুঝতেই ঘুরে দাঁড়িয়ে ঝেড়ে দৌড় দিল লোকটা। দু’কানের দু’পাশে দুটো গুলি পাঠিয়ে তার দৌড়ের গতি আরও বাড়িয়ে তুলল বেনন।

গালাগালের তুফান ছোটাচ্ছে লোকগুলো। বোধহয় এরকম ঝামেলার মুখোমুখি হতে হবে ভাবেনি। বিহ্বল অবস্থা দেখে বোঝা যাচ্ছে একাজে একেবারেই আনকোরা আমদানী হয়েছে।

এতক্ষণে সংবিৎ ফিরে পেল বুড়ো ড্রাইভার, আউট-লদের মনোযোগ অন্যদিকে দেখে শটগান তুলে নিয়ে আকাশের গায়ে গুলি করল সে।

শটগানের গুরুগম্ভীর আওয়াজে বিশৃঙ্খলতা আরও বাড়ল, আঁতকে উঠে পিছু হটল ঘোড়াগুলো। এবার ওগুলোকে ফেরাবার চেষ্টা না করে তাড়া দিল দুবৃত্তরা, পালাতে পারলে বাঁচে এখন। যত দ্রুত সম্ভব চলে যেতে চাইছে এখান থেকে।

তৃতীয় আউট-ল ঘোড়ায় চড়ে চেঁচিয়ে উঠল, দাঁড়াও! দাঁড়াও!! আমাকে ফেলে যেয়ো না!

তীর বেগে ছুটতে শুরু করল ঘোড়াগুলো, তাদের উৎসাহ দেয়ার জন্যে স্টেজের ভেতর থেকে ঘোড়ার খুর লক্ষ্য করে অস্ত্র খালি করল ব্যাগলে। দ্রুত আবার ভরে নিল টাটকা বুলেট। কোন কার্পণ্য নেই ব্যাগলের মধ্যে; তস্করের দল আওতার বাইরে চলে যাওয়ার পর ইচ্ছে না থাকলেও থামল সে, জানালা দিয়ে মুখ বের করে খুশি খুশি গলায় বলল, ওদের আমরা ভয় পাইয়ে দিয়েছি, বেনন!

জবাবে মাথা দুলিয়ে স্টেজ ড্রাইভারের দিকে তাকাল বেনন। দীর্ঘদিন ঘোড়া চালিয়ে ঘোড়ার মতই চেহারা বাগিয়েছে মুষকো লোকটা। এখন সে বন্দুক নামিয়ে রেখে ব্যস্ত ভঙ্গিতে ঘোড়া সামলাচ্ছে।

বার কয়েক চাবুকের আওয়াজ তুলে দক্ষ হাতে ভীত জন্তুগুলোকে বশ করে ফেলল লোকটা। তারপর বড় বড় হলদে দাঁত বের করে বেননের দিকে চেয়ে হাসল। আগের জামানায় ডাকাতগুলোর বুকে সাহস ছিল–পালাত না; লড়াই করে জিততে চাইত ওরা আগে হলে।

মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি দিয়ে কোচে উঠল চিন্তিত বেনন। গোটা ব্যাপারটাই ওর কাছে মস্ত এক ধাঁধার মত লাগছে। সাধারণ

প্রবঞ্চক

একটা স্পারের জন্যে লোকে কেন এত ঝুঁকি নেবে ভেবে পেল না ও। ভাববে সেই অবকাশও মিলল না, ওকে দেখেই মিস হ্যাটার বলে উঠলেন, দারুণ দেখালেন, মিস্টার স্টার্ন; আর কখনও কারও জিনিস কেড়ে নেয়ার কথা ভুলেও ভাববে না ওরা। ক্লাসে আমি বলব কিভাবে আপনার সাহসী, সময়োপযোগী পদক্ষেপের জন্যে ভয়ঙ্কর একদল দস্যুর হাত থেকে রক্ষা পেয়েছি আমরা।

এর চেয়েও কত ভয়ঙ্কর বিপদ যে আমরা মোকাবিলা করেছি…’ কথা শেষ না করে তাচ্ছিল্য ভরে হাসল ব্যাগলে।

ম্লান হয়ে গেল ওর হাসি। ওকে উপেক্ষা করে বেননের উদ্দেশে বললেন মিস হ্যাটার, জানেন, সারাটা বিকেল আমার মাথা ব্যথা করছিল, এই উত্তেজনার পর দেখছি ব্যথাটা আর নেই।জ কুঁচকে পলায়নরত দুবৃত্তদের ওড়ানো ধুলো দেখলেন তিনি। তারপর আবার তাকালেন বেননের দিকে। আচ্ছা, লোকজন নিয়ে ওরা আবার ফিরে আসবে না তো?

আসবে বলে আমার মনে হয় না, ম্যাম।

একটু নিশ্চিন্ত হলেন টীচার। কপালে জমে ওঠা ঘাম মুছে নিয়ে বললেন, না এলেই ভাল।

ডক্টর ওয়াং বলল, শিক্ষা হয়ে গেছে ওদের। বেননের দিকে চেয়ে হাসল লোকটা। আমি কৃতজ্ঞ, মিস্টার স্টার্ন। আপনি না থাকলে সামান্য যা কিছু আছে খোয়াতে হত আমাকে।

ও কিছু না। সীটে বসে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল বেনন। অস্ত্রটা ফেলে রেখেছে কোলের ওপর।

ঝাঁকি খেয়ে সামনে বাড়ল স্টেজ। মিস হ্যাটারকে মুখে সান্তনা দিলেও সতর্কতায় ঢিল দেয়নি বেনন, সন্ধে নামার পর জানালার পর্দা ফেলল ও, খাপে ভরে রাখল অস্ত্র। বাইরের মত কোচের ভেতরটাও ঘুটঘুঁটে আঁধার, কেউ কারও চেহারা দেখতে পাচ্ছে না, ফলে আলাপ আর জমল না। কিছুক্ষণ পর নাক ডাকাতে লাগল ব্যাগলে। মিহি সুরে তার সঙ্গে সঙ্গত জুড়লেন স্কুল মিসট্রেস। চুপ করে বসে থাকল বেনন। চেষ্টা করে দেখল, কিন্তু কালো কোট পরা ওয়াংকে কালি গোলা অন্ধকার থেকে আলাদা করতে পারল না।

মাঝরাতের খানিক আগে টেইলহল্টে পৌঁছল স্টেজ। ডিপোতে ঢুকে শেষ একটা ঝাঁকি দিয়ে এযাত্রায় ওদের মুক্তি দিল ওটা।

জেগে উঠে বাইরেটা দেখলেন মিস হ্যাটার। হাই তুলে ঘুম জড়ানো স্বরে বললেন, এটাই তাহলে টেইলহল্ট? শেষ পর্যন্ত পৌঁছলাম তাহলে!

ব্যাগলেও জানালা দিয়ে উঁকি দিল।

আহামরি কোন শহর নয় টেইলহল্ট। তবে সাধারণ কাউটাউনও নয়। রেল কোম্পানি এসে অফিস খোলায় শহরের কর্মব্যস্ততা বেড়ে গেছে অনেক গুণ। বোর্ডওয়াকে এত রাতেও লোক সমাগম কম নয়। বেশিরভাগই এসেছে শহরের বাইরে থেকে। দু’তিনটে করে ঘোড়া দাঁড়িয়ে আছে প্রত্যেকটা হিচর‍্যাকে। চাকার ঘড়ঘড় আওয়াজ তুলে ধুলোময় একমাত্র সরু রাস্তাটা ধরে যাওয়া-আসা করছে বাকবোর্ড আর বিরাট বিরাট ফ্রেইট ওয়্যাগন।

রাস্তার দু’ধারে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে ফলস্ ফ্রন্ট দেয়া দু’সারি কাঠের বাড়ি; কোনটা একতলা, কোনটা বা দোতলা; তিনতলাও যে নেই তা নয়; আছে দু’একটা, তবে একই স্থপতির অবহেলার কারণেই বোধহয় সবগুলো বাড়ির চেহারা একইরকম। কিন্তু তাই বলে পশ্চিমের অন্যান্য শহরের মত টেইলহল্টে জায়গা খালি পড়ে নেই, নতুন করে আবিষ্কৃত খনি আর রেলওয়ের কারণে গড়ে উঠেছে অসংখ্য ছোট ব্যবসা। একটা দোকান হলেই যেখানে চলে সেখানে একই জিনিস বেচার জন্যে প্রতিযোগিতা করছে অনেক দোকানি।

রেলওয়ের মজুরদের হৈ-হল্লায় গমগম করছে শহরটা। রাস্তায় চিনেদের সংখ্যাই বেশি, কাজ শেষে শহরে জুয়া খেলতে, আমোদ-ফুর্তি করতে এসেছে। পকেট খালি করে ফিরে যাবে সন্তুষ্ট মনে।

এখানে থাকলে লোকে পাগল হয়ে যাবে, অসন্তুষ্ট হয়ে বিড়বিড় করল ব্যাগলে। মিস হ্যাটারকে বোর্ডওয়াকে উঠতে সাহায্য করার জন্যে মহিলার ব্যাগ হাতে পাশে দাঁড়িয়ে আছে সে। নিজের ব্যাগটা ঝুলিয়ে নিয়েছে কাঁধে।

বেনন নামার পর কোচ থেকে নামল ডক্টর ওয়াং, সবাইকে চওড়া একটা হাসি উপহার দিয়ে মুহূর্তের মধ্যে চাইনিজদের ভিড়ে হারিয়ে গেল। লোকটাকে আর একবারের জন্যেও দেখতে পেল না বেনন।

চারপাশে চোখ বুলিয়ে অসহায় মুখখভঙ্গি করলেন মিস হ্যাটার। বেননের দিকে তাকিয়ে বললেন, নাহ, কেউ তো দেখছি নিতে আসেনি আমাকে!

চোখের ইশারায় দেখাল বেনন। রাস্তার ওপারেই হোটেল, চলুন ওখানে পৌঁছে দিই আপনাকে।

রাস্তা পার হতে গিয়ে রীতিমত মেধা খরচ করতে হলো ওদের। যখন তখন তেড়ে এসে গায়ের ওপর পড়তে চাইছে ওয়্যাগনগুলো। ক্ষিপ্ত ড্রাইভারদের গালাগালের মাত্রা ব্যাগলেকেও অবাক করল। একবার থেমে দাঁড়িয়ে নতুন কয়েকটা গালি আত্মস্থ করে নিল ও।

হোটেলে ঢুকে আর দেরি করলেন না মিস হ্যাটার, কোনমতে রেজিস্ট্রারে নামটা সই করেই ওদের শুভরাত্রি জানিয়ে চলে গেলেন নিজের ঘরে।

নাম লিখে ডেস্ক ক্লার্কের দিকে তাকাল বেনন। ব্যাগটা ঘরে রেখে দিয়ো। বাইরে যাচ্ছি আমরা, একটু দেরি হবে আসতে।…আচ্ছা, বলতে পারো মার্লোন ব্র্যান্ডনকে কোথায় পাওয়া যাবে?

শহরে যদি থাকে তো রেলওয়ের অফিসে থাকবে। সবচেয়ে বড় দোতলা বাড়িটাই রেলের অফিস। আর সেখানে যদি না পাও তাহলে তাকে পাবে এন্ড অভ স্টীলে। ওখানেই এখন লাইন পাতছে ওরা।

আবার রাস্তায় বেরিয়ে এলো ওরা। জুতোটার ফুটো বড় হয়ে যাওয়ায় খোড়াচ্ছে ব্যাগলে, বুড়ো আঙুল মাটিতে ঘষা খাচ্ছে, সর্বক্ষণ ভাগ্যকে অভিশাপ দিচ্ছে ও বিড়বিড় করে।

রেলওয়ের অফিসটার কাছাকাছি এসে অবাক হয়ে থেমে দাঁড়াতে হলো ওদের। দড়াম করে খুলে গেছে পাশের সেলুনটার দরজা। হুড়মুড় করে বেরিয়ে এলো এক দল লোক নিজেদের মধ্যে কথা বলছে না কেউ। সামনের জনের হাতে ফাঁসির দড়ি। রেঞ্জের মোটা কাপড়ের পোশাক সবার পরনে। প্রত্যেকের পা হাঁটুর কাছ থেকে একটু বাঁকা, দীর্ঘদিন ঘোড়ায় চড়ে গরু সামলানোর ফল। কালো কোট পরা একজন লোককে টেনে হিচড়ে আনছে তারা। অসহায় লোকটার পা দুটো বালিতে গভীর দাগ কাটছে; হাল ছেড়ে দিয়েছে বোধহয়, নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে না। কোন দিকে ভ্রুক্ষেপ নেই কারও, মানুষটাকে ছেড়ে নিয়ে রাস্তার শেষ প্রান্তে একটা বড় কটনউড গাছের দিকে চলেছে সবাই।

লিঞ্চিং মব! ফিসফিস করে বলল উত্তেজিত ব্যাগলে, ওরা লোকটাকে ঝুলিয়ে দিচ্ছে!

এসো! হাত আঁকড়ে ধরে টানল বেনন। ঠেকাতে হবে ওদের। এভাবে কাউকে মরতে দেয়া যায় না।

অনেক খানি এগিয়ে গেছে লোকগুলো। দৌড়াতে শুরু করল বেনন। খোঁড়াতে খোড়াতে তাকে অনুসরণ করল ব্যাগলে। রাস্তা পেরতে গিয়ে থামতে হলো ওদের। সামনে দিয়ে বিদ্যুদ্বেগে ছুটে গেল পরপর কয়েকটা ফ্রেইট ওয়্যাগন। ওগুলো চলে যাবার পর র‍্যাঞ্চারদের আবার দেখতে পেল ওরা। শহরের শেষ মাথায় শাখা প্রশাখা বিস্তার করে রাতের পটভূমিকায় দাঁড়িয়ে থাকা বিশাল সেই কালো কটনউডের কাছে পৌঁছে গেছে খেপা লোকগুলো; জটলা করে এখন ফাঁসির আয়োজন করছে।

বেনন আর ব্যাগলে পৌঁছাবার আগেই নিচের একটা ডালে দড়ি ঝুলিয়ে দেয়া হলো। ওরা দেখল লটকে দেয়া হয়েছে মানুষটাকে। আঁধারে দড়িটা দেখতে পাচ্ছে না বলে গুলি করে ছিঁড়ে দিতে পারল না বেনন।

দেরি হয়ে গেল, বেনন! আফসোস করে বলল ব্যাগলে। প্রাণপণে দৌড়াচ্ছে ওরা। লোকগুলো এখনও ফুট বিশেক দূরে; ঝুলন্ত দেহটা দেখছে সবাই। উদ্যত অস্ত্র হাতে তাদের পেছনে গিয়ে দাঁড়াল ওরা।

নামাও ওকে! খেপাটে চেহারায় গর্জন ছাড়ল ব্যাগলে। পরিশ্রমে হাঁপাচ্ছে সে, বারকয়েক দ্রুত শ্বাস নিয়ে আবার বলল, যা বলছি করো তাড়াতাড়ি! বলে দিচ্ছি গুলি করব কিন্তু আমি…

মাঝপথেই থেমে গেল ওর হুমকি, থতমত খেয়ে চুপ করে গেল ব্যাগলে। এই প্রথম তাকিয়েছে ও ঝুলন্ত দেহটার দিকে। এতক্ষণে বুঝতে পারল অস্ত্র বের করেও বেনন নিচুপ হয়ে থোকার মত দাঁড়িয়ে আছে কেন।

খড় দিয়ে বানানো একটা পুতুলকে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছে র‍্যাঞ্চাররা। ঝোলানোর আগে পুতুলটাকে পরিয়ে নিয়েছে কালো কোট-প্যান্ট।

কে এই লোকটা? সবাই ওকে দেখছে বুঝতে পেরে ঢোক গিলে জানতে চাইল ব্যাগলে।

ফিলিপ হারমান, জবাব দিল রাগী চেহারার বয়স্ক একজন মোটাসোটা লোক।

কি করেছিল সে?

ওই লোকটা, আঙুল তুলে পুতুলটাকে দেখাল র‍্যাঞ্চার, ওইটা হচ্ছে ফিলিপ হারমানের প্রতিকৃতি-টেইলহল্টের ব্যাঙ্কার ছিল লোকটা, আমরা ওকে বিশ্বাস করে টাকা জমা রেখেছিলাম; বিশ্বাসের মর্যাদা না রেখে পালিয়ে গেছে সে সমস্ত টাকা নিয়ে। ধরা পড়লে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দিতাম, কিন্তু ধরা পড়েনি; তাই গত তেরো বছর ধরে ওকে সেরাতের স্মরণে লটকে দিয়ে সান্ত্বনা পাচ্ছি। একটু থামল সে, তারপর জানতে চাইল কুঁচকে, তোমার কোন অসুবিধা করেছি নাকি আমরা?

ভিড়ের মধ্যে আরও কয়েকজনের দৃষ্টিতে রাগের ছাপ দেখতে পেল বেনন। উড়ে এসে জুড়ে বসা উটকো এই আগন্তুকদের মোটেই পছন্দ হয়নি, মারমুখী একটা ভঙ্গি তাদের আচরণে। মানে মানে সরে পড়ার জন্যে মিষ্টি একটা হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে ব্যাগলেকে চোখ টিপল বেনন। হাতে টান দিয়ে বলল, চলো, ব্যাগলে, বুড়ো খোকা, বোকা বনেছি আমরা।

কৌতূহল মেটেনি, তবু বিপদ বুঝতে পেরে সরে এলো ব্যাগলে। লোকগুলোকে হয়তো অস্ত্রের মুখে ঠেকিয়ে দেয়া যেত, কিন্তু ফাস হয়ে যেত ওদের উপস্থিতি, সেক্ষেত্রে রেলওয়ের হয়ে গোপনে কাজ করার আশা ছাড়তে হত।

একবারও পেছনে না তাকিয়ে হনহন করে হাঁটতে লাগল ওরা। রেল দালানের কাছে এসে দেখল অফিস বন্ধ। জানালা থেকে আলো অদৃশ্য হয়ে গেছে। অগত্যা, বাধ্য হয়ে হোটেলে ফিরল ওরা। একটা কথাও বলছে না, গম্ভীর চেহারায় কি যেন ভাবছে বেনন। বোকা বনে ব্যাগলে এত মুষড়ে পড়েছে যে সেলুনে ঢুকে দু’ঢোক গেলার কথাও ভুলে গেল।

ওদের ঘরটা পশ্চিমের আর সব কমদামী হোটেলের মতই সাদামাঠা। ঘরের দুপাশে দেয়াল ঘেঁষে দুটো নড়বড়ে খাট পড়ে যাবার অপেক্ষায় দিন গুনছে। চেয়ার দুটোর বয়স আরও বেশি, ওগুলো খাটের দাদার বয়সী। দরজার পাশে একটা ব্যুরো, সেটার ওপর রাখা আছে একটা পিচার আর হাজারো ট্যাপ খাওয়া একটা ছাতাপড়া গামলা। ঘরে একটা টেবিল রাখার জায়গা ছিল, কিন্তু হোটেল মালিকের বদান্যতায় সেটা নেই।

বাতি জ্বেলে খাটের দিকে পা বাড়িয়েও থেমে যেতে হলো বেননকে। জুতোর ফিতে খোলার জন্যে ঝুঁকেও থমকে গেল ব্যাগলে। রীতিমত বিস্ফোরিত হয়েছে দরজাটা ওদের পেছনে। চমকে ঘুরে তাকাল ওরা। ভাবতেও পারেনি এদৃশ্য দেখতে হবে।

বিরাট লম্বা এক চাবুক উঁচিয়ে দরজা জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে রণরঙ্গিণী এক যুবতী। খুবই বেমানান লাগছে চাবুকটা ওই পেলব হাতে, কিন্তু প্রথম দর্শনে ওটা কেউ খেয়াল করবে না। অপরূপা বলতে যা বোঝায় মেয়েটা আসলেই তাই। পায়ের নখ থেকে মাথার চুল পর্যন্ত সবকিছু ধীরেসুস্থে অতি যত্নে অবসর সময়ে তৈরি করেছেন ঈশ্বর; তৈরি করার পর নির্ঘাত শিল্পটিকে দেখেছেন বিভোর হয়ে। হাঁ করে তাকিয়ে থাকল ওরাও।

প্রেমে পড়েনি বেনন কখনও, এতদিন একা কাটিয়েছে, হাজারো বিপদের মোকাবিলা করেছে, তোয়াক্কা করেনি বন্ধুদের টিটকারির, ভেবে এসেছে প্রেম ব্যাপারটা সবার সামনে মুখ থুবড়ে পড়ার মতই লজ্জাজনক; প্রেমে মানুষ পড়ে, কিন্তু ওঠেনি কেউ আজ পর্যন্ত; অন্তত উঠেছে বলে বেননের জানা নেই। কিন্ত বেনন আজ, এই মুহূর্তে, নির্দ্বিধায় বলে দিতে পারে; হ্যাঁ, এই মেয়ের জন্যে এক মুহূর্তের একটি সিদ্ধান্তে, হাসিমুখে জীবন দিয়ে দেয়া যায়।

একমাথা অবিন্যস্ত কালো চুল, ধনুকের মত ভ্রূ; অচিন্তনীয় আঁখি পল্লব, সাগরের মত গভীর মায়াবী কালো দু’চোখে অতল জলের রহস্যময়তা; নিখুঁত পান পাতার মত মুখে কঠোরতা লজ্জা পেয়ে কোথায় কোন্ অজানায় লুকিয়ে গেছে স্বয়ং ঈশ্বরও বুঝি তা বলতে পারবেন না। কমলার কোয়ার মত দু’ঠোঁটে হাসি ফুটলে বিশ্বসেরা হীরের মত দ্যুতি ছড়াত, কিন্তু দেবীর দয়া হয়নি, যে কারণেই হোক, এমুহূর্তে ভীষণ রেগে আছে সে। ছোটবেলায় একটা মেয়েকে পছন্দ করত, মন দিয়ে চাইত বেনন; সাধনা করত; আজ ওর হঠাৎ করেই কেন কে জানে মনে হলো সেই মেয়েটা বড় হয়ে ঠিক এমনি করেই শাসন করত ওকে, কিছুতেই নষ্ট হয়ে যেতে দিত না, সমাজের মুখে থুতু দিয়ে দখল করে নিত ভালবাসার মানুষটিকে। কোনদিন সাহস করে বলার সুযোগ পায়নি বেনন সেই মেয়েটিকে নিজের ভাল লাগার কথা; অপরাধীর ছেলে হিসেবে সমাজে ও নিজেও ছিল বিনা দোষে অপরাধী, জানত প্রেম নিবেদন করলে অবহেলা ছাড়া আর কিছুই জুটবে না। করুণা চায়নি বেনন, সান্তনা চায়নি; নীরবে দেখেছে প্রতিষ্ঠিত মানুষের ছেলেরা কিভাবে মেয়েটিকে অর্থ-বিত্ত প্রভাব-প্রতিপত্তি দেখিয়ে প্রভাবিত করে। রাতের পর রাত কেঁদেছে বেনন, তারপর সিদ্ধান্ত নিয়েছে টাকাই যদি সব হয় তাহলে অনেক টাকা রোজগার করবে ও, তারপর ফিরে গিয়ে দাঁড়াবে মেয়েটির মুখোমুখি, তখনও যদি অবিবাহিত থাকে তো বলবে ওকে সে ভালবাসে, শত ভুলের পরেও নিজেকে শুধরে নিয়েছে ও শুধু ওরই জন্যে; আর যদি ফিরে গিয়ে দেখে মেয়েটি ঘর-সংসার করছে, একটি কথাও বলবে না ও, দূরে সরে যাবে নীরবে, ভাববে এই পৃথিবীটা বড় নিষ্ঠুর।

বেশ। বাতাসে ফুটল চাবুক। জিনিসটা কোথায়?

কি জিনিস? চমক কাটিয়ে উঠে সমস্বরে জানতে চাইল বেনন আর ব্যাগলে।

আবার কথা! কণ্ঠ অতি সুরেলা হলেও কড়া এক ধমক দিল অপ্সরী। স্পারটা কোথায়?

কিসের স্পার?

গোঁফে তা দিতে গিয়ে তাড়াতাড়ি হাত ফিরিয়ে নিল ব্যাগলে। ওর নাকের পাশ ঘেঁষে বাতাসে শিস কেটে ঘুরে গেল চাবুকটা।

আমি ডেইজি হ্যাটার, বলল যুবতী, শহরে এসে জানতে পারলাম আমার খালার কাছ থেকে স্পারটা তোমরা চুরি করেছ। স্টেজ কোচে ছিলে তোমরা তাঁর সঙ্গে; তোমরাই ব্যাগ খুলে ওটা সরিয়েছ। আমি জানি তোমাদের মধ্যে একজন আউট-ল ছিলে।

ডক্টর ওয়াং, তিক্ত চেহারায় বলল বেনন।

আমার ধারণা কাজটা তোমাদের। একজন ডক্টর কখনোই বয়স্কা কোন অসহায় ভদ্রমহিলার সঙ্গে এধরনের নোংরা রসিকতা করবে না। আঘাত হানার জন্যে চাবুকটা গুটিয়ে নিল মেয়েটা। স্পারটা এতই দরকার ছিল যে মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়েও ডাকাতদের ঠেকিয়েছ তোমরা। কড়া চোখে বেননকে দেখল যুবতী। লজ্জা করে না মেয়েমানুষের জিনিস কেড়ে নাও? বেনন, কথা বলার জন্যে হাঁ করতেই হাত তুলে থামিয়ে দিল। শেষ একটা সুযোগ দিচ্ছি, স্পারটা ফেরত দাও, নইলে চাবকে পিঠের ছাল তুলে নেব।

আরে, আরে করে কি! আঁতকে উঠল ব্যাগলে মেয়েটাকে চাবুক তুলতে দেখে।

<

Super User