নরকে
গোলাম মাওলা নঈম
প্রথম প্রকাশ:
১৯৮৮

০১.

রাতটা গানসাইট হিলসে কাটিয়েছে এরিক ক্ৰেবেট। অভিযাত্রীদের অন্য একটা দল আগেই ওঅটর হোলে পৌঁছে গিয়েছিল; তাদের এড়িয়ে যাওয়ার ইচ্ছে থেকে এগোয়নি সে, পাহাড়ী ঢালে শুকনো একটা জায়গায় ক্যাম্প করে শুয়ে পড়েছিল; তারপর ভোর হওয়ার পরপরই ট্রেইল ধরে ইয়োমা ক্রসিঙের উদ্দেশে যাত্রা করল ও।

এরিক ক্ৰেবেটকে দেখলেই বোঝা যায় পোড়খাওয়া মরুভূমির মানুষ। রোদপোড়া চামড়া, ঘন কালো চুল; চৌকো মুখে বা স্বচ্ছ নীল চোখে কোমলতার চিহ্নমাত্র নেই। চোখের কোণের চামড়ায় অসংখ্য ভাঁজ পড়েছে; চাহনি এত ঠাণ্ডা আর নির্লিপ্ত যে দ্বিতীয়বার তাকাতে চিন্তা করবে যে-কেউ।

দীর্ঘ সুঠামদেহী মানুষ সে। চওড়া কাঁধ, সরু কোমর। সহজ স্বতঃস্ফূর্ত চলাফেরা, অশ্বারোহীদের স্বাভাবিক আড়ষ্টতা নেই; শিকারীর ক্ষিপ্রতায়, নিঃশব্দে হাঁটে ও। বহু অর্থেই শিকারী বলা চলে ওকে।

ফ্ল্যাট ব্রিমের, ফ্ল্যাট ক্রাউনের কালো হ্যাট মাথায়, সরু এক প্রস্থ দড়ি দিয়ে চিবুকের সঙ্গে ঝোলানো। একসময় লাল ছিল গায়ের শার্টটা, কিন্তু রঙ ঝলসে গিয়ে ফ্যাকাসে হয়ে গেছে এখন। বহুল ব্যবহৃত কালো ভেস্ট গরুর চামড়ার তৈরি, দু’এক জায়গায় ছড়ে গেছে; জিন্সের উপর পরেছে ঝালর দেওয়া শটগান চ্যাপস। নিচু করে ঝোলানো জোড়া স্মিথ এন্ড ওয়েসন ঝুলছে কোমরে, পয়েন্ট ফোর-ফোর সিক্সশূটার। পয়েন্ট সেভেন থ্রী উইনচেস্টারটা স্যাডল-স্ক্যাবার্ডে রয়েছে।

দীর্ঘ পা-অলা একটা জেব্রা ডানে চড়েছে এরিক। জ্বলজ্বলে চাহনি ওটার শক্তি, সামর্থ্য আর সহিষ্ণুতার প্রমাণ দেয়। আতঙ্কিত কয়োটের মত ছুটতে সক্ষম, উট বা লঙহর্ন হরিণের মত পানি ছাড়া ছুটতে পারে দিনের পর দিন।

এরিক ক্ৰেবেট পুরোমাত্রায় বাস্তববাদী মানুষ। ধন, সম্পত্তি বা গন্তব্য কোনটাই নেই ওর। চোদ্দ বছর বয়সে কলেরায় বাবা-মাকে হারানোর পর সুদীর্ঘ দেড় যুগ নানা কাজ করেছে-ফ্রেইটার, কাউবয়, মোষ শিকারী, আর্মি স্কাউট; শটগান, গার্ড এবং দুটো শহরের মার্শাল হিসাবে কাজ করেছে। ট্রেইল ড্রাইভে টেক্সাস থেকে ক্যাম্পাসে গেছে তিনবার। কখনোই নির্দিষ্ট কোন পরিকল্পনা ছিল না ওর; যখন যে-কাজ পেয়েছে, তাই করেছে। এক হিসাবে ভবঘুরেও বলা চলে ওকে, যেহেতু কোথাও বেশিদিন থাকেনি। ঘোড়ার কান দুটোকে অনুসরণ করে ও, নিত্যদিনের নানা সমস্যা সামলে টিকে আছে।

গানসাইট হিলস থেকে ঘণ্টা খানেক পর শুকনো একটা ওঅশের তলায় ঘোড়া থামাল এরিক, স্যাডল ছেড়ে ক্রল করে ওঅশের কিনারায় চলে এল। চারপাশ দেখবে। কিনারায় উঁচু বোল্ডারের আড়াল উঁচিয়ে মাথা তুলল ও, খুঁটিয়ে মরুভূমি জরিপ করল। কঠিন জীবনে অভ্যস্ত এরিক জানে ইন্ডিয়ান এলাকায় সতর্কতার আরেক নাম জীবন। দূরে, সরু রেখার মত দৃশ্যমান অ্যারিজোনা আর মেক্সিকোর সীমান্তে ধুলো চোখে পড়ছে।

দশজন রাইডার, বিড়বিড় করল এরিক। বারোজনও হতে পারে।

চিন্তার কথা। মরুভূমিতে একসঙ্গে এত লোকের আগমনের তাৎপর্য একটাই-ঝামেলা। চারদিন আগে টুকসন থেকে রওনা দেওয়ার সময় এ-ধরনের কোন সংবাদ পায়নি এরিক। দক্ষিণে মরুভূমির বেশিরভাগ অংশ এতটা ভাল করে চেনা আছে ওর যে জানে নেহাত বাধ্য না হলে এই নরকে আসে না কেউ।

এক ডজন মানুষ। পাসি, আউটল, ইন্ডিয়ান কিংবা ফোর্ট ইয়োমা থেকে আসা আর্মির পেট্রল বাহিনীও হতে পারে। তবে অনেকদিন ধরে শান্ত আছে এলাকা, তাই আর্মির আসার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ, আর এতটা পশ্চিমে অ্যাপাচিদের আনাগোনা নেই বললেই চলে।

কিন্তু অ্যাপাচি চীফ চুরুতির ব্যাপারে কোন কিছুই নিশ্চিত বলা যায় না। মা-র দিক থেকে ইয়াকিদের সঙ্গে রক্তের সম্পর্ক আছে বলে প্রায়ই পশ্চিম সোরায় যাতায়াত করে সে।

স্যাডলে চেপে পশ্চিম-মুখো পথ ধরল এরিক। ধুলো উড়াতে চায় বলে ঘোড়ার গতি কমিয়ে ফেলেছে। দক্ষিণের এক ডজন রাইডার এবং গতরাতে গানসাইট হিলসের পাদদেশে রাত কাটানো তিনজনের উপস্থিতি অস্বস্তি ধরিয়ে দিয়েছে ওর মনে। এরিকের কাছ থেকে অনেক দূরে ছিল তারা, মুখ দেখার উপায় ছিল না। কিন্তু ক্যাম্পের আগুন অপেক্ষাকৃত বড় ছিল, ইন্ডিয়ানরা কখনও এত বড় আগুন জ্বালায় না। সেক্ষেত্রে, নিশ্চিতভাবেই বলা যায় এরা সাদা মানুষ।

সরাসরি ট্রেইল ধরে এগোচ্ছে না ও, বরং ট্রেইলের পঞ্চাশ গজ সমান্তরালে এগিয়ে চলেছে; কারণটাও সহজ-এরিক চায় না অন্য কেউ সহজে ওর ট্র্যাক খুঁজে পাক। এ অবস্থায়, দক্ষিণ থেকে কেউ মূল ট্রেইলের দিকে না এলে খুঁজে পাবেও না।

*

পশ্চিম অ্যারিজোনার বিস্তীর্ণ এই মরুভূমিতে চলাচলের পূর্বশর্ত হচ্ছে পানি। কয়েকশো মাইলের মধ্যে গুটি কয়েক ওঅটর হোল রয়েছে, একটার সঙ্গে আরেকটার দূরত্ব অনেক; উপরন্তু কোন কোনটা গ্রীষ্মের সময় পুরোপুরি শুকিয়ে যায়। যে-ট্রেইল ধরেই যাক না কেন, একাধিক ওঅটর হোল ব্যবহার করতে হবে, নইলে এখানে বেঁচে থাকা প্রায় অসম্ভব।

সামনে, গতরাতের ক্যাম্প থেকে আনুমানিক বিশ মাইল দূরে প্রথম ওঅটর হোলটা-পশ্চিমমুখী দুই ট্রেইলের মাঝামাঝি। কিন্তু টুকসনে থাকতে এরিক শুনেছে পানিশূন্য থাকতে পারে ওটা। সেক্ষেত্রে, ওটার উপর নির্ভর না করাই উচিত। পরের পানির উৎস আরও বিশ মাইল দূরে পাপাগো ওয়েলস। দক্ষিণের লাভা ভূমির শুরুতে জায়গাটা। নেহাত দুর্ভাগা না হলে দুটোই খুঁজে পাওয়ার কথা। হয়তো সেখানে দেখা হয়ে যেতে পারে দুই দলের কারও সঙ্গে, তবে এ-নিয়ে তেমন ভাবছে না এরিক, পানি পাওয়াই হচ্ছে আসল ব্যাপার।

মরুভূমি মানেই পানির অভাব, উপরন্তু বৃষ্টি হয় না। মানুষ বা পশুর হাড় দেখে, ট্রেইল চিনতে হয়-কখনও কখনও মানুষের পাশেই মারা যায় ঘোড়া-পানির অপরিহার্যতাই এখানে সমস্ত চলাচলের দিক নির্ধারণ করে। নানা দিক থেকে ওঅটর হোলের দিকে চলে আসে ট্রেইল। কাছেরটা যদি শুকনো হয়, তা হলে পাপাগো ওয়েলসে যেতে হবে। জায়গাটা নির্জন, ব্যাসল্টের তৈরি তিনটা বেসিনে কালচে পানি রয়েছে। পানির যতই চাহিদা থাকুক, প্রয়োজনের চেয়ে বেশি সময়, ওখানে থাকতে চাইবে না কেউ।

পাপাগো ওয়েলসের পর সবচেয়ে কাছের পানির উৎস টুল ট্যাঙ্ক, ইয়োমা ট্রেইল ধরে ত্রিশ মাইল পথ অতিক্রম করতে হবে। এক ইন্ডিয়ানের কাছে অন্য একটা ওঅটর হোলের কথা শুনেছে এরিক, জায়গাটার নাম হার্ট ট্যাঙ্ক, পাপাগো ওয়েলসের উত্তরে সিয়েরা পিন্টার কাছাকাছি। এরিকের পরিচিত কেউ জানে না হার্ট ট্যাঙ্কের কথা। নির্দিষ্ট অবস্থান জানা না থাকলে মরুভূমিতে কোন ওঅটর হোল খুঁজে পাওয়া রীতিমত অসম্ভব, জানে ও। এ-ধরনের পানির উৎস পাহাড়ের উঁচুতে থাকতে পারে, যেমন আছে টিনাজা অ্যাটলাসে। হয়তো ওটার কয়েক হাত দূর দিয়ে পার হয়ে যায় তৃষ্ণার্ত মানুষ, কিন্তু পানি পায় না; কিংবা যখন ওখানে পৌঁছায়, পাহাড়ের উঁচুতে ওঠার শক্তি অবশিষ্ট থাকে না।

তীব্র গরম পড়ছে।

চোখ কুঁচকে দিগন্তের দিকে তাকাল এরিক। প্রচণ্ড দাবদাহে তাপতরঙ্গ নাচছে। গতরাতে গানসাইট হিলসে ক্যাম্প করেছিল যে তিনজন, তাদের তৈরি ধুলো দেখতে পেল ও। এরাও পশ্চিমে যাচ্ছে। চট করে দক্ষিণে চলে গেল এরিকের দৃষ্টি…বড়সড় দলটা আরও কাছে চলে এসেছে, তবে এখনও বহু মাইল দূরে রয়েছে। সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় পাপাগো ওয়েলসে যাওয়া উচিত-পিস্তল হাতে তৈরি হয়ে–এটা এমন এক এলাকা যেখানে একটা ঘোড়া বা পানির জন্য খুন হয়েছে বহু মানুষ।

কয়েকবার ঘোড়া থামিয়ে চারপাশ খুঁটিয়ে দেখে নিল এরিক, অস্বস্তি বোধ করছে ভিতরে ভিতরে। নির্জন মরুভূমিতে হঠাৎ এত লোকের উপস্থিতি ভাল ঠেকছে না।

এই মুহূর্তে পাপাগো ওয়েসের দিকে এগিয়ে চলেছে ছয়জন ঘোড়সওয়ার, আপাতত এরিকের অচেনা সবাই। তীব্র শঙ্কা এদের মনে, দু’একজন ইতোমধ্যে যমদূতের হাতছানিও দেখে ফেলেছে।

*

বেশ উত্তরে, অন্য এক ট্রেইলে রয়েছে দু’জন ঘোড়সওয়ার। এরাও চলেছে পাপাগো ওয়েলসের পথে। দক্ষিণের রাইডারদের সম্পর্কে কিছুই জানে না এরা, গুরুত্ব দিচ্ছে না, বরং মাঝে মধ্যে পিছন ফিরে তাকাচ্ছে, দু’জনের মধ্যে পুরুষটিই বেশি উদ্বিগ্ন ও শঙ্কিত।

একজন সৈনিকের যা করা উচিত-মাথা উঁচু, বুক টানটান করে স্যাডলে বসেছে সে। বেন ডেভিস সাবেক ক্যাভালরিম্যান। পরিপাটি চুল, সযত্নে ছাঁটা গোঁফ; সাদা হ্যাটের ব্রিমের নীচে তীক্ষ্ণ অন্তর্ভেদী নীল চোখ। দারুণ সুদর্শন, অভিব্যক্তি আর আচরণে সামর্থ্য এবং নির্জলা আত্মবিশ্বাস ঠিকরে পড়ে। মরুভূমির হালকা ধুলো জমলেও ডেভিসের পরনের কালো কোট উজ্জ্বল ও পরিপাটি দেখাচ্ছে। সবকিছুতে নিখুঁত থাকতে বা হতে পছন্দ করে সে। গর্বিত ভঙ্গিমায় ঘোড়া ছোটায়, সর্বক্ষণ সশস্ত্র থাকে। শক্তিশালী অপূর্ব একটা চেস্টনাটে চড়ে; বালিময় বা পাথুরে এবড়োখেবড়ো এলাকায় নয়, বরং ভার্জিনিয়ার পাহাড়ী অঞ্চলে ব্যবহারের জন্য শঙ্কর করা হয়েছিল ওটাকে। আত্মবিশ্বাসী টগবগে এক যুবক।

রাইডারদের অন্যজন অপরূপা এক যুবতী। ঘন কালো দীঘল চুল, ধূসর-নীল চোখ। মুখের অপরূপ সৌন্দর্য বা শরীরের প্রতিটি বাঁকে পরিপূর্ণতার আভাস থাকলেও মেয়েটির অভিব্যক্তিতে প্রচ্ছন্ন দৃঢ়তার ছাপ রয়েছে, যদিও সেটা পুরোপুরি বিকশিত হয়নি।

কী মনে হয়, তোমার বাবা অনুসরণ করবে আমাদের?

নিশ্চিত থাকতে পারো।

আমরা যদি বিয়ে করে ফেলি?

কিছু যায়-আসে না তাতে। ধরতে পারলে তোমাকে খুন করে ফেলবে বাবা। আমার জন্মদাতা হতে পারে, কিন্তু এত নিষ্ঠুর মানুষ আর দেখিনি। নিজের চোখে একটা খুন করতে দেখেছি ওকে, সেই থেকে বাবাকে ঘৃণা করি আমি।

লোকটা তোমাদের পরিচিত কেউ?

না…শুধু চেহারাটাই চিনতাম। শহরে কয়েকবার দেখেছি। একবার আমাদের র‍্যাঞ্চেও এসেছিল। বয়সে তরুণ হবে, সুদর্শন, খুব হাসি-খুশি ছিল। আমার তখন দশ-এগারো চলছে, আরেকটু হলে ওর প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম, তখনই ছেলেটাকে খুন করল বাবা। কারণটা কখনও জানতে পারিনি আমি।

ঘোড়ার খুরের আঘাতে ধুলো উড়ছে। চারপাশে কোথাও কোন শব্দ নেই, শুধু স্যাডলের খসখসে আর ঘোড়ার দ্রুত নিঃশ্বাস ফেলার আওয়াজ। প্রচণ্ড উত্তাপ থাকা সত্ত্বেও ধূসর ঘোড়ায় আসীন মেয়েটিকে শান্ত, পরিপাটি এবং পুরোপুরি বিনম্র দেখাচ্ছে।

গত ছয় বছরের মধ্যে এই মেয়েটির সঙ্গে পরিচয় সবচেয়ে মধুর এবং সৌভাগ্যের ঘটনা মনে হচ্ছে বেন ডেভিসের কাছে। গৃহযুদ্ধের আগ পর্যন্ত ভালই ছিল সে, কিন্তু যুদ্ধ সর্বনাশ নিয়ে এসেছিল ডেভিসদের জন্য। ওর বাবা, মাইক ডেভিস ছিলেন মেক্সিকান যুদ্ধের সক্রিয় সৈনিক, সহযোদ্ধা এক ক্যাপ্টেনকে দারুণ সমীহ করতেন। সেই ক্যাপ্টেন যখন দক্ষিণের বিরুদ্ধে ইউনিয়নের পক্ষ হয়ে দাঁড়িয়ে গেল, মাইকও শরীক হলেন। কিন্তু এটাই কাল হলো ডেভিসদের জন্য। যুদ্ধ শেষে দেখা গেল মর্যাদা বা কৌলিন্য না হারালেও সমৃদ্ধি হারিয়ে ফেলেছে ডেভিসরা। যুদ্ধে দারুণ সামর্থ্যের পরিচয় দিয়ে কর্নেল পদমর্যাদা লাভ করেছিলেন মাইক, এর কিছুদিন পর মিশনারি রিজে মারা যান তিনি। তরুণ বেন বাড়ি ফিরে এসে দেখতে পেল, ওদের পারিবারিক এস্টেট টিকে আছে বটে, কিন্তু প্রায় তছনছ হয়ে গেছে। ওটাকে খাড়া করতে সময় এবং শ্রম দুটোই ব্যয় করতে হবে। জমি তখনও যথেষ্ট উর্বর, বেগার খাটলে হয়তো দাঁড়িয়ে যেত এস্টেটটা, কিন্তু বেচে দিয়ে পশ্চিমে চলে আসার সিদ্ধান্ত নিল বেন।

একজন নিপাট ভদ্রলোকের যে-সব দক্ষতা থাকা উচিত, তাই ছিল ওর। নাচতে, রাইড করতে কিংবা গুলি করতে পটু; পানীয় বা তাসে আসক্তি এবং দক্ষতা দুটোই ছিল, কিন্তু তারপরও দ্র জীবনই বেছে নিয়েছিল বেন। আজীবন যে-ধারণা বুকে নিয়ে বড় হয়েছে-ডেভিসরা বরাবরই ভাগ্যবান, কখনোই দুঃসময়ে পড়ে না-বেশিদিন থাকল না। এস্টেট বিক্রির টাকা দ্রুত ফুরিয়ে গেল। এক সকালে ঘুম থেকে উঠে বেন ডেভিস হঠাৎ আবিষ্কার করল মাত্র দু’শো ডলার রয়েছে ওঁর, আর আছে অন্ধকার ভবিষ্যৎ। এরপরই পেশাদার জুয়াড়ী বনে যায় সে।

শুরুতে নদীর বোটে ভাগ্য যাচাই করেছিল ও, তারপর সবার মত হুজুগে পড়ে পশ্চিমে চলে আসে। ক্যান্সাস সিটি, এলসওঅর্থ, অ্যাবিলিন, ভজ, ফোর্থ ওঅর্থ, সিমারন হয়ে সান্তা ফেয় গেছে।

আর সেদিন, স্টেজে টুকসন যাওয়ার পথে মেলানি রিওসের সঙ্গে পরিচয়।

মেলানি ওর বাবার একমাত্র সন্তান। টুকসনের চৌহদ্দিতে টম রিওস খুবই পরিচিত নাম। ঘাসের উপর সাম্রাজ্য গড়তে জানে রিওস, জানে, মানুষ, গরু বা অ্যাপাচিদের সামলাতে; কিন্তু মেয়ের সঙ্গে কীভাবে দুটো স্নেহের কথা বলবে, সেটা কখনও শেখা হয়নি তার, তাই কখনও বোঝাতেও পারেনি মেলানি তার জীবনে কতটা গুরুত্বপূর্ণ। কঠিন জীবনে অভ্যস্ত টম রিওসের অভিধানে মিষ্টি কথা বলে কিছু নেই, আছে অকপট স্পষ্টবাদিতা-বেশিরভাগ সময় অন্যদের কাছে চাঁছাছোলা, কর্কশ এবং রূঢ় মনে হয়। পশ্চিমের সেরা ও বিখ্যাত র‍্যাঞ্চার পিয়ার্স, স্লটার, ফেডন এবং লয়েডদের কাতারে নিজের নাম লেখাতে সক্ষম হয়েছে রিওস।

পুব থেকে র‍্যাঞ্চে ফিরছিল মেলানি, পথে বেনের সঙ্গে পরিচয়, একসঙ্গে ক্রআর বাথানে পৌঁছা’য় ওরা। বিশাল, পাথুরে র‍্যাঞ্চ হাউসটা দেখে নিজেদের এস্টেটের কথা মনে পড়ে যায় বেনের। দামী স্পেনিশ আসবাবে ভরা শান্ত ঘরোয়া পরিবেশ হৈচৈ-এ পূর্ণ জুয়ার হলে কাটিয়ে আসা বেনের জন্য ছিল রীতিমত স্বর্গের মত কাক্ষিত ও স্বস্তিকর।

অতিথি হিসাবে কয়েকটা দিন মহা আনন্দে কেটে গেল ক্রস আরে। সুস্বাদু খাবার তো ছিলই, আর ছিল মেলানির উপভোগ্য সঙ্গ। অপ্রতিভ কাউবয়দের ভিড়ে বেনের উপস্থিতি ছিল চমকপ্রদ, কাঙ্ক্ষিত; দ্রতা বা সৌজন্য তো জানাই রয়েছে ওর, মেলানিকে অভিভূত করতে কোন সমস্যাই হলো না। কিন্তু মোটেই প্রভাবিত হলো না টম রিওস, স্রেফ মেয়ের অতিথি বলে বেনের উপস্থিতি নীরবে সহ্য করে গেল। তারপর…একদিন বিয়ের প্রস্তাব দিল বেন।

ইতোমধ্যে ছোটখাট ব্যাপারে বাপের সঙ্গে হালকা ঝগড়া হয়ে গেছে মেলানির। সুযোগ চিনতে ভুল করল না বেন। ওর বিয়ের প্রস্তাব সাগ্রহে গ্রহণ করল মেলানি। কিন্তু টম রিওসের কাছে প্রস্তাবটা দিতে গিয়ে বাধল যত বিপত্তি। এক ঘণ্টার মধ্যে কেটে পড়ার নির্দেশ পেল। সত্যি সত্যি ক্রস-আর ছেড়ে চলে এল বেন, কিন্তু ভোরে ওর সঙ্গে যোগ দিল মেলানি। তারপর টুকসনের উদ্দেশে ছুটল দু’জন।

টম রিওসের সম্মতি ছাড়া তার মেয়ের বিয়ে পড়াবে, এমন বুকের পাটা নেই টুকসনের কোন পাদ্রী বা যাজকের। রাতটা এক বান্ধবীর বাসায় কাটাল মেলানি, বাবার প্রতি ক্ষোভে ফেটে পড়ছিল। সকালে এরেনবার্গের উদ্দেশে যাত্রা করা এক অভিযাত্রী দলের সঙ্গী হলো ওরা। ট্রেইল যেখানে দু’ভাগ হয়ে গেছে, ওখানে এসে ইয়োমা ক্রসিঙের পথ ধরল দুজন।

দক্ষিণে বেটস ওয়েলের উদ্দেশে এগোল ওরা। অ্যারিজোনার দক্ষিণ অঞ্চল সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানা নেই বেনের, দূরে অসংখ্য চলমান ধুলোর মেঘ দেখে শঙ্কিত হয়ে পড়ল। তুমুল বেগে ঘোড়া ছুটিয়ে চলল, বিকাল নাগাদ বেটস ওয়েলে পৌঁছল ওরা।

মেলানির চিৎকারে সংবিৎ ফিরল বেনের।

দুটো লাশ পড়ে আছে। পাশবিক নির্যাতন চালানো হয়েছে মানুষগুলোর উপর। গায়ে কাপড় নেই, বিকৃত পুরো দেহ। অন্তত দশটা করে তীর বিধেছে শরীরে। ওঅটর হোলের শুকনো খটখটে তলা ভিজে গেছে চাপচাপ রক্তে। লাশ দুটোর চারপাশে নালহীন ঘোড়ার অসংখ্য খুরের ছাপ।

ভয় কী জিনিস, জীবনে এই প্রথম উপলব্ধি করতে পারল বেন ডেভিস। সৈনিক জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে বুঝল বেশিক্ষণ আগে মারা যায়নি এরা, তারমানে ধারে-কাছেই রয়েছে ইন্ডিয়ানরা।

মেলানি, এখান থেকে চলে যেতে হবে আমাদের।

ওঅটর হোলের পিছনে, পাথরের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসা এক লোকের উপস্থিতি টের পায়নি দুজনের কেউ; সদ্য তরুণ সে, কিশোরই বলা চলে-দীর্ঘদেহী, আড়ষ্ট ও লাজুক চলাফেরা, কিন্তু হাতে উদ্যত রাইফেলটা ধরার মধ্যে এতটুকু আড়ষ্টতা নেই। মলিন, কুঁচকানো কাপড় পরনে। কথা বলার আগে কেশে গলা পরিষ্কার করে নিল সে। পশ্চিমে যাচ্ছ তোমরা?

ঝট করে ঘুরল বেন ডেভিস, সহজাত প্রবৃত্তি বশে পিস্তলের বাটে চলে গেছে হাত, দীর্ঘদেহী ছিপছিপে কিশোরকে দেখে শেষ মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিল। কে তুমি? টানটান স্বরে জানতে চাইল ও।

তোমরা বোধহয় পশ্চিমে যাচ্ছ, ভাবছি আমিও সঙ্গে যাব। আমার নাম ড্যান কোয়ান।

এদের চেনো নাকি? লাশ দুটোর দিকে ইশারা করল বেন।

আমার সঙ্গে ছিল, একত্রে কাজ করেছি এক আউটফিটে। ঠিক করেছিলাম ক্যালিফোর্নিয়ায় চলে যাব সবাই। পশ্চিমে রওনা দিয়ে এ পর্যন্ত এলাম।

এখান পর্যন্ত আসতে আসতে পানি শেষ হয়ে গেল সবার। পাথরের ওদিকে গেলাম আমি, আশা ছিল হয়তো একটা টিনাজা খুঁজে পাব। আচমকা হামলা করল ইন্ডিয়ানরা। অন্তত পনেরোজন ছিল ওরা। গুলি করার সুযোগই পেলাম না, তার আগে শেষ হয়ে গেল সবকিছু।

দৃষ্টি সরিয়ে রেখেছে মেলানি, কিন্তু চাইলেও ভুলতে পারছে না বীভৎস দৃশ্যটা। বুক ধড়ফড় করছে ওর। বাবার কাছে শোনা ইন্ডিয়ান রেইডের গল্প মনে পড়ল। একটা দল এখানে এসে থাকলে, ধারে কাছে আরও দল থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।

চলে যাওয়াই ভাল, নিজেকে সামলে নিয়ে মৃদু স্বরে বলল ও। ওরা ফিরে আসতে পারে।

সবচেয়ে কাছে পানি পাওয়া যাবে পাপাগো ওয়েলসে…বিশ মাইল দূরে, মেলানির দিকে ফিরল ড্যান কোয়ান। ম্যাম, তুমি আপত্তি না করলে তোমাদের সঙ্গে যেতে চাই আমি।

চলো।

প্রতিবাদ করতে মুখ খুলেছিল বেন ডেভিস, কিন্তু শেষ মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিল। বাড়তি একজন লোক থাকলে মন্দ হবে না, ভাবল সে, বয়স কম হলেও চটপটে মনে হচ্ছে ছেলেটাকে। এটা এমন এক দেশ, যেখানে বয়স নয় কারও কাজই হচ্ছে আসল ব্যাপার। ছেলেটার রাইফেল ধরার ভঙ্গিতে বোঝা যায় ব্যবহারে অভ্যস্ত সে।

*

ওদের দক্ষিণে আরও একটা পানির উৎস রয়েছে, শুধু ইন্ডিয়ানরাই জানে ওটার অবস্থান। গুটিকয়েক প্রসপেক্টর আর আর্মির স্কাউট এটার অস্তিত্বের গুজব শুনেছে। এ-মুহূর্তে ছয়জন ইন্ডিয়ান ব্যবহার করছে পানির উৎসটা, ওদের সঙ্গে বন্দি সাদা একটা মেয়েও রয়েছে।

সৌভাগ্য নাকি দুর্ভাগ্য বলা মুশকিল, পুরো পরিবারের মধ্যে একমাত্র মিমি রজার্সই বেঁচে আছে, অন্যরা নৃশংসভাবে খুন হয়েছে ইন্ডিয়ানদের হাতে। মিমি হয়েছে বন্দিনী। কারও কাছ থেকে সাহায্য পাওয়ার আশা নেই। পাবে কীভাবে? ও যে বেঁচে আছে, কেউ জানলে তো! তা ছাড়া, পরিচিত এমন কেউ নেই যে ও বন্দি থাকলে তার কিছু যাবে-আসবে। ভয়ে আর হতাশায় প্রায় মুষড়ে পড়েছে মিমি, ঠায় বসে আছে, নড়ার সাহস পাচ্ছে না, পাছে যদি ওর প্রতি মনোযোগ দেয় ইন্ডিয়ানরা!

তবে এ-মুহূর্তে ওরকম সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। খাওয়ায় ব্যস্ত ইন্ডিয়ানরা। র‍্যাঞ্চ থেকে চুরি করে আনা মিউলের মাংস ঝলসানোর পর সানন্দে সদ্ব্যবহার করছে। পেট পুরে খাওয়ার পর ঘুমাবে ওরা, জানে মিমি, আর তখনই আসবে ওর সুযোগ। যদি পালাতে পারে…

বেটস ওয়েল থেকে কিপ্রিয়ানো ওয়েলের দূরত্ব দশ মাইল, ট্রেইলের এক পাশে ওটার অবস্থান। মিমি জানে অন্তত বিশ মাইল দূরে পাপাগো ওয়েলস; কিন্তু সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে, অসম্ভবকে সম্ভব করার চেষ্টা করবে। ইন্ডিয়ান গ্রামে বন্দি থাকার চেয়ে বরং মরুভূমিতে কষ্টের মরণ হওয়াও ঢের ভাল। হয়তো পাপাগো ওয়েলসে পৌঁছে যেতেও পারে…সবসময় পানি থাকে ওখানে, রয়েছে পর্যাপ্ত আড়াল। পরে কেউ এলে তার সঙ্গে নিরাপদ দূরত্বে চলে যেতে পারবে

পাপাগো ওয়েলসে কখনও যায়নি মিমি, তবে ওদের ওয়্যাগন। ট্রেনের গাইডের কাছে ওটার কথা শুনেছে। নিকট ভবিষ্যৎ দিব্যি আঁচ করতে পারছে ও। এখানে থাকলে আগামীকাল বলে কিছু আসবে না ওর জীবনে। পেট পুরে খেয়েছে ক্ষুধার্ত ইন্ডিয়ানরা, ঘুমাচ্ছে এখন। ঘুম থেকে জেগে প্রথমেই ধর্ষণ করবে ওকে, শেষে খুন করবে। এরা ওঅর পার্টি, এখনই গ্রামে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছে এদের নেই। তাই সঙ্গে ওকে রাখা মানে বাড়তি ঝামেলা।

স্থির বসে থাকল মিমি, ভিতরে ভিতরে ভয়ে বেসামাল অবস্থা, কিন্তু আশায় থাকল..হয়তো কাক্সিক্ষত সুযোগটা পেয়ে যাবে…

*

মাত্র কয়েক মাইল দূরে, ব্রো ডানটাকে ক্ষণিকের জন্য থামাল নিঃসঙ্গ রাইডার। হ্যাটে পানি ভরে ঘোড়ার মাথা ধুয়ে দিল সে, তলানিটুকু খাওয়াল জেব্রা ডানকে। বিস্তীর্ণ মরুভূমি পাড়ি দেওয়ার জন্য বড়সড় দুটো ক্যান্টিন নিয়ে যাত্রা করেছিল ও, সামান্যই অবশিষ্ট রয়েছে এখন। ভাগ্য ভাল হলে হয়তো সন্ধ্যা নাগাদ পৌঁছে যাবে পাপাগো ওয়েলসে।

স্যাডলে চেপে পশ্চিমে এগোল এরিক ক্ৰেবেট।

<

Super User