আস্তে আস্তে পুর্ব থেকে পশ্চিমে পাড়ি দিলো সূর্য, তারপর এক সময় পাহাড় সারির আড়ালে হারিয়ে গেল। গোধূলির রঙ লাগলো তাকাশে, সারাদিনের দুঃসহ গরম থেকে নিস্তার পাওয়া গেল। অন্ধকার আরো গাঢ় হওয়ার অপেক্ষায় রইলো কলিন ফোর্বস। ওয়াগোনারের উপকণ্ঠে স্টোনি রিভারের তীরে গাছপালার মাঝে ঘুরে ফিরে বিকেলটা পার করে দিয়েছে ও। আর কিছুক্ষণ পর শহরের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়বে, অ্যারন হোরের সঙ্গে দেখা করতে হবে।

পাইপে আবার তামাক ভরলো কলিন, আগুন জ্বেলে ফের বিচার করতে বসলো রেডফিলডের বক্তব্য। রেডফিলডের কথা থেকে যত দুর বোঝা যায় : বছর দুয়েক আগে ওয়ারেন নামে এক লোক স্টোনি বিভার বেসিনে হাজির হয়, ম্যাকমিলান র‍্যাঞ্চটা কিনে নেয় সে, এখানে পা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে ড্যানিয়েল ফোর্বসের সাথে তার বিরোধ জন্ম নেয়। ক্লেব্যাংকসের ওপর থেকে ওয়ারেনের গরুর পাল স্ট্যামপিড করার অভিযোগ থেকে বোঝা যায় ইদানীং ওদের রেষারেষি তুঙ্গে পৌছে গিয়েছিলো। আনুষ্ঠানিকভাবে আইনের শরণাপন্ন হয়েছে ওয়ারেন, শেরিফকে সঙ্গে নিয়ে ফোর্বস র‍্যাঞ্চে গেছে। র‍্যাঞ্চে সংঘটিত সংঘর্ষে এডি আর ড্যানিয়েল ফোর্বস প্রাণ হারিয়েছে।

রেডফিলডের কাহিনীতে দুটো বড় ধরনের ফাঁক ধরা পড়েছে কলিন ফোর্বসের চোখে। বাবার সাথে কারো বিরোধ দেখা দিলে সামনাসামনি তার ফয়সালা করার কথা, প্রতিশোধ স্পৃহায় প্রতি পক্ষের পোষা জানোয়ার হত্যা করার মতো নৃশংস কাপুরুষ নয় বাবা। আইনের কতৃত্ব ত স্বীকার করাও বাবার চরিত্রের সঙ্গে খাপ খায় না। বরং ড্যানিয়েল ফোর্বসের সক্রিয় সহযোগিতায়ই স্টোনি রিভার বেসিনে আইন-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

পাইপ নিভে গেছে কলিনের। আবার ধরিয়ে কিছুক্ষণ পাইপ টানলো ও, তারপর উঠে দাঁড়িয়ে আড়মোড়া ভাঙলল, জমাট অন্ধ কারে চোখ কুঁচকে তাকালো ওয়াগোনারের দিকে। এবার এগোনো যায়, ভাবলো, যথেষ্ট অন্ধকার হয়েছে। ঘোড়ার পিঠে জিন চাপিয়ে উঠে বসলো, তারপর গাছপালার আড়ালে আড়ালে নদীর উজানে সামনে এগোলো।

ওয়াগোনারের কাছাকাছি পৌছে আড়াল ছেড়ে বেরিয়ে এলো কলিন ফোর্বস। ঘুটঘুটে অন্ধকার চারপাশে, সামনের ঘরবাড়ির সারি আলাদা করে চেনা দায়। হঠাৎ কোত্থেকে ছুটে এলো একটা কুকুর, খেকিয়ে উঠলো ওর উদ্দেশে, আরো একটা স্বজাতি এসে যোগ দিলে ওটার সঙ্গে। কিন্তু ওদের তীক্ষ্ণ চিৎকার সন্ধ্যার জমাট অন্ধ কারে কাউকে কৌতূহলী করে তুললো না দেখে স্বস্তি বোধ করলো কলিন।

যদ্দূর মনে আছে, শহরের নদী তীরের অংশে প্রধান সড়ক থেকে সামান্য ভেতরে অ্যারন হেলারের বিশাল অথচ বিবর্ণ দালান। বাড়িটা খুঁজে বের করতে কষ্ট হলো না কলিনের। পর্দা টানানো জানালায় আলোর আভাস দেখতে পেয়ে স্যাডল থেকে নেমে পড়লো ও, হিচিং পোস্টে বাঁধলো ঘোড়াটা। এক মুহূর্ত পর হেলারের দরজায় টোকা দিতে দেখা গেল ওকে।

কলিনের স্মৃতিতে অ্যারন হেলার লম্বা মানুষ, হালকা পাতলা গড়ন, সামান্য কুঁজো; পুর থেকে এখানে এসেছে সে। কথা বলার সময় অদ্ভুত এক রকম খসখসে শব্দ বেরোয় গলা থেকে; অমায়িক, তাই তার বন্ধু আর শুভাকাঙ্ক্ষীর সংখ্যা প্রচুর। দরজা খুলে দাড়ালো অ্যারন হেলার, আগের মতোই লম্বা এবং কুজো, কিন্তু তারুণ্য বিদায় নিয়েছে অবয়ব থেকে, গালের চামড়া যেন লেপ্টে গেছে চোয়ালের হাড়ে, চোখজোড়া কোটরাগত, বিলোপের পথে মাথার চুল।

        কি চাই? জানতে চাইলে হেলার, কণ্ঠে বিরক্তি।

আমি কলিন ফোর্বস।

ঝট করে সোজা হয়ে দাড়ালো অরিন হেলার, এক পা পিছিয়ে গেল সে, ঢোক গিলে বললো, ফোর্বস! পরমূহুর্তে আবার জানতে চাইলো, তুমি এসেছো কেউ জানে? এখানে আসতে দেখেছে কেউ?

বোধ হয় না, বললো কলিন।

এসো, ভেতরে এসো। দরজাটা আটকে দাও।

ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করলে কলিন ফোর্বস, বুঝতে পারছে ওর আগমন ভালো চোখে দেখছে না হেলার। কেন কে জানে শঙ্কিত হয়ে পড়েছে।

আমার চিঠি পাওনি? জানতে চাইলে অ্যাটর্নি।

পেয়েছি, জবাব দিলো কলিন।

তাহলে ফিরে এলে কেন? কোনো দরকার ছিলো?

না এসে উপায় ছিলো না।

এখনো আগের মতোই আছো? বাপের মতোই বদরাগী।

অনেক সময় বদরাগী না হলে চলে না, বললো কলিন, এবার বোধ হয় তার সময় এসেছে। আচ্ছা, কার ভয়ে কুকড়ে রয়েছো তুমি, ভূতের?

হাড়সর্বস্ব হাত দুটো কচলালে অ্যাটর্নি। না, রবার্ট ওয়ারেন আর ওর সাঙ্গপাঙ্গরা ভূত-পেত্নী নয়, দানব। বেসিনে কয়েক দিন থাকলেই ওদের পরিচয় জানতে পারবে। কিন্তু এখানে থাকা তোমার জন্যে ঠিক হবে না। বরং দেরি না করে যত তাড়াতাড়ি পারো সরে পড়ো, বুদ্ধিমানের কাজ হবে। তোমার র‍্যাঞ্চ বিক্রির দায়িত্ব আমার হাতে ছেড়ে দাও, মোটামুটি ভালো দাম আদায়ের চেষ্টা করবো। আমি, টাকাটা হাতে পেলে মনে করবে মহা বাঁচা বেঁচে গেছে। চিঠিতেই তো এখানে আসতে নিষেধ করেছিলাম তোমাকে, বুঝতে পারেনি?

তোমার লেখার ঢঙ এমন ছিলো যে না এসে থাকতে পারিনি।

কি বোকার মতো কথা বলছো!

নিজেই আবার পড়ে দেখে চিঠিটা।

পকেট থেকে বের করে বাড়িয়ে ধরলো কলিন চিঠিটা। মাথা নাড়লো হেলার।

থাক, আর পড়তে হবে না, বললো সে, এসে তো গেছো, এখন কি করার কথা ভাবছো তুমি?

র‍্যাঞ্চ চালাবো!

অসম্ভব!

কেন?

এক কথায় তোমার প্রশ্নের জবাব দেয়া যায় : ওয়ারেনের জন্যে।

ওয়ারেন আমাকে ঠেকাবে কিভাবে?

বুলেট, ফোর্বস, সে নিজের হাতে গুলি করবে কিংবা আর কাউকে দিয়ে সারবে কাজটা। ছেলের জন্যে তোমাদের র‍্যাঞ্চটা দরকার তার, সেদিন আমার কাছে কেনার কথা তুলেছে। তাই বলে তুমি আবার ভেবে বসে না যেন রাঞ্চের জন্যেই তোমার বাবার সাথে লড়াইতে নেমেছে সে। ওদের বিবাদের কারণ সম্পূর্ণ ভিন্ন। আমায় মনে হয় না ড্যানিয়েলের সঙ্গে লড়াইয়ের সময় তোমাদের র‍্যাঞ্চ নেবার কথা ভেবেছে সে। কিন্তু এখন প্রায় পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে হয়তো কাজে লাগাতে চাইছে ওটা। ওর ছেলেটা বুনো, খামখেয়ালী স্বভাবের, বলগাহীন ঘোড়া একটা; র‍্যাঞ্চিং ওর কাজ নয়, তবু হয়তো চেষ্টা করে দেখতে চায় ওয়ারেন, ছেলেটাকে যদি পোষ মানানো যায়।

ঘাড় ফিরিয়ে কামরার চারপাশে নজর বোলালো কলিন ফোর্বস। ছোট এবং অগোছালো, একপাশে একটা টেবিলে কাগজ আর বইয়ের ছড়াছড়ি।

বসো, ফোর্বস, বললো হেলার, অস্থির হবার কিছু নেই। সন্ধ্যায় সাধারণত আমার কাছে কেউ আসে না।

মাথা নাড়লো কলিন। ওয়ারেন সম্পর্কে বলো আমায়।

এগিয়ে গিয়ে একটা চেয়ার টেনে বসে পড়লো অ্যাটর্নি, পায়ের ওপর পা তুলে দিলো। লণ্ঠনের ম্লান হলদে আলো ওর চেহারায় একটা রোগা ভাব এনে দিয়েছে।

ওয়ারেন সম্পর্কে জানতে চাও? কোত্থেকে শুরু করি? একজন মানুষের পক্ষে আরেকজন মানুষকে মূল্যায়ন করা কি সহজ? কাউকে যখন আমাদের ভালো লাগে আমরা তার ভালো দিকগুলোই সব সময় লক্ষ্য করি, অপছন্দ করলে তার সব আচরণই বাঁকা চোখে দেখি; আর যখন কারো ব্যাপারে নিরাসক্ত থাকি, সেক্ষেত্রে তার সম্পর্কে দায়সারা গোছের এমন কিছু বলি যেটা ভালো বা খারাপ কিছুই বোঝায় না। ওয়ারেন সম্পর্কে আমি তোমাকে অনেক কথাই বলতে পারি, কিন্তু তা কতখানি বিশ্বাস্য তোমাকেই বুঝে নিতে হবে। তবে এটা ঠিক, যথা সম্ভব সত্যির কাছাকাছি থাকার চেষ্টা করবো আমি।

শুরু করো, বললো কলিন।

মাথা দোলালো হেলার। ওয়ারেনের বয়স আন্দাজ চল্লিশ বছর, বিশাল শরীর ওর, চওড়া কাধ, স্বাস্থ্যবান; প্রচণ্ড শক্তিশালী এবং নিজের শক্তি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। অহঙ্কারী লোক। ভারি গলায় কথা বলে, যখন কাউকে নির্দেশ দেয়, মনে হয় ঝগড়া করছে। ওর হাবভাবে একটা রাজকীয় ভাব আছে, উদ্ধত; দুর্বল লোককে একেবারেই সহ্য করতে পারে না। টেকসাস থেকে কলোরাডো হয়ে এখানে এসেছে ওয়ারেন, বংশপরম্পরায় র্যাঞ্চিং ব্যবসা করে আসছে ওরা, র‍্যাঞ্চিং কিভাবে করতে হয় জানে। প্রচুর টাকা নিয়ে এখানে এসেছে সে, আসামাত্র ম্যাকমিলানের র‍্যাঞ্চটা কিনে নিয়েছে, তারপর খবর পাঠিয়ে লোকজন এনেছে; এখন যারা ওর র্যাঞ্চে কাজ করছে বেশির ভাগই পুরোনো লোক। কঠিন একটা দল, সবাই মদ্যপ, কাউকে পরেরয়া করে না। কোমরে ঝোলানো পিস্তল চালানো কিংবা গরু চরানো-দুটোতেই ওস্তাদ। এবং চমৎকার কাজ দেখাচ্ছে ওরা। বুড়ো ম্যাকমিলান-এর র‍্যাঞ্চ থেকে এখন প্রচুর টাকা মুনাফা করছে ওয়ারেন, অথচ ম্যাকমিলান কখনো লাভের মুখ দেখেনি।

কিন্তু চিঠিতে তুমি লিখেছে বাজার খুব মন্দা।

ঠিক, কিন্তু ওয়ারেন ঝানু ব্যবসায়ী। বাস্তববাদী লোক এবং দক্ষ। কোনো বাধাই তার কাছে বাধা নয়।

আর ওর ছেলে?

বিল ওয়ারেন, দীর্ঘদেহী, সুদর্শন এবং দারুণ মেয়ে ঘেষা, মেয়ে দেখলেই বেসামাল হয়ে যায়।

র‍্যাঞ্চ চালাতে পারবে?

আগেই বলেছি সেটা ওকে দিয়ে হবার নয়, তবে বাপ ওকে সাহায্য করতে পারতেও পারে।

ওয়ারেনের স্ত্রী?

নীল নকশা

এখানে বিপত্নীক অবস্থায় এসেছিলো ওয়ারেন। কিন্তু বছর খানেক আগে একবার ক্যানসাস সিটিতে গিয়েছিলো সে, ওখানে বিয়ে করে সস্ত্রীক ফিরে আসে। ওয়ারেনের তুলনায় মেয়েটার বয়স অনেক কম, বড়জোর তিরিশ। দীর্ঘ একহারা গড়ন, সুন্দরী এবং আমার বুঝতে ভুল না হয়ে থাকলে ভীষণ অসুখী।

কেন?

কে জানে! তবে আন্দাজ করতে পারি। যে কোনো বিচারেই ক্যানসাস সিটির তুলনায় ওয়াগোনার তুচ্ছ, এখানে এই মেয়েকে সন্তুষ্ট করার উপকরণ কই? তাছাড়া ওয়ারেন সবসময় এত ব্যস্ত থাকে, স্ত্রীকে সময়ই দিতে পারে না। মেয়েটাকে অবশ্য কালেভদ্রে শহরে নিয়ে আসে, ওই পর্যন্তই।

কি নাম তার?

লিনডা।

লিনডা? পুরো নাম? ক্যানসাস সিটিতে লিনডা ওয়াইলড নামে একটা মেয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিলো।

পুরো নাম জানি না, তবে ওর বাবা শুনেছি ক্যানসাস সিটির হোমড়া-চোমরাদের একজন।

সিনডিকেটের কাজ নিয়ে বছর দুই আগে ক্যানসাস সিটিতে গিয়েছিলো কলিন। ওখানে লিনডা ওয়াইলড নামে একটা মেয়েকে বিপদ থেকে বাঁচায়। ওর বাবাও ক্যানসাস সিটির একজন ব্যবসায়ী, বিরাট ধনী। সেই লিনডাইকি ওয়ারেনের স্ত্রী এখন? কিন্তু কিভাবে তা সম্ভব? লিনডার বাবা রবার্ট ওয়ারেনের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিতে যাবে কেন?

চিন্তিত চেহারায় মাথা দোলালো কলিন।

বাবার সঙ্গে রবার্ট ওয়ারেনের রেষারেষির আসল কারণটা কি?

উপত্যকায় একটা সমিতি গঠনের প্রস্তাব তুলেছিলো ওয়ারেন, সে থেকেই বিরোধের সূত্রপাত। সমিতি করার প্রস্তাব গৃহীত হলে রবার্ট ওয়ারেনের হাতেই সব ক্ষমতা চলে যেতো, সে-ই সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করতে পারতো। তোমার বাবা সঙ্গে সঙ্গে নাকচ করে দেয় প্রস্তাবটা। ড্যানিয়েল ফোর্বস ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদে বিশ্বাস করতো। নিজের গরু সবসময় নিজেই বাজারে চালানের ব্যবস্থা করেছে ও। ওয়ারেনের ইশারায় চলবে এমন কোনো সমিতির হাতে সেই কাজ তুলে দেবে তোমার বাবা, চিন্তার বাইরে। কিন্তু ওটা ছিলো মতা নৈক্যের কেবল শুরু। এরপর প্রায় সব ব্যাপারেই ওদের দ্বিমত পোষণ করতে দেখা গেছে, রাজনীতি, র‍্যাঞ্চের সীমানা ঘেষে বয়ে যাওয়া ইনডিয়ান ক্রীকের পানি ভাগাভাগি, রেনজে বেড়া দেয়া কোনো কিছুই বাদ যায়নি। ওয়ারেন যখনই কিছু বলেছে তার বিরোধিতা করেছে তোমার বাবা। ড্যানিয়েল ফোর্বস তো নগণ্য কেউ নয় যে তাকে উপেক্ষা করা যায়। কিন্তু ওয়ারেন আর শেষ পর্যন্ত পদে পদে এই বিপর্যয় মেনে নিতে পারেনি। ড্যানিয়েল ফোর্বসকে ধ্বংস করা ছাড়া তার কোনো উপায় ছিলো না এবং সেটাই ঘটেছে।

স্ট্যামপিড এম্পর্কে বলল এবার।

মাস খানেক আগের কথা, হঠাৎ একদিন ওয়ারেনের প্রায় পনেরো শে গরুর একটা বিশাল পাল নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। পাহাড় থেকে নেমে আসার পথে স্টোনি ক্রীক যেখানটায় বাঁক নিয়েছে সেখানে বেসিনের পুব প্রান্তের দিকে উঁচু একটা মাঠে চরছিলো গরুগুলো তোমার নিশ্চয়ই মনে আছে, নদীটা ওখানে কতখানি ভীব, সেজন্যে ক্লেব্যাংসের ওপর নদীর কিনারে বেড়া দিয়ে ঘেরারও ব্যবস্থা করেছিলো ওয়ারেন। কিন্তু একরাতে কে বা কারা সেই বেড়া কেটে ছত্রভঙ্গ করে দিলো গরুর পাল, অত উঁচু থেকে নিচে পড়ায় একটা গরুও বাঁচেনি। তোমার বাবা আর ভাইয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলে ওয়ারেন, ওদের নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করায়। তারপর শেরিফ আর স্থানীয় লোকদের সহায়তায় সদলে তোমাদের র্যাঞ্চে গিয়ে হাজির হয় সে। গ্রেপ্তারে তোমার বাবা বাধা দেয়ায় সংঘর্ষ বেধে যায়। লড়াইয়ে সে রাতেই মারা যায় তোমার ভাই, মারাত্মকভাবে আহত হয় ড্যানিয়েল, শেষ পর্যন্ত ওকে বাঁচানো যায়নি।

চার্লস রেডফিলডের কাছে শুনলাম বাবা নাকি প্যসিকে র‍্যাঞ্চ ত্যাগ করার হুকুম করেছিলো?

হ্যাঁ, আমিও তাই শুনেছি।

কিন্তু, হেলার, বাবা তো এরকম কিছু বলতে পারে না! অতীতে কোনো সময় বাবা আইনের বিরুদ্ধে যায়নি। গরুর পাল ছত্রভঙ্গ করার অভিযোগও আমি বিশ্বাস করি না। বাবার চরিত্রের সঙ্গে কোনোটাই মেলে না।

তোমার বাবা তো অস্বীকারও করেনি।

সেটা তুমি কি করে জানলে?

লোকজনের কথায় সেরকমই মনে হয়।

লড়াইয়ের সময় আমাদের লোকেরা কোথায় ছিলো?

র‍্যাঞ্চেই ছিলো প্রায় সবাই। ওদের দুজন লড়াইতে মারা যায়। লড়াইয়ের পর আত্মসমর্পণকারীদের শহরে নিয়ে আসা হয়, কয়েক দিন জেলে আটক ছিলো ওরা। তারপর বেসিন ছেড়ে চলে যাবে কথা দেয়ায় ছেড়ে দেয়া হয়। ওয়ারেনের মাথা থেকেই বেরিয়েছে বুদ্ধিটা। চমৎকার চাল, এর ফলে সবার চোখে ওর একটা ভালো ইমেজ গড়ে উঠেছে। সে ঝামেলা করতে চায় না–এটাই সবাইকে বোঝাতে চেয়েছে ওয়ারেন। শত্রু হিসেবে ওয়ারেন সাধারণ কেউ নয়, ফোর্বস, জীবনের বিনিময়ে তা জেনে গেছে তোমার বাবা।

ঘরময় পায়চারি করতে লাগলো কলিন ফোর্বস। আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে উপত্যকার পরিস্থিতি সম্পর্কে ঠিক বিবরণই ওকে দিয়েছে, অ্যাটিনি, এখানে থেকে র‍্যাঞ্চিংয়ের চেষ্টা করলে কি পরিণতি হতে পরে তারও আভাস মেলে ওর কথায়। কিন্তু হেলারের বক্তব্যে কোথায় যেন একটা ফাঁক থেকে যাচ্ছে। এডি আর বাবা ওয়ারেনের গরু স্ট্যামপিড করতে পারে ভাবাই যায় না। বাবা তেমন মানুষই নয়। ড্যানিয়েল ফোর্বসের লড়াইয়ের কৌশল অমন হতে পারে না। অবশ্য অভিযোগ যদি ভিত্তিহীন হয়, সেক্ষেত্রে গ্রেপ্তারে বাধা দেয়াই ওর পক্ষে স্বাভাবিক। বাবার যদি মনে হয়ে থাকে যে প্যসি আইনের প্রতিনিধিত্ব করছে না বা আইন রবার্ট ওয়ারেনের ইচ্ছেয় চলছে, সন্দেহ নেই পরিণাম চিন্তা না করেই অস্ত্র তুলে নেবে।

ভালো করে খোঁজ নিয়ে দেখতে হবে ওকে, ভাবলে কলিন। বাবার ঘনিষ্ঠ কারো সাথে কথা বলতে হবে। ডাক্তার মারভিনের কাছ থেকে হয়তো সাহায্য মিলতে পারে। মৃত্যুর আগে জ্ঞান ফিরে পেয়ে হয়তো ওর উদ্দেশে কোনো বার্তা রেখে গেছে বাবা।

আঙুল তুলে কলিনের দিকে ইঙ্গিত করলে অ্যারন হেলার। এখন, ফোর্বস, আস্তে আস্তে বললল সে, ছেলের জন্যে তোমাদের র্যাঞ্চটা কিনতে চাইছে রবার্ট ওয়ারেন। তুমি যদি নিজেই র্যাঞ্চ চালাতে যাও, কিছুতেই মানতে চাইবে না সে। এবং তোমাকে সরিয়ে দেয়া ওর জন্যে কঠিন কিছু নয়

একথা বলার মানে?

মানে খুব সহজ। আজ থেকে আট বছর আগে এখানে একটা গানফাইটে জড়িয়ে পড়েছিলে তুমি, সেবার একজন প্রাণ হারিয়ে ছিলো তোমার হাতে, এরপর বেসিন থেকে পালিয়ে গেছে তুমি–অন্তত সবাই তাই জানে।

ওই লোকের অনেক বন্ধুবান্ধব ছিলো। বাবা ভাবলো—

নিশ্চয়ই। ড্যানিয়েলই তোমাকে পালিয়ে যাবার পরামর্শ দিয়ে ছিলো, নইলে লোকটার কোনো বন্ধুর সঙ্গে গানফাইটে নৈপুণ্যের পরিচয় দিতে হতো সেজন্যেই পালাতে হয়েছে তোমাকে। সম্ভবত এরপর আর কাউকে প্রাণ দিতে হয়নি তোমার হাতে, হতে পারে ঝামেলাহীন ভাবে কাটিয়ে দিয়েছে আটটি বছর, কিন্তু মানুষ হত্যা করেই এখান থেকে পালিয়েছিলে তুমি–এটা ভোলেনি কেউ। সুতরাং উপত্যকাবাসীদের সহজেই বোঝানো যাবে যে বাবার মৃত্যুর বদলা নিতেই তুমি বেসিনে ফিরে এসেছে। ফলে ওয়ারেনের সহজ শিকারে পরিণত হবে। ক্রমাগত উত্যক্ত করে লড়াইতে নামতে বাধ্য করে অনায়াসে তোমাকে হত্যা করতে পারবে ওরা। এবং শেষে তোমাকেই দায়ী করবে লোকে, তাই নয় কি? তোমার পক্ষে কথা বলার কেউ থাকবে না।

ব্যাপারটা আসলেই এরকম?

হ্যাঁ। তোমার কোনো সুযোগই নেই।

তোমার কথা আমাকে আগ্রহী করে তুলছে।

মরণ যদি আগ্রহ জন্মানোর মতো কিছু হয়…

এলোচুলে হাত চালালে কলিন ফোর্বস, বললো, স্ট্যামপিড সম্পর্কে আমাকে বিস্তারিত জানতে হবে, হেলার। এখন ডাক্তার মারভিনের সাথে দেখা করতে যাচ্ছি আমি। মৃত্যুর আগে ডাক্তার কে হয়তো কিছু বলে গেছে বাবা। এদিকে আমার হয়ে কয়েকটা কাজ করতে হবে তোমাকে।

কি রকম?

এক, ওয়ারেনকে বলবে, ফোর্বস র‍্যাঞ্চ আমি বিক্রি করবে। না। ওকে জানিয়ে দেবে, আমি ফিরে এসেছি এবং নিজেই র‍্যাঞ্চটা চালাবে।

ও তা মানবে না।

তাতে আমার বয়ে গেল। আর হ্যাঁ, টাকা পয়সার ব্যাপারে কিছু জানো? বাবার ব্যাংকে জমা কত? তোলা যাবে?

সম্পত্তির একটা নিষ্পত্তি না হলে তোমার বাবার অ্যাকাউনটে হাত দেয়া যাবে না, তবে খুব যদি দরকার থাকে, আমার কাছ থেকে ধার হিসেবে নিতে পারো।

তোমার কাছ থেকে? কেন?

প্রশ্ন করো না, কলিন। টাকাটা জানি গচ্চা যাবে, খরচ করার জন্যে বেঁচে থাকবে না তুমি।

থাকতেও পারি।

অসম্ভব, ভুরু কুচকে বললো হেলার, যদি না সমস্যার মুলে আঘাত হানতে পারো।

ওয়ারেনের কথা বলছো?

নয়তো কার? ওয়ারেনের অনুপস্থিতিতে ওর দল ছিন্নভিন্ন হয়ে। যাবে।

         অ্যাটর্নির দিকে চিন্তিত চেহারায় তাকালো কলিন। লোকটার উদ্দেশ্য যেন ক্রমশ পরিষ্কার হয়ে আসছে। কারণটা যাই হোক, ওয়ারেনের বিনাশ চায় হেলার। ওর চিঠি আর এখন টাকা ধার দেয়ার প্রস্তাব, এসব তারই ইঙ্গিত দেয়।

আমি আমার মতো কাজ করতে চাই, গম্ভীর কণ্ঠে বললো কলিন।

তবে বোকার মতো কিছু করো না। এবার বলো কত টাকা দর কার?

এখনই লাগবে, তা বলিনি। তবে লাগতে পারে।

যখনই লাগবে, বলো। এখন তো ডাক্তার মারভিনের কাছে যাবে বললে, তারপর?

জানি না। র‍্যাঞ্চে কেউ আছে?

আদালত থেকে একজন কেয়ার টেকার নিয়োগ করা হয়েছে। ডার্ক পিট, লোকটা—

হঠাৎ দরজায় টোকার শব্দ হলো, থেমে গেল হেলার, দ্রুত এক পলক তাকালো দরজার দিকে উঠে দাড়ালে চট করে। রান্না ঘরে চলে যাও, তুমি, ফিসফিস করে বললো কলিনকে।

না, আমি চলে যাচ্ছি, জবাব দিলো ফোর্বস। পরে দেখা হবে, হেলার।

আবার টোকা পড়লো দরজায়, অস্থির।

আসছি। বিরক্তির সঙ্গে বললো হেলার। এক মিনিট।

দরজার দিকে পা বাড়ালো সে।

রান্নাঘর হয়ে বাইরে চলে এলো কলিন। বাইরে পা রাখার আগমুহূর্তে ফ্রণ্টরুম থেকে ভেসে আসা সমবেত কণ্ঠস্বরকানে লাগলো, কিন্তু একটা শব্দও বুঝতে পারলো না ও। উঠোনে এসে দালানের পেছন দেয়ালের অন্ধকার ছায়ায় দাড়িয়ে পড়লো। ইতিমধ্যে হয়তো ওর প্রত্যাবর্তনের খবর ওয়ারেনের কানে পৌঁছে গেছে, ভাবলে ও। বেডফিলড যদি খবরটা দিয়ে থাকে, তাহলে এটাও নিশ্চয়ই বলেছে যে ওকে ওয়গোনারের দিকেই আসতে দেখা গেছে। ওকে ধরার জন্যে লোক পাঠিয়ে দিতে পারে ওয়ারেন।

চারপাশের অন্ধকারে নজর বোলালো কলিন, কোনো নড়াচড়া ধরা পড়লো না। চোখে। উঠোন পেরিয়ে পাশের বাড়ির আড়ালে আড়ালে ঘুরপথে প্রধান সড়কের দিকে এগোলো ও। শহরের অপর প্রান্তে ডাক্তার মারভিনের বাড়ি। হেলারের বাড়ির সামনে রয়ে গৈছে ওর ঘোড়াটা, অপ্রত্যাশিত কোনো বিপদ না ঘটলে পরে এসে নেয়া যাবে। আপাতত পায়ে হেঁটে যাওয়াই ভালো, অযথা উৎকণ্ঠায় ভুগতে হবে না।

পাঁচ মিনিট পর ফীড স্টোর আর স্যাডল শপের মাঝখানের গলি পথ থেকে বেরিয়ে রাস্তা অতিক্রম করলে কলিন ফোর্বস। হোটেলের বারান্দায় কয়েকজন লোক জটলা করছে, রিভার বেনড স্যালুনের সামনে আরেক দল। ওদের চোখে ধরা পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করলো কলিন। কিন্তু অন্ধকারে ওকে আলাদা করে চেনা যাবার কথা নয়। আরো দুমিনিট পর ডাক্তার মারভিনের বাড়ির বারান্দায় পৌঁছুলে কলিন, টোকা দিলে দরজায়।

<

Super User