দুঃসাহসী টম সয়্যার বইটা পড়া না থাকলে আমার ব্যাপারে কিছুই জান না তোমরা। অবশ্য তাতে ক্ষতি নেই কোন, কারণ এখন আমার অভিযানের সব কথাই বলতে যাচ্ছি আমি।

স্টম সয়্যার বইখানার লেখক মিস্টার মার্ক টোয়েন। কিছু কিছু ব্যাপার একটুআধটু বাড়িয়ে বলার চেষ্টা থাকলেও, মূলত সত্যি কথাই বলেছেন তিনি ওই বইতে। বাড়িয়ে বলাটা এমন কিছু দোষের না। একেবারে মিথ্যে বলে না এমন মানুষ আমি দেখিনি আজতক। তবে টমের পলিখালা আর সেই বিধবা-মানে ডগলাস সাহেবের বিধবা স্ত্রীর কথা আলাদা। মেরিকেও বোধহয় ফেলা যায় ওই দলে। টম সয়্যার বইয়ে আছে ওদের কথা।

ওই বই শেষ হয়েছে এভাবে: গুহার ভেতর ডাকাতেরা যে ধনরত্ন লুকিয়ে রেখেছিল, টম আর আমি সেগুলো পেয়ে প্রচুর টাকা-পয়সার মালিক হয়েছি। ভাগে ছহাজার ডলার করে পেয়েছি আমরা—সবই সোনা। ওগুলো এক জায়গায় জড় করে দেখলে চোখ ঠিকরে পড়ার দশা হয়। জাজ থ্যাচারের কাছে গচ্ছিত আছে সোনা। ঠিক হয়েছে, সুদ হিসেবে রোজ এক ডলার পাব আমরা। এক ডলার রোজ, কম নয়-একজনের প্রয়োজনের তুলনায় অনেক।

আমার বাবা মাতাল। তার হাত থেকে বাঁচাতে ডগলাস সাহেবের বিধবা স্ত্রী দত্তক নিয়েছে আমাকে। তার দায়িত্ব আমাকে মানুষ করা। জীবনটা ওখানে বড্ড কড়াকড়ি, আমার হাল হয়েছে খাঁচায় আটকা পাখির মত। রোজ স্নান করে ধোপদুরস্ত জামা-জুতো পরতে হয়। মন চাইলেই খেতে পারিনে: সময় বাধা আছে খাবার, তখন খেতে হয়। বিধবা ঘণ্টা বাজালে টেবিলে বসে ছুরিকাটা দিয়ে খেতে হয়। রাতে কোথাও বেরুনোর উপায় নেই। আমার জন্যে এ এক বিড়ম্বনা। রাতে আমার অভ্যেস জঙ্গলে ঘুমানো, নয়ত রাস্তায় টো টো করা। তবে, স্বীকার না করে উপায় নেই, বিধবা আমাকে সত্যিই খুব ভালবাসে। অথচ সেখানে আমার মন টেকে না। শেষে একদিন সটকে পড়লাম। সঙ্গে নিলাম আমার পুরোন ছেড়া কাপড় আর গলায় ঝুলানোর চিনির পাত্রটা। কিন্তু বন্ধু টম সয়্যার বুঝিয়ে সুঝিয়ে আবার বুড়ির কাছে ফেরত পাঠাল আমায়।

হাক, বলল টম, একটা ডাকাত দল গড়তে যাচ্ছি আমি। জো হার্পার আর বেন রজার্স যোগ দিচ্ছে। তুমিও আসতে পার, হাক। তবে তার আগে ওই বিধবার কাছে ফিরে যেতে হবে তোমাকে। আদব-কায়দা শিখতে হবে। এখন তুমি চিন্তা করে দেখ, কী করবে।

টমের প্রস্তাবটা নিয়ে বহু চিন্তাভাবনার পর বিধবার কাছে ফিরে গেলাম।

আমাকে ফিরে পেয়ে বিধবার সে কী কান্না। দুষ্টুমির জন্যে স্নেহের সুরে শাসন করল। তবে ওই পর্যন্তই, তার বেশি কিছু নয়। আমাকে আবার কাপড় পরাল নতুন করে। আমার আর কিছু করার ছিল না, কেবল বসে বসে ঘামতে লাগলাম। আবার সে-ই পুরোন কাণ্ড শুরু হল। রাতে খাবার পালা চুকলে বাইবেল থেকে নানান গপ্পো শোনায় বুড়ি। একদিন মুসা নবী আর বুলরাশারদের কাহিনীটা শোনাল। মুসা নবীর গল্প শুনতে শুনতে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল আমার, ঘামে ভিজে গেল শরীর।

কিন্তু যখন বুড়ি, মিসেস ডগলাস, বলল মূসা অনেক কাল আগেই মারা গেছে, সব আগ্রহ হারিয়ে ফেললাম আমি। কারণ মরা মানুষের প্রতি আমার কোন আকর্ষণ নেই।

খুব শিগগিরই ধোঁয়া টানার ইচ্ছে জাগল আমার। বিধবাকে সে কথা জানাতেই আমাকে বারণ করল সে। বলল, ওটা নাকি খুব বাজে নেশা, আমি যেন কক্ষনও না করি। কিছু মানুষের থাকে এরকম, সবতাতেই বাড়াবাড়ি। বুড়ি নিজে নস্যি নেয়, তাতে দোষ নেই; অথচ আমাকে তামাক খেতে দেবে না।

এর মাঝে একদিন বেড়াতে এল মিস ওয়াটসন, বিধবাটির বোন। কুমারী হলে কী হবে বয়েস তাই বলে নেহাত কম না মিস ওয়াটসনের। বডি: লম্বা ছিপছিপে; চোখে রঙিন চশমা। প্রায়ই আমাকে নিয়ে বানান শেখাতে বসে সে। প্রায় এক ঘণ্টা ধরে আমার ওপর চলে বানানের ব্যায়াম। তারপর বিধবা এসে খানিক বিশ্রাম দেয় তার বোনকে। এ আমার সহ্যের বাইরে। মৃত্যুর মত নিরানন্দ একটা ঘণ্টা, কিসসু করার নেই। খালি উশখুশ। মাঝেমধ্যে মিস ওয়াটসন বলে, তোমার পা ওখানে রেখ না, হাকলবেরি; ওরকম খখশ শব্দ কোরো না—সোজা হয়ে বস। আবার কিছুক্ষণ পরেই বলে, অমন করে হাই তুলে পা ছড়িয়ে বোসা না, হাকলবেরি-ভদ্রতা বজায় রাখ। তারপর যতসব ভয়ঙ্কর জায়গা আছে, সে সবের গপ্পো শোনায়।

ইস্! যদি যেতে পারতাম ওখানে, বলি আমি। শুনেই খেপে যায় বুড়ি। আমার কিন্তু ও কথা বলার ভেতর নষ্টামি কিছু ছিল না। আসলে একভাবে আটকা থেকে হাঁফিয়ে উঠেছিলাম। কোথাও যাওয়া, তা সে যেখানেই হোক না কেন, দরকার হয়ে পড়েছিল ভীষণ। মোটকথা, একটা পরিবর্তন চাইছিলাম।

ওসব কথা আর কখনও বলবে না, হাক, বলে মিস ওয়াটসন। অন্যায় করেছ বলে। তারপর বলে, সারা পৃথিবীটা দিয়ে দিলেও নাকি অমন কথা বেরুবে না তার মুখ দিয়ে। আরও বলে বাস করার জন্যে কোন ভাল জায়গায় চলে যাবে সে। সেখানে কোন পাপী-তাপী নেই। কিন্তু আমি দেখলাম তার সাথে গিয়ে লাভ নেই। তাই মনে মনে স্থির করলাম, আমি যাব না। তবে আভাস দিলাম না তা; ঝামেলা বাড়ত তাতে, লাভ হত না কোন।

এরপর বলবার মত একটা কিছু পেয়ে আরও খানিকক্ষণ বকবক করে বুড়ি। স্বর্গের গপ্পো শোনায়। সেখানে নাকি অনন্ত সুখ। লোকের কাজ বলতে, ঘুরে ঘুরে গান গাওয়া আর বেহালা বাজান। ওই জায়গার কথাও তেমন ভাল লগে না। আমার, তবে সে কথাও বলি না তাকে। শুধু জিজ্ঞেস করি, টম সেখানে যাবে কি-না। মিস ওয়াটসন জানিয়েছে তেমন সম্ভাবনা খুব কম। শুনে ভারি খুশি হয়েছি। আমি। কারণ আমি টমের সাথে থাকতে চাই।

এদিকে মিস ওয়াটসনের কথা আর থামতে চায় না, শুনতে শুনতে কান পচে যায় আমার। ক্রমে কাজকাম সারা হয় সবার। নিগ্রো চাকরদের ডেকে আনা হয় ঘরে, প্রার্থনা সেরে যে যার বিছানায় চলে যায়।

আমি এক টুকরো মোমবাতি হাতে ওপরে আমার কামরায় যাই। মোমটা টেবিলের ওপর রেখে চেয়ার টেনে বসি জানলার ধারে। মজার কোন কথা ভাবতে চেষ্টা করি। কিন্তু ফল হয় না কোন। ভীষণ একা লাগে, ইচ্ছে হয় মরে যাই। তারা ঝকমকে আকাশ, গাছের পাতার খশখস—হুঁ হুঁ করে ওঠে মনটা। একটা পেঁচা, অনেক দূরে কেউ হয়ত মারা গেছে তার শোকে, কাঁদছে হুঁ হুঁ করে। একটা হপোবিল পাখি আর একটা কুকুর কেউ মারা যাবে বলে চেঁচাচ্ছে। ফিসফিস করে বাতাসও যেন কী বলতে চায় আমাকে, ঠাওর করতে পারি না। একটা হিম স্রোত বয়ে যায় শিরদাঁড়া বেয়ে। ভূতে যখন মনের কথা বলতে চায় কিন্তু না পারার বেদনায় অস্থির হয়ে শব্দ করে কবর থেকে, তেমনি সব কান্নার মত আওয়াজ প্রতি রাতে ভেসে আসে দূরের জঙ্গল থেকে। আমার গা ছম ছম করে ওঠে। ইচ্ছে যায়, সঙ্গী হিসেবে পাই কাউকে!

হঠাৎ একদিন একটা মাকড়সা আমার কাঁধ বেয়ে উঠল। দু আঙলে টোকা দিতেই মোমশিখার ওপর গিয়ে পড়ল ওটা; আমি কিছু করার আগেই ঝলসে গেল মাকড়সাটা। খারাপ লক্ষণ, স্পষ্ট বুঝতে পারলাম, কপালে দুর্ভোগ আছে। ভীষণ ভয় পেয়ে গেলাম আমি। তাড়াতাড়ি গায়ের জামাকাপড় ঝাড়লাম। উঠে ঘরের ভেতর তিন পাক ঘুরলাম, প্রতিবার ঘোরার সময় ক্রুশচিহ্ন আঁকলাম বুকে। তারপর ডাইনীদের তাড়াবার জন্যে সুতো দিয়ে মাথায় ঝুটি বাঁধলাম। তবে এসবের পরেও ভরসা পেলাম না তেমন। কারণ, আমি শুনেছি, কুড়িয়ে পাওয়া ঘোড়ার নাল দরজার ওপর পেরেক দিয়ে আটকে না রেখে, কেউ যদি হারিয়ে ফেলে সেটা—তখন কাজ দেয় এসব টোটকায়। কিন্তু মাকড়সা মারলে কীভাবে রক্ষা পাওয়া যায়, সেই ব্যাপারে কিছু শুনিনি কারো কাছে।

আবার বসলাম চেয়ারে, শরীর কাঁপছে থরথর। তামাক খাওয়ার জন্যে পাইপ বের করলাম। মরার মত ঘুমুচ্ছে সবাই, বিধবা তো আর জানছে না এর কথা! কতক্ষণ পর বলতে পারব না-তবে অনেকক্ষণ হবে-হঠাৎ চমক ভাঙল আমার। দূরে ঢং ঢং করে বারটার ঘণ্টা বাজছে টাউন হলের ঘড়িতে। তারপর আবার সব চুপচাপ, সূঁচ পড়লেও বুঝি শোনা যাবে। আচমকা মনে হল, অদূরেই মট করে একটা গাছের ডাল ভাঙল যেন একটা কিছু ঘটছে। কান পাতলাম আমি।

মা-ও! মা-ও! বেড়াল ডাকার ক্ষীণ শব্দ ভেসে এল নিচ থেকে।

আহ! বাঁচলাম! যতটা সম্ভব মিহি সুরে বললাম, মা-ও! মা-ও! তারপর আলো নিবিয়ে জানলা টপকে কারনিসে নামলাম, সেখান থেকে বারান্দার চাল বেয়ে মাটিতে। তারপর বুকে হেঁটে এগিয়ে গেলাম ঝোপঝাড়ের ভেতর দিয়ে। ঠিক—টম সয়্যারই অপেক্ষা করছে আমার জন্যে।

<

Mark Twain ।। মার্ক টোয়েন