পরদিন সকালে এসে হাজির হলো বিশাল হলদে কুকুরটা।

আলো ফুটেছে তখন। ডগ রানে গিয়ে খানিকটা মাংস কেটে এনে দিতে বলল আম্মা।

দরজা খুলে দেখি মাংসটা নেই। ভালুক-ঘাসে তৈরি দড়ি দিয়ে বেঁধে কাঠের খুঁটিতে ঝুলিয়ে রেখেছিলাম। এখন শুধু দড়িটা ঝুলছে, মাথাটা ছেড়া।

নিচে তাকালাম। এক কোণে একটা পিপা, তাতে কর্নমিল রাখি আমরা। কুণ্ডলী পাকিয়ে ওখানে ঘুমাচ্ছিল কুকুরটা, শব্দ শুনে উঠে দাঁড়াল। বিশাল আকৃতি। খাটো খাটো কান। তারও আবার একটা কাটা। অন্য কোন কুকুরের সঙ্গে লড়াই বাধিয়েছিল বোধহয়, কামড়ে কেটে ফেলেছে। লেজের গোড়াটা একটুখানি আছে শুধু। রোগ, হাড় জিরজিরে কুৎসিত শরীর। পেটটা ফুলে কুমড়া হয়ে আছে।

পেট ওরকম ফুললো কি করে বুঝতে অসুবিধে হলো না। যেখানে শুয়েছিল তার পাশে বড় একটা হাড় পড়ে আছে। একচিমটি মাংস নেই, চেঁচেপুঁছে খেয়েছে।

গত শীতে শুয়োর কেটেছিলাম আমরা। তারই শেষ টুকরোটা বাকি ছিল। এখন সেটাও গেল, রাগ লাগাটা স্বাভাবিক। কিন্তু আমি খেপে গেলাম কুকুরটার আচরণে। অপরাধ যে করেছে সেজন্যে সামান্যতম অনুশোচনা নেই, লজ্জা নেই। ধীরে-সুস্থে উঠে দাঁড়িয়ে, আড়মোড়া ভেঙে, হাই তুলে, একটুখানি-লেজের গোড়া নেড়ে ঘেউ ঘেউ করে এমন ভঙ্গিতে আমার দিকে এগিয়ে এল যেন আমি তার কতদিনের বন্ধু।

হারামজাদা, চোর কোথাকার! গাল দিয়ে উঠে কষে এক লাথি মারলাম।

ঝট করে নিচু হয়ে গেল সে। অল্পের জন্যে ফসকে গেল লাথিটা। কিন্তু দেখলে কেউ বলবে না ফসকেছে। ধপ করে মাটিতে পড়ে, চার পা শূন্যে তুলে বিকট চিৎকার করে উঠল। যেন লাঠি দিয়ে পিটিয়ে ওর হাড়গুলো একটা একটা করে ভাঙা হচ্ছে।

দৌড়ে এল আম্মা। দরজা দিয়ে উঁকি দিয়ে জিজ্ঞেস করল, কি হয়েছে, ট্র্যাভিস?

দেখো না, কোত্থেকে এই চোরের বাচ্চাটা এসে সমস্ত গোস্ত খেয়ে ফেলেছে!

আরেকটা লাথি তুললাম। মারার আগেই চোখের পলকে লাফিয়ে উঠে সরে গেল, আবার মাটিতে পড়ে চেঁচাতে লাগল আরও জোরে।

এইবার বেরিয়ে এল আরলিস। উদোম গা, একটা সুতোও নেই, গরমকালে এরকম করেই ঘুমায় সে। হই হই করে উঠল, কুত্তা! কুত্তা! আমার হাতের নিচ দিয়ে ছুটে গিয়ে বসে পড়ল কুকুরটার পাশে। হাত বুলিয়ে শান্ত করল ওটাকে। তারপর ফিরে তাকাল আমার দিকে, দুচোখে আগুন।

আমার কুত্তাকে মারছ কেন!…তোমাকে আমি তোমাকে আমি… রাগে কথা হারিয়ে ফেলল সে। পিটিয়ে কাপড় পরিষ্কার করার লাঠিটা বেড়ার গায়ে ঠেস দিয়ে রাখা আছে। ওটা তুলে নিয়ে বাড়ি মারতে এল আমাকে।

আরলিসকে ওভাবে রুখে উঠতে দেখে তো আমি অবাক। হাঁ করে তাকিয়ে আছি। বাড়িটা যখন মারল তখনও কিছু করলাম না। তবে আরেকবার বাড়ি তুলতেই লাফিয়ে সরে গেলাম। লাঠিটা ওর হাত থেকে কেড়ে নিল আম্মা।

ও তখন বেসামাল। আম্মাকেই কিল মারার জন্যে হাত তুলল। শেষে কি মনে করে নামিয়ে নিল। ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরল কুকুরটার গলা। আমার দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলতে লাগল, ও আমার কুত্তা! খবরদার! ওর গায়ে হাত তুলতে এলে কাউকে ছাড়ব না আমি!

সাহস পেয়ে উঠে দাঁড়াল কুকুরটা। লেজের গোড়া নেড়ে লাল টকটকে জিভ বের করে আরলিসের গালের পানি চেটে দিতে লাগল।

হাসতে হাসতে আম্মা বলল, ট্রাভিস, মনে হচ্ছে আরেকটা কুকুর পেয়ে গেলাম আমরা।

কি বলছ তুমি? ওরকম বিচ্ছিরি একটা কুত্তা রাখব? এক নম্বরের চোর। রাতে এসে চুরি করে সব গোস্ত খেয়ে ফেলেছে।

রাখতে পারলে তো রাখবই। তবে ওর মালিক নিতে এলে আর কিছু করার নেই। সেটলারদেরই কারও হবে।

এখানকার কারও না। সল্ট লিকের সব কুত্তা আমি চিনি।

তাহলে আর কি। আরলিসের পছন্দ হয়েছে, রেখে দিক। বুদ্ধি আছে বুঝতে পারছি। এত উঁচুতে রাখা মাংস পেড়ে খেয়েছে। পিপাটার ওপর উঠে টেনে নামিয়েছে।

এগিয়ে গেলাম। পিপার ঢাকনার দিকে তাকিয়েই বুঝে গেলাম আম্মার কথা ঠিক। ধুলোর হালকা আস্তরণের ওপর কুকুরের পায়ের ছাপ।

হ্যাঁ, চোরগুলো চালাকই হয়, নইলে চুরি করবে কি করে? এই কুত্তা রাখা যাবেনা।

ট্রাভিস, এবার কিন্তু অন্যায় হচ্ছে। তুই তো জন্মেই কুকুর পেয়েছিলি। আরলিস কি পেয়েছে? তুই থাকবি হাজারটা কাজ নিয়ে ব্যস্ত। ওর সঙ্গে কে খেলবে? অতটুকুন একটা ছেলে একা কি থাকতে পারে, বল? একটা কিছু তো দরকার?

চুপ হয়ে গেলাম। এখন আর কিছু বলে লাভ নেই। কোন ব্যাপারে আম্মা একবার মনস্থির করে ফেললে সহজে আর তার মত বদলানো যায় না। কিন্তু ওরকম একটা চোরকে রাখার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই আমার। আপাতত কিছু না বলাই ভাল। সুযোগ আসবেই। তখন ওটাকে তাড়াব।

রান্না করতে চলে গেল আম্মা। ফায়ারপ্লেসের ওপর একটা হাঁড়ি ঝুলিয়ে কর্নমিলের জাউ রাঁধল। তাতে মধু ঢালল। গেল বসন্তে আমি আর আব্বা বনের ভেতরের একটা গাছ থেকে মৌমাছির চাক কেটে মধু বের করেছিলাম। তারই খানিকটা রয়ে গেছে এখনও। মিষ্টি জাউয়ে মাখন মিশিয়ে আমাদের খেতে দিল।

চমৎকার স্বাদ, কোন সন্দেহ নেই। তবু এই মুহূর্তে এই মিষ্টি খাবার ভাল লাগল না। মাংস দরকার। ভাজা মাংস। কিন্তু পাব কোথায়? সব খেয়ে ফেলেছে পাজি কুকুরটা। আবার রাগ হতে লাগল ওটার ওপর। ইচ্ছে হলো এক বাড়িতে মাথা ফাটিয়ে দিই।

আমার মনের ভাব বুঝতে পারল আম্মা। খাওয়া শেষ হওয়ার আগে কিছু বলল না। কয়েকবার কোমল দৃষ্টিতে তাকাল কেবল। তারপর নরম গলায় বলল, ট্রাভিস, এক কাজ কর, গরু দোয়ানো শেষ করে বন্দুক নিয়ে বনে চলে যা। হরিণ মেরে নিয়ে আয়। মাংস হয়ে যাবে।

<

Super User