ঠিক মাঝরাতে গিরিপথের মাথায় এসে পৌঁছল ওরা। অর্ধ বৃত্তাকারে সামনের দিকে হাত নেড়ে জুলিয়াস বলল, ভাল করে চেয়ে দেখো, এড, পুরো ইডেন পার্কটাই দেখা যাচ্ছে নিচে।

কতটা চওড়া? প্রশ্ন করল এড।

যে-কোন দিকেই ঘোড়ার পিঠে একদিনের পথ। মাঝে মধ্যে জঙ্গল, আছে, কিন্তু ফাঁকা এলাকা সবটাই চমৎকার সবুজ মাঠ।

অন্ধকারে বিশেষ কিছুই দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু এখানকার সব কিছুই জুলিয়াসের এত পরিচিত যে সে অন্ধকারেই আঙুল নির্দেশ করে একে একে বলে গেল কোথায় কি আছে। সে ভাল করেই জানে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না এড, তবু কেবল কথা চালিয়ে যাবার খাতিরেই বলে চলল। কথা বলার মোটামুটি একটা নিরাপদ বিষয় এটা। এর আগেও কয়েকবার থেমেছে ওরা, কিন্তু দু’জনেই কেমন একটা অস্বস্তি বোধ করেছে। এখন আর কেউই নিশ্চিন্তে মন। খুলে কথা বলতে পারছে না।

রকিং এইচে পৌঁছতে কি আমাদের শহর হয়ে যেতে হবে?

না, শহরকে দক্ষিণে রেখে সোজা পথে পশ্চিমে যাব আমরা।

আর কতক্ষণ লাগবে?

এখনও দূর আছে। ভোর হয়ে যাবে। একটা সিগারেট ধরাল এড। ক্রেস্টলাইনের শেরিফ কে?

ডিগবি নোল লোকটা কেমন?

আমার ভাল লাগে না। লোকটাও পছন্দ করে না আমাকে। অবশ্য সেটা আমাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার।

ঘোড়ার ওপর একটু নড়ে চড়ে বসল এড়। তারপর ওর দিকে মুখ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, জুলিয়াস, আমার সম্বন্ধে কৌতূহল হচ্ছে না তোমার?

নিশ্চয়ই।

তবে কোন প্রশ্ন করোনি কেন?

তাতে কি কোন ফল হত?

না।

আমিও তাই আন্দাজ করেছিলাম, এড।

মৃদু হাসল লোকটা। বলল, জুলিয়াস, আমরা দুজনে একই পক্ষে থাকলে। খুশি হতাম, কিন্তু দুঃখের বিষয় তা হবার নয়।

শুষ্ক হাসি হাসল জুলিয়াস। যাবার জন্যে তৈরি তুমি?

তোমার বলার অপেক্ষাতেই রয়েছি।

ধীরে ধীরে পার্কে নামতে শুরু করল ওরা। ঘণ্টা দুই পরে কয়েকটা অতি পরিচিত জায়গা পার হলো জুলিয়াস। ছেলেবেলায় জারভিস আর পেপির সাথে অনেক খেলেছে এখানে। তার সৎমা বেঁচে থাকতে কোনদিন সে বুঝতে পারেনি ওরা তার আপন ভাইবোন নয়। সৎমাকেই নিজের মা বলে জানত। তিনি মারা যাবার অনেকদিন পর ধীরে ধীরে টের পেয়েছে সে। তার নিজের মা ছিলেন বাঙালী। খ্রীস্টান ছেলের সাথে বিয়ে দিতে রাজি হননি তাঁর বাপ-মা। চুপিচুপি বিয়ে করে তার মাকে নিয়ে দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছিলেন সেবাস্টিন দত্ত। অনেক দেশ ঘুরে শেষ পর্যন্ত আমেরিকায় এসে ঘর বেঁধেছিলেন তাঁরা। কিন্তু জুলিয়াসের জন্মের সময়েই মারা যান তিনি। দুই বছর পর একজন আমেরিকান মহিলাকে বিয়ে করেন সেবাস্টিন দত্ত। তাঁরই গর্ভে জন্ম জারভিস আর পেপির।

বড় হবার পরে সে যে ওদের সৎ ভাই হাজারো রকমে তা বুঝিয়ে দিতে ত্রুটি করেনি ওরা।

উনিশ বছর বয়সেই জারভিস লম্বা সুপুরুষ হয়ে উঠেছে। চেহারা সুন্দর হলেও বয়স যতই বাড়ছে ততই সে হয়ে উঠছে মদ্যপায়ী, উচ্ছঙ্খল, অদূরদর্শী আর অস্থির। জুয়া খেলতে খুব ভালবাসে, তবে জেতার চেয়ে হারেই বেশি। পিস্তল একটা কোমরের বেল্টে ঝুলায় বটে তবে ওটার ব্যবহার জানে না সে। ওটা কোমরে থাকলে নিজেকে পরিণত-বয়স্ক পুরুষ মনে হয় বলেই রাখা! বাবা তাকেও পিস্তল চালানো শেখাতে অনেক চেষ্টা করেছেন, কিন্তু কষ্ট করে নিয়মিত অনুশীলন করতে হয় এমন কোন কাজেই সে উৎসাহী নয়।

জারভিসের মাত্র এক বছরের ছোট পেপি। কিন্তু পেপি যে আসলে কেমন তা জুলিয়াস নিজেও বর্ণনা করতে পারবে না। অপূর্ব সুন্দরী, আর জারভিসের মতই অস্থির সে-ও। যে-কোন পুরুষ মানুষের মতই ঘোড়া চালাতে আর ল্যাসো ব্যবহার করতে পারে, কিন্তু পুরুষদের মোটেও সহ্য করতে পারে না। অনেকেই তার সাথে একটু বন্ধুত্ব করতে পারলে বর্তে যায়, ওদের কাউকেই পাত্তা দেয় না পেপি। এমনকি বাবাও বিচলিত হয়ে ওর ব্যাপারে দু’একবার জুলিয়াসের সাথে আলাপ করেছেন। সে বাবাকে অভয় দিয়েছে সময় হলেই সব ঠিক হয়ে যাবে-কিন্তু নিজেই সে এ ব্যাপারে নিশ্চিত নয়।

আমাদের তো এতক্ষণে পৌঁছে যাবার কথা? প্রশ্ন করল এড।

আকাশ ফিকে হয়ে আসছে। সকাল হতে আর বেশি বাকি নেই। রকিং এইচের বাবুর্চি সকালের নাস্তার যোগাড়ে লেগে গেছে। ঠিক সময় মতই ওরা হাজির হবে।

প্রায় এসে গেছি, আর মাত্র দু’মাইল।

নিজের পিস্তল চেক করে নিল এড। তারপর মস্করা করে বলল, এটা আমার একটা পুরোনো অভ্যাস।

আমারও, বলে নিজেরটাও পরীক্ষা করে দেখে আবার খাপে ভরল জুলিয়াস।

তাই নাকি? কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বলে উঠল এডু।

হ্যাঁ, সত্যিই তাই, হেসে জবাব দিল ও।

তাদের সামনে চওড়া মাঠটার পরেই দেখা যাচ্ছে র‍্যাঞ্চের ঘরগুলো। উঁচু ছাদওয়ালা বিরাট গুদাম ঘরটাই সবার আগে নজরে পড়ে। তবে প্রধান বাড়িটাও নেহাত ছোট নয়। ওটার পরেই একটা কেবিন, কয়েকটা টিনের চালা আর আস্তাবল। বাড়ির পিছনে ঢাকা পড়ে আছে আরও কয়েকটা ছোট ছোট ঘর।

বিরাট ব্যাপার, তাই না? এডের স্বরে সন্তোষ প্রকাশ পেল।

আমাদের বেশ চলে যায়, বলল জুলিয়াস।

মাঠের ওপর দিয়ে এগিয়ে চলল ওরা। হাসিহাসি মুখ করে রয়েছে জুলিয়াস। বাড়ি ফিরে এসেছে বলে স্বস্তি বোধ করতে চাইছে সে। কিন্তু দেহের সবক’টা পেশী উৎকণ্ঠায় টানটান হয়ে আছে, পেটের ভিতরে অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে। দূরে নাস্তার আয়োজনের সাড়া পাওয়া যাচ্ছে।

সময় মতই হাজির হয়েছি আমরা, বলল এড।

উঠানে পৌঁছানোর পরেও কাউকে দেখতে পেল না ওরা। কেউ নিশ্চয়ই ওদের দেখেছে, কারণ ওরা নেমে ঘোড়া বাধতে বাঁধতেই মেডক লেটন বেরিয়ে। এল। ওদের দেখেই মুখ বাড়িয়ে ভেতরে কাকে যেন কি বলল সে। ওরা এগিয়ে যেতেই আরও কয়েকজন এসে হাজির হলো মেডকের পাশে। জারভিস আর পুরোনো লোক ব্রায়েন চাইল্ডকে চিনতে পারল জুলিয়াস, অন্যেরা তার অপরিচিত। ওদের মধ্যে দু’জনকে বেশি করে নজরে পড়ল তার। একজনের কেমন একটু পেঁচানো দেহ, একটা কাঁধ অন্যটার চেয়ে কিছুটা নিচু, রোদে পোড়া গায়ের রঙ। দ্বিতীয়জনের বিশাল লম্বা-চওড়া দেহ, লালচে গাল, মোটা

এক জোড়া ঠোঁট আর থ্যাবড়া নাক। দাঁত বের করে হাসছে লোকটা।

কি ব্যাপার, একেবারে পুরো অভ্যর্থনা কমিটি! ঠাট্টা করে বলল এড।

চট করে একবার এডের দিকে চেয়ে দেখল জুলিয়াস। কৌতুকে ভরা ওর চেহারা, চোখ দুটো ঝিকমিক করছে। দুশ্চিন্তার কোন ছাপ নেই ওর মুখে।

ও কিছু না, সব এখানকারই লোক, বলল জুলিয়াস।

তাই নাকি?

মেডক আর জারভিস একটু দূরে বারান্দায় দাঁড়িয়ে খানিক আলাপ সেরে নিয়ে এখন ঘুরে ওদের দিকে চেয়ে রয়েছে। ভারি চওড়া কাঁধ মেডকের। মুখে গভীর বলীরেখা, কঠিন চোখ আর শক্ত উঁচু চোয়াল। লোকটা সব সময়েই রেগে আছে বলে মনে হয়। কিন্তু আসলে ওর চেহারাটাই ওরকম। জুলিয়াস যেদিন ওকৈ চাকরিতে নিয়েছিল সেদিনও ওর চেহারাটা এই রকমই দেখেছিল। র‍্যাঞ্চে লোকের খুব প্রয়োজন থাকায় একরকম বাধ্য হয়েই ওকে নিয়েছিল সে। জারভিসের চেহারাও রুষ্ট। কোন কিছু সামান্য একটু এদিক ওদিক হলে বা পছন্দ মত না হলেই সেটা ফুটে ওঠে ওর চেহারায়!

কেমন আছ, জারভিস? সহজ ভাবেই জিজ্ঞেস করল জুলিয়াস, বাবা কোথায়?

প্রশ্নের জবাব না দিয়ে মুখটা একটু বাড়িয়ে অস্বাভাবিক উঁচু স্বরে সে পালটা প্রশ্ন করল, আবার ফিরে এলে কেন তুমি?

এ আবার কেমন প্রশ্ন? বাড়িতে ফিরব না আমি?

সে কথা বলছি না। তোমার গোলমালে জড়িয়ে পড়ার খবর আমরা পেয়েছি।

ঝামেলা যা ছিল মিটে গেছে, বলল জুলিয়াস। বাবা কোথায়?

অস্বস্তিভরে মেডকের দিকে চাইল জারভিস। এগিয়ে এসে মেডক বলল, আমি দুঃখিত, জুলিয়াস, তোমার বাবার শরীর খারাপ-আসলে খুবই দুর্বল আর

অসুস্থ উনি।

অসুখ! উৎকণ্ঠিত হয়ে উঠল জুলিয়াস। কি হয়েছে বাবার?

শরীর অত্যন্ত দুর্বল, বিশ্রাম দরকার।

কোথায়, নিজের ঘরে?

হ্যাঁ, কিন্তু এখন দেখা করতে পারবে না তুমি।

কি বললে? জুলিয়াসের বিস্ময় চরমে পৌচেছে।

ঠিকই বলছি। ডাক্তারের নির্দেশ, কোন রকম উত্তেজনা একেবারে নিষিদ্ধ। তুমি দেখা করতে গেলে স্ট্রোক হয়ে মৃত্যু ঘটতে পারে।

একেবারে হতবুদ্ধি হয়ে গেছে জুলিয়াস। নিজের কানকেই আর বিশ্বাস হচ্ছে না ওর। বুড়ো হননি তার বাবা। সুস্থ, সবল আর কর্মঠ-মাত্র পঞ্চাশের কোঠায় তার বয়স। যে-কোন তিরিশ বছরের যুবকের সাথে পাল্লা দিয়ে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘোড়া দাবড়েও ক্লান্ত হবার পাত্র নন তিনি। সেই লোক বিছানায় মরণাপন্ন! ভাবতেই অসম্ভব ঠেকছে তার। দেখা করতে পারবে না-কিন্তু সে দেখা করলে বাবার উত্তেজিত হবার কি কারণ থাকতে পারে?

জারভিস কথা বলছে, ব্যাখ্যা দিচ্ছে, কিন্তু সেই সাথে জুলিয়াসকে দোষারোপ করছে। সবই তোমার দোষ, জুলিয়াস। তুমি চলে যাওয়ার সাথে সাথেই বাবা অসুস্থ হয়ে পড়ে। তোমার সাথে ঝগড়া করার পরই এই রকম হয়েছে। ডাক্তার বলেছে তোমার জন্যেই আজ তার এই দশা, তুমি যদি আবার তার সামনে যাও…

বাধা দিয়ে জুলিয়াস বলে উঠল, আমাদের কথা কাটাকাটি হয়েছে তা কে বলল তোমাকে?

আমি ছিলাম কাছেই-গুদাম ঘরের ভিতর সেদিন তোমাদের কি কথা হয়েছিল সব শুনেছি আমি।

তাহলে শেষটুকুও নিশ্চয়ই শুনেছ? সমঝোতা হয়েছিল আমাদের।

বাবা তোমাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিল।

তুমি ভাল করেই জানেনা, জারভিস, বাবা তেমন কিছুই করেননি।

ঠোঁট কামড়াল জারভিস। যা শোনার ঠিকই শুনেছি আমি। বাবা তোমাকে বের করে দিয়েছে।

এইভাবে গলাবাজি করে কোন মীমাংসা হবে না। বারান্দায় দাড়ানো সবার। দিকে চাইল জুলিয়াস। পুরোনো লোক ব্রায়েন ইশারায় তাকে সাবধান করল। কি বোঝাতে চাইছে সে? কিসের বিরুদ্ধে সাবধান করছে? তার ইচ্ছে করছে সব ভেঙেচুরে দরকার হলে সবার সাথে মারপিট করে ছুটে বাবার ঘরে গিয়ে হাজির হতে। কিন্তু উপায় নেই, বাবা যদি সত্যি অসুস্থ থাকেন তবে কোন মতেই তা ঠিক হবে না। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে জারভিসের দিকে চেয়ে সে বলল, শোনো জারভিস, বাবা একা তোমার নন; আমারও। আমি তার সাথে দেখা করব, বাধা দেয়ার চেষ্টা কোরো না।

খুবই আশঙ্কাজনক পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে। জুলিয়াস জানে না এর পরে কি করবে। তাকে অবাক করে দিয়ে হঠাৎ মেডক, বলে উঠল, এত উত্তেজিত হয়ে। ওঠার কিছু নেই, জুলিয়াস। বাবার সাথে দেখা নিশ্চয়ই হবে তোমার। এত ভোরে এখনও ওঠেনি সেবাস্টিন-তোমরা বরং ততক্ষণে নাস্তা সেরে নাও।

এড বলে উঠল, আমার ব্যাপারটা কি হবে?

তুমি আবার কোন নাগর? বিরক্ত হয়ে প্রশ্ন করল মেডক।

আমার নাম এডমন্ড ফিনলে। চাকরি খুঁজছি আমি। জুলিয়াসের সাথে পথে দেখা, সে বলল এখানে কাজ পেতে পারি আমি।

তোমার ব্যাপারে পরে ভেবে দেখব। নাস্তার পর কথা হবে।

এবার জুলিয়াসের অবাক হবার পালা। মেডকই চিঠি লিখে খবর দিয়ে আনিয়েছে এডকে, নিশ্চয়ই ওরা দু’জন দু’জনকে চেনে, অথচ ভাব দেখাচ্ছে। যেন কেউ কাউকে দেখেইনি কোনদিন!

যাক, আমাকে অন্তত দূর দূর করে তাড়াচ্ছে না, অস্ফুট কণ্ঠে বলল এড।

সময় এখনও ফুরিয়ে যায়নি, জবাব দিল জুলিয়াস।

সার বেঁধে ভিতরে ঢুকল সবাই। খাওয়ার মাঝে বিশেষ কথা হলো না। সবাইকে অগ্রাহ্য করে জারভিস বসেছে টেবিলের মাথায় বাবার আসনে। মেডক লেটন বসেছে তার ডান দিকে, তিন মাস আগেও ওই আসনটা ছিল জুলিয়াসের মেডকের উল্টোদিকে বসেছে এড়। ব্রায়েন চাইলডের পাশে বসতে পারলে ভাল হত, কিন্তু ওর দু’পাশে আগেই অপরিচিত লোক বসে গেছে। কার কোথায় বসার অধিকার আছে না আছে এ-নিয়ে আর হট্টগোল বাধাল না সে। পরে এক সময়ে সুযোগ বুঝে ব্রায়েনের সাথে কথা বলবে-জারভিস আর মেডকের সাথেও অনেক কথা আছে তার। নানান প্রশ্নের ভিড় জমেছে ওর মাথায়।

খেতে বসে আপন মনেই পরিস্থিতিটা বিচার করে দেখছে জুলিয়াস। বাবা অসুস্থ, হয়তো বা অকর্মণ্য হয়ে পড়েছেন। তাতে সব দায়িত্ব জারভিসের কাঁধে চেপেছে, আর তার কাজে সহযোগিতা করার জন্যে মেডককে বেছে নিয়েছে সে। কিন্তু টেবিলের আর সব লোক কোথা থেকে এল? কেবল ব্রায়েন ছাড়া। বাকি সবাই জুলিয়াসের অপরিচিত। হয়তো নতুন কাজে নেয়া হয়েছে ওদের। কিন্তু এর মধ্যে আরও কথা আছে! এড়কে চিঠি লিখে খবর দিয়ে আনানো হয়েছে। বাকি সবাইকেও কি একইভাবে আনা হয়েছে? তাই যদি হয়, এসবের কারণ কি? মেডকের কি কোন মতলব আছে?

আর এক কাপ কফি খেলো জুলিয়াস। পেপি এখনও অনুপস্থিত। কিন্তু এতে আশ্চর্য হবার কিছুই নেই। পুরুষ লোকদের সাথে খেতে পছন্দ করে না সে। বাড়ির মধ্যে ওদের নিজস্ব আর একটা খাবার ঘর আছে, সেখানেই খায়

সবার আগে জারভিসের খাওয়া শেষ হলো। মেডকের সাথে একটু আলাপ করে নিয়ে উঠে দাড়াল সে। দেখি বাবা উঠেছে কিনা, বলল জারভিস, তার ঘরে তোমাকে ঢুকতে দেবে কিনা সেটাও জিজ্ঞেস করব আমি।

ধন্যবাদ, শুকনো গলায় জবাব দিল জুলিয়াস।

বাবার, জবাব সম্বন্ধে কোন সন্দেহ নেই তার মনে। যাবার দিন তার সাথে কথা কাটাকাটি হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু তখনই তা মিটমাট হয়ে গেছে। মাথা গরম করে বেরিয়ে গেলেও বাবা তার সাথে দেখা করতেন। কোন সমস্যাই এড়িয়ে যাওয়া তার নীতি নয়, সমস্যার সামনাসামনি মোকাবিলা করাই তার চিরকালের স্বভাব।

ব্রায়েন বেরিয়ে গেল। বাকি সবাই থাকল ঘরে। মেডক আর এড কাজের ব্যাপারে আলাপ শুরু করল এবার। জুলিয়াস ভাবছে এত ভণিতা কেন? টেবিলের অন্য সবাইকে এত সব কথা কি তার উদ্দেশেই শোনানো হচ্ছে? লোক নেয়ার আগে সাধারণত যেসব প্রশ্ন করা হয় সেসব প্রশ্নই করল মেডক। এডও ঠিক ঠিক জবাব দিল। অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়ে নেয়া হলো ওকে। সন্দেহ নেই শিগগিরই ওদের মধ্যে গোপন বৈঠক বসবে।

হঠাৎ পেপিকে দেখা গেল দরজার মাথায়। সম্ভবত, জারভিসই তাকে খবর দিয়েছে। বুট পরেছে সে, স্কার্টটা দুই পাশে ফাড়া, গায়ে বাদামী ব্লাউজ আর গলায় কায়দা করে একটা রুমাল বাঁধা। চুল পিছন থেকে তুলে শক্ত করে মাথার সাথে ক্লিপ দিয়ে আঁটা। ঘোড়ায় চড়ে বেরুবোর সাজে সেজেছে সে। সুন্দর লম্বা গড়ন, ছিপছিপে দেহ। আকর্ষণীয় অথচ নিপ্রাণ। হাসলে চোখ ধাধিয়ে যায়। কিন্তু এ মুহূর্তে আসছে না। ঠোঁট দুটো চেপে বসে আছে-চোখ দুটো কঠিন।

কেমন আছ, পেপি? উঠে দাঁড়াল জুলিয়াস।

জবাব না দিয়ে ঠাণ্ডা গলায় পাল্টা প্রশ্ন করল সে, তুমি ফিরে এলে কেন?

না ফেরার তো কোন কারণ দেখি না।

আমরা শুনেছি ডেনভারে তুমি মানুষ খুন করেছ, ফাঁসি হবে তোমার।

হাসল জুলিয়াস। ভুল শুনেছ তোমরা।

খবরটা শুনেই বাবার প্রায় মরার দশা হয়েছিল। এখন আবার নিজেই এসে হাজির হয়েছ-তোমাকে কোন প্রয়োজন নেই আমাদের।

সব লোকজনের সামনেই কথাগুলো বলল পেপি। বাবা যখন বাড়ির প্রধান কর্তা ছিলেন তখন পারিবারিক ঝগড়া বিবাদ অন্যদের কাছ থেকে গোপন রাখাই ছিল তাঁর নীতি। বাবার অনুপস্থিতিতে পুরোনো সব নিয়ম-কানুনও বিসর্জন দেয়া হয়েছে।

টেবিলের লোকজনের দিকে চাইল জুলিয়াস। আসলে ওদের দেখছে না, পেপিকে বোঝার চেষ্টা করছে সে। পেপি কোনদিনই খুব একটা আপন ছিল না, কিন্তু তার আজকের এই রূঢ় ব্যবহার সত্যিই অভাবনীয়। কঠিন সে আগেও ছিল তবে কথায় এই বিষ ছিল না। বরং বছরখানেক ধরে জুলিয়াসের সাথে বেশ বন্ধুসুলভ ব্যবহারই করেছে ও। একবার জারভিসের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন হয়ে জুলিয়াসের সাথে খোলাখুলি আলাপও করেছিল পেপি। কিন্তু কি হয়েছে ওর? বোঝাই যাচ্ছে জুলিয়াসের ঝামেলার কথা কিছু শুনেছে সে, কিন্তু সেটাই কি কারণ?

পেপির দিকে মুখ তুলে চাইল এড়। ওর চেহারা শান্ত অথচ কঠিন। দেখাচ্ছে। বলো তো ওকে এখান থেকে বের করে দেই। এই কাজে ওস্তাদ আমি।

ওর দিকে চোখ ফিরাল পেপি! তুমি আবার কে?

এইমাত্র কাজে নেয়া হয়েছে আমাকে। হয়তো তোমাদের কথার মাঝে কথা বলা ঠিক হয়নি-কিন্তু ওই আমার দোষ, যেখানে নাক গলানোর কোন দরকার নেই সেখানেই গলিয়ে বসে থাকি।

বড় বেশি কথা বলো তুমি! তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল পেপি।

জারভিস ফিরে এসে দাঁড়াল পেপির পাশে। বোনের কাঁধে একটা হাত রেখে জুলিয়াসের দিকে চেয়ে সে বলল, বাবা তোমার সাথে দেখা করতে রাজি। হয়েছেন-কিন্তু মনে রেখো মাত্র এক মিনিট সময় দেয়া হবে তোমাকে। আর তুমি যদি কোনরকম বাদরামি বা চালাকির চেষ্টা করো তবে আমি নিজে তোমার সবকটা হাড় ভেঙে গুড়িয়ে দেব।

হাস্যকর শাসানি, একেবারে খেলো শোনাল। এর কোন জবাব না দিয়ে। টেবিল ছেড়ে উঠে ওদের দিকে এগিয়ে গেল জুলিয়াস।

<

Super User