একাই আছে ও, চাপা স্বরে বলল কেউ। ঠিক খবরই দিয়েছে হারলো।

চোখ মেলে তাকাল বেন, দেখল আগুনের পাশে দাঁড়িয়ে আছে তিনটে ছায়া। কারও মুখ দেখা যাচ্ছে না, কারণ প্রত্যেকের হাটের ব্রিম নিচু করা; তাছাড়া সবে ঘুম ভেঙেছে ওর, তন্দ্রালু ভাবটা উধাও হয়ে গেলেও দৃষ্টি পরিষ্কার হয়নি।

জাগাও ওকে! নির্দেশ দিল শীতল একটা কণ্ঠ।

কণ্ঠটা চেনা চেনা লাগছে, চোখ সরু করে লোকটাকে দেখল বেন। ছোটখাট গড়ন, লম্বায় বড়জোর সাড়ে পাঁচ ফুট হবে; তবে চওড়ায় পুষিয়ে নিয়েছে সে। কষ্ট করতে হবে না, জেগে আছি আমি, নিরুত্তাপ স্বরে বলল ও।

তাহলে উঠে বসো, বলল সবচেয়ে কাছের লোকটা। পিস্তলের দিকে হাত বাড়িয়ে না আবার।

নড করল বেন। কোল্টের দিকে হাত বাড়ানোর ইচ্ছে নেই ওর। গা থেকে কম্বল সরিয়ে দিল, ঠাণ্ডা বাতাস শরীরে কামড় বসাতে অজান্তে মৃদু কেঁপে উঠল। দেখল পশ্চিমাকাশে চলে গেছে চাঁদ, গাছপালার ছায়া লম্বা হয়ে গেছে। পায়ে বুট গলিয়ে জ্যাকেটের দিকে হাত বাড়াল ও।

থামো! শীতল একটা কণ্ঠ বাধা দিল।

খানিকটা পাশ ফিরে তাকাল বেন। লুকানো পিস্তল নেই আমার কাছে। জ্যাকেট পরব।

দরকার নেই, স্লেজেল! একটু ঠাণ্ডা লাগলে এমন কিছু হবে না তোমার।

শ্ৰাগ কুরল ও। একে একে সবার দিকে তাকাল, মুখগুলো ছায়ায় ঢাকা। তারপরও অন্তত একজনকে চেনা চেনা মনে হচ্ছে, কাঠামোটা পরিচিত। সবচেয়ে খাটো লোকটা ছোটখাট একটা গরিলা বলা যাবে তাকে; কি যেন একটা অসঙ্গতি আছে লোকটার মধ্যে, মনে হলো বেনের।

চিবুকে হাত বুলাল দীর্ঘদেহী লোকটা। এখানে কি করছ তুমি, স্লেজেল?

ক্যাম্প করেছি।

সে তো দেখতেই পাচ্ছি। কিন্তু লেযি-এনের জমিতে কেন?

খানিকটা বিস্ময় নিয়ে লোকটার দিকে তাকাল বেন। এটা তো ডাবল-বির জমিঃ স্কিলেট ক্রীক পেরিয়ে এসেছি, নিশ্চিত হওয়ার পর ক্যাম্প করেছি আমি।

তাই নাকি? তুমি কি নিশ্চিত ওটাই স্কিলেট ক্রীক? বিদ্রূপ ঝরে পড়ল লোকটার কণ্ঠে।

তুমিও নিশ্চিত জানো, পার্ড।

পরস্পারের দিকে তাকাল তিনজন। আগুনে কিছু কাঠ ফেলল, নির্দেশ দিল খাটো গরিলা।

আগুন উস্কে দেওয়ার পর আলোকিত হলো জায়গাটা। জিভ দিয়ে শুকনো ঠোঁট ভেজাল বেন। খাটো লোকটার ডান বাহুর দিকে তাকাল, শীতল শিহরণ বয়ে গেল সারা দেহেলোকটার কনুইয়ের নিচ থেকে কিছুই নেই! কনুইয়ের নিচে শার্টের আস্তিন কাটা। ফ্রেড মোরিস? প্রায় স্বগতোক্তি করল ও।

নড করল সে, একইসঙ্গে পিস্তলও তুলল। তাহলে মনে করতে পেরেছ আমাকে? এখনও মনে রেখেছ দেখে সত্যিই অবাক হয়েছি।

কাউকে পঙ্গু করে দেওয়া পছন্দ করি না আমি, মোরিস।

তাই? হাসালে, স্লেজেল! কিন্তু উল্টোটাই সত্যি মনে হচ্ছে আমার, ছয় বছর আগে আমাকে বিকলাঙ্গ করে দিতে তো খারাপ লাগেনি তোমার! পঙ্গু হাত নিয়েও দিব্যি কাজ চালিয়ে নিচ্ছি আমি, তাই না, বয়েজ?

নড করল অন্যরা।

লেযি-এনের ছায়াও মাড়াবে না, কয়েক বছর আগে সেই নির্দেশই দেয়া হয়েছিল তোমাকে, তাই না?

সেটার বরখেলাপ করলাম কোথায়? ওই তো স্কিলেট ক্রীক, আর এপাড়ে ডাবল-বির জমি।

পাশের লোকটার দিকে ফিরল ফ্রেড মোরিস। স্লিম, ওটাই কি স্কিলেট ক্রীক?

নাহ।

কার্লি?

আরে নাহ, ফ্রেড।

মিথ্যে বলছে ওরা, মোরিস, এবং তুমিও তাই করছ! শুকনো স্বরে বলল বেন। মনে শঙ্কার দামামা বাজছে, অনায়াসে আঁচ করতে পারছে নিকট ভবিষ্যৎ, নির্ঘাত ওকে রাসলার বা ট্রেসপাসার দাবি করবে এরা।

ঝুঁকে এল খাটো গরিলা, সস্তা হুইস্কির গন্ধ আঘাত করল বেনের নাকে। আমাকে মিথ্যুক বলছ, স্লেজেল? উস্কানির স্বরে জানতে চাইল সে। লোকটার কণ্ঠে হিংস্র সুর টের পেল বেন। পরিষ্কার আক্রোশ। মামলা চুকিয়ে ফেলতে অস্থির হয়ে পড়েছে।

ফ্রেড মোরিসের কাঁধের দিকে তাকাল ও। খাপ থেকে পিস্তল বের করে ফেলেছে কার্লি আর স্লিম। কোন চান্সই নেই ওর। নির্দ্বিধায় ওকে খুন করবে এরা, তারপর লাশটা টেনে নিয়ে যাবে রিও ফ্রিয়ের ওপাড়ে, যাতে দাবি করতে পারে। বেনই ট্রেসপাস করেছে কিংবা ঝামেলা করছিল। রিও ফ্রিয়ো অঞ্চলে এই ঘটনা নতুন কিছু নয়।

তো? শীতল স্বরে তাগাদা দিল মোরিস।

ওটাই স্কিলেট ক্রীক! জেদী স্বরে ঘোষণা করল বেন।

চোখের নিমেষে সক্রিয় হলো ফ্রেড মোরিস। বাম হাতে সজোরে ঘুসি হাকাল বেনের পেটে, এক লহমায় বেরিয়ে গেল ফুসফুসের সব বাতাস। অজান্তে সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ল বেন, সুযোগটা কাজে লাগাল লোকটা, বিকলাঙ্গ ডান হাত দিয়ে আঘাত করল ওর মুখে। তারপর কাঁধ দিয়ে ধাক্কা মারল বেনের বুকে। কনুইয়ের নিচে হাতের বাকি অংশ না থাকলে কি হবে, আঘাতের চোটে চোখে অন্ধকার দেখল বেন, মনে হলো একটা গদা দিয়ে আঘাত করছে মোরিস। নিজের বেডরোলে চিৎপটাং হয়ে পড়ল ও।

ওর বুকের ওপর একটা বুট তুলে দিল মোরিস, ধীরে ধীরে চাপ বাড়াচ্ছে। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে বেনের। মরিয়া চেষ্টায় দু’হাতে বুটটা চেপে ধরল ও, তারপর গায়ের জোরে মোচড় দিল। অস্ফুট স্বরে কাতরে উঠল মোরিস, বুটের চাপ কমে গেছে।

সুযোগটা লুফে নিল বেন, বুট ধরে ঠেলে দিল মোরিসের শরীর। উড়ে গিয়ে চিৎ হয়ে পড়ল সে ঘাসের ওপর। এদিকে গড়ান দিয়ে সরে গেছে বেন, ছেড়ে দেওয়া ম্প্রিঙের মত ঝটিতি উঠে বসল, দ্রুত হাত বাড়াল জুনিপারের শাখায় ঝুলন্ত কোল্টের দিকে।

কিন্তু ওর চেয়ে অনেক বেশি ক্ষিপ্র ফ্রেড মোরিস। এতটাই ক্ষিপ্র যে, নিজেকে শুধু সামলেই নেয়নি, বরং সুবিধাজনক অবস্থানে পৌঁছে গেছে। কিছু টের পাওয়ার। আগেই মাথার পেছনে আবারও গদার মত আঘাত অনুভব করল বেন-সুযোগ। পেয়ে সরোষে গায়ের ঝাল মেটাচ্ছে মোরিস। মুখ থুবড়ে পড়ল ও, দেখল জুনিপারের শাখাটা তীব্র গতিতে ধেয়ে আসছে ওর দিকে।

কোন রকমে সামলে নিল ও, জুনিপারের সঙ্গে সংঘর্ষ এড়াতে পারলেও ফ্রেড মোরিসের নির্মম মার এড়াতে পারল না। হাঁচড়ে-পাঁচড়ে উঠে দাঁড়াল ও, আধ পাক ঘুরে দাঁড়াতে পেটে পরপর দুটো ওজনদার ঘুসি এসে পড়ল। বাতাসের অভাবে খাবি খেল বেন, যন্ত্রণায় কুঁচকে গেছে মুখ। সুযোগ পেয়ে ওর অরক্ষিত মুখে আঘাত করল গরিলা, গদাসদৃশ ডান কনুই ব্যবহার করছে নিপুণ দক্ষতায়। আঘাতের চোটে চোখে সর্ষে ফুল দেখল বেন, মনে হলো নড়বড়ে হয়ে গেছে কয়েকটা দাত, মুখ ভরে গেছে তাজা রক্তে। ঠোঁটের কোণ দিয়ে গড়িয়ে পড়া রক্ত চিবুক হয়ে বুকের কাছে ওর শার্টে পড়ল।

টলমল পায়ে পিছিয়ে গেল বেন, নিজের ওপর কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। ভারসাম্যহীন শরীরটা গিয়ে পড়ল আগুনের ওপর। লেভাইসের আবরণ ভেদ করে শরীরে আগুনের তপ্ত হ্যাঁকা লাগতে যন্ত্রণায় অস্ফুট শব্দ করে উঠল।

দাড় করাও হারামজাদাকে! চাপা স্বরে নির্দেশ দিল মোরিস।

সঙ্গীর সাহায্যে এগিয়ে এল স্লিম নামের লোকটা, বেনের দুই বাহু চেপে ধরে। আগুন থেকে সরিয়ে আনল, তারপর মোরিসের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিল।

শীতল ক্রোধ আর জিঘাংসা নিয়ে অপেক্ষা করছে ফ্রেড মোরিস। চোখ দুটো জ্বলছে হিংস্র শ্বাপদের মত, গরিলার ন্যায় বিশাল মুখে নগ্ন আক্রোশ ফুটে উঠেছে। এদিকে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে বেন, তবে এতটা হয়নি যে সুযোগ পেয়েও পাল্টা আঘাত করতে পারবে না-ক্ষণিকের বিরতির সুযোগ নিল ও। একটা হাঁটু তুলে মোরিসের পেটে আঘাত করল, চটপট দুটো ঘুসি হকাল প্রশস্ত মুখটায়।

তীব্র ব্যথায় খিস্তি করল মোরিস, মুখ কুঁচকে গেছে। মাথা নিচু হয়ে গেল তার। বেনের বুটের ঝাড়া লাথিতে পরমুহূর্তে মাটিতে পড়ে গেল সে।

ঘুরে ফ্লিমের দিকে মনোযোগ দিল বেন। ঘুসির তোড়ে উড়ে গিয়ে ছুটে আসা কার্লির ওপর পড়ল স্লিম ফ্লেচার, জোড়া দেহ আছড়ে পড়ল একটা লগের ওপর।

স্খলিত পায়ে দু’পা এগোল বেন। অনুভব করছে তাজা রক্তে ভরে গেছে মুখ। সশব্দে থুথু ফেলল ও, হাতের চেটো দিয়ে মুখের কোণে লেগে থাকা রক্ত মুছল। ফ্রেড মোরিস উঠে বসার চেষ্টা করতে লাথি চালাল তার গলায়। কাত হয়ে ঘাসের গালিচায় ঢলে পড়ল লোকটা।

হাত বাড়িয়ে কোল্ট তুলে নিয়ে কক করল বেন। পিস্তল বাগিয়ে ধরে দেখল উঠে বসার চেষ্টা করছে কার্লি আর স্লিম, সমানে খিস্তি করছে। কোল্টের মাজল দিয়ে তিনজনকে কাভার করল বেন।

খুব কাছেই গর্জে উঠল একটা পিস্তল, সংবিৎ ফিরল ওদের।

যথেষ্ট হয়েছে, স্লেজেল, বলল চেনা একটা কণ্ঠ। পিস্তল ফেলে দাও!

নিশানা করা কোল্টের নল নিচু করল বেন, কিন্তু ফেলল না। পাশ ফিরে দেখল তিনজন দর্শক জুটে গেছে। এদের একজন লেযি-এন ফোরম্যান স্টিভ হারকার। গোল্লায় যাও তুমি, হারকার! ত্যক্ত স্বরে গাল দিল ও।

দীর্ঘ নীরবতা নেমে এল। স্থির দৃষ্টিতে বেনকে দেখছে স্টিভ হারকার, মুখটা পাথরের মতই কঠিন, নির্বিকার। চোখের কোণ দিয়ে দেখল হাঁচড়ে-পাঁচড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে অবাঞ্ছিত তিন অতিথি, দ্রুত শ্বাস ফেলছে এখনও। শীতল উম্মা ঝরে পড়ছে ফ্রেড মোরিসের চাহনিতে। কিন্তু স্লিম আর কার্লির চোখে শঙ্কা। জানে খেপে গিয়ে বেন যদি গুলি করে, তবে ওদের তিনজনই আসল টার্গেট।

আবারও বলছি, পিস্তলটা খাপে ভরে রাখো, স্লেজেল! কোন চান্স নেই তোমার! নিরুত্তাপ স্বরে সতর্ক করল লেযি-এন র‍্যামরড।

তিনটা ধেড়ে শয়তান পিটিয়ে আমাকে আধমরা করার চেয়ে বরং চান্সটা নেওয়াই ভাল।

দু’পা এগিয়ে এল স্টিভ হারকার। দীর্ঘদেহী মানুষ সে, ছ’ফুটের কাছাকাছি হবে। কালো একটা কোট পরনে, এমনকি হাতের দস্তানাগুলোও কালো। চাঁদের। আলোয় মুখটা মড়ার মত ফ্যাকাসে আর বিবর্ণ দেখাচ্ছে। ফ্রেড, সঙের মত দাঁড়িয়ে না থেকে সরে এসো, শান্ত স্বরে নির্দেশ দিল সে। স্লিম, কার্লি…তোমরাও চলে এসো। ক্রীক পেরিয়ে সরাসরি লাইন ক্যাম্পে চলে যাও।

কিন্তু স্টিভ, প্রতিবাদ করল মোরিস। এই হারামজাদা… ফোরম্যানের চোখের দিকে তাকাতে নিস্তেজ হয়ে এল তার কণ্ঠ। হাতের চেটো দিয়ে মুখ মুছল, তারপর হিংস্র দৃষ্টিতে তাকাল বেনের দিকে। শ্রাগ করে হারকারকে পেরিয়ে গেল সে, অনুসরণ করল স্লিম আর কার্লি।

পিস্তলটা খাপে ভরে রাখো, স্নেজেল, নিস্পৃহ স্বরে বলল হারকার।

মাথা খারাপ!

আপাতত নিরাপদ তুমি।

ফোরম্যানের পেছনে পরিচিত একটা মুখ দেখতে পেল বেন। জ্যাক হারলো। বেনের সঙ্গে চোখাচোখি হলো তার, মৃদু নড করল টেক্সান।

আমার সঙ্গে লাগতে এসো না, স্লেজেল! আলগোছে কোটের ল্যাপেল সরিয়ে দিল হারকার, নিচু করে বাঁধা ভয়াল দর্শন কোল্ট উঁকি দিচ্ছে হোলস্টারে। টান টান বুক আর পা দুটো কিঞ্চিৎ ফাঁক করে দাঁড়িয়ে আছে সে, ডান হাতের আঙুলগুলো লেপ্টে আছে হোলস্টারের গায়ে; ভঙ্গিটায় স্পষ্ট প্রকাশ পাচ্ছে আত্মবিশ্বাসী সে, এতটাই যে বেনের হাতে খোলা পিস্তল থাকার পরও চ্যালেঞ্জ করতে দ্বিধা করেনি।

ঠাণ্ডা বাতাস বইছে প্ৰেয়ারিতে, বাতাসে মৃত্যুর ফিসফিসানি। শীতল অনুভূতি হচ্ছে বেনের। সামনে দাঁড়ানো লোকটিকে নিরীখ করল-লেযি-এন ফোরম্যানের নির্লিপ্ত মুখ, খানিক বেঁকে থাকা ঠোঁটের কোণে তাচ্ছিল্যের হাসি গায়ে জ্বালা ধরিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু নিজেকে সামলে নিল ও, অযথা বেপরোয়া হয়ে বেঘোরে প্রাণ হারানোর মানে হয় না। তাতে ফ্রেড মোরিসের ইচ্ছের কাছে নিজেকে সঁপে দেওয়াই সার হবে। শুধু রিও ফ্রিয়ো অঞ্চলই নয়, সারা নিউ মেক্সিকোয় বোধহয় স্টিভ হারকারের চেয়ে ফাস্টগান নেই কেউ।

স্লেজেল? মৃদু স্বরে ডাকল সে। দস্তানা পরা হাতের মুঠি খুলে আবারও বন্ধ করল। এটাই তোমার শেষ সুযোগ।

আবারও নড় করল হারলো, চোখের কোণ দিয়ে দেখল বেন, বুকে ক্রস আঁকল।

হ্যামার নামিয়ে পিস্তলটা বেডরোলের ওপর ছুঁড়ে ফেলল ও। এবার নিশ্চিন্তে গুলি করতে পারো তুমি, হারকার, তিক্ত স্বরে বলল বেন। কি চান্স বাকি থাকল আমার?

কয়েক পা এগিয়ে এল স্টিভ হারকার। কফি তৈরি করো তো, জ্যাক, মি. স্লেজেলের সৌজন্যে।

আগুনে আঁরও কাঠ ফেলল তৃতীয় লোকটা, আড়চোখে বেনকে জরিপ করছে সে। মেক্সিকান নাকি দো-আঁশলা, নিশ্চিত হতে পারল না বেন। পরিচিত মনে হচ্ছে লোকটাকে, কিন্তু চিনতে পারল না। রিও ফ্রিয়ো অঞ্চল ছাড়ার আগে এমন বহু লোককেই চিনত। লোকটার উপস্থিতি কিংবা নির্লিপ্ত চাহনি অস্বস্তি ধরিয়ে। দিচ্ছে মনে, শীতল অনুভূতিটা ক্রমশ জোরাল হচ্ছে। স্টিভ হারকার হয়তো কঠিন বিপজ্জনক মানুষ, একটা নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত তাকে বিশ্বাসও করা যায়; কিন্তু এই লোককে কখনোই বিশ্বাস করা যাবে না, অভিজ্ঞতা বলছে বেন স্লেজেলকে, কেউটের মতই দু’মুখো সাপ সে।

শ্রাগ করে ডেনিম জ্যাকেট গায়ে চাপাল বেন।

বেশ ঠাণ্ডা পড়ছে, আলাপী সুরে বলল হারলো। শীত বোধহয় এবার তাড়াতাড়ি আসবে। রাজহাঁসগুলো দেখেছ, দক্ষিণে যাচ্ছে ওরা?

পাখিদের দক্ষিণে যাওয়ার সময় এখন। তোমার মত অতিথি পাখি, শ্লেজেল, নড করে বলল লেযি-এন ফোরম্যান। রিও ফ্রিয়োয় কি করছ তুমি?

স্বজনদের সঙ্গে দেখা করতে এসেছি, শুকনো স্বরে বলল বেন, আলতো হাতে কেটে যাওয়া ঠোঁট স্পর্শ করল।

কনুইহীন হাতটা ব্যবহার করতে জানে বটে ফ্রেড, মন্তব্যের সুরে বলল হারলো। এমনকি সুস্থ যে কোন লোকের মুঠির চেয়েও ঢের ভাল ব্যবহার করে।

কোন একদিন ওর গলাটাই কেটে ফেলব আমি! বিড়বিড় করে বিষোদার করল বেন।

হয়তো, নিস্পৃহ স্বরে বলল হারকার, বেনের মন্তব্যটাকে স্রেফ উপেক্ষা করল। আগুনের কাছে গিয়ে দস্তানা পরা মুঠি দুটো মালিশ করল উষ্ণতার আশায়। ওকে খেপিয়ে দেওয়া উচিত হয়নি তোমার, স্লেজেল।

আমি ওর ওপর চড়াও হইনি, হারকার, বরং ওরাই ঘুমের মধ্যে আক্রমণ করেছে আমাকে।

ফ্যাকাসে নীল চোখ জোড়া স্থির হলো বেনের ধূসর চোখে। উঁহু, আজ রাতে ওকে খেপাওনি তুমি, স্লেজেল। ছয় বছর আগে সিরেনোর রাস্তায় ওর ডান হাতের কনুই উড়িয়ে দিয়েছ তুমি।

ওর হাতে তখন একটা পিস্তল ছিল, হারকার। এর মানে নিশ্চয়ই বোঝো? যদূর জানি তুমি নিজেও কয়েকটা খুন করেছ, কিছু লোককে পঙ্গুও করেছ।

ফট করে ফাটল আগুনে ঠেসে দেওয়া জুনিপারের শুকনো শাখা। কফির কেতলি আগুনে চাপিয়ে দিল জ্যাক হারলো, তারপর সাবধানী দৃষ্টিতে তাকাল বেনের দিকে-চাহনিতে ভৎর্সনা।

বিকেলে লেযি-এনের জমি পাড়ি দিয়েছ তুমি, শান্ত স্বরে বলল স্টিভ হারকার, যেন বেনের মন্তব্যটা শুনতেই পায়নি। এর পরিণতি জানো নিশ্চয়ই? অন্য যে কারও চেয়ে তোমার সেটা ভাল জানার কথা।

দ্রুত রিও ফ্রিয়ো পেরুতে চাইলে এটাই…

অন্য পথেও রিও ফ্রিয়ো পেরুনো সম্ভব। হয়তো ঘুরপথ, কিন্তু সেটাই স্বাভাবিক। তুমি ভাল করেই জানো লেযি-এনের জমিতে অবাঞ্ছিত কারও উপস্থিতি সহ্য করে না বস্। ইচ্ছে করলে তোমার শরীরে একাধিক বুলেট ঢুকিয়ে দিতে পারত হারলো।

না হেসে পারল না বেন। সুযোগ আমারও ছিল।

বরফের মত শীতল হয়ে গেল নীল চোখের চাহনি। কোন লেযি-এন ক্রুকে গুলি করেই দেখো, এই মাটিতেই খুন হয়ে যাবে তুমি!

গাট-হুক আইন, তাই না, হারকার?

ফিরে এসেছ কেন?

বলেছি তো, দেখা করতে। কার্ল ব্রেনেলের মৃত্যু সম্পর্কে আগ্রহ নেই তোমার?

কেতলিতে পানি ফুটতে শুরু করেছে। শীতল অস্বস্তিকর পরিবেশে উষ্ণ আমেজ এনে দিল যেন শব্দটা। একটু পর, কাপে কফি ঢেলে সবাইকে পরিবেশন। করল জ্যাক হারলো।

দীর্ঘদেহী গানফাইটারকে নিরীখ করছে বেন। এক হিসেবে ঠিকই বলেছ।

প্রতিশোধ নিতে চাও?

না, কফিতে চুমুক দিল ও। কার ওপর প্রতিশোধ নেব? কেউই জানে না কে খুন করেছে ওকে।

সেটা ঠিক।

কফির কাপের ওপর দিয়ে চোখাচোখি হলো দু’জনের, স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল ওরা। বেনের দৃষ্টিতে চ্যালেঞ্জ, কিন্তু র্যামরডের চাহনিতে শীতল উষ্মা ঝরে পড়ছে।

কাপ নামিয়ে রেখে সিগারেট ধরাল হারকার। হয়তো বুড়োর কাছে কোন দেনা আছে তোমার?

নড করল বেন। স্মৃতি, হারকার। একজন বিশাল হৃদয়ের মানুষের স্মৃতি, যে কিনা কুড়িয়ে পাওয়া একটা বাচ্চাকে নিজের সন্তানের মত মানুষ করেছে, অথচ মানুষটা নিঃসন্তানও ছিল না। আমাদের মধ্যে কখনোই পার্থক্য করেনি সে, সবাই ওর কাছে সমান গুরুত্বপূর্ণ ছিলাম।

কিন্তু তারপরও তোমাকে বেসি ছাড়া করেছে সে।

না, আমি নিজেই চলে গেছি। হয় বিল নয়তো আমাকেই যেতে হত। বিল ওর নিজের রক্তের।

স্মিত হাসি দেখা গেল আরকারের ঠোঁটে। কেউ কেউ বলে বিলকেই বেসিন ছাড়া করা উচিত ছিল তার।

কি বলতে চাও তুমি?

কফি নিঃশেষ করে উঠে দাঁড়াল ফোরম্যান। শিগগিরই জেনে যাবে।

সিগারেটের গোড়া আগুনে ছুঁড়ে ফেলে উঠে দাঁড়াল বেন। বুঝতে পারছে স্টিভ হারকারকে প্রশ্ন করে লাভ হবে না, নিজে না চাইলে মুখ খুলবে না সে। বরং

আগে যা করেনি কখনও, অনেকক্ষণ কথা বলেছে ওর সঙ্গে।

আয়েশী ভঙ্গিতে দু’হাত মালিশ করছে হারকার। দেখো, স্লেজেল, ব্যক্তিগত ভাবে তোমার ওপর কোন বিদ্বেষ নেই আমার; কিন্তু টম নোলানের হয়ে কাজ করি আমি। সে যা বলে সেটাই হয় এখানে। কার্ল বেনেলের মৃত্যুর পরপরই আমাকে নির্দেশ দিয়ে রেখেছে বস, ঠিকই আঁচ করেছে যে ফিরে আসতে পারো তুমি। আরও একটা আন্দাজ করেছে সে: এসেই ঝামেলা শুরু করবে তুমি। সেজন্যেই। দেখতে এলাম কিছু ঝামেলা যাতে তোমাকেও ফেরত দেয়া যায়। পরিষ্কার?

নিজস্ব কোন ইচ্ছে আছে তোমার, হারকার? টম নোলান কি তোমার জন্যে ভাবে কখনও, বলে দেয় আসলে তোমার কি করা উচিত?

রাগে জ্বলে উঠল ফোরম্যানের চোখ দুটো, চোখের পাশে দপদপ করে লাফাচ্ছে একটা শিরা। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিল সে। মন্তব্যটা এড়িয়ে যাচ্ছি, আপাতত, নিস্পৃহ স্বরে বলল। কাল ডাবল-বিতে পৌঁছে যাবে তুমি, যতদিন ইচ্ছে থাকো; কিন্তু ঝামেলা করতে এদিকে এসো না, কারণ বিনিময়ে এর কয়েকগুণ ফেরত পাবে তুমি। এবং আমি না চাইলেও হবে এসব।

নড করল ও।

আজ রাতে আর কোন ঝামেলা হবে না তোমার।

গ্রেসিয়াস, শুকনো স্বরে বলল বেন।

মুহূর্তের জন্যে নীরব হয়ে গেল হারকার। ছয় বছর পর বিল ব্রেনেলের সঙ্গে দেখা হবে তোমার, তাই না?

হ্যাঁ।

শুনেছ তো বিয়ে করেছে ও, স্লেজেল? কিংবা জানো মেয়েটা কে? বাঁকা হাসি ঝুলছে লেযি-এন র্যামরডের ঠোঁটের কোণে, পমেল আঁকড়ে ধরে স্যাডলে চড়ে বসল। মাথায় হ্যাট চাপিয়ে দস্তানা পরা হাত তুলে উইশ করল বেনের উদ্দেশে।

স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল বেন। ওর বিয়ের খবর পাইনি আমি।

মাত্রই তো এলে। যাক না কটা দিন। আরও অনেক খবরই পাবে, বেন স্লেজেল!

<

Super User