দুদিন পর রৌদ্রোজ্জ্বল এক দুপুরে জেরেমি টাউনে পৌঁছল দলটা।

পাহাড়ের কোলে গড়ে উঠেছে শহরটা। একপাশে পাহাড় থেকে নেমে আসা নদী মাইল খানেক দূরে উজানে গিয়ে পড়েছে, দুই তীরে গড়ে উঠেছে জীর্ণ শ্যাক আর তাড়াহুড়ো করে তৈরি কিছু কেবিন। ক্লেইমগুলো নদীর আশপাশে। সবার আগে অবশ্য কয়েক মানুষ সমান উঁচু কয়েকটা উইন্ডমিল চোখে পড়ল ওয়্যাগন যাত্রীদের।

দীর্ঘ রাস্তার দুপাশে গুটি কয়েক দালান, কেবিন আর তারু। চুন-সুরকির ব্যবহার দূরে থাক, আসলে কোনটাই মজবুত করে তৈরি হয়নি। এখানকার বাসিন্দারা যেন জানে অনিশ্চয়তায় ভরা প্রতিটি দিনের মতই খোদ জেরেমি টাউনের অস্তিত্বও অনিশ্চয়তা আর কিছু প্রশ্নের সম্মুখীন; ঠিক সোনার মত-কবে কোন ক্লেইমে কতটুকু সোনা পাওয়া যাবে আগে থেকে বলা সম্ভব নয়। তাই অল্প আয়াসে, দ্রুততার সাথে তৈরি হয়েছে বাড়িগুলো। সর্বত্র অযত্ন আর অবহেলার ছাপ। ছড়ানো-ছিটানো কয়েকটা ওয়্যাগন চোখে পড়ল, দালান বা কেবিন তৈরির ঝামেলায় না গিয়ে ওগুলোকে অস্থায়ী দোকান-কাম-আবাস হিসেবে ব্যবহার করছে কেউ কেউ। সব মিলিয়ে, উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন বুকে নিয়ে আসা লোকগুলো অবাক হয়ে লক্ষ্য করল, অন্তত দুশো লোকের সমাগম ঘটেছে এখানে।

ব্যাপারটা খানিক ভড়কে দিল ওদের। কেউই ভাবেনি এখানে এসে এরকম এলাহী কাণ্ড দেখতে পাবে; কিংবা শীতল অভ্যর্থনার কথাও তাদের মাথায় আসেনি, যেটা আগে আসা লোকগুলোর চোখে দেখতে পেল তারা, এবং সাথে কিছু তাচ্ছিল্যও। ট্রেইলের ধূলি উড়িয়ে প্রথম ওয়্যাগনটা যখন সিড হ্যামারটনের জেনারেল স্টোরের সামনে থামল ততক্ষণে উৎসুক কিছু লোকের ভিড় জমে গেছে। আশপাশে। কৌতূহলী হয়ে অপেক্ষায় থাকল ওরা। সবার সামনে থাকা জেসি ওয়েনের ক্লান্ত মুখে প্রসন্ন হাসি, স্যাডল ত্যাগ করার ঝামেলায় গেল না সে, থেমে যাওয়া প্রথম ওয়্যাগনের পাশে এসে রাশ টেনে ঘোড়া থামাল। তারপর মাসট্যাঙের মুখ ঘুরিয়ে উল্টোদিকে ফিরল, মিনিট পাঁচেক অপেক্ষা করল সে, একে একে থামল সব ওয়্যাগন। বাতাসে ওড়া ধুলোর অত্যাচার এড়াতে একপাশে সরে এল ওয়েন! হ্যাট চালিয়ে উড়ন্ত ধুলো সরিয়ে দিল, তারপর পকেট থেকে দুমড়ানো একটা সিগার বের করল। সিগার ধরানোর ফাঁকে আড়চোখে একবার দেখে নিল কৌতূহলী জেরেমিবাসীদের।

শেষ লোকটি নামা পর্যন্ত অপেক্ষা করল ওয়েন। আমার সাথে এসো সবাই, জরুরী কথা আছে তোমাদের সঙ্গে। ওখানে, হাত উঁচিয়ে জেনারেল স্টোরের পাশের সেলুনটা দেখাল সে। এই শহরে আমাদের সফল আগমন উপলক্ষে পান করব সবাই, আর… স্মিত হাসল সে। আমাদের দেনা-পাওনা চুকিয়ে ফেলব।

তাকে অনুসরণ করে এগোল কয়েকজন পুরুষ, ওয়েনের পেছন পেছন সেলুনে ঢুকে পড়ল।

কামারের দোকানের পোর্চে দাড়িয়ে ছিল এক তরুণ আর বয়স্ক এক লোক। নিস্পৃহ দৃষ্টিতে এতক্ষণকার নাটক দেখছিল ওরা। অধৈর্য ভঙ্গিতে পায়ের ভর বদল করল তরুণ, সঙ্গীর দিকে ফিরে নিচু কণ্ঠে বিতৃষ্ণা প্রকাশ করল: লোকটা কে, টিম? ভাব-চক্কর দেখে মনে হচ্ছে শহরটা যেন ওর!

জেসি ওয়েন, সংক্ষেপে জানাল টিম কার্টিস।

অ, মন্টানার সেই রকবাজ? বুঝলাম! উম্মা প্রকাশ পেল তরুণের কণ্ঠে। কিন্তু সঙ্গে এত লোক নিয়ে এসেছে কেন তা তো বুঝতে পারলাম না।

বেশি বোঝার চেষ্টা কোরো না, বব। জেসি ওয়েনের ব্যাপারে আগ্রহী না হলে আখেরে তোমারই লাভ হবে। মুখ বুজে দেখে যাও, নিজ থেকে কিছু জানতে চেয়ো না, ওর উদ্দেশ্য ঠিকই জেনে যাবে একসময়।

কিন্তু এই লোকগুলো?

আর সবার মতই সোনার লোভে এসেছে ওরা।

ওয়্যাগনের দিকে তাকিয়ে আছে রবার্ট অ্যালেন। জুলিয়া লারকিনকে দেখে চরম বিস্ময় বোধ করল, চোখ সরাতে পারছে না। আরে, টিম! দেখো, একটা গোলাপও এসে জুটেছে দেখছি! চাপা স্বরে বলল সে।

বব, তোমার ছোঁকছোঁক করার অভ্যেসটা বাদ দাও তো! বিরক্ত হয়ে বলল কার্টিস। নইলে শেষে পস্তাবে। ও হয়তো এমন কারও বউ বা মেয়ে যার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে তোমার বুক কেঁপে উঠবে।

সবকিছুতে খারাপ দিকটা আগে ভাবো তুমি, খানিকটা বিষণ্ণ সুরে অভিযোগ করল তরুণ। এবং ভয় ধরিয়ে দেয়ার মত কথা বলো শুধু!

তোমার চেয়ে অনেক দেখেছি, বাছা। সামান্য একটা ভুল বা মুহূর্তের খেয়ালের জন্যে বহু লোককে মরতে দেখেছি আমি।

উফ, তোমার মাস্টারগিরি যে কবে বন্ধ হবে!

নাক-কান বুজে শুনে নাও, তোমার এখন শেখার বয়স, বাছা।

আমি ভাবছি কিনকেড বা রক্সের কি প্রতিক্রিয়া হবে।

ওয়্যাগনের আশপাশে অপেক্ষায় থাকা লোকজনকে দেখছে কাটিস। তাদের ওপর থেকে চোখ না সরিয়ে অভ্যস্ত হাতে তামাক-কাগজ বের করে সিগারেট রোল করল, তারপর নখে দেয়াশলাইয়ের কাঠি ঘষে আগুন জ্বালাল। সিগারেট ধরিয়ে একমুখ ধোয়া ছেড়ে বলল, আমার তো মনে হয় খুশিই হবে ওরা।

কেন?

এখানে এমন লোকই চায় ওরা–নিরীহ, আনাড়ি এবং পশ্চিমে নতুন। জোর করতে গেলে বাধা দেওয়ার সাহস করবে না, কিংবা প্রতিরোধও করতে পারবে না। তাতে সহজ হয়ে যাবে ওদের কাজ।

এদিকে সেলুনের ভেতরে, ততক্ষণে ছয়জন পুরুষের উদ্দেশে ছোটখাট একটা বক্তৃতা দিয়ে ফেলেছে জেসি ওয়েন। আশা করি এখানে কোন ঝামেলায় জড়াবে না কেউ, শেষে উপসংহার টানল সে, যার যার পছন্দ মত জায়গা বেছে নিয়ে ক্লেইম করতে পারো। তবে ভুলেও অন্যের ক্লেইমে যেয়ো না, কেউই সেটা পছন্দ করবে না। এখানে কিছু অর্জন করতে হলে তা শ্রম দিয়েই করতে হবে, এমনকি সোনা তোলার কাজটাও। নদীর কাছে গিয়ে দেখো, বেগার খাটছে ওরা। সারা দিনে হয়তো এক আউন্স সোনাও তুলতে পারেনি, কিন্তু পরদিন ঠিকই নতুন উদ্যমে শুরু করছে আবার। যাকগে, এবার বিদায়ের পালা, আশা করি আমার পাওনা মেটাতে আপত্তি নেই কারও? থেমে হুইস্কিতে চুমুক দিল জেসি ওয়েন, গ্লাসের কিনারার ওপর দিয়ে সামনে দাড়ানো লোকগুলোকে নিরীখ করল।

একটা কথা, জেসি, উঠে দাঁড়াল মাঝবয়সী এক লোক। তুমিই বলেছ এখানে আসার পর ভাগ্য ফিরে যাবে আমাদের, কারণ জেরেমি টাউনে প্রচুর সোনা আছে। কিন্তু এখানে এসে দেখতে পাচ্ছি আগেই ক্লেইমের দখল নিয়ে বসে আছে বহু লোক।

এমন কোন কথা কি সত্যিই বলেছি? সহাস্যে পাল্টা প্রশ্ন করল ওয়েন, সযত্নে বিরক্তি আর অসন্তোষ চেপে রেখেছে। আমি তোমাদের স্বপ্ন দেখাইনি, বন্ধুরা, তোমরা নিজেরাই দেখেছ। আমি শুধু এখানে নিয়ে এসেছি তোমাদের। বিনিময়ে কিছু ডলার পাওনা হয়েছে আমার। লোকটির মুখে চাপা অসন্তোষ দেখে ব্যাখ্যা দিতে বাধ্য হলো সে। দেখো, মি, ক্যামেরন, আমি বলেছি এখানে সোনার সন্ধান পাওয়া গেছে। খবরটা তোমরা আগেই পেয়েছ, কিন্তু নিশ্চিত হয়েছ আমার কথায়। সোনা কি এখানে নেই, তাহলে এতগুলো লোক পড়ে আছে কেন? সোনা তোলার দায়িত্ব নিশ্চয়ই আমাকে দাওনি?

আনমনে মাথা নাড়ল ক্যামেরন, চাহনিতে, অনিশ্চয়তা ঝরে পড়ছে। টেবিলের ওপর রাখা হুইস্কির গ্লাস তুলে চুমুক দিল সে। নিরাসক্ত দৃষ্টিতে বাইরে অপেক্ষমাণ সঙ্গীদের দেখল, তারপর পকেট থেকে টাকা বের করে টেবিলে রাখল।

পাওনা টাকা বুঝে নিয়ে মাথায় হ্যাট চাপাল ওয়েন। আশা করি আমাকে আর দরকার হবে না তোমাদের। তবুও, কয়েকটা দিন থাকব এখানে। প্রয়োজন হলে বারকীপের কাছে খোঁজ কোরো, খবর পেয়ে যাব আমি। তোমাদের সাফল্য, কামনা করছি।

সবার পানীয়ের দাম মিটিয়ে দৃঢ় পায়ে বেরিয়ে গেল জেসি ওয়েন। খানিকটা নিরাশ হয়ে বসে থাকল লোকগুলো, কেবল হ্যান্স কোবার্ন ছাড়া। কৌতূহলী চোখে অন্যদের দেখছে সে।

কিছুটা হলেও হতোদ্যম হয়ে পড়েছে উচ্চাকাঙ্ক্ষী লোকগুলো। এদের অনেকেই আকাশ-পাতাল ভেবে এসেছে এতদিন, অথচ তিক্ত বাস্তব আঁচ করতে পারছে এখন। সবার আগে যে কাজটি তাদের করা উচিত, ভাবল হ্যান্স কোবার্ন, নিরাপদ একটা আশ্রয় খোঁজা উচিত; কিন্তু তা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না কেউ। অবশ্য কিছুক্ষণ পরই হতাশা কেটে যাবে, আশপাশে প্রচুর খালি জায়গা আছে, ক্লেইম করার পাশাপাশি নদীর তীরে যে কোন জায়গায় রাতটাও কাটিয়ে দিতে পারবে। যেমন কেটেছে গত কয়েকদিন।

হুইস্কি শেষ করে উঠে দাঁড়াল সোনা ব্যবসায়ী। প্রচুর কাজ পড়ে আছে তার-জেফরি হ্যালার্ডকে খুঁজে বের করতে হবে, জরুরী কিছু আলাপ প্রথমেই সেরে ফেলা দরকার; হাতে সময় মাত্র দুদিন। ক্রুদের থাকার ব্যবস্থা করতে হবে, এবং…ড্যানি লসনের খোঁজ করতে হবে, হয়তো এখানেই আছে সে। আশা ছাড়তে রাজি নয় কোবার্ন।

বেরিয়ে এসে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে সারা শহরের ওপর চোখ বুলাল ও। সর্বত্র অযত্নের ছাপ, সবকিছুই বড় তাড়াহুড়োর সঙ্গে করা হচ্ছে। রাস্তার ওপাশে একটা স্টোরের দেয়াল দাঁড় করাচ্ছে বাপ-বেটা, খোলা দোকানে পসরা সাজিয়ে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে আরেকজন। পাবলিক স্টেবলে কেবল কয়েকটা খোলা স্ট্র চোখে পড়ল। ল-অফিসটা একেবারে শেষপ্রান্তে, মাটি আর ইটের আলগা একটা কাঠামো বলা উচিত। পাশে নামকাওয়াস্তে কোর্ট হাউস। নাহ্, জেরেমি টাউনের বয়স দুই মাস হয়েছে ঠিকই, ভাবল ও, কিন্তু একবিন্দু এগোয়নি শহরটা। শুরুতে যেমন ছিল, তারচেয়ে খারাপ হয়েছে অবস্থা। পরিকল্পনা বা যত্নের ছাপ নেই কোথাও।

রাস্তায় নেমে হ্যাটের ব্রিম আরও নামিয়ে দিল হ্যান্স কোবার্ন, চোখ কুঁচকে তাকাল ওয়্যাগন সারির দিকে। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে গল্প করছে নতুন আসা লোকগুলো, মাঝে মধ্যে ইতি-উতি তাকাচ্ছে। নিজের বাগির কাছে পৌঁছতে দেখল ওর দিকেই এগিয়ে আসছে পিট লারকিন।

কোবার্ন, তুমি তো আগেও এখানে এসেছ?

মাথা ঝাঁকাল সে, অপেক্ষায় থাকল।

তুমি কি উইলিয়াম লারকিনকে চেনো? এখানে একটা ক্লেইম আছে বিলের। ওর কাছেই এসেছি আমরা।

ঠিক বলতে পারব না, মাইনারদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ নেই আমার। কোবার্ন খেয়াল করল উত্তরটা অপ্রতিভ করে তুলেছে লারকিনকে। তবে আমার অফিসে গেলে হয়তো খোঁজ পেতে পারো। মাইনারদের কাছ থেকে সোনা কেনে আমার কেরানি, ও হয়তো চিনতে পারে।

ধন্যবাদ।

বাগির আসনে চড়ল কোবার্ন। চাবুক চালিয়ে ঘোড়া দুটোকে এগোতে বাধ্য করল, সকাল থেকে টানা ছুটেছে বলে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে পশুগুলো। পিছু পিছু আসছে লারকিনদের ওয়্যাগন। ধীরে ধীরে শহরে প্রবেশ করল ওরা। খানিক এগিয়ে মূল রাস্তা ছেড়ে পাশের গলিতে ঢুকল, বিশ গজ দূরে একটা দালানের সামনে এসে থামল। চাকার ঘর্ঘর শব্দ শুনে ভেতর থেকে বেরিয়ে এল শীর্ণদেহী এক লোক। টুপি খুলে হিচিং রেইলের প্রান্তে ঝুলিয়ে রাখল সে, তারপর দ্রুত এগিয়ে এল।

কেমন চলছে এদিকে, টড? জানতে চাইল কোবার্ন, বাগি থেকে নেমে পড়েছে।

ভাল, মি, কোবার্ন।

সব ঠিকঠাক আছে তো?

হেসে ওকে আশ্বস্ত করল টড মার্টিন।

ও পিট লারকিন, লারকিনকে দেখিয়ে বলল সোনা ব্যবসায়ী। আর লারকিন, এ হচ্ছে আমার ম্যানেজার-টড মার্টিন।

হাত মেলাল দুজন।

মেরী আর জুলিয়া সহ অফিসে এসে বসল ওরা। সামনের বড়সড় ঘরটা অফিস-রূম, পেছনের একটা কামরা নিজের কোয়ার্টার হিসেবে ব্যবহার করে মার্টিন; আরেকটা কামরা খালি পড়ে থাকে, তবে গোছানো। জেরেমি টাউনে এলে

এখানেই থাকে হ্যান্স কোবার্ন।

জুলিয়াকে নিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ল মেরী।

টড, তুমি বোধহয় সাহায্য করতে পারবে ওকে, গদি-মোড়া একটা চেয়ারে বসে বলল কোবার্ন। উইলিয়াম লারকিন নামে কেউ ক্লেইম করেছে?

করেছে।

লারকিনের চোখে এবার খুশি দেখা গেল। সশব্দে হাঁপ ছাড়ল সে, তারপর বসে পড়ল একটা চেয়ারে। বলতে পারবে ঠিক কোথায় ওর ক্লেইম?

নদীর একেবারে শেষ মাথায়, জেফরি হ্যালার্ডের পর ওর ক্লেইমটাই সবচেয়ে বড়। সোনাও তুলছে প্রচুর।

ধন্যবাদ। এবার বোধহয় যেতে পারি আমরা। উঠে দাঁড়াল পিট লারকিন।

বোসো, কফি খেয়ে যাও, আমন্ত্রণ জানাল সোনা ব্যবসায়ী। লারকিন দ্বিমত করে বসে পড়ল চেয়ারে। কফির আয়োজনে ব্যস্ত হয়ে পড়ল টড মার্টিন।

মিনিট বিশ পর বিদায় নিয়ে ওয়্যাগনে চড়ল বাপ-বেটি। গলি ধরে চলে এল শহরের শেষ মাথায়। খানিকটা খোলা জায়গার পর ঢালের শুরু হয়েছে কয়েকশো গজ দূরে। ওয়্যাগনের চাকা আর ঘোড়ার খুরের গভীর দাগ পড়েছে ধূলিধূসর ট্রেইলে। দূর থেকে মাইনিং এলাকার ওপর চোখ বুলাল পিট লারকিন। শ্যাকগুলোর ধারে-কাছে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। নদী বা পাহাড়ের কাছে ব্যস্ত সবাই, মাটি খুঁড়ছে অথবা নদীর তীরে লোহার তৈরি সূক্ষ্ম ছাকনি দিয়ে মাটি মেশানো সোনা হেঁকে তুলছে।

চালকের আসনে, বাপের পাশে বসেছে জুলিয়া। অবাক হয়ে লোকজনের ব্যস্ততা দেখছে ও। অযথা সময় নষ্ট করছে না কেউ, হয়তো উৎসুক হয়ে একনজর দেখছে ওদের, তারপরই নিজের কাজে মনোযোগ দিচ্ছে। অথচ তিনশো গজ দূরে শহরের চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন-সেলুন বা বাড়ির পোর্চে দাঁড়িয়ে থেকে অলস। সময় কাটাচ্ছে বেশিরভাগ লোক; ব্যস্ততা নেই সেখানে নেই কোন প্রাণচাঞ্চল্য।

কি যেন ভাবছে পিট লারকিন, হয়তো বহু বছর পর ভাইয়ের সাথে দেখা হওয়ার পর কেমন লাগবে, ছোট ভাইকে কেমন দেখবে তা-ই তার চিন্তার বিষয়। চারপাশে কৌতূহলী দৃষ্টি চালাচ্ছে সে, ধারণা করার চেষ্টা করছে ঠিক কোটা বিল লারকিনের ক্লেইম। শেষপর্যন্ত আমরা এসেই পড়লাম, তাই না? হালকা সুরে বলল সে।

আনমনে মাথা ঝাঁকাল জুলিয়া। বাপের অতিরিক্ত আগ্রহ পছন্দ করতে পারছে না, এমনকি পশ্চিমে আসার ব্যাপারটাও সহজে মেনে নিতে পারেনি। বিল লারকিন সম্পর্কে ধারণা নেই ওর, জানে না লোকটি কেমন। ছেলেবেলায় দেখেছিল, ওর যখন নয়-দশ বছর। মানুষটা বাউণ্ডুলে ছিল বলে বাড়িতে খুব কমই থাকত, তার বেশিরভাগ সময় কেটেছে পশ্চিমে। মাঝে মধ্যে ফিরে যেত সনোরায়, দুএকদিন থেকে কাউকে কিছু না জানিয়ে হাওয়া হয়ে যেত আবার। ভাইয়ের ভবঘুরে স্বভাব পছন্দ করত না বিল লারকিন, এবং সেটা প্রকাশ করতেও দ্বিধা ছিল না তার। এ নিয়ে দুভাইয়ের মধ্যে ঝগড়ার পরিণতিতে অভিমান করে বাড়ি ছেড়েছিল বিল, আর ফিরে যায়নি। তারপর বহু দিন তার কোন সংবাদ পায়নি ওরা, কেবল মাসখানেক আগের চিঠিটা ছাড়া-হঠাৎ বড়লোক হয়ে যাওয়ার কথা জানিয়েছে সে, এবং পিটকে পশ্চিমে আসার অনুরোধ করেছে।

চিঠি পেয়ে ভাইয়ের ওপর সমস্ত অভিমান এবং আত্মমর‍্যাদা, সবই ভুলে গিয়েছিল পিট লারকিন। পনেরো দিনের মধ্যে রওনা দেয় ওরা। জুলিয়ার ইচ্ছে ছিল না, তবু আসতে হলো। কারও দয়ায় বেঁচে থাকাকে ঘৃণা করে ও। সেজন্যে বাপের ওপর কিছুটা হলেও অসন্তুষ্ট। পিট লারকিনের আগ্রহ কোথায় ভাল করেই জানে ও, সুদীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েছে সে কেবল বড়লোক হওয়ার আশায়। ভাইয়ের অনুগ্রহে নিজের ভবিষ্যৎ গড়ে নেবে!

বিল খুব অবাক হবে, নীরবতা ভাঙল লারকিন। কেন?

এই যে এতদিন পর আবার দেখা। কত বদলে গেছি আমরা সবাই, তোকে দেখেছে সেই ছোট্ট অবস্থায়।

এতে অবাক হওয়ার কি আছে!

তর্ক করল না লারকিন।

বাঁক ঘুরে দক্ষিণে এগোল ওয়্যাগন। টড মার্টিনের নির্দেশনা অনুযায়ী বিল লারকিনের ক্লেইম কাছাকাছি হওয়ার কথা। নদীর ধারে ছোট্ট একটা কেবিন দেখা যাচ্ছে। আশপাশে কেউ নেই, পাহাড়ের কোলে গজিয়ে ওঠা বুনো ঝোপের কাছে দাড়িয়ে আছে একটা ঘোড়া। কাঁটাতার দিয়ে বেষ্টিত সীমারেখার ভেতরে একটা সাইনবোর্ড, সেটার লেখা অনুযায়ী এই জমিতে বিল লারকিনের মালিকানা প্রকাশ পাচ্ছে।

কাঁটাতারের ফাঁক গলে এগোল ওয়্যাগন। পঞ্চাশ গজ রাস্তা পেরিয়ে কেবিনের সামনে পৌঁছে গেল ওরা। নদীর পাড়ে দীর্ঘকায় এক লোককে দেখতে পেল পিট লারকিন। হাতে, কাপড়ের এখানে-সেখানে কাদা লেগে আছে। হ্যাটটা স্ট্র্যাপের সাহায্যে পিঠে ঝোলানো। ঘেমে সারা, গায়ের সাথে লেপ্টে আছে শার্ট। কোমরের হোলস্টারে পিস্তলের নল উঁকি দিচ্ছে। প্রথমে শীতল নিরুত্তাপ দৃষ্টিতে তাকালেও পরে আগন্তুকদের চিনতে পেরে প্রাণের সঞ্চার হলো লোকটার চোখে। হাসি-মুখে এগিয়ে এল সে।

আরে, পিট যে! উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলল সে। সত্যি এসে পড়েছ তাহলে!

লাফিয়ে ওয়্যাগন থেকে নামল পিট লারকিন, ভাইয়ের দিকে এগিয়ে গেল। হাত মিলিয়ে পরস্পরকে আলিঙ্গন করল ওরা। এই বয়সেও দেখছি তাগড়া জোয়ানই রয়ে গেছ তুমি, বিল! স্মিত হেসে বলল বড় ভাই।

এখানে আরামে জীবন কাটানো যায় না, পিট। আসলে তেমন কোন সুযোগই নেই। যাকেই পাবে, দেখবে প্রচুর পরিশ্রম করছে। জুলিয়ার দিকে ফিরল সে এবার, অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে নিরীখ করছে ওকে; ধীরে ধীরে উজ্জ্বল হয়ে গেল মুখ। আরিব্বাস, তুমি দেখছি পুরোপুরি লেডি হয়ে গেছ, জুলি! এগিয়ে এসে জুলিয়াকে ওয়্যাগন থেকে নামতে সাহায্য করল সে। তারপর আচমকা জড়িয়ে ধরল ওকে, সস্নেহে চুমো খেল কপালে। সরে গেলেও ওকে ছাড়ল না বিল লারকিন, দুই কাঁধ ধরে রেখে ফের খুঁটিয়ে দেখতে শুরু করল, মিটিমিটি হাসি লেগে আছে ঠোঁটের কোণে; শেষে জুলিয়ার মুখে স্থির হলো দৃষ্টি। বেশ লম্বাও হয়েছ দেখছি, আর…সুন্দরী!

লজ্জা পেল জুলিয়া। কেমন আছ তুমি?

দারুণ! ওকে ছেড়ে দিয়ে পিছিয়ে গেল বিল লারকিন, কাপড়ে লেগে থাকা কাদার দিকে তাকিয়ে ক্ষীণ হাসল। এ মুহূর্তে নিশ্চয়ই সঙের মত দেখাচ্ছে আমাকে? দাড়াও, এক মিনিট, ধুয়ে আসছি! নদীর দিকে এগোল সে, হাত-মুখ ধুয়ে ফিরে এল মিনিট কয়েক পর। এসো, ভেতরে এসে বোসো, বলে কেবিনের দিকে এগোল।

ঘণ্টাখানেক পর খেতে বসল ওরা।

জুলি এসেছে, এটা আমার জন্যে সুখবর, সহাস্যে বলল বিল লারকিন। নিজের রান্না খেতে খেতে অরুচিতে ধরে গেছে। খাওয়ার ব্যাপারে এখন থেকে চিন্তা করতে হবে না আর।

তুমি এখানে এলে কিভাবে? জানতে চাইল বড় ভাই।

সে অনেক লম্বা গল্প, অবসরে একদিন বলা যাবে, কৌশলে এড়িয়ে গেল সে, চুরুট ধরিয়ে চিন্তিত ভঙ্গিতে তাকাল বড় ভাইয়ের দিকে, আড়চোখে পলকের জন্যে দেখল জুলিয়াকে। ভাবছি তোমাদের এখানে এনে ভুল করলাম নাকি।

কেন? সবিস্ময়ে জানতে চাইল পিট।

একেকটা দিন যা হচ্ছে এখানে! মারপিট বা গোলাগুলি লেগেই থাকে।

তেমন কিছুই তো দেখলাম না।

দেখবে, সন্ধে হলেই টের পাবে।

 

জেফরি হ্যালার্ডের ইদানীং প্রায়ই মনে হয় এখানে আসাটাই দারুণ ভুল হয়েছে। কিন্তু সোনা আবিষ্কার করার সময় ও কি ঘুণাক্ষরেও ভেবেছে যে হলদেটে উজ্জ্বল ধাতুটা শেষপর্যন্ত আসলে বহু লোকের সর্বনাশ ডেকে আনবে?

পাহাড়ের কোলে নিজের ক্লেইমে, কেবিনের পোর্চে পায়চারি করছে সে। নিরাসক্ত দৃষ্টিতে ঢলের নিচে শহরের দিকে তাকাচ্ছে মাঝে মধ্যে। কদিন হলো? বড়জোর দুই মাস, ভাবছে হ্যালার্ড, অথচ কত দ্রুত বদলে গেছে সবকিছু। শুরুতে ওরা যখন এসেছিল, কিছুই ছিল না এখানে। সুনসান নীরবতা, নির্জন প্রেয়ারি, আকাশছোঁয়া জারকান মাউন্টেসের সুবিশাল অবয়ব আর পাহাড় থেকে উড়ে আসা শীতল বাতাসই ছিল ওদের প্রথম কদিনের সঙ্গী। তারপর একে একে আসতে শুরু করল সবাই। চোখের নিমেষে গড়ে উঠল শহরটা। লোকজন দেখে প্রথমে খুশি হয়েছিল ওরা, ভুলেও ভাবেনি শেষে এত ঝামেলা হবে।

নতুন এক জীবনের স্বপ্ন দেখেছিল ওরা—জ্যাক ক্লেটন, জো হারপার, জেরেমি শেভলিন আর সে। কিন্তু জেরেমি শেভলিন সেই স্বপ্নের দেখা পায়নি। জোন্স সিটি থেকে রওনা দেয়ার দ্বিতীয় দিনেই অমঙ্গলের সূচনা হয়েছিল, সাপ্লাই আনতে গিয়ে বিগ বে শহরের এক রকবাজের সঙ্গে ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ে শেভলিন। চারজনের জায়গায় তিনজন হয়ে যায় তারা। বন্ধুর মৃত্যুর শোক কাটতে না কাটতে ঝামেলা শুরু হয়ে যায়। পিছু পিছু চলে এসেছে ধান্ধাবাজ কিছু লোক।

ভাল লোকের চেয়ে খারাপ লোকই বেশি এসেছে। আইনের প্রতি শ্রদ্ধা নেই কারও, পরোয়াও করছে না কেউ, শহরের বেশিরভাগ লোকের ক্ষেত্রে এ কথা প্রযোজ্য। এ পর্যন্ত ছয়জন মার্শাল নিয়োগ করা হয়েছে, কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয়নি। প্রতিদিনই দুএকটা খুন হচ্ছে। বেপরোয়া লোকগুলোকে আইন শেখাবে কে, সেই দৃঢ়তা কারও নেই। ওর বন্ধুদের মতে বিগ থমসন, কার্ট রক্স বা স্যামুয়েল কিনকেডের মত লোকদের আইনের পথ দেখিয়ে দিতে হয়, গায়ের জোরে অথবা পিস্তলের নলে সেটা শেখাতে হয়।

জেফরি হ্যালার্ড তা মানতে রাজি নয়। ওর ধারণা কিছুদিনের মধ্যে স্বাভাবিক হয়ে যাবে এখানকার জীবনযাত্রা। খুন-জখমের ঘটনা কমে যাবে, ধীরে হলেও শান্ত হয়ে যাবে জেরেমি টাউন। ধারণাটা প্রায় হেসেই উড়িয়ে দিয়েছে জো হারপার। অন্যদের মত শহরের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত না হলেও সে-ও স্বীকার করে শুরুতেই জেরেমি টাউনের ধ্বংস হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা একেবারে নাকচ করে দেওয়া যায় না। পশ্চিমের উঠতি অনেক শস্ত্র এভাবেই ধ্বংস হয়ে গেছে।…

সন্ধের অন্ধকার তখন বিছিয়ে পড়ছে সমস্ত চরাচরে। আগুন জ্বেলে রান্নার আয়োজন করছে জ্যাক ক্লেটন, অন্যরা শুয়ে-বসে অলস সময় পার করছে। কেবিনের পোর্চে দাঁড়িয়ে ছিল জো হারপার। আবছা অন্ধকারে দুরে গাঢ় চারটে ছায়া দেখতে পেল সে। চোখ কুঁচকে ঘোড়সওয়ারদের চেনার চেষ্টা করল। সবার সামনে বিশালদেহী এক লোক, বলিহারি স্বাস্থ্য আর তোবড়ানো মেক্সিক্যান হ্যাটই চিনিয়ে দিচ্ছে বিগ শেইন থমসনকে।

জেফ, জ্যাক! চাপা স্বরে বন্ধুদের ডাকল সে। শহরের অতিথিরা এদিকে আসছে বোধহয়।

কেবিনের দরজায় উঁকি দিল জ্যাক ক্লেটন। নির্বিকার মুখে আগুয়ান ঘোড়সওয়ারদের দেখল সে, অকথ্য খিস্তি করল। হারামজাদারা এখানে কোন ঝামেলা করতে চাইলে বুলেট দিয়ে ওদের খায়েশ মিটিয়ে দেব!

ভেতরে থাকে তোমরা, শান্ত স্বরে বলল হারপার। হাতে একটা উইনচেস্টার ওর, এমন ভাবে ধরা যাতে প্রয়োজন পড়া মাত্র ব্যবহার করতে পারে। আমিই ওদের সঙ্গে কথা বলব। রাইফেলে থমসনের বুক নিশানা করে রেখো। বেতাল কিছু করলে ব্যাটার বুক এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিয়ো।

এটা আমাদের ক্লেইম, ওর কিছু করার নেই এখানে! যুক্তি দেখাল হ্যালার্ড।

ওর হয়তো ভিন্ন মত থাকতে পারে, দলটার ওপর চোখ রেখে বলল হারপার। ওদের ক্লেইমে ঢুকে পড়েছে থমসনের বাহিনী।

ধীরে ধীরে এগিয়ে এল ওরা। বিশ হাত দূরে এসে থামল। বাতাসে ওড়া ধুলো থিতিয়ে এল আস্তে আস্তে।

ব্যস, আর এগোতে হবে না! বিশালদেহীর ঘোড়া আগে বাড়তে শুরু করায় হাত উঁচিয়ে নিষেধ করল হারপার। যথেষ্ট হয়েছে। কাউকে খুঁজছ, থমসন?

তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে তাকাল সে, কিন্তু স্থির জো হারপারের চাহনি। তা দেখে মুচকি হাসল শেইন থমসন, হারপারের হাতে রাইফেল দেখে ভুরু কোঁচকাল, এমন একটা ভঙ্গি করল যেন সত্যিই ভয় পেয়েছে। ক্যাম্প করার জন্যে চমৎকার জায়গা, তাই না? গা ছেড়ে দেয়া অলস ভঙ্গিতে সঙ্গীদের উদ্দেশে জানতে চাইল সে। নিউ টাউনের মত নোংরা বা বাজে জায়গা নয় এটা। কি বলো, বাছারা?

সঙ্গে সঙ্গে সায় জানাল ওর তিন সঙ্গী।

এ জায়গার ক্লেইম করা হয়ে গেছে, থমসন! দৃঢ় স্বরে বলল জো হারপার।

বাহ, তাতে কি! আমরা তো শুধু ক্যাম্প করার মত একটা জায়গা চাইছি।

মাথা নাড়ল হারপার, সামান্য হাসি ফুটে উঠেই মিলিয়ে গেল ওর মুখে। প্লেসভিলের কথা তুমি ভুলতে পারো, থমসন, কিন্তু আমি ভুলিনি। নিরীহ এক লোকের ক্লেইমে ক্যাম্প করার অনুমতি চেয়েছিলে তুমি। অনুমতিও পেয়েছিলে। অথচ পরদিন সকালে দেখা গেল সেই লোক নেই। তুমি বললে সবকিছু তোমার কাছে বেচে দিয়ে চলে গেছে সে। …আমি সেখানে ছিলাম, থমসন, ওই লোকের কবর নিজ হাতে খুঁড়েছি।

রেগে গেল থমসন। এরকম বানানো গল্প যদি আরেকবার বলো তবে গুলি খাবে!

এইমাত্রই তো বললাম। কি করবে? এক পা পিছু হটে রাইফেলের হ্যামার টানল জো হারপার। কেটে পড়ো, থমসন, ঈশ্বরের দোহাই, ট্রিগারে বেশিক্ষণ থাকলেই আমার আঙুল চুলকাতে শুরু করে!

আরে দূর! এত অস্থির হচ্ছ কেন? পরিস্থিতি নাজুক দেখে সুর পাল্টাল সে। আমরা তো তোমাদের সঙ্গে আলাপ করতে এসেছি, শহরের পরিস্থিতি যা হয়েছে…

তোমাকে এখানে ডাকেনি কেউ! চাঁছাছোলা স্বরে বাধা দিল হারপার।

গা জ্বালানো হাসি থমসনের মুখে। সবসময় ডাকা লাগে না। নিজের গরজে এসেছি আমি।

কি বলতে চাও? তাড়াতাড়ি বলে কেটে পড়ো।

হেসে পকেটে হাত ঢোকাল থমসন। দুমড়ানো একটা সিগার বের করে সময়, নিয়ে ধরাল, এই ফাঁকে কেবিন আর আশপাশে চোখ বুলিয়ে নিল। বোঝার চেষ্টা করল কেউ লুকিয়ে আছে কিনা। জায়গাটা অনেক বড়, প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি সোনা তুলছ তোমরা, এক মুখ ধোয়া ছেড়ে হালকা চালে বলল সে।

তাতে তোমার কি?

অনেক কিছু। বিশাল একটা জায়গার দখল নিয়েছ অথচ আমরা কোন জায়গা পাচ্ছি না, এটা কি ঠিক হলো?

পেছনে, নদীর ওপারে, কাঁধের ওপর বুড়ো আঙুল তুলে ইশারা করল হারপার। অনেক জায়গা আছে ওখানে। ইচ্ছেমত বেছে নাও।

কিন্তু এটাই যে আমার পছন্দ।

তাই নাকি? কিন্তু কিছুই করার নেই তোমার, থমসন। আমাদের আগে এলে হয়তো জায়গাটা তোমারই হত।

কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল বিগ থমসন। সিগার ফুকছে। তারপর হাসল সে, স্যাডলে নড়েচড়ে বসল। এক কাজ করা যাক, তোমাদের ক্লেইমের কিছু অংশ না হয় ছেড়ে দাও আমাদের। ছোট একটা অংশ হলেই চলবে। বিনিময়ে ন্যায্য দাম দিতে রাজি আছি আমি।

রাজি নই আমি।

তাকিয়ে থাকল শেইন থমসন, সামনে দাঁড়ানো লোকটির দৃঢ়তা বোঝার চেষ্টা করছে। হয়তো ভুল করছ তুমি। পরে পস্তাবে এমন কোন সিদ্ধান্ত না নেওয়াই ভাল।

সে আমি বুঝব! অধৈর্য স্বরে বলে উঠল হারপার। আর কিছু বলার আছে। তোমার?

হয়তো একটা চুক্তিতে আসতে পারি আমরা। আমার লোকেরা, পেছনে আঙুল উঁচিয়ে অন্যদের দেখাল সে। সোনা তোলায় সাহায্য করতে পারে তোমাদের। বিনিময়ে…

তোমার সাথে চুক্তি? স্মিত হেসে তাকে থামিয়ে দিল হারপার। এরচেয়ে একটা কেউটের সাথে চুক্তি করাও অনেক ভাল।

ইচ্ছে করলেই ক্লেইমটা দখল করে নিতে পারি আমরা। খারাপ উদ্দেশ্য থাকলে প্রস্তাব নিয়ে আসতাম না!

হয়তো, তবে তোমার কথায় আস্থা রাখতে পারছি না। শোনো, থমসন, দুই মিনিট সময় দিলাম। ক্লেইম ছেড়ে কেটে পড়ো। সময় শেষ হলে সরাসরি তোমার বুক সই করে গুলি করব আমি।

অবজ্ঞার হাসি দেখা গেল থমসনের মুখে। বুঝে-শুনে বলছ তো?

তুমি কতটা বুঝেছ, থমসন, তোমার বুকের দিকে একটা রাইফেলের নল তাকিয়ে আছে, এটা যদি দেখতে পেতে নিশ্চয়ই হাসি মুখে কথা বলতে পারতে না এতক্ষণ?

হয়তো ধাপ্পা দিচ্ছ না, ম্লান হলো না থমসনের হাসি, আড়চোখে কেবিনের দিকে তাকাল সে। ঠিক আছে, এবার না হয় যাচ্ছি। কিন্তু আবার আসব আমরা। তখন…পরিস্থিতি যেভাবে পাল্টে যাচ্ছে, দ্র ভাষায় প্রস্তাব দেয়ার সুযোগ হয়তো পাওয়া যাবে না। মার্শালের অফিসটা কিন্তু খালি পড়ে আছে।

তাতে কি?

নতুন একজনকে নিয়োগ করছ না কেন? আচ্ছা, জেফরি হ্যালার্ড কি নেই এখানে? ওকে একটা পরামর্শ দিতাম! লুকাস শাটনকে মার্শাল বানিয়েছিল ও। আমার বিরুদ্ধে ড্র করতে চেয়েছিল সে…

ওকে খুন করেছ তুমি!

টাকরায় জিভ ঠেকিয়ে দুঃখসূচক শব্দ করল থমসন। বেচারা! একটু আনন্দফুর্তি করছিলাম আমরা, আর ও কিনা বাধ সাধল। সামান্য কথা কাটাকাটি হতেই পিস্তলে হাত দিল। এ অবস্থায় কি করতে পারতাম আমি? …যাকগে, আমার প্রস্তাবটা ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে দেখো, তোমাদের ক্লেইমের চতুর্থ অংশের জন্যে এক হাজার ডলার দেব।

মাথা খারাপ হয়ে গেছে তোমার! ওটার দাম মিলিয়ন ডলার।

হয়তো, হয়তো না। তাছাড়া, কাউকে যদি মারা পড়তে হয় তার কাছে এক হাজার আর মিলিয়ন ডলারের তফাৎ কি!;

জো হারপার কিছু বলার আগেই কেবিনের ভেতরে হ্যামার টানার গম্ভীর শব্দ শোনা গেল, অখণ্ড নীরবতায় বেশ জোরাল শোনাল শব্দটা। যথেষ্ট হয়েছে, থমসন! জ্যাক ক্লেটনের অধৈর্য কণ্ঠ শুনতে পেল ওরা। তোমার প্রস্তাব নিশ্চয়ই পেশ করা হয়েছে? বেশ, এবার মার্শালের কবরের পাশে আরেকটা কবর খোড়ার ব্যবস্থা করার আগেই চলে যাও এখান থেকে!

শব্দ করে হাসল শেইন থমসন, টুপির কিনারা উঁচিয়ে নড করল, তারপর ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে ফিরতি পথ ধরল। তাকে অনুসরণ করল অন্যরা।

কেবিন থেকে বেরিয়ে বন্ধুর পাশে এসে দাঁড়াল হ্যালার্ড, চিন্তিত দেখাচ্ছে। অবস্থা ভাল ঠেকছে না, জো, ম্লান কণ্ঠে বলল শহর কমিটির চেয়ারম্যান। লোকগুলোর সাহস দেখো, জবরদখল করার জন্যে এখানে চলে এসেছে।

এটাই স্বাভাবিক, জেফ। শহরে ওদের জন্যে কোন আকর্ষণ আর নেই এখন। লোভে পেয়েছে ওদের। অল্প কয়েক ডলারে খায়েশ মিটছে না। যে কোন একটা ক্লেইম দখল করতে পারলে অল্প সময়ে বড়লোক হয়ে যাবে।

সেটা যে সহজ হবে না তা নিশ্চয়ই টের পেয়েছে? খানিকটা সম্ভষ্টির সুর সাবেক স্কুল-মাস্টারের কণ্ঠে।

কিন্তু তোমার মত নিশ্চিন্ত হতে পারছি না আমি। থমসন আসলে নিজের ইচ্ছের কথা জানিয়ে গেল, গোলমাল করার জন্যে আসেনি। যখন আসবে ওকে ঠেকিয়ে রাখতে পারব কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে আমার।

তোমার ধারণা ঠিক না-ও হতে পারে।

উঁহু, পকেট থেকে তামাক-কাগজ বের করে সিগারেট রোল করল হারপার। এই একটা ব্যাপারে তোমার ঘাটতি আছে, জেফ। এ লোকগুলোকে তুমি চেনো না। এদের সাথে কখনও চলাফেরা করোনি, তাই জানো না কতটা খারাপ হতে পারে ওরা। কিন্তু আমি চিনি, জানি ঠিক কি করতে পারে ওরা।

কি করবে?

আপাতত কিছুই করবে না থমসন। নিজের খায়েশের কথা জানিয়ে গেছে, অপেক্ষা করবে এখন। বোধহয় সোনার সাপ্লাইটা হাতানোর তালে আছে ও। ওটা হাত করতে পারলে ক্লেইমের কথা হয়তো ভুলেই যাবে। খনিতে বেগার খেটে কামাই করার চেয়ে মুফতে দুই লাখ ডলারের সোনা, একেবারে তৈরি অবস্থায় পেয়ে যাচ্ছে, লোভনীয় নয়? এ তল্লাটে যত আউট-ল আছে সবাই জেনে গেছে এটার কথা, যে কারও লোভ হবে।

স্টেজে অন্তত দুজন গার্ড থাকবে।

চারজনই বা থাকল! কিন্তু তাতে কি? অন্যদের কথা বাদ দিলাম, এক থমসনের দলেই লোকের অব নেই।

তুমি শুধু ভয় পাইয়ে দাও।

থমসন সুযোগ পেলেই তোমাকে খুন করবে, জো, শঙ্কা প্রকাশ করল ক্লেটন।

মার্শাল ছাড়া কিভাবে চলবে এখানে? চিন্তিত স্বরে প্রসঙ্গ বদলাল হ্যালার্ড। আইনের লোক ছাড়া এতকিছু সামলানো যাবে না। হারপার গুলি খাক, আমাদের সবকিছু হাতছাড়া হয়ে যাক, তা তো হতে পারে না। হয়তো আমরাই সামলাতে পারব, কিন্তু মার্শাল থাকলে সুবিধা, সবকিছু আইন মাফিক হবে।

উইনচেস্টারটা পায়ের কাছে রেখে চুরুট ধরাল হারপার, তারপর ক্ষীণ হাসল। কোন মার্শালই পাব না আমরা। থমসন আর কিনকেড আছে এখানে-এ কথা শোনার পর নেহাত বোকা ছাড়া দায়িত্ব নেবে না কেউ। ওদের এখনও চিনতে পারোনি তুমি, জেফ। দেখেছ তো, কিভাবে শায়েস্তা করেছে শাটনকে?

থমথমে হয়ে গেল হ্যালার্ডের মুখ। এই শহর ছেড়ে চলে যাওয়ার হুকুম দেব ওদের!

জেফ, ভুলেও ওই কাজ করতে যেয়ো না, বলল ক্লেটন। মানছি যথেষ্ট সাহস আছে তোমার, কিন্তু সাহসে সবকিছু হয় না। ওদের মত দ্রুত নও তুমি, হাসতে হাসতেই তোমাকে খুন করে ফেলবে এদের যে কেউ।

পলকহীন দৃষ্টিতে জ্যাক ক্লেটনকে দেখছে হ্যালার্ড, তলে তলে রাগ আর অসন্তোষে ফেটে পড়তে বাকি। তাহলে ওদের মত দ্রুত কে?

কয়েকজন তো আছেই…শ্যানন, অ্যাৰ্প, কোবিন উইন্সটন, হারডিন… হ্যালার্ডের রাগের কারণ বুঝতে পারছে হারপার, তবে হাসল না সে। এবং ড্যানি লসন। ওকে ছাড়া ধারে-কাছে কাউকে পাওয়া যাবে না বোধহয়। শুনেছি এদিকেই এসেছে লসন। কেউ যদি পারে তো সে ড্যানি লসনই।

ও তাহলে আরেক বিগ থমসন!

না, ড্যানি লসন ওরকম নয়। জীবন বাজি রেখে বলতে পারি আমি। সত্যি কথা বলতে কি, কয়েকবার তাই করেছি।

<

Super User