পাপাগো ওয়েলসের কুয়াগুলোর বয়স কয়েক হাজার বছর। পাথুরে জমির বুকে তিনটা গভীর খাদ, ভূমিকম্পে শিলাচ্যুতির সময় তৈরি হয়েছিল। একটু সামনে, নিচু একটা অ্যারোয়ো রয়েছে; আর পিছনে পাথুরে শৈলশিরা কশেরুকার শেষপ্রান্তের মত চোখা, তির্যক অবয়ব তৈরি করেছে।

পাপাগো ওয়েলস থেকে গাল্ফ অভ ক্যালিফোর্নিয়া জুড়ে লাভা বয়ে যাওয়ার ফলে এবড়োখেবড়ো ও দুর্গম হয়ে উঠেছে এলাকার এই অংশ। ছোটখাট একটা নরক বলা চলে একে। জ্বলন্ত, উত্তপ্ত এবং বাস্পীয় লাভার স্রোত ঠাণ্ডা হওয়ার পর আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখের মত গভীর গর্ত তৈরি করেছে, কোনটা কোনটা মাটির নীচে কয়েকশো ফুট পর্যন্ত গভীর। খাদে ক্যাকটাস, শোলা, বিসনাগা আর ওকটিয়া জনেছে।

নির্জন অঞ্চল এটা, ভূমিকম্পের ফলে অদ্ভুত চেহারা পেয়েছে। মাটিতে অসংখ্য ফাটল ছাড়াও রয়েছে গভীর অ্যারোয়ো বা লাভার ঢালু চাঙড়। ওগুলোয় কখনও কখনও পানি পাওয়া যায়। পাপাগো ওয়েলসের পানির উৎস তিনটা সমতল পাথুরে বেসিন। সূর্যের আলো এত নীচে পৌঁছায় না বলে পানি স্ফটিকের মত স্বচ্ছ, শীতল ও সুপেয়। ইন্ডিয়ান বা তাপদগ্ধ মরুর কিছু পশুপাখি ছাড়া এটার কথা খুব কম লোকই জানে।

প্রাচীন কোন এক সময়ে, যখন প্রচুর বৃষ্টিপাত হত, বেসিন তিনটা প্রায়ই পূর্ণ থাকত; সরীসৃপ এবং পরে স্তন্যপায়ীদের তেষ্টা মিটিয়েছে বছরের পর বছর। উত্তরে সমস্ত গ্লেসিয়ার গলে যাওয়ার পর বৃষ্টির পরিমাণ কমে এল, ক্রমশ শুকিয়ে এল জমি, ঘাস উধাও হয়ে গেল ধীরে ধীরে।

পরে আরও পাথরধস এবং ভূমিকম্প হলো, বেশিরভাগ সরীসৃপ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল, গুটিকয়েক টিকে থাকল, উত্তর থেকে আসা ইন্ডিয়ানদের জন্য কিংবদন্তী হয়ে টিকে থাকল এরা। তবে সরীসৃপ ও স্তন্যপায়ী, দু’ধরনের প্রাণীকেই হারিয়ে যেতে দেখেছে ইন্ডিয়ানরা। কূপের কাছাকাছি, বালির নীচে খড়গের মত দাঁতঅলা বাঘের করোটি আর হাড় রয়েছে, আরও কাছে আছে বিশালকায় একটা শ্লোথের (স্লোথ (Sloth) উত্তর আমেরিকার এক জাতীয় জন্তু) কঙ্কাল। সিকি মাইল দূরে প্রকাণ্ড দুটো ম্যামথ শিকার করেছিল আদিম মানুষেরা, বিশাল পাথর ছুঁড়ে মেরেছিল ওগুলোকে।

সাত হাজার বছর আগে এক শিকারী পানি পান করতে এসে আবিষ্কার করে কূপগুলো। সে-ই ছিল পাপাগো ওয়েলসের পানি পান, করা প্রথম মানুষ। হাঁটু গেড়ে বসে পানি পান করার জন্য, টের পায়নি আরও এক শিকারী রয়েছে ধারে-কাছে-খড়গঅলা দাঁতের একটা বাঘ ঘাপটি মেরে ছিল লাভার পিছনে। বর্শা আর পাথরের তৈরি কুঠার ছিল আদিম মানুষটির কাছে। পিছনে শব্দ শুনতে পেয়ে ঝটিতি ঘুরে দাঁড়াল সে, একেবারে মোক্ষম সময়ে; ততক্ষণে লাফ দিয়েছে বাঘটা। নাকের ডগায় যখন চলে এসেছে, তখনই বর্শা চালাল লোকটা। বাঘের মগজে বিধলেও হাতল ভেঙে মাটিতে পড়ে গেল বর্শাটা। মরিয়া চেষ্টায় পাথরের ধারাল কুঠার চালাল লোকটা। লোকটাকে পঞ্চাশ গজ দূরে টেনে নিয়ে গেল বাঘ, ওখানেই পাশাপাশি পড়ে থেকে মারা গেল মানুষ আর পশু। বাঘের মাথায় বিধে যাওয়া বর্শার ফলাটা পরে ওঅটর হোলের পশ্চিম কিনারে মাটি খুঁড়ে পাওয়া গেছে।  

নেহাত ঠেকায় না পড়লে এত দক্ষিণে কোন লোকই আসে না। স্বাভাবিক সময়ে উত্তরের এলাকায় যথেষ্ট পানি থাকে, তবে কয়েকশো বর্গমাইলের এই এলাকায় পানি খুব কমই দেখা যায়। কদাচিৎ বৃষ্টির ফলে পাথুরে বেসিনে যদি জমা হয় কখনও, তাই পাওয়া যায়। স্বভাবতই, এদিকে কেউ এলে পানির যোগান নিয়েই আসে, নিজ দায়িত্বে।

পাপাগো ওয়েলসের কুয়ায় মিষ্টি, পরিষ্কার পানি, মাটি থেকে কয়েক ফুট গভীরে। লাগোয়া লাভার দেয়ালের কারণে কুয়ায় সবসময়ই ছায়া থাকে। মূল কুয়ার পিছনে অপেক্ষাকৃত ছোট এবং প্রায় গুপ্ত আরেকটা বেসিন রয়েছে, পাথুরে প্রস্তরে প্রায় ঢাকা, একেবারে কাছে না গেলে চোখে পড়ে না। আর মূল কুঁয়ার নীচে ছড়ানো-ছিটানো পাথরের আড়ালে আরেকটা কুয়া লুকিয়ে আছে, নিচু অ্যারোয়োতে জন্ম নেওয়া মেস্কিট, আয়রনউড, প্যালো ভার্দে আর ক্যাট-ক্লর ঘন ঝোঁপের আড়ালে পড়ে গেছে ওটা।

বছরের পর বছর বৃষ্টির কারণে পাথরের পৃষ্ঠ মসৃণ ও স্বচ্ছ হয়ে গেছে, প্রবল ঝড়ে স্থানচ্যুত হয়ে কুয়ায় এসে পড়েছে ছোট ছোট পাথর। বিস্তীর্ণ এলাকার মধ্যে এটাই পানির জন্য সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য উত্স। বিগহর্ন ভেড়া, পাহাড়ী সিংহ, জাগুয়ার, কয়োট বা অ্যান্টিলোপ পানি পান করতে আসে এখানে। মানুষও আসে, তবে কেউই বেশিক্ষণ থাকে না। পানির চাহিদা মিটে গেলে যার যার পথে চলে যায়।

মরুভূমির মানুষ আর আশপাশে যত পশু আছে, সবার কাছে পানির নিশ্চয়তার আরেক নাম পাপাগো, ওয়েলস। বছরের যে-কোন সময়ে পানি পাওয়া যায় এখানে। শুধু সুপেয় পানিই নয়, অ্যারোয়ায় রয়েছে শীতল ছায়া এবং গ্যালেটা ঘাস…এমন জায়গার কথা সহজে বিস্মৃত হওয়ার নয়। বছরের বেশিরভাগ সময় শুকনো থাকে বেটস ওয়েল, কিপ্রিয়ানো ওয়েলে রয়েছে নামমাত্র, গানসাইট নামের ওঅটর হোলটা এখান থেকে বহু দূরে-পিছন দিকে, আর টুলে ওয়েলসের অবস্থান আরও সামনে।

*

পাপাগো ওয়েল্স থেকে বেশ দক্ষিণে মরুভূমি ধরে উত্তর-পশ্চিমে এগোচ্ছে কয়েকজন রাইডার। ইন্ডিয়ান এরা। ওদের নেতার নাম চুরুতি। আধা অ্যাপাচি আধা ইয়াকি। হিংস্র, নৃশংস। মা বা বাবা, কারও গোত্রে ঠাই হয়নি তার, নিজের দোষেই টিকতে পারেনি। সাদা মানুষকে মনে-প্রাণে ঘৃণা করে চুরুতি, খুন-জখম এবং লুটপাট ছাড়া আর কিছু বোঝে না। ওর জীবনের সার্থকতা শুধু এতেই। ম্যান্টেসা এবং উত্তর সনোরার ইসপুমা পাহাড়কে পাশ কাটিয়ে পশ্চিমে এগিয়ে চলেছে ওরা। দলে রয়েছে তেইশজন অ্যাপাচি। সনৈটায় ছোটখাট কয়েকটা দলের সঙ্গে মিলিত হওয়ার কথা ওদের। উত্তরে কয়েকটা বিচ্ছিন্ন বাথান আর মাইনিং ক্লেইম রয়েছে। এলাকায় অবশ্য পিমা এবং পাপাগো ইন্ডিয়ানদের বসবাস। পিমারা ওদের বহু পুরানো শত্রু। কিন্তু সীমান্ত পেরিয়ে এখানেই ঘাঁটি গেড়েছে চুরুতির দলবল। মাঝে মধ্যে সীমান্তের ওপাশে চলে যায়, ঝটিকা রেইড চালিয়ে ফিরে আসে। এখন যেমন, আনন্দিত সন্তুষ্ট দল নিয়ে ফিরছে চুরুতি। সীমান্তের ওপাশে এবারের অভিযানে দারুণ মৌজ হয়েছে-খুন, লুটপাট ছাড়াও বেশ কিছু বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে ওরা।

বিশালদেহী মানুষ চুরুতি। গাঢ় চামড়া। নাক বোঁচা, সারা মুখে অসংখ্য ক্ষতচিহ্ন। অন্যকে খুন করে জীবনের আনন্দ উপভোগ করে সে। আচমকা যাত্রার গতিপথ বদলে কুইটোভাকের দিকে এগোল। একটা খনিতে কাজ করে আট-দশজন মেক্সিকান।

মিনিট কয়েকের মধ্যে কাজ সেরে উত্তরে কুইটোবাকিটোর দিকে এগোল ওরা। বেশ কয়েকটা ঘোড়ার পাল আছে ওখানে। ঠিক পশ্চিমে পাপাগো ওয়েলস।

কুইটোভাকে অন্তত পাঁচজন মেক্সিকান খুন হলো, যদিও চুরুতির ধারণা একজনকেও রেহাই দেয়নি, কিন্তু আসলে একজন মেক্সিকান ছাড়াও সাদা এক পুরুষ আর একজন মহিলা বেঁচে গেছে। আরও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার…ষাট হাজার ডলারের স্বর্ণমুদ্রার এত কাছে এসেও জানতে পারল না চুরুতি।

মরুভূমি ধরে এগিয়ে চলেছে দলটা, একেকজনকে দেখে মনে হচ্ছে বাদামি ভূত। চুরুতির মনে পাপাগো ওয়েলসের মিষ্টি সুপেয় পানির স্মৃতি।

*

ছায়ার কারণে পানির ছোঁয়া পায়নি সূর্যের আলো। চারপাশ নীরব, শান্ত; নীচে আয়রনউড ঝোপে ডেকে উঠল একটা কোয়েল…ব্যস, আর কোন শব্দ নেই।

সূর্যাস্তের পর দলেবলে পানি পান করতে এল ভেড়ার পাল। নেতৃত্বে একটা বিগহর্ন। ঠাণ্ডা গাঢ় পানিতে মুখ ডুবিয়ে দিল ওরা, সময় নিয়ে পান করল। কিছুক্ষণ ওখানেই থাকল দলটা, পানির নৈকট্য উপভোগ করছে। হঠাৎ দূরে পাথরের সঙ্গে ঘোড়ার খুরের সংঘর্ষের শব্দ কানে আসতে চমকে উঠল নেতা-ভেড়াটা। হুড়োহুড়ি পড়ে গেল ওদের মধ্যে, চট করে লাভার বোল্ডারে হারিয়ে গেল সবকটা। গোধূলির শেষ লগ্নের ফিকে আলোয় আবার নীরব হয়ে গেল পাপাগো ওয়েলস এলাকা।

স্যাডলের খসখস শব্দ হলো, শব্দের উৎস, কাছে চলে এসেছে। এখন; পশ্চিম দিক থেকে কুয়ার দিকে এগিয়ে এল দু’জন রাইডার। নিচু স্বরে কথা বলছে তারা। যাক, নিরাপদ জায়গায় চলে এসেছি, টনি। ইয়োমার শেরিফ যদি আমাদের পিছু নিয়ে থাকে, গানসাইটের ট্রেইল ধরে এগোবে। ওখান থেকে কাভারড ওয়েলস বা ইন্ডিয়ান ওয়েসিসে চলে যাবে ওরা।

টনি চিডলকে ততটা নিশ্চিন্ত মনে হলো না। এটা ইয়াকি এলাকা, মনে করিয়ে দিল সে।

তোমাদের পিমাদের এই এক দোষ, নিখাদ বিরক্তি আর তাচ্ছিল্যের সুরে মন্তব্য করল এড মিচেল। ইয়াকিদের কথা শুনলেই ভয়ে হিসি করে দাও!

শ্রাগ করল চিডল। ইয়াকিদের সঙ্গে বহুবার লড়াই করেছে পিমারা, বেশিরভাগ সময় পিমারাই জিতেছে।

একই বিষয়ে তর্ক চালিয়ে যাওয়া অপছন্দ টনি চিডলের। যা বলেছে, সেটাই ওর শেষ কথা। এড মিচেল যখন পাপাগো ওয়েসে থামতে চাইছে, বেশ, আপত্তি নেই ওর। নাছোড়বান্দা টাইপের লোক ইয়োমার শেরিফ, পালিয়ে আসার আগে দীর্ঘদেহী যে-তরুণকে খুন করেছে ওরা, সম্পর্কে শেরিফের ভাতিজা হয় সে। লেজ তুলে পালানোর জন্য এই যথেষ্ট। সত্য উদ্ঘাটন করার ঠেকা পড়েনি শেরিফের, অথচ দুই তাঁদোড় দোস্তকে নিয়ে ভাতিজাই শুরু করেছিল। নাম কিনতে এসে নরকের টিকেট কিনে ফেলেছে বেয়াড়া ছেলেটা। শহরে প্রবেশ করার পর গলা ভিজাতে একটা সেলুনে ঢুকেছিল ওরা, তখনই বেহুদা ঝামেলা। অপরিচিত মানুষ দেখে পিস্তলে নিজের কারিশমা দেখানোর খায়েশ চাপে শেরিফের ভাতিজার। বয়স উনিশ হলে কী হবে, আক্কেল হয়নি ছেলেটার বা ওর বন্ধুদের।

মোষ শিকারী ছিল এড মিচেল। পোড়খাওয়া মানুষ। জীবনে বহু ঘাটের পানি খেয়েছে। এমনিতে গম্ভীর হলেও, আসলে রসিক, কৌতুকপ্রিয়। বাউই ছুরিতে দক্ষ এবং বিপজ্জনক। অন্তত পঞ্চাশবার ইন্ডিয়ানদের সঙ্গে লড়ার অভিজ্ঞতা রয়েছে মিচেলের, হাতাহাতি লড়েছে তারচেয়েও বেশি; অথচ দেখে মনে হয় নিতান্ত নিরীহ গোছের মানুষ। নিরীহই বটে, তবে কেউ ঘাটাতে এলে মোটেও ছেড়ে কথা বলে না।

দোআঁশলা টনি চিডল একসময় আর্মির স্কাউট ছিল। মাঝারি গড়নের পেটা শরীরের অধিকারী। মুখ দেখে বয়স বোঝা কঠিন। তরুণ বয়সেই অ্যাপাচি আর হুয়ালাপাইদের ঘোড়া চুরি করে দুঃসাহসী হিসাবে নাম কামিয়েছে। জীবনে চলার পথে বহু লড়াই করেছে। মিচেলের মত বয়স্ক বা অভিজ্ঞ না হলেও ত্রিশটা বসন্ত সেও পার করেছে, দেখেছে বহু মৃত্যু এবং দুর্ঘটনা। পশ্চিমে মানুষের জীবনের মূল্য কত সস্তা, জানে বলেই কখনোই ঝামেলার ফিকির করে না ওরা, অথচ ইয়োমার ছেলেগুলো শিকার হিসাবে বেছে নিয়েছিল ওদের। দু’জনের বয়স উনিশ, অন্যজন সবে কুড়ি পেরিয়েছে। মিচেল আর চিডলকে মনে করেছিল বুড়ো প্রসপেক্টর এবং নিরীহ এক ইন্ডিয়ান, এতটুকু বিপজ্জনক নয়। ভুলের মাশুলও দিয়েছে ওরা-কবরের বাসিন্দা হয়েছে শেরিফের ভাতিজা, আজীবনের জন্য একটা বাহু বাতিল হয়ে গেছে একজনের; আর তৃতীয়জন গুরুতর আহত, উপযুক্ত চিকিৎসা পেলে বেঁচে যাবে হয়তো।

কুয়ার পাশে যখন ঘোড়া থেকে নামল ওরা, উজ্জ্বল চাঁদের আলো ছড়িয়ে পড়েছে চারপাশে। তেষ্টা মিটিয়ে নীচের ঝোঁপের কাছাকাছি ক্যাম্প করল ওরা, পানির বেশি কাছে নয়, আবার দূরেও নয়। জানে যে অন্য লোকজনও আসতে পারে। আগুন না জ্বালিয়েই শুয়ে পড়ল। দু’জন। গ্যালেটা ঘাস আর টর্নিলো সীমের সদ্ব্যবহার শুরু করল ঘোড়া দুটো। ঘুমিয়ে পড়ার আগে চারপাশ ভাল করে দেখে নিল ওরা, তারপর মুখের উপর হ্যাট চাপিয়ে দিল। মোটামুটি নিশ্চিত যে পাপাগো ওয়েলসের ধারে-কাছে আসছে না কেউ।

মিচেল যা জানে না তা হচ্ছে, পাপাগো ওয়েসের কাছে বহু লোক আসে, কিন্তু ফিরে যেতে পারে না সবাই। স্পষ্ট না হলেও এমন একটা ধারণা রয়েছে দোআঁশলার, তবে যথেষ্টই বলেছে ও। ইয়াকি এলাকায় যে-কোন কিছু ঘটতে পারে। মিচেল পোড়খাওয়া মানুষ, বেশি কিছু তাকে বলা অর্থহীন।

যা ঘটার ঘটবেই, আগে থেকে হাপিত্যেশ করে লাভ নেই।

*

পাপাগো ওয়েসের দক্ষিণ-পশ্চিমে, দূর থেকে যাদের দেখেছিল এরিক ক্ৰেবেট, এরা আসলে ইয়োমা থেকে আসা পাসির সদস্য। হঠাৎ দিক বদলে উত্তরে এগোল তারা। যতটা আচমকা সিদ্ধান্ত নিয়েছে, পরিণতি ঠিক ততটাই ভয়ঙ্কর আর চরম হয়ে উঠল তাদের জন্য।

সনৈটার নির্দিষ্ট স্থানে চুরুতির সঙ্গে দেখা করার জন্য যাচ্ছিল রেনিগেড ইন্ডিয়ানদের একটা দল, দূর থেকে পাসির উপস্থিতি টের পেয়ে শুকনো ওঅশে লুকিয়ে পড়ে তারা। ওঁৎ পেতে থাকা ইন্ডিয়ানদের সামনে গিয়ে পড়ল পাসির সদস্যরা। দীর্ঘ রাইডের কারণে ক্লান্ত এরা, প্রায় সবাই স্যাডলে বসে ঢুলছে, তীব্র উত্তাপে স্বাভাবিক সতর্কবোধ হারিয়ে ফেলেছে। কোত্থেকে বিপদ এল, টেরই পেল না কেউ পয়েন্ট-ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ বলা যায়, বড়জোর চল্লিশ ফুট দূরত্ব; ইন্ডিয়ানদের আক্রমণের প্রথম তোড়ে ঝটপট চারটা স্যাড়ল, খালি হয়ে গেল। হুলস্থুল পড়ে গেল সদস্যদের মধ্যে, মুহূর্তে ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল দলটা।

ইয়োমো শেরিফের বিচক্ষণতা বা বুদ্ধিও কাজে এল না, নিজেদের সংগঠিত করতে পুরোপুরি ব্যর্থ হলো দলটা। ক্লান্তিময় তপ্ত একটা দিনের শেষ হলো করুণ ও অসহায় মৃত্যুর মাধ্যমে। রাইফেলের প্রচণ্ড গর্জনে ঘুম টুটে গেল সবার, স্যাডল থেকে খসে পড়তে দেখল সঙ্গীদের, উভ্রান্তের মত চারপাশে তাকাল কেউ কেউ। দু’জন লোককে ধাওয়া করতে এসে নিজেরা শিকার বনে গেছে, ব্যাপারটা বিশ্বাসই করতে পারল না কেউ। আধ-পোষা একটা ব্রঙ্কো রাইড করছে শেরিফ, মুহুর্মুহু গুলি হচ্ছে, আতঙ্ক আর সহজাত প্রবৃত্তি বশে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল নির্দিষ্ট কোন লক্ষ্য ছাড়াই। পরে যখন ঘোড়ার রাশ টানল সে, দেখল প্রায় চার মাইল দূরে চলে এসেছে এবং একা সে।

পিছনে ছাড়াছাড়াভাবে গোলাগুলি চলছে। আসলে কী ঘটেছে, পরিষ্কার ধারণা করতে পারেনি শেরিফ। বিহ্বল দৃষ্টিতে ঘাড় ফিরিয়ে পিছনে তাকাল। সবচেয়ে কাছে পানি রয়েছে গানসাইট ওয়েলসে, বুঝতে পারছে না ফিরে যাবে নাকি একাই চলে যাবে গানসাইটে। সামান্য ইতস্তত করার পর সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল সে, হাঁটুর গুঁতোয় ঘোড়াকে আগ বাড়াল, তখনই হুড়মুড় করে গড়িয়ে পড়ল ঘোড়াটা। মিনিট খানেকের মধ্যে শেরিফের জানা হয়ে গেল গুলি খেয়েছে পশুটা।

এবার সত্যিকার অর্থে একা হয়ে পড়ল শেরিফ। ইয়োমায় ফেলে আসা প্রিয়তমা স্ত্রীর কথা মনে পড়ল তার, হয়তো আর কখনোই দেখা হবে না! মরুভূমি সম্পর্কে অন্য দশজনের চেয়ে বেশিই জানে সে, অভিজ্ঞতা থেকে নিজের সম্ভাবনা বিচার করতে সক্ষম হলো-বেঁচে থাকার সম্ভাবনা একেবারে ক্ষীণ। কিন্তু সাহস হারাল না অভিজ্ঞ মানুষটা।

তিন বেয়াড়া তরুণের খামখেয়ালির চরম দণ্ড দিতে হলো এতগুলো লোককে! তিক্ত মনে খিস্তি করল শেরিফ, হাঁটতে শুরু করল। জীবনে সবচেয়ে কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে, জানে সে।

পরদিন, দুপুর তখন। গানসাইট থেকে বহু দূরে রয়েছে শেরিফ। হাঁটছে তো হাঁটছেই। পথ আর ফুরায় না। ক্লান্তির চরমে পৌঁছে গেছে সে। তেষ্টায় বুকের ছাতি ফেটে যাচ্ছে, ফুলে গেছে ঠোঁট, চোখ জ্বালা করছে সারাক্ষণ। তপ্ত রোদ্দুর এখন আর কোন প্রভাবই সৃষ্টি করছে না তার মধ্যে। বোধশূন্য মানুষের মত টলমূল পায়ে এগোল শেরিফ, জানে না নিজের অজান্তে পথ হারিয়েছে, গানসাইটের পথ ফেলে এসেছে পিছনে।

একসময় ধৈর্য হারাল সে। তিক্ত মনে পরাজয় মেনে নিল। হোলস্টার থেকে পিস্তল বের করে কপালে ঠেকিয়ে গুলি করল। একটার বেশি দরকার হলো না।

পুরোপুরি সফল হয়েছে ইন্ডিয়ানরা। সংখ্যায় বারোজন ছিল ওরা, অথচ আক্রমণের প্রথম তোড়ে কচুকাটা করে ফেলল। প্রথম দফায় খুন হয়ে গেল চারজন। উভ্রান্ত ও দিশেহারা সদস্যরা যখন দিগ্বিদিক ছুটছে, আরও একজন খুন হয়ে গেল। শেরিফের, মৃত্যুর খবর অবশ্য কারও জানা হলো না। বেঁচে যাওয়া বাকি ছয়জনের পাচজন ফোর্ট ইয়োমার সৈন্য, তাদের নেতৃত্ব দিচ্ছে এক অভিজ্ঞ আইরিশ সার্জেন্ট। চমক কাটিয়ে কেবল এরাই কিছুটা প্রতিরোধ গড়তে সক্ষম হলো। অগভীর একটা জায়গায় আশ্রয় নিল, পাল্টা গুলি শুরু করল ইন্ডিয়ানদের উদ্দেশে।

সুশৃঙ্খল সৈন্যদের বিরুদ্ধে লড়ার পরিকল্পনা ছিল না ইন্ডিয়ানদের, পাল্টা আক্রমণ শুরু হওয়ার একটু পরই অবস্থা বেগতিক দেখে কেটে পড়ল অ্যাপাচিরা। রেডস্কিনরা দক্ষিণে পালিয়ে যাওয়ার পর আড়াল ছেড়ে বেরিয়ে এল সার্জেন্ট টমাস হ্যালিগান, লাশের আশপাশে পড়ে থাকা অস্ত্রশস্ত্র আর পানির ক্যান্টিন সগ্রহ করল। সন্ত্রস্ত দুটো ঘোড়াকে ধরতে সক্ষম হলো সৈন্যরা, মালপত্র ওগুলোর পিঠে চাপিয়ে পশ্চিমে রওনা দিল।

পরদিন দুপুরে তাদের সঙ্গে যোগ দিল পাসির শেষ সদস্য, ইয়োমার অধিবাসী মার্ক জুগান। অ্যাপাচিদের তোপের মুখে পড়া বারোজনের মধ্যে এ ছয়জনই সৌভাগ্যবান। বাস্তবে, পাসির-মূল ছয় সদস্যের মধ্যে কেবল ডুগানই বেঁচে গেছে। সুখের খবর, সঙ্গে ঘোড়া রয়েছে তার।

টুকসন পর্যন্ত রুটের ধারে-কাছে ওঅটর হোলগুলোর অবস্থা জানার জন্য পাঠানো হয়েছিল সৈন্যদের। কাজ শেষে ইয়োমায় ফেরার পথে শেরিফের সঙ্গে দেখা হয় তাদের সঙ্গে সৈন্যরা থাকলে বাড়তি নিরাপত্তা পাবে, শেরিফের প্রস্তাবে রাজি হয়ে যায় সার্জেন্ট। কিন্তু আচমকা দিক পরিবর্তন করে উত্তরে এগিয়েছে বলেই যে চরম মূল্য দিতে হলো, সবার আগে স্বীকার করতে হবে সার্জেন্ট টমাস হ্যালিগানকে।

নাজুক পরিস্থিতি। যত শীঘ্রি সম্ভব ইন্ডিয়ান রেইডের খবর রিপোর্ট করা সার্জেন্টের দায়িত্ব, কিন্তু কাউকে একটা ঘোড়া দিয়ে পাঠানো সম্ভব নয় এখন। এ-মুহূর্তে সবার জীবন নির্ভর করছে ঘোড়া, অ্যামুনিশন আর ক্যান্টিনের উপর। মানুষ ছয়জন, অথচ ঘোড়া মাত্র তিনটা। একটার পিঠে অস্ত্রশস্ত্র এবং ক্যান্টিন রেখেছে, অন্য দুটোয় পালাক্রমে চড়ছে সবাই। পাপাগো ওয়েসে যদি পৌঁছতে পারে, তা হলে হয়তো বেঁচে যাবে অসহায় মানুষগুলো।

পাপাগোতে পৌঁছতে পারলে, বিশ্রাম নেওয়া যাবে। জায়গাটা নিরাপদ পানির চাহিদা মিটবে, ক্যান্টিনও ভরে নিতে পারবে। তারপর ইয়োমায় যাত্রার চিন্তা করা যাবে। যাত্রার সবচেয়ে খারাপ অংশটা সামনে-পাপাগো ওয়েলস, আর এখানকার পথটুকু। ইন্ডিয়ানরা ফিরে আসতে পারে আবার। হয়তো দলে আরও ভারী হয়ে আসবে। হ্যালিগানের ধারণা যারা ওদের আক্রমণ করেছিল, শুধু এরাই নয়, বরং নরকে আরও কয়েকটা ছোট ছোট দল রয়েছে চৌহদ্দিতে।

এভাবে, বিভিন্ন দিক থেকে পাপাগো ওয়েলসের উদ্দেশে এগোতে থাকল কয়েকটা দল। কেউ পায়ে হেঁটে, কেউ ঘোড়ায় চড়ে। সাধারণ অথচ অনিবার্য একটা চাহিদা একই গন্তব্যমুখী করেছে, তাদের-পানি।

*

কিপ্রিয়ানো ওয়েল। অঘোরে ঘুমাচ্ছে ইন্ডিয়ানরা। ভরপেট খাওয়া, তারও আগে কয়েকদিন প্রায় অনাহারে কাটানো…আপাতত খানিকটা আয়েশ করা যেতেই পারে। মিমি রজার্স সম্পর্কে প্রায় ভুলে গেছে সবাই। ঘুণাক্ষরেও ভাবেনি ভয়ে সিঁটিয়ে যাওয়া মেয়েটা পালানোর দুঃসাহস করে বসেছে।

পিছনে বাঁধা মিমির হাত। কষে বেঁধেছে ইন্ডিয়ানরা। টেনে-টুনে পরখ করেছে, খোলা সম্ভব নয়। একটা ঘণ্টা ঠায় বসে ছিল ও, তবে শরীর বেকার থাকলেও মাথাটাকে খাটিয়েছে-পরিকল্পনা করেছে। বাঁধন খোলার বুদ্ধি পেয়ে গেছে ও। ইন্ডিয়ানদের নিঃসাড়ে ঘুমাতে দেখে সক্রিয় হলো এবার।

দু’হাত কোমরের কাছে নিয়ে এল ও। ভাগ্যিস, বয়সের তুলনায় শীর্ণ আর ক্ষীণকায় ও, একটু চেষ্টা করতে কোমর ছাড়িয়ে পশ্চাদ্ভাগ পেরিয়ে হাঁটুর পিছনে চলে গেল দড়িতে বাঁধা দু’হাত। আড়ষ্ট একটা অবস্থান, ঢলে পড়ে যাওয়ার অবস্থা। কিন্তু দুই হাঁটু ভাঁজ করে একেবারে চিবুকের কাছে তুলে ফেলল মিমি। বাহু আর হাতের তৈরি চক্রে গলিয়ে দিল গোড়ালিতে বাঁধা জোড়া পা। সামনে চলে এল দু’হাত। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল মিমি, দেরি না করে মুখের সামনে তুলে ধরল হাত দুটো। র-হাইডের গেরোতে দাঁত বসিয়ে কাজ শুরু করল।

ঘণ্টাখানেকের ক্লান্তিকর ও উদ্বিগ্ন চেষ্টার পর মুক্ত হলো হাত দুটো। পায়ের বাঁধন খুলতে আরও আধ-ঘণ্টা লাগল। সন্তর্পণে উঠে দাঁড়াল ও, পা টিপে টিপে সরে এল ক্যাম্পের এক পাশে। একটা ঘোড়া দখল করার চিন্তা মাথায় এলেও সঙ্গে সঙ্গে বাতিল করে দিল। সাদা মানুষের গন্ধ পেলে ভড়কে যাবে পনিগুলো। অস্বাভাবিক শব্দে জেগে যাবে ইন্ডিয়ানরা। তারচেয়ে বরং পায়ে হেঁটে যাওয়াই মঙ্গল। একটা পানির ব্যাগ নিতে যা দেরি, তারপরই রওনা দিল মিমি। প্রথমে সন্তর্পণে, শেষে প্রায় পা চালিয়ে এগোল। চাপ চাপ অন্ধকার আড়াল দিল ওকে।

এই বসন্তে ষোলো হবে মিমির-জনমদুঃখীই বলা যায় ওকে। ওর জীবনে ভালবাসা, মায়া বা সহানুভূতির পরিমাণ যতটা, তারচেয়ে একাকীত্ব আর কঠিন শ্রমের অংশই বেশি। বছরের পর বছর কেটে গেছে অসম্ভবের প্রতীক্ষা করে…ভেবেছে হয়তো কোন একদিন ভাগ্য বদলে যাবে ওর। মিথ্যে আশা। কিন্তু এ থেকে অর্জনও হয়েছে। স্বপ্ন সবসময়ই প্রেরণা দেয় মানুষকে। মিমি রজার্স তাই অনুভব করছে এখন, কোত্থেকে মনের জোর পেয়েছে জানা নেই, কিন্তু এই চালিকা শক্তি ত্রাণকর্তা হয়ে এসেছে ওর জন্য।

আত্মবিশ্বাসী, নিঃসঙ্কোচ পায়ে বিস্তীর্ণ মরুভূমি ধরে এগিয়ে চলল মিমি রজার্স, মনে এতটুকু ভয় বা সংশয় নেই।

<

Super User