শিকারি পরিণত হয়েছে শিকারে।

ঠিক কখন থেকে যে ওকে অনুসরণ করা হচ্ছে, জানে না পাশা। ভাল নাম ইউসুফ পাশা, বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির একজন দুর্ধর্ষ ফিল্ড এজেন্ট। প্রথম টের পেয়েছে, একটা দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে কাচের ওপাশে সাজানো জিনিসগুলো দেখার সময়, আধব্লক পিছনে ঢেঙা একটা লোককে স্থির দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে।

একেবারেই নবিস মনে হলো লোকটাকে। পেশাদার কেউ এভাবে খোলাখুলি সামনে এসে তাকিয়ে থাকত না।

সাইড স্ট্রিট ধরে ধীরেসুস্থে হেঁটে চলল পাশা, এমন ভাব দেখাল যেন লক্ষ্যই করেনি ব্যাপারটা। দুই হাত পকেটে ঢোকানো। সামনের মোড়টা ঘুরেই হাটার গতি বাড়িয়ে দিল। পথচারীদের মাঝখান দিয়ে পথ করে এঁকেবেঁকে এগোল।

কী-ওয়েন্টে এখন শেষ বিকেল। রাস্তায় লক্ষ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে অসংখ্য মানুষ, সুযোগ পেয়ে ফ্লোরিডার রোদ শুষে নিচ্ছে যেন শরীরে।

একটা কাপড়ের দোকানের দরজার আড়ালে ছায়ায় গা মিশিয়ে দাঁড়াল পাশা। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। পাশ দিয়ে দৌড়ে গেল লোকটা, ডানে-বায়ে তাকাতে তাকাতে, দরজার আড়ালে দাঁড়ানো পাশাকে দেখতে পেল না। আরও দশটা সেকেন্ড চুপচাপ দাড়িয়ে রইল পাশা। তারপর সাবধানে সরে এসে মুখ বাড়িয়ে উঁকি দিয়ে দেখল।

পরের মোড়টার কাছে পৌঁছে গেছে লোকটা। অস্থির ভঙ্গিতে এপাশ-ওপাশ তাকাচ্ছে, বোঝার চেষ্টা করছে কোথায় লুকাল পাশা। পরনে জিনসের প্যান্ট আর খাটো-হাতা শার্ট, বাঁ হাতে টাটু আঁকা দেখা যাচ্ছে। মাথার বালি-রঙা চুলের ওপর বসানো একটা রঙচটা ক্যাপ।

এগিয়ে চলল লোকটা। পিছন থেকে অনুসরণ করল পাশা। কার হয়ে কাজ করছে লোকটা, আর ওকেই বা চিনল কী করে, জানা জরুরী।

ওর দক্ষিণ ফ্লোরিডায় আসার খবর জানে আমেরিকার মাত্র হাতেগোনা কয়েকজন লোক। ওর বন্ধু আমেরিকান সিক্রেট সার্ভিসের অপারেশন গ্রুপের ডিরেক্টর স্টিফেন হান্টার, মিশন কন্ট্রোলার জোয়ানা কলিনস, ও পরিচালক ‘মিস্টার এক্স’। পরিষ্কার বুঝতে পারছে পাশা, খবরটা যেভাবেই হোক লিক-আউট হয়েছে। শত্রুপক্ষ ওর কী-ওয়েন্টে আসার কথা জেনে গেছে।

একটা নতুন মাদক পাচারকারী চক্র সক্রিয় হয়েছে এখানে। আমেরিকান ড্রাগ এনফোর্সমেন্ট এজেন্সির সূত্রমতে প্রচুর পরিমাণ কোকেইন ফ্লোরিডার ‘কী’-গুলো দিয়ে মেইনল্যান্ডে ঢুকছে। ধারণা করা হচ্ছে ‘কী-ওয়েস্ট থেকে হাতবদল হয়ে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ছে এই মাদক, তবে কর্তৃপক্ষ কোনমতেই বুঝতে পারছে  না, এই কোকেইন টুকছে কীভাবে এখানে।

বহুবার মাদকসম্রাটদের বিরুদ্ধে টক্কর লেগেছে পাশার। বার বার ওদের পাইপলাইনে বাধার সৃষ্টি করেছে ও। একটা দল ধ্বংস হলে নতুন করে গজিয়ে ওঠে আরেকটা। আবার নতুন করে মাদক সরবরাহ শুরু করে। বাংলাদেশও এদের কবল থেকে রেহাই পায়নি।

একেক সময় পাশার মনে হয়, ভয়ঙ্কর এই চক্রের হাত থেকে কোনদিনই বুঝি রেহাই পাবে না পৃথিবীবাসী। কিন্তু সে-ও ছাড়ার পাত্র নয়। ওর কাছে এটা এক বিশাল চ্যালেঞ্জ, মাদকচক্রগুলোকে দমন করা। কিন্তু বড় কঠিন কাজ। একেক সময় মনে হয় অসম্ভব। তবু হাল ছাড়ে না ও। নিজেকে বোঝায়, হতাশ হওয়ার কিছু নেই।

একটা চক্রকে ধ্বংস করে দেয়ার পর ওই অঞ্চলে কিছুদিনের জন্য অন্তত মাদক ব্যবসায়ীদের কার্যক্রম বন্ধ থাকে। এই বন্ধ থাকার কারণে মাসে যদি একজন মানুষও নেশায় আসক্ত হওয়া থেকে বিরত থাকে, একটি স্কুলপড়ুয়া ছেলে কিংবা মেয়েও বেঁচে যায়, সেটাও বিরাট লাভ। আর তাই, পৃথিবীর যে দেশেই থাকুক না কেন পাশা, মাদক সরবরাহকারীদের সন্ধান পেলে ওদের ধ্বংস করতে লেগে যায়-যদি হাতে সময় থাকে, কিংবা অন্য কোন জরুরি কাজে ব্যস্ত না থাকে।

যা-ই হোক, এ মুহুর্তে পিছন ফিরে তাকাচ্ছে না ওর অনুসরণকারী। এগোনোর সময় প্রতিটি সাইড স্ট্রিটে পাশাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে লোকটা, ক্রমেই উদ্বেগ বাড়ছে ওর। একটা সিফুড রেটুরেন্টের কাছে গিয়ে তাতে ঢুকে পড়ল লোকটা। রাস্তা পেরিয়ে এল পাশা। পার্ক করে রাখা একটা ভ্যানের আড়াল থেকে উকি দিয়ে।

রেস্টুরেন্টের ভিতরে তাকাল ও। কাচের বড় জানালা দিয়ে দেখতে পেল, পে ফোন থেকে ফোন করছে লোকটা।

লোকটার হাবভাব আর চেহারাই বলে দিচ্ছে, প্রচন্ড উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে। অবশেষে রিসিভার নামিয়ে রেখে রেটুরেন্ট থেকে বেরিয়ে এল লোকটা।

ওকে দূরে যাওয়ার সুযোগ দিল পাশা। তারপর আবার পিছু নিল। মাঝখানে বেশ খানিকটা দূরত্ব রাখল, আর লক্ষ্য রাখল, সব সময়ই যাতে অন্তত দু-তিনজন পথচারী ওদের মাঝখানে থাকে। শীমি ডকের কাছে চলে এল দুজনে। মোড় নিয়ে সরু রাস্তা ধরে পুরানো একটা দোতলা বাড়ির দিকে এগোল লোকটা। এক হাঁটু গেড়ে বসে জুতোর ফিতে বাঁধার ভান করল পাশা।

বাড়ির দরজায় টোকা দেয়ার প্রয়োজন বোধ করল না লোকটা। যেন নিজের বাড়ি, এমন ভঙ্গিতে ভিতরে ঢুকে দড়াম করে দরজা লাগিয়ে দিল।

সোজা হয়ে দাড়িয়ে সরু রাস্তাটা আর মেইন রোডের সংযোগস্থলে পিছিয়ে এল পাশা। রাস্তা পেরোল, তারপর এগিয়ে গেল পুরো এক ব্লক। তারপর ডানে মোড় নিয়ে হেঁটে এসে দাঁড়াল দোতলা বাড়িটার পিছনে। সামনের চেয়ে পিছনটা আরও মলিন। রঙের চলটা উঠে দেয়াল থেকে খসে পড়েছে এখানে ওখানে। নীচতলার একটা জানালার কাচ ভাঙা।

জ্যাকেটের ভিতরে হাত ঢুকিয়ে বা বগলের নীচে হোলষ্টারে রাখা ৯ এমএম বেরেটা পিস্তলটা বের করে আনল পাশা।

চট করে একবার দুই পাশে তাকিয়ে দেখে নিল কেউ নজর রাখছে কি না। তারপর কোমর সমান উঁচু দেয়ালটা লাফিয়ে পেরিয়ে এল। ঝট করে উবু হয়ে দাঁড়াল একটা ঝোপের আড়ালে। বাড়ির ভিতরে অ্যালার্ম বেল বাজল কি না কান পেতে শুনল।

ঘন্টা বাজল না। ও যে ঢুকেছে সেটাও কেউ লক্ষ্য করেছে বলে মনে হলো না। পা টিপে টিপে পিছনের দরজার কাছে এসে দাঁড়াল পাশা। নব চেপে ধরে আস্তে মোচড় দিতেই ঘুরে গেল ওটা। তালা দেয়া নেই। কিন্তু অসতর্ক হলো না ও। ঢোকার আগে বায়ে সরে চলে এল ভাঙা জানালাটার কাছে।

জানালায় পর্দা টানা। ভিতর থেকে দুজন লোকের তর্ক শোনা যাচ্ছে। ওরা চাপাস্বরে কথা বললেও কথাগুলো পরিষ্কার শুনতে পেল পাশা।

‘আমি বলছি, আমি যে পিছু নিয়েছি ও ব্যাটা কিছুই বুঝতে পারেনি। ওর হারিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা একেবারেই অপ্রত্যাশিত।’

‘অপ্রত্যাশিত?’ দ্বিতীয় কণ্ঠটা বলল। ‘তোমার মাথায় ঘিলু আছে, নাকি গোবর পোরা, টনি? শয়তানটা যে তোমাকে ধোকা দিয়েছে, এটাও বুঝতে পারনি। ডুয়েরো জানতে পারলে এখন তোমার কী অবস্থা করে দেখো।’

‘ডুয়েরোকে আমি ভয় পাই না।’

‘পাওয়া উচিত। ও যে কী ভয়ঙ্কর লোক, এখনও বোঝনি। হাসিমুখে তোমাকে খুন করবে, অথচ চোখের পাপড়িটাও সামান্যতম কাঁপবে না ওর। জানো, নিজের ভাইকেও মাপ করেনি ও; ভাই ভুল করেছে জানা মাত্র খুন করেছে।’ দ্বিতীয় লোকটার চাপা হাসির শব্দ শোনা গেল। ‘পরে জানল, ভুলটা ওর ভাই করেনি, আরেকজন করেছে। সেই লোকটাকে তখন এভারগ্রেডে ধরে নিয়ে গিয়ে জ্যান্ত ফেলে দিল অ্যালিগেটরের মুখে ডুয়েরো’

‘আমাকে এত কথা শুনিয়ে লাভ নেই, হ্যাসি,’ টনি বলল, তবে গলায় জোর নেই, ‘আমি যা বলার বলেছি।’

ক্ষীণ হয়ে গেল দুজনের কণ্ঠস্বর। দরজার কাছে সরে এল পাশা। ঢুকতে যাবে, ঠিক এ সময় দরজার ওপাশে পায়ের শব্দ এগিয়ে আসতে শুনল।

‘মনে মনে খোদাকে ডাকো, যাতে ডুয়েরোর মেজাজ ভাল থাকে,’ হ্যাসির কথা শোনা গেল। ‘এ সব ঝামেলা মিটানোর জন্য আমাদেরকে ভাল টাকা দেয় ও। আর তুমি ঝামেলা আরও বাড়িয়েছ শুনলে, মোটেও খুশি হবে না।’

পাক খেয়ে ঘুরল পাশা। ছোটখাট ঝোপঝাড় আর অযত্নে বেড়ে ওঠা ঘাসের মধ্যে লুকানোর জায়গা নেই কোথাও। দৌড়ে সরে এল বাড়িটার এক কোণে, আর ঠিক এ সময় খুলে গেল দরজাটা।

কালো চামড়ার লোক হ্যাসি। গাট্টাগোট্টা শরীর। মস্ত থাবা। গায়ে হালকা জ্যাকেট। ডান বগলের নীচে ফুলে থাকা জায়গাটা বুঝিয়ে দিল কী রয়েছে ওখানে। হাতে একটা সবুজ রঙের ময়লা ফেলার ব্যাগ। কোণের ডাস্টবিনে ব্যাগের আবর্জনাগুলো ফেলল।

দরজায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে টনি, পাশার পিছু নিয়েছিল যে লোকটা। হ্যাসিকে বলল, ‘আমার পরামর্শ যদি শোনো, জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে এখুনি মেইনল্যান্ডের দিকে চলে যাওয়া উচিত আমাদের। এই ‘কী’-তে আয়উপার্জন বড় কম। তুমিও জানো সেটা। ভাগ্যিস ডুয়েরোর লোক এসে এই কাজটা দিয়েছিল আমাদের, নইলে খাওয়ার জন্য টুরিস্টদের কাছে ভিক্ষে করা ছাড়া উপায় ছিল না।’

‘আরে, তোমার কথা শুনলে না পিত্তি জ্বলে!’

‘এর চেয়ে ভাল বুদ্ধি আর দিতে পারো?’

‘পারি। আরও মাস ছয়েক এখানে থাকব আমরা। ডুয়েরোর আরও কয়েকটা কাজ করব, কিছু টাকা জমলে তখন মায়ামিতে চলে যাব।’ ‘আরও ছয় মা-আ-স?’ সুর করে টেনে টেনে বলল টনি। ‘এ তো মেলা সময়।

শুধু এখানে দাঁড়িয়ে আড়ি পেতে আসল তথ্য জানতে পারবে না বুঝে তাড়াতাড়ি বাড়ির পাশ ঘুরে সামনের দিকে চলে এল পাশা। সামনের দরজা খুলে ঢুকে পড়ল। লম্বা বারান্দার শেষ মাথায়। এদিকে পিছন করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল টনিকে।

নিঃশব্দে এগিয়ে প্রথম যে ঘরটা দেখল, তাতেই ঢুকে পড়ল পাশা। একটা লিভিং রুম। সস্তা আসবাবপত্রে সাজানো। একটা খোলা আলমারি দৃষ্টি আকর্ষণ করল ওর। ঢুকে পড়ল ওটার ভিতরে। দরজাটা টেনে বন্ধ করল, আর ঠিক এ সময় কানে এল। ভারী পায়ের শব্দ। নিশ্চয় হ্যাসি, ফিরে এসেছে। দুজনকে কাবু করা কিছুই না ওর জন্য, কিন্তু আরও কিছুক্ষণ কথা শোনার অপেক্ষায় রইল ও। ডুয়েরোর ব্যাপারে আরও তথ্য জানতে হবে।

নামটা আগেও শুনেছে পাশা। জেনেছে, এখানকার কোকেইন মার্কেট নিয়ন্ত্রণ করে এব্রো ডুয়েরো। আর বিশাল পরিমাণে মাদক সরবরাহ করে আমেরিকার বড় বড় শহরে। কিন্তু ডুয়েরো কোথায় থাকে, ওর প্রিয় ক্লাব কোনটি, কেউ জানে না। কিংবা জানলেও ভয়ে মুখ খোলে না। হ্যাসির মতই এখানকার সবাই যমের মত ভয় করে ডুয়েরোকে।

শুধু একজন বাদে। বোট ভাড়া নিয়ে দেয়ার একজন দালাল, যে সামান্য কিছু তথ্য দিতে পেরেছে পাশাকে।

বাসন পেয়ালার ঝুনঝুন, খাবারের আলমারির দরজা খোলার মৃদু ক্যাচকোচ, আর মেঝেতে চেয়ারের পায়া ঘষার শব্দ শুনল পাশা। বুঝল, রাতের খাবার খেতে বসেছে লোক দুজন।

একটা ফাঁকে কান চেপে ধরে রাখল ও। কথা বলছে লোকগুলো, কিন্তু এতই আস্তে, কিছু বোঝা যাচ্ছে না। কয়েক মিনিট কাটল। আলমারি থেকে বেরিয়ে এল পাশা। নিঃশব্দে এসে দাঁড়াল বারান্দায়। বিশ ফুট দূরের একটা ঘরে আলো দেখে বুঝতে পারল, রান্নাঘরটা কোথায়।

পা টিপে টিপে রান্নাঘরের দরজার দিকে এগোল ও। টনির কথা কানে এল, ‘ডুয়েরোর সঙ্গে কখন দেখা করব আমরা?’

‘ন’টা’

‘ওর ঘরে, নাকি বোটে?’

কান খাড়া করে ফেলল পাশা। জবাবে হ্যাসি কী বলে শোনার অপেক্ষা করছে। বুঝল, এদেরকে অনুসরণ করলে ডুয়েরোর কাছে চলে যেতে পারবে। হ্যাসি আর কিছু বলার আগেই লিভিং রুমের টেলিফোন বেজে উঠল। রান্নাঘর থেকে ছুটে বেরোল টনি। আরেকটু হলেই মুখোমুখি ধাক্কা খেত পাশার গায়ে।

হোচট খেয়ে দাঁড়িয়ে গেল যেন টনি। মুহুর্তে হাত চলে গেল ঢোলা শার্টের নিচে। একটা .৪০ ক্যালিবারের এসআইজি-সাউয়ার পি- ২২৯ পিস্তলে।

বিদ্যুৎ খেলে গেল যেন পাশার শরীরে। লোকটা পিস্তল ধরা কব্জি চেপে ধরে জোরে মোচড় দিল, একই সঙ্গে এক হাটু চালাল ওর দুই পায়ের উরুর ফাকে। বিদঘুটে শব্দ বেরোল টনির মুখ থেকে, মুখটা লাল হয়ে গেল।

টনির নিস্তেজ দেহটাকে সজোরে দেয়ালে ধাক্কা দিয়ে ফেলল পাশা। আঙুল সোজা রেখে তালু দিয়ে প্রচণ্ড থাবড়া মারল নাকেমুখে। নাকের কার্টিল্যাজ ভেঙে ফিনকি দিয়ে রক্ত এসে পড়ল পাশার গায়ে। দেয়ালে পিঠ লাগিয়ে ধীরে ধীরে ধসে পড়ে যাচ্ছে টনি, আরেকটা ঘুষি খেলেই বেঁহুশ হয়ে যাবে। হাত তুলল পাশা, কিন্তু নামিয়ে আনতে পারল না, তার আগেই রান্নাঘরের দিক থেকে ওর গায়ের ওপর এসে পড়ল যেন দুশো পঁচাত্তর পাউন্ড ওজনের একটা ষাঁড়।

প্রায় উড়ে গিয়ে উল্টোদিকের দেয়ালে পড়ল পাশা, হস করে মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল ফুসফুসের সমস্ত বাতাস। মেরুদণ্ডে ছড়িয়ে গেল তীক্ষ্ণ ব্যথা। অজগরের মত মোটা একটা বাহু ওর কোমর পেঁচিয়ে ধরে টান দিয়ে মেঝে থেকে এমনভাবে উঁচু করে ফেলল, যেন পাশা একটা শিশু।

‘এখানে ঢোকাটা মোটেও উচিত হয়নি তোমার, হাদা!’ গর্জে উঠল হ্যাসি। মিস্টার ডুয়েরোর বর্ণনার সঙ্গে মিলে যাচ্ছে তোমার চেহারা।’ হিসিয়ে উঠে পাশার কোমরে হতের চাপ আরও বাড়াল ও। ‘ডুয়েরো জানতে চান, ক-ওয়েস্টে এসে মানুষকে এত প্রশ্ন করে বেড়াচ্ছ কেন। আমাকে বলবে?’

অনেকটা সামলে নিয়েছে পাশা। হ্যাসির চোয়ালে ঘুষি মারল। মনে হলো ইটের দেয়ালে আঘাত হেনেছে। ঘুষিটাকে যেন হেসে উড়িয়ে দিল হ্যাসি। হাতের চাপ বাড়াল। কোমরের ব্যথাটা পাশার সারা দেহে ছড়িয়ে পড়ছে।

‘ব্যথা লাগছে, হাদা?’ হাসিমুখে জিজ্ঞেস করল হ্যাসি। ‘যখন ছাড়ব, পাজরের একটা হাড়ও আর আস্ত থাকবে না তোমার। হাড়-মাংস সব ভর্তা হওয়ার আগেই আমাকে বলো, এত প্রশ্ন করে বেড়াচ্ছিলে।

কথা বলে বেশি সময় দিয়ে ফেলেছে হ্যাসি। মূল্যবান সেকেন্ডগুলোকে কাজে লাগাল পাশা। পা দুটো দেয়ালে ঠেকিয়ে আচমকা ঠেলা মারল। পিছনে হেলে পড়তে পড়তে সোজা হওয়ার চেষ্টা করল হ্যাসি। কিন্তু পারছে না। উল্টে পড়ে যাচ্ছে। পাশাকে ছেড়ে পতনের ধাক্কা ঠেকাতে দুই হাত পিছনে নিয়ে গেল।

সুযোগটা হাতছাড়া করল না পাশা। হ্যাসি সোজা হয়ে দাঁড়ানোর আগেই পাশার হাতের দুটো মারাত্মক কারাতে মার খেল। সাধারণ কেউ হলে এই আঘাতেই ধরাশায়ী হতো। কিন্তু কালো দৈত্যটাকে কাবু করা এত সহজ হলো না। পাশার মনে হলো গাছের গুঁড়ির মত দুটো পা ছুটে এসে আঘাত করল ওর বুকে।

যেন গুলতি থেকে ছুড়ে দেয়া হলো পাশাকে, ভারি পাথরের মত ছয় ফুট শূন্যে লাফিয়ে উঠল ওর দেহটা। কাত হয়ে কাঁধের ওপর ভার রেখে মেঝেতে পড়ল পাশা। পরক্ষণে পায়ের গোড়ালিতে ভর দিয়ে দক্ষ দড়াবাজিকরের মত লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল।

উঠে পড়েছে হ্যাসিও। খেপা ষাঁড়ের মত ছুটে এল। দুই হাত চালাচ্ছে সমানে। কিলঘুষি মেরে অজ্ঞান করে ফেলতে চাইল প্রতিপক্ষকে।

কিন্তু এত সহজে পাশাকে কাবু করতে পারল না ও। কারাতের কায়দায় দুই হাতে ঘুষিগুলোকে সরিয়ে দিতে লাগল পাশা। গায়ে লাগতে দিল না। তারপর সুযোগ বুঝে হাঁটু তুলে সজোরে চালিয়ে দিল হ্যাসির থুতনি লক্ষ্য করে। টলে উঠল ষাঁড়, কিন্তু মাটিতে পড়ল না।

পা সোজা করে হ্যাসির পেটে কারাতে মার মারল পাশা। তাতেও কাবু করা গেল না দৈত্যটাকে, পাশার মনে হলো পুরু রবারের গায়ে আঘাত হানল ওর পা। পিপার মত বুকের ভিতর থেকে ঘড়ঘড় শব্দ বেরোচ্ছে হ্যাসির-কুদ্ধ গ্রিজলি ভালুকের মত, দুই হাত ছড়িয়ে প্রতিপক্ষকে জড়িয়ে ধরার জন্য ঝাঁপ দিল সামনে।

দ্বিতীয়বার নিজেকে আর হ্যাসির নাগালে পড়তে দিল না পাশা। পিছাতে পিছাতে একটা দরজার কাছে চলে এসেছে। দরজার বাজু ধরে দোলা দিয়ে চলে এল ভিতরে। কিন্তু দরজা ছাড়ল না। আবার দোলা দিয়ে দরজাসহ সামনে এগোল, পা দুটো সোজা করে বাড়িয়ে দিয়েছে সামনের দিকে।

পাশাকে ধরে ছুটে আসছে হ্যাসি। গতি কমানোর আগেই ওর বুকে লাগল পাশার পা, উড়ে গিয়ে ধাক্কা খেল বারান্দার উল্টোদিকের দেয়ালে। মনে হলো পুরো বাড়িটা কেঁপে উঠেছে। মাথা ঝাড়া দিতে দিতে গর্জন করে উঠল দৈত্য। নতুন করে আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে। তবে এবার আর তাড়াহুড়া করল না, মস্ত থাবাকে মুঠো পাকিয়ে সাবধানে এগিয়ে এল।

ঘরের মাঝখানে চলে এসেছে পাশা, যাতে নড়ার জায়গা পায়। ওর ডানে একটা বিছানা বায়ে ড্রেসার, তাতে ছড়ানো কলম, পেন্সিল আর কাগজ। ওর সামান্য পিছনে একটা কাঠের চেয়ার।

হ্যাসির কালো চোখে রক্তের নেশা দেখল ও। আচমকা ছুটে এল দৈত্যটা। চোখের পলকে দেহ ঘুরিয়ে পিছনের চেয়ারটা তুলে নিয়ে গায়ের জোরে বাড়ি মারল হ্যাসির উচু করে রাখা মুখে। ভেঙে চুরমার হয়ে গেল চেয়ারটা। ব্যথা আর রাগে শুঙিয়ে উঠল দানব।

এক ভুরুর ওপরের চামড়া কেটে রক্ত পড়ছে। দাঁত বের করে গর্জে উঠল হ্যাসি, ‘জাহান্নামে যাক ডুয়েরোর প্রশ্ন করা। আগে তোমাকে আমি ভর্তা বানাব, তারপর কিছু অবশিষ্ট থাকলে তুলে নিয়ে যাব ডুয়োরোর কাছে!’

পাশাও এতক্ষণ যুঝেছে দৈত্যটাকে কাবু করে প্রশ্ন করার জন্য। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, প্রশ্ন করার চেয়ে ওর হাত থেকে নিজেকে বাঁচানোটাই বেশি জরুরি। সামান্যতম সুযোগ দিলে খুন করে ফেলবে ওকে হ্যাসি। তবু দৈত্যটাকে কাবু করে কিছু তথ্য আদায়ের শেষ চেষ্টা করল ও। কোন একটা অন্ত্র পাওয়া যায় কি না, দেখল।

যে মুহুর্তে অন্যদিকে মুখ ফেরাল পাশা, আঘাত হানল হ্যাসি। এত বিশালদেহী একজন মানুষের তুলনায় অবিশ্বাস্য দ্রুত দৈত্যটা।

চোখের পলকে পাশার ওপর এসে পড়ল ও। হাতের আঙুল সোজা করে হ্যাসির গলায় কারাতের খোঁচা মারতে গেল পাশা, কিন্তু ঝট করে গলা সরিয়ে ফেলল হ্যাসি, পাশার আঙুলগুলো ওর গলা স্পর্শ করে পাশ কেটে বেরিয়ে গেল।

‘তোমার এ সব চালাকির মার দিয়ে আমার কিছু করতে পারবে না, হাদা!’ হ্যাসি বলল।

বেশ কয়েকটা মারাত্মক ঘুষি ঠেকাল পাশা। ধীরে ধীরে পিছিয়ে যাচ্ছে। এক সেকেন্ড পরেই দেখল, কোণঠাসা হয়ে পড়েছে ও।

থেমে গেল হ্যাসি। পাশার দিকে তাকিয়ে হাসল। যেন বিকৃত আনন্দ পাচ্ছে। বলল, ‘বেরোনোর কোন জায়গা রাখলে না, আমার পাশ দিয়ে তো যেতেই পারবে না।

একটা বুদ্ধি এল পাশার মাথায়। শুরু থেকেই দেখছে, বেশি কথা বলা হ্যাসির স্বভাব। জিজ্ঞেস করল, ‘একটা চুক্তিতে এলে কেমন হয়?’

চোখ মিটমিট করল হ্যাসি। চুক্তি? দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে তোমার, এ অবস্থায় চুক্তি কীসের?’ কথাটায় এতই আনন্দ পেল ও, পিছন দিকে মাথা এলিয়ে হা-হা করে হেসে উঠল।

আর এ ধরনের একটা সুযোগই চাচ্ছিল পাশা। লাফ দিয়ে সামনে এসে ডান গোড়ালি দিয়ে প্রচও জোরে ছেঁচা দিল হ্যাসির পায়ের আঙুলে।

মট করে শব্দ হলো। হ্যাসির হাসিটা আটকে গেল মাঝপথে। ব্যথায় চিৎকার করে উঠল, ‘আমার আঙুল ভেঙে ফেলেছ!’

শুধু আজুল ভেঙেই ক্ষান্ত হলো না পাশা। দুই হাতের তালু মেঝেতে রেখে তাতে ভর দিয়ে দেহ লম্বা করে দিয়ে ঘোরাল। ওর জঙ্ঘা বাড়ি খেল হ্যাসির হাঁটুর পিছনে। দৈত্যের পা দুটো ওপরে উঠে গেল। আরও একবার বাড়ি কাপিয়ে ধুরুস করে পড়ল মেঝেতে।

হ্যাসি উঠে বসতে বসতে জ্যাকেটের ভিতরে হাত ঢুকিয়ে পিস্তলটা বের করে ফেলেছে পাশা। হ্যাসির কপালে দ্রুত বাড়ি মারল তিনবার। শেষ বাড়িটাতে গুঙিয়ে উঠে, চোখ বন্ধ করে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল হ্যাসি।

বারান্দা থেকে ধাতব একটা শব্দ কানে এল পাশার। চোখের পলকে হ্যাসির দেহের ওপর দিয়ে গড়িয়ে অন্যপাশে চলে এল ও। উপুড় হয়ে পিস্তল তাক করল দরজার দিকে।

এসআইজি-সাউয়ারটা দুই হাতে চেপে ধরেছে টনি। মুখে লেগে আছে চটচটে রক্ত। রাগে বিকৃত হয়ে গেছে ঠোঁটের দুই কোণ দুইবার ট্রিগার চাপল।

পাশার মুখের সামনে কাঠের মেঝের চলটা তুলল বুলেট। নির্দিধায় গুলি করল পাশা। মনে হলো কাঠের মুগুর দিয়ে আঘাত করেছে কেউ টনিকে, বুলেটের ধাক্কায় দেয়ালে গিয়ে পড়ল।

আরেকবার দেয়ালে পিঠ রেখে বসে পড়ছে ও। দেয়ালে লেগে যাচ্ছে রক্তের দাগ। কোনমতে উচু করল পিস্তলটা। আরও অন্তত একটা গুলি করতে চায়। থরথর করে কাপছে হাতটা। কিন্তু গুলি করতে দৃঢসংকল্প।

সেই সুযোগ আর ওকে দিল না পাশা। গুলি করল আবার। টনির দুই চোখের মাঝখানে কপালে লাল আরেকটা চোখের মত দেখাল বুলেটের ফুটোটা।

টনির মাথার পিছনটা দেয়ালে বাড়ি খেল। দু’একটা মুহুর্ত ছটফট করল মেঝেতে পড়ে যাওয়া দেহটা, তারপর নিথর হয়ে গেল।

ধীরে ধীরে উঠে দাড়াল পাশা। টনির কাছে এসে নাড়ি দেখল থেমে গেছে। দ্রুত লাশের পকেটগুলো খুঁজে দেখল ও। একটা ওয়ালেট পাওয়া গেল, তাতে সত্তর ডলার আর কিছু খুচরো রয়েছে। একটা ড্রাইভিং লাইসেন্স আর হাসিমুখে তাকিয়ে থাকা একটা তরুণী মেয়ের ছবিও আছে, তবে এগুলো থেকে এব্রো ডুয়েরোর কোন সন্ধান মিলল না।

জোরে নিশ্বাস ফেলে সোজা হয়ে দাঁড়াল পাশা। এখনও সুযোগ আছে। দুজনের একজন গেছে, আরেকজন হতে রয়ে গেছে। ওকে কথা বলাতে হবে। হ্যাসির দিকে ঘুরতে গেল, ঠিক এ সময় গায়ের ওপর এসে পড়ল যেন একটা এক্সপ্রেস ট্রেন। হ্যাসির দেহ প্রচন্ড ধাকা দিয়ে ওকে দেয়ালের ওপর ফেলে ঠেসে ধরল, হাত থেকে ছুটে গেল পিস্তলটা। চোখের সামনে একটা তারা লক্ষ-কোটি টুকরো হয়ে ফেটে পড়ল যেন। বনবন করে ঘুরতে লাগল বারান্দাটা।

‘তোমাকে মরতে হবে, হাদা!’ কানের কাছে শোনা গেল হ্যাসির খসখসে কণ্ঠ।

লোহার সাঁড়াশির মত কঠিন আঙ্গুল ঘাড় চেপে ধরল পাশার। নখগুলো ঢুকে যাচ্ছে চামড়া কেটে। ঘুরতে শুরু করেছে কব্জিটা। প্রাণ বাঁচানোর প্রচণ্ড তাগিদ যেন জ্ঞান হারাতে দিল না পাশাকে। ও বুঝে গেছে, ওর ঘাড় মটকাতে যাচ্ছে হ্যাসি। কনুই দিয়ে হ্যাসির পেটে গুতো মারার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো।

সোজা হওয়ার চেষ্টা করছে পাশা। কিন্তু চেপে ধরে নুইয়ে রেখেছে। হ্যাসি। ঘোরার চেষ্টা করল পাশা। পারল না। ঠেলে সরানোর চেষ্টা করল হ্যাসিকে। কিন্তু পর্বতের মত অটল রইল দৈত্যটা। আর ইতিমধ্যে ক্রমেই ওর আঙুলগুলো আরও বেশি চেপে বসছে পাশার ঘাড়ে।

তীব্র ব্যথায় চিন্তাশক্তি ঘোলা হয়ে আসছে ওর। খুব শীঘি কিছু একটা করতে না পারলে বেহুশ হয়ে যাবে। বহু চেষ্টায় শরীরটাকে আরও নিচু করে মরিয়া হয়ে মেঝে হাতড়াতে লাগল পিস্তলটার জন্য। একটা পিস্তল ঠেকল আঙুলে, তবে ওরটা নয়। তাতে কিছু যায় আসে না।

পিস্তলটা চেপে ধরল ও। কুৎসিত হাসি আর রক্তে ভেজা হ্যাসির বিকৃত হয়ে যাওয়া মুখটা দেখল। চোখের পলকে পিস্তলটা উচু করে একবারে চোখের কাছে ঠেকিয়ে গুলি করল পাশা। হ্যাসির ডান চোখের গোলকটা ফেটে গেল।

একটা মুহুর্ত কিছুই ঘটল না। ঠেলা দিয়ে ওকে যখন সরিয়ে দিতে গেল পাশা, টলে উঠল দৈত্যটা। উপুড় হয়ে পড়ে গেল টনির লাশের ওপর।

হাঁপাচ্ছে পাশা। লাশ দুটোর দিকে তাকিয়ে ভ্ৰকুটি করল। এত কষ্ট সব বিফলে গেল। শুধু শুধু দুজন লোকের প্রাণ গেল, সে নিজেও মরতে মরতে বাঁচল, কিন্ত এব্রো ডুয়েরো কোথায় থাকে, জানা হলো না।

<

Super User