তবুও বেঁচে থাকার চেষ্টা চলে নিরন্তর।

সময় কাটতে চায় না কিছুতে।

মরুভূমির দীর্ঘ দুপুরে শুয়ে শুয়ে শত্রুর অপেক্ষা করে ওরা। টিলার কোল ঘেঁষে এক চিলতে ছায়া। সেখানে পালাক্রমে বিশ্রাম নেয় হেনরি আর পাওয়েল। মাঝে মাঝে দূর থেকে ছুটে আসা ঘাতক বুলেট মাথার উপর দিয়ে শিস কেটে চলে যায়।

অপেক্ষায় আছে ইন্ডিয়ানরাও। এ মুহূর্তে খুব কাছে আসছে না তারা পাল্টা বুলেটের ভয়ে। শুধু মাঝে মাঝে জানিয়ে দিচ্ছে নিজেদের উপস্থিতি।

একটা মাঝারি আকৃতির পাথরের পিছনে শুয়ে পজিশন নিয়েছে ইয়াসীন। চিবুকে জমে আছে ঘাম শুকানো মিহি লবণ। ছাউনির কথা ভাবছে সে। মাত্র চারজন সৈন্য ও একজন অফিসার রয়ে গেছে ক্যাম্প কেডি ছাউনিতে। সেখানেও ইন্ডিয়ানরা আক্রমণ চালাতে পারে। তবু নিরাপদ তারা। কারণ পর্যাপ্ত পানি আছে ক্যাম্প কেডিতে।

পর্যাপ্ত পানি পেলে এই টহলদার সেনাদলটাও হয়তো টিকে যেত এ যাত্রা। ওদের শক্তি সম্পর্কে ভুল ধারণা আছে ইন্ডিয়ানদের। ক্যাম্প কেডি হতে যে কোনও মুহূর্তে একটা সাহায্যকারী দল এদিকে আসতে পারে বলে ধারণা করে তারা। অথচ যদি জানত আর মাত্র পাঁচজন সৈন্য আছে সেখানে!

মনে মনে একটা হিসাব মেলাতে চাইছে ইয়াসীন। শেষবারের মত মরিয়া হয়ে চেষ্টা চালানো যেতে পারে ওই পাহাড়ে পৌঁছা’বার। কিন্তু তার জন্য প্রয়োজনীয় দৈহিক শক্তি অবশিষ্ট আছে কিনা সন্দেহ।

দীর্ঘস্থায়ী তৃষ্ণায় নির্জীব হয়ে পড়েছে সবাই। কথা বলা দূরে থাক, সামান্য শব্দও করছে না কেউ। টকটকে লাল হয়ে উঠেছে মুখ। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। চোখ বুজে আসতে চাইছে অবসাদে। যেন ঘুম হয় না কতকাল!

মাঝে মাঝে মেসেজ করার ভঙ্গিতে হাত পা ডলছে পাওয়েল। বুনো জন্তুর মত মাথা ঝাঁকি দিচ্ছে।

লক্ষণগুলো জানে ইয়াসীন। ভীষণ তৃষ্ণায় ফাঁকা হয়ে যাবে বুক। শ্বাস নিতে কষ্ট হবে। ঝিমঝিম করতে থাকবে হাত পা ও মাথা। এরপর জিভ ফুলে উঠবে। কান হারিয়ে ফেলবে শোনার ক্ষমতা। শুরু হবে প্রলাপ।

বোতলের অবশিষ্ট সামান্য পানিটুকু মুখে ঢালল পাওয়েল। শেষ হয়ে গেছে জেনেও বোতলটা মুখের উপর উপুড় করে ধরে রাখল কিছুক্ষণ। ফেলে দিচ্ছিল।

‘না’-তাকে নিষেধ করল ইয়াসীন। ‘আগামীকাল হয়তো পানি পাব আমরা। তখন ওটা দরকার হবে।’

ঢুলু ঢুলু চোখে তার দিকে তাকাল পাওয়েল। হয়তো বুঝতে পারেনি কথা। মাথা ঝাঁকাল আর একবার। তবে ফেলল না বোতলটা।

আর কতক্ষণ টিকবে তারা?

হিসাব কষে চলল ইয়াসীন। বারবার এলোমেলো হয়ে গেল চিন্তা। আর একটা বুলেটের শব্দে সচকিত হয়ে আবার প্রথম থেকে আরম্ভ করল হিসাব।

অবশেষে সন্ধ্যা নেমে এল। একটা দুটো করে তারা উঁকি দিচ্ছে আকাশে। অনেকক্ষণ হলো থেমে গেছে গুলির আওয়াজ!

টলতে টলতে উঠে দাঁড়াল ইয়াসীন। উঠতে নির্দেশ দিল অন্যদের। মোকাটো উঠল সবার আগে। কোনওমতে উঠল হেনরি। পাওয়েল নিজে উঠতে পারল না। তাকে ধরে দাঁড় করিয়ে দিল মোকাটো। হাঁটতে শুরু করল ওরা। এক পা এগিয়েই পড়ে যাচ্ছিল পাওয়েল। হোঁচট খাওয়ার ভঙ্গিতে সামলে নিল। তারপর হাঁটতে থাকল ঠিকমতই।

আড়াল হতে এখনও গর্জে ওঠেনি কোনও রাইফেল। তবু একটু ছড়িয়ে ছিটিয়ে হাঁটতে লাগল চারজনের দলটা। এতে টার্গেট স্থির করা কঠিন হবে ইন্ডিয়ানদের পক্ষে। এমনিতেই অন্ধকার নেমে আসতে কোনও কিছু পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে না।

দূরের পাহাড়টার দিকে সোজা এগোতে থাকল ওরা। ওটাই শেষ ভরসা এ যাত্রা।

হাঁটতে হাঁটতে একবার পড়ে গেল পাওয়েল। উঠল সাহায্য ছাড়াই। হাঁটতে থাকল আবার।

ঘণ্টাখানেক হাঁটার পর থামল ইয়াসীন। জায়গাটা ফাঁকা। মিনিট দশেক বিশ্রাম নিয়ে আবার সচল হলো দল।

একনাগাড়ে অনেকক্ষণ হাঁটল এবারে। দেখা গেল কিছু কাঁটালতার ঝোঁপ। সামনের জমি এক বিশাল পিরিচের আকৃতি নিয়েছে। তার কিনার ধরে গজিয়েছে ঝোঁপগুলো। পিরিচের কেন্দ্রের দিকটা বেশ ঢালু। সম্ভবত কালেভদ্রে বৃষ্টি হলে দূরের পাহাড় বেয়ে নেমে আসে পানি। ক্ষণিকের জন্য জমা হয় পিরিচে।

ঝোঁপগুলোর মধ্য দিয়ে হাঁটতে থাকল সবাই। এতে বুলেট এড়ানো হয়তো যাবে না, তবে টার্গেট করা মুশকিল হবে শত্রুর।

হোঁচট খেলো মোকাটো। পড়ে যাচ্ছিল। জমিতে রাইফেলের বাঁট ঠেকিয়ে নিশ্চিত পতন বাঁচাল সে। থেমে দাঁড়াল ইয়াসীন। বসে পড়ল হেনরী। ‘পাহাড়টা এখনও মাইল তিনেকের পথ। ওটার ডানদিকে পানি রয়েছে কোথাও’। বলল মোকাটো।

‘আজ রাতে আর এগোব না আমরা,’ ঘোষণা দিল ইয়াসীন। বিক্ষিপ্ত ভাবে বসে পড়ল সবাই। শুয়ে পড়ল হেনরী। দেখাদেখি অন্যরাও শুলো। ঘুমিয়ে পড়ল অল্পক্ষণে।

ঘুমায়নি ইয়াসীন। কনুইয়ের উপর মাথা রেখে আধশোয়া ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে সে সামনের দিকে। পাহাড়টা অন্ধকারে আবছা। ওখানে হয়তো কোনও সরু ঝরণা আছে। তাই যদি থাকে, তবে ইন্ডিয়ানরাও জানে না। এটা ওদের দেশ। কিছুতেই পানির কাছে পৌঁছতে দেবে না ওরা। কারবালার কথা মনে পড়ল ইয়াসীনের। হাসল ও আনমনে। তারপর চিৎ হয়ে শুয়ে তাকিয়ে রইল সপ্তর্ষিমণ্ডলের দিকে।

একসময় ফর্সা হয়ে এল পুব আকাশ। তবু উঠতে ইচ্ছে হয় না। সারাটা রাত জেগে কাটিয়েছে সে। এখন ঘুম আসছে দু’চোখ ভরে। অবসাদে ভারি হয়ে আসছে মাথা। তবু ঘুমানো চলবে না। আবার আরম্ভ করতে হবে যাত্রা। পায়ে পায়ে এগিয়ে যেতে হবে পাহাড়টার কাছে।

জীবনমৃত্যুর এই ক্ষমাহীন সংঘাতে এতক্ষণে দেখা গেছে সামান্য আশার আলো। এখন থেকে প্রতিটি পদক্ষেপ তাদের নিয়ে যাবে বিজয়ের আরও কাছাকাছি। তবে হয়তো সে বিজয়ের জন্য দিতে হবে অত্যধিক চড়া মূল্য।

ঝটপট উঠে দাঁড়াল ইয়াসীন। দ্রুত জাগিয়ে তুলল সবাইকে। এটাই শেষ চেষ্টা।

‘মার্চ!’ কর্কশ কণ্ঠে আদেশ করল সে। পুব আকাশে ছড়িয়ে পড়েছে যেন লাল রক্ত।

টলতে টলতে পিরিচের ঢালে নেমে এল চারজনের দলটা। পিঠে বাড়তি একটা রাইফেলের বোঝা নিয়ে আগে আগে চলেছে ইয়াসীন। সবার পিছনে আসছে মোকাটো।

আর পারা যায় না। তবু দাঁতে দাঁত চেপে পা টেনে টেনে এগিয়ে যাচ্ছে সবাই একপা, দুপা, দশপা-একশো পা। একশো গজ-দুশো গজ। এগিয়ে চলেছে ওরা। হঠাৎ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলল হেনরী। এলোমেলো কয়েক পা এগিয়ে ধপ করে বসে পড়ল। সাথে সাথে শুয়ে পড়ল পাওয়েল।

এদিকওদিক মাথা ঝাঁকিয়ে নিজেই আবার উঠে দাঁড়াল হেনরী। কিন্তু পাওয়েল উঠছে না। তাকে টেনে তুলল মোকাটো। দাঁড় করিয়ে দিল দু’পায়ের উপর। আবার ভেঙেচুরে লুটিয়ে পড়তে যাচ্ছিল সে। ধরে রাখল মোকাটো। কষে একটা থাপ্পড় মারল তার গালে। তাকাল ইয়াসীনের দিকে।

‘এগোও’। অনেক কষ্টে তিনবারের প্রচেষ্টায় কথাটা বলতে পারল ও। ব্যাঙের মত কর্কশ শোনা গেল কণ্ঠস্বর।

কিছুদূর গিয়ে পড়ে গেল মোকাটো। নিজেই উঠল। এবারে হোঁচট খেয়ে পড়ল ইয়াসীন। সেও উঠল নিজে নিজে। এভাবে উঠে পড়ে অতিক্রান্ত হলো আরও কয়েকশো গজ।

‘ডাইনে ঘোরো’। শুকিয়ে আড়ষ্ট হয়ে গেছে জিভ। অনেক কষ্টে কথাগুলো বলল ইয়াসীন। টলতে টলতে বিশাল পিরিচটার বাইরে বেরিয়ে এল সবাই।

সামনের জায়গাটা ফাঁকা। চারদিকে ছড়িয়ে আছে পাথরের চাই। পাহাড়টা এখন আর বেশি দূরে নয়। ডাইনে ঘোরার ফলে হাতের বাঁ দিকে সরে যাচ্ছে ওটা। কিছুটা কোনাকুনি ভাবে পাহাড়টার দিকে এগিয়ে চলেছে সবাই।

আচ্ছা, ওখানে যদি পানি পাওয়া না যায়! ভুল হতে পারে মোকাটোর। দেশটা তার নিজের নয়। এর আগে মাত্র একবার এসেছে সে এখানে। এমন তো হতে পারে, সামনের পাহাড়টা ঈগল পাহাড়ই নয়?

গুলিয়ে গেল ইয়াসীনের মাথা। আশঙ্কাটা জোর করে মন থেকে তাড়াবার চেষ্টা করল সে। পানি থাকুক বা না থাকুক, পৌঁছতে হবে ওখানে? আগাগোড়া আগ্নেয়শিলায় গড়া-ধূসর লাল ওই উঁচু পাহাড়টার কাছে।

পিছনে রাইফেলের আওয়াজ। চলকে উঠল পায়ের কাছে বালি। সৎ করে একটা তীর চলে গেল মাথার উপর দিয়ে। সাথে সাথে বালিতে ডাইভ দিল সবাই।

‘ট্রিগার টিপবে না কেউ-’ সাপের মত হিসহিস করে উঠল ইয়াসীনের কণ্ঠ। এড়ানো যাবে না যুদ্ধটা-শেষবারের মত ভাবল সে।

সামান্য রস নেই মুখে। মার্বেলের মত পাথরটা গালের ভিতর নাড়াচাড়া করছে সে। কাজ হতে পারে এতে। আরও একটা তীর এসে পড়ল কাছেই।

‘হেনরী, পাওয়েল-লড়তে পারবে, তোমরা?’ প্রশ্ন করল ইয়াসীন। কথা বলল না পাওয়েল। ‘বাঁচতে হলে পারতে হবে’। কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর বলল হেনরী। চোখের কোনা দিয়ে তার দিকে তাকাল ইয়াসীন।

থমথমে নির্দয় একটা মুখ নুয়ে আছে রাইফেলের উপর। দুদিন আগে আহত হয়েছে হেনরী। প্রচুর রক্ত পড়েছে বাম কাঁধের ক্ষতটা থেকে। তার উপর মরুভূমির এই প্রচণ্ড পরিশ্রম আর পিপাসা। তবু হারতে রাজি নয় মরুভূমির সৈনিক!

দূরের ঝোঁপ থেকে বেরিয়ে এল একজন ইন্ডিয়ান। মাথায় পালকের মুকুট। হাতে তীরধনুক। তার পিছনে বেরিয়ে এল আরও দুজন।

রাইফেল তাক করার চেষ্টা করল ইয়াসীন। দুর্বলতায় হাত কাঁপছে। আশি বছরের বৃদ্ধের মত হাতের চামড়া কুঁচকে গেছে ডিহাইড্রেশন-এ। দূরের ইন্ডিয়ান হঠাৎ ঝাঁপসা হয়ে গেল দৃষ্টিতে। তবুও একাগ্রচিত্তে তাকিয়ে থাকল সে সামনের দিকে। এবং গুলি করল।

ঝাঁকি খেলো ইন্ডিয়ানটার শরীর। তারপর মাটিতে পড়ে স্থির হয়ে গেল। অন্য দুজন দ্রুত পিছু হটে হারিয়ে গেল ঝোঁপের আড়ালে।

আশাতীত কাজ হবে এ সাফল্যে। ভয় ঢুকবে ইন্ডিয়ানদের মনে। অতিরিক্ত ঝুঁকি নিয়ে আক্রমণে এগিয়ে আসবে না আর।

যুদ্ধে কখনও পিছপা হয় না মোযেভ ইন্ডিয়ানরা। তবে কিছুতেই হারতে চায় ওরা এই ভয়ংকর খেলায়।

লোকবল সীমিত ওদের। এদিকে ঝাঁকে ঝাঁকে আসছে লোভী সাদা চামড়াদের দল। ক্রমে দখল করে নিচ্ছে ওদের আকাশ বাতাস মাটি। রক্তের বিনিময়ে তা উদ্ধার করার প্রচেষ্টা অর্থহীন। তাতে শুধু উর্বর হবে ভূমি। সেখানে ফসল ফলাবার জন্য অবশিষ্ট থাকবে না কেউ।

‘মরে গেছে লোকটা,’ পাশ থেকে বলল মোকাটো।

সায় দিল ইয়াসীন। জীবনে অনেক ইন্ডিয়ান মারতে হয়েছে তাকে। উপায় ছিল না। যুদ্ধের একটাই নিয়ম। মারো অথবা মরো!

উত্তরোত্তর উত্তপ্ত হয়ে উঠছে বালি। মাথার উপরে চোখ রাঙাচ্ছে সূর্য। থমকে দাড়িয়েছে সময়।

শুয়ে আছে ওরা বালিতে। সামান্য নড়াচড়া নেই কারও। ইন্ডিয়ানদের দেখা যাচ্ছে না কোথাও।

ওঠা দরকার, ভাবল ইয়াসীন। সময় সম্পর্কে সঠিক ধারণা হারিয়ে ফেলেছে সে। হয়তো কেটে গেছে দুতিন ঘণ্টা। তবু উঠতে ইচ্ছে হয় না। এদিকে অসহ্য হয়ে উঠছে বুকের তলায় গরম বালি।

সমস্ত মনোবল একত্রিত করে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল সে। ‘ওঠো সবাই,’ ঘোষণা দিল। কিন্তু সামান্য নড়ল না কেউ। মোকাটোর কাছে গিয়ে কলার ধরে তাকে টেনে তুলল ও। মোকাটো তুলল হেনরীকে। পাওয়েলকে তুলতে হলো ধরাধরি করে। প্রথমে নিজে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিল না। মোকাটোর কাঁধে হেলান দিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। অবশেষে হাঁটুতে সামান্য বল ফিরে এল তার। কোনওমতে পাহাড়টার দিকে এগিয়ে চলল সবাই।

বেশ কিছুক্ষণ দেখা নেই ইন্ডিয়ানদের। কিন্তু আবার আসবে, ওরা জানে ইয়াসীন। সামনের দিকে সামান্য কুঁজো হয়ে হাঁটছে সে। পিঠের বাড়তি রাইফেলটা বোঝার মত মনে হচ্ছে। পায়ের তলায় শক্ত বালি। বিচিত্র রং তার। কোথাও সাদা, কোথাও গোলাপী, কোথাও বা ধূসর। পাহাড়টা এগিয়ে এসেছে বেশ কাছে। ওটার চূড়া অনেক উঁচু থেকে উঁকি দিয়ে দেখছে চারজনের বিধ্বস্ত, দলটাকে!

আবার দেখা দিল ওরা। ঘোড়ায় চড়ে আসছে পিছন দিকে থেকে। দুইজন। আরও আছে হয়তো। ঘুরে দাঁড়িয়ে রাইফেল তুলে তাদের শাসাল ইয়াসীন। থেমে দাঁড়াচ্ছিল বাকি সবাই। তাড়া লাগাল। আর একবার থামলে উঠতে পারবে না কেউ, বোঝা যাচ্ছে। তিনজনকে সামনে দিয়ে, পিছন থেকে তাড়িয়ে নিয়ে চলল ও।

পানির সন্ধান এখনও সম্ভাবনা মাত্র। কোত্থাও কোনও ট্রাকের চিহ্ন নেই। ট্রাক অর্থাৎ মানুষের যাতায়াত পথ। মরুভূমিতে মানুষ সর্বদা পানির হিসাবে চলে। যদি ভুল থাকে হিসাবে, তবে পানির পরিবর্তে মৃত্যুর শীতল স্পর্শই মিটিয়ে দেবে সমস্ত তৃষ্ণা। দিনটাকে খুব নিষ্ঠুর বলে মনে হলো ইয়াসীনের।

ক্রমে হাতের বাঁয়ে সরে যাচ্ছে সামনের পাহাড়টা। কোনাকুনি এগোচ্ছে ওরা। পিছনে ইন্ডিয়ানরা আসছে অনুসরণ করে। অথচ সামনে পানির সামান্যতম চিহ্ন নেই কোথাও।

বেশ কাছে চলে এল ইন্ডিয়ানদের দলটা। সংখ্যায় অবশ্য পনেরোজনের বেশি নয়। তবে ঘোড়ায় চড়ে আসছে ওরা। দু’জনের হাতে রাইফেল। অন্যদের হাতে রয়েছে তীর ধনুক অথবা থ্রোইং নাইফের মত লম্বা ছোরা।

আবার পড়ে গেল পাওয়েল। বুনো জন্তুর মত মুখ ঘষছে উত্তপ্ত বালিতে। তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে গেল মোকাটো আর হেনরী। হাঁটু গেড়ে বসে পিছনের ইন্ডিয়ানদের দিকে রাইফেল তুলল ইয়াসীন।

হিট ওয়েভে কেঁপে কেঁপে যাচ্ছে বাতাস। কেঁপে যাচ্ছে আগুয়ান ইন্ডিয়ানদের বাদামী দেহ। ঝাঁপসা দেখাচ্ছে দৃশ্যমান সবকিছু। অবাস্তব কোনও দুঃস্বপ্নের মত এক অস্পষ্ট প্রেক্ষাপট। অথচ নির্মম বাস্তব।

রাইফেল নামিয়ে নিল ইয়াসীন। এরকম অবস্থায় টার্গেট মিস হবার সম্ভাবনাই বেশি।

তোলা হয়েছে পাওয়েলকে। আবার চলতে আরম্ভ করল সবাই।

‘ওই যে ওখানে!’ কেঁপে গেল লোকটার গলা। ‘মেসকাইটের ঝোঁপ ওগুলো। অর্থাৎ পানি আছে আশেপাশে’।

বেশি দূরে নেই ইন্ডিয়ানরাও। পিছনে স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে ওদের ঘোড়ার ক্ষুরের আওয়াজ। ‘আমি ফায়ার করার পরই তোমরা শুরু করবে। তবে রিলোড করার জন্যে কিছু সময় দিও আমাকে। পাওয়েল, তুমি রাইফেল চালাতে পারবে?’

উত্তর নেই। তবু কাঁধ থেকে আস্তে আস্তে রাইফেল নামাল সে। ওতেই চলবে, ভাবল ইয়াসীন। এবং হঠাৎ আধপাক ঘুরে বালিতে এক হাঁটু পেতে ফায়ার করল।

খুব কাছে এগিয়ে এসেছিল একজন ইন্ডিয়ান। ভারি ক্যালিবারের বুলেটটা আচমকা ঝাঁকি দিল তাকে। ছিটকে বেরিয়ে গেল তার ডান হাতের ছোরা। ঘোড়া ঘুরিয়ে কিছুটা পিছিয়ে গেল সবাই।

‘মেসকাইটের ঝোঁপের দিকে চলে যাও তোমরা। জলদি!’ আদেশ দিল ইয়াসীন।

দুটো দলে ভাগ হয়ে যাচ্ছে পিছনের ইন্ডিয়ানরা। সম্ভবত দুইপাশ হতে সাঁড়াশী আক্রমণ করবে।

অতি অল্প লোকসানে, অনেক বেশি লাভ করার ফন্দি এঁটেছে মোযেভরা। মানুষ বা বুলেট কিছুই হারাতে চায় না ওরা, কারণ দুটোই সীমিত ওদের। তাই কৌশলে কাছে এগিয়ে আসতে চাইছে। যাতে তীরধনুক বা বর্ষা ছোরা দিয়ে আক্রমণ করা যায়।

আসুক কাছে-কোমরের পিস্তলটা অনুভব করল ইয়াসীন। তীর ছুঁড়ে কিছু করতে হলে কমপক্ষে ষাট গজের মধ্যে আসতে হবে ওদের, জানে সে। ওই রেঞ্জে তার পিস্তল কী করতে পারে তাও জানে।

উঠে দাঁড়াল ইয়াসীন। অন্য তিনজন দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে মেসকাইটের ঝোঁপের দিকে। সেদিকে এগোল।

এখনও কোন ট্র্যাকের চিহ্ন নেই। কোনও উড়ন্ত মৌমাছিও দেখা যাচ্ছে না। মরুভূমিতে পানির আশেপাশে উড়ে বেড়ায় সেগুলো। প্রশ্নটা বারবার উঁকি দিচ্ছে মনে। ওই মেসকাইটের ঝোঁপের ভিতরে, তবে কি পাওয়া যাবে না পানি?

সেক্ষেত্রে আর এগোনো সম্ভব হবে না। ইন্ডিয়ানরা যদি নাও মারে, তবু মারা যাবে পাওয়েল। তারপর যাবে হেনরী। তারপর?

আর ভাবতে ইচ্ছে হলো না ইয়াসীনের। বরং যুদ্ধই থোক। ডানদিকে, দূরের ইন্ডিয়ানদের দিকে তাকাল সে।

পানি আছে ওদের। যুদ্ধের জন্যে প্রয়োজনীয় রসদ আছে। আর আছে দ্রুতগামী ঘোড়া। যদি ফুরিয়ে যায় কিছু, ঘোড়া হাঁকিয়ে ফিরে যাবে কেউ নিকটবর্তী কোনও আস্তানায় নিয়ে আসবে সব। তা ছাড়া এটা তো ওদেরই দেশ!

আর বেশি দূরে নেই মেসকাইটের ঝোঁপ। হয়তো মৃত্যুও বেশি দূরে নেই আর! জীবনে অনেকবার-এভাবে মৃত্যুর খুব কাছাকাছি এসেছে ইয়াসীন। প্রতিবারই আপ্রাণ লড়তে হয়েছে বেঁচে থাকার জন্যে। ‘তবু বড় নিষ্ঠুর একটা দিন আজ’-ভেবে দেখল ও।

আস্তে আস্তে কাছিয়ে আসছে ইন্ডিয়ানরা। হঠাৎ একজন বাড়িয়ে দিল ঘোড়ার গতি। দ্রুত আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে এগিয়ে এল ইয়াসীনের দিকে। রাইফেল তুলল সে। চট করে ঝুঁকে পড়ে ঘোড়ার ওধারে দেহ লুকাল ইন্ডিয়ানটা। ঘুরিয়ে নিল ঘোড়া। কিন্তু পিছন হতে আর একজন ইন্ডিয়ান ছুটে এল একই ভাবে।

‘না!’ গুঙিয়ে উঠল ইয়াসীন। ‘গুলি করবে না কেউ। ওরা চাচ্ছে আমরা যেন এলোপাতাড়ি গুলি চালিয়ে রাইফেল ফাকা করে ফেলি। যাতে কাছে এসে আক্রমণ করতে পারে ওরা।’

পিছিয়ে পড়তে শুরু করল ইয়াসীন। এতে অন্যরা কভার পাবে। দ্রুত পৌঁছে যেতে পারবে মেসকাইট ঝোঁপের কাছে। পাওয়েলকে সাহায্য করছে হেনরী। মোকাটো, রাইফেল তুলে পিছু হটার ভঙ্গিতে চলেছে ওদের সাথে।

একের পর এক আসতে থাকল ইন্ডিয়ানরা। দুর্বার গতিতে আক্রমণ করার উদ্দেশ্যে ছুটে এসে, শেষ মুহূর্তে ঘুরে চলে যাচ্ছে দূরে। মুখে বিচিত্র সব আওয়াজ তাদের। টিটকারী দিচ্ছে!

হঠাৎ একসাথে আক্রমণ করল ডানপাশের সব কজন ইন্ডিয়ান। দলবেঁধে ঝড়ের বেগে ধেয়ে এল তারা। রাইফেল তুলল ইয়াসীন। রাইফেল তুলল হেনরী। ঘুরে গেল মোকাটোর রাইফেল, ডানদিকে। সবকটা চোখ, সবার মনোযোগ এখন ডানদিকে। হয়তো এটাই চায় ওরা-ভাবনাটা বিদ্যুতের মত খেলে গেল ইয়াসীনের মনে। নিজের অজান্তে বাঁয়ে ঘুরে গেল তার দেহ। আঙুল চেপে ধরল রাইফেলের ট্রিগার।

একেবারে ঘাড়ের উপর এসে পড়েছিল বাঁয়ের ওরা। গুলিটা ঘোড়ার পিঠ হতে নামিয়ে দিল একজন ইন্ডিয়ানকে। ভরা বস্তার মত ধপাস করে পড়ল মৃতদেহটা মরুভূমির বালিতে। সাথে সাথে রাইফেল ফেলে পিস্তল টেনে নিল ইয়াসীন। সামান্য ভাঁজ হয়ে গেল হাঁটু, কুঁচকে গেল বাম চোখ, বাম কব্জির উপর উঠে এল পিস্তল ধরা ডান হাত।

টাসস তিন তিনটে বুলেট ছুটে গেল মাত্র একটা গুলির অখন্ড আওয়াজের গর্ভ হতে। প্রথম বুলেটটায় একজন ইন্ডিয়ান চমকে উঠে নুয়ে পড়ল ঘোড়ার পিঠে। দ্বিতীয় বুলেটটা থাপ্পড় মারার মত ঘুরিয়ে দিল একজনের মুখ। সাথে সাথে সামনের পা দুটো শূন্যে তুলে চিঁহি ডাকল তার ঘোড়া। তারপর ঘুরে ছুট দিল পিছনের দিকে। সামনে ঝুঁকে গুলি এড়ানোর চেষ্টার ফলে তৃতীয় বুলেটটা কাঁধে নিয়ে অন্যদের সাথে পালিয়ে যেতে সক্ষম হলো আর একজন।

পিছনে গুলির শব্দ শুনতে পেল ইয়াসীন। একটা-দুটো, আরও একটা বুলেট বেরিয়ে গেল তার পিস্তল হাতে এবং নীরব হয়ে গেল মরুভূমি।

চলে গেছে ইডিয়ানরা। হারিয়ে গেছে মরুভূমির কেঁপে যাওয়া বাতাসের ভাজে ভাজে। এসেছিল, তার প্রমাণ হিসেবে রেখে গেছে লোকসানের চিহ্ন। বালিতে কুণ্ডলী পাকিয়ে পড়ে রয়েছে ইন্ডিয়ান যোদ্ধার প্রাণহীন দেহ।

হোলস্টারে পিস্তল রেখে রাইফেলটা তুলে নিল ইয়াসীন। হাঁটতে হাঁটতে বুলেট ভরল তাতে। অন্যেরা অনুসরণ করল তাকে।

হেনরী এগিয়ে এল পাশে। তাকাল ইয়াসীন। তার দিকে তাকিয়ে আছে হেনরী। অচেনা দৃষ্টি সে চোখে। ‘ম্যান!-আসলেই ওস্তাদ তুমি! জীবনে এই প্রথম সত্যিকার শুটিং দেখলাম!’ বলল সে।

মেসকাইটের ঝোপে ঢুকল ওরা। ওপাশে পরিষ্কার একটু জায়গা। শুকনো কাদা ফেটে চৌচির হয়ে আছে সেখানে। পাথরের মত শক্ত। পানি নেই কোথাও!

<

Super User