দক্ষিণ গোলার্ধ আর উত্তর গোলার্ধ যেমন বিপরীত দিকে, তেমনি আবহাওয়াগত দিক থেকেও সম্পূর্ণ উল্টো। জানুয়ারি মাসে উত্তর গোলার্ধে যখন বরফের মতো ঠাণ্ডা, দক্ষিণ গোলার্ধ তখন রীতিমতো উত্তপ্ত, ভ্যাপসা গরম। সেসময়ে অতলান্ত সাগরও থাকে উত্তাল। এক কথায় বলতে গেলে দক্ষিণ গোলার্ধ তখন পৃথিবীর বুকে নরক ছাড়া আর কিছু নয়।

আমাদের কাহিনীর পটভূমিও অতলান্ত সাগরের তীরে দক্ষিণ আমেরিকার আর্জেন্টিনা। দক্ষিণের সেই তিয়েরা দেল কিউগো থেকে রিও ডি প্লাটা নদীর মোহনা পর্যন্ত বিস্তৃত আর্জেন্টিনা দেশটির সাগর। বেলা।

রিও ডি প্লটার মোহনার কাছেই আর্জেন্টিনার রাজধানী, বুয়েন্স আয়ার্স বন্দর-শহর। মুক্তো আর ঝিনুক ব্যবসার জন্যে পৃথিবী বিখ্যাত এই সাগরবন্দর এবং রাজধানী।

বন্দরের কিছুটা বাইরে সমুদ্রে খাঁড়ির মুখে নোঙর ফেলে দাঁড়িয়ে আছে একটা জাহাজ। জাহাজটির নাম জেলিফিশ। রাতের আকাশে জ্বলজ্বল করছে হাজারো কোটি নক্ষত্র। আকাশের কালো চাদরে মিটমিটে তারারাজি আর নিচে নিকষ কালো অতলান্ত মহাসাগর। শান্ত, নিঝুম পরিবেশ বিরাজ করছে চারপাশে জাহাজটিতেও কোন প্রাণচাঞ্চল্য নেই। কিছু একটা ঘটবে সে আশায় চুপচাপ অপেক্ষা করছে যেন।

জাহাজটা মুক্তো শিকারীদের। শিকার আপাতত শেষ। ডেকে শুয়ে বিশ্রাম নিচ্ছে একদল ক্লান্ত ডুবুরি। তাদের পরনে মোটা ক্যানভাসের কৌপিন। ওরা এতই ক্লান্ত যে পোশাক বদলানোর ইচ্ছেও জাগেনি কারও মনে। সাগব্র থেকে উঠেই গা মুছে শুয়ে পড়েছে জাহাজের ডেকে, সেঁটে ঘুম দিয়েছে।

মাঝে মাঝে ডুবুরিদের কেউ কেউ ঘুম থেকে উঠে টলমল পায়ে জাহাজের পেছনে যাচ্ছে। যেতে গিয়ে সঙ্গীদের গায়ে পা দিয়ে বিরক্তি উৎপাদন করছে। দোষ দেয়া যায় না তাদের। ঘুমের ঘোরে হাঁটতে গিয়েই যত বিপত্তি। জাহাজের পেছনে মাস্তুলের কাছে একটা পিপে রাখা আছে। সেটার সঙ্গে আছে একটা মগ। সেই মগে করে পানি খেয়ে কোনমতে একটু জায়গা করে নিতে পারলেই আবার শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ছে ডুবুরিরা। ভীষণ ক্লান্ত তারা। সামান্য বিরাম নিয়ে সারাদিন সাগরের পানির নিচে ডুব দিয়েছে। পানির প্রচণ্ড চাপের মধ্যে কাজ করতে হয় বলে দিনে এরা প্রায় কিছু খায় না বললেই চলে। সন্ধেয় যখন ছুটি মেলে, কোনমতে নাকে মুখে দুটো গুঁজে দিয়েই ঘুমের অতলে তলিয়ে যায়। খাদ্য বলতে নোনা মাংস। বছরকে বছর ওই একই জিনিস। পুষ্টিকর কিন্তু বিস্বাদ খাবার।

জেলিফিশ জাহাজটার মালিক নিজেই জাহাজের ক্যাপ্টেন। নাম তার পেদরো জুরিতা। তার বিশ্বস্ত অনুচর আছে একজন। লোকটা রেড ইন্ডিয়ান। প্রায় সর্বক্ষণ ক্যাপ্টেনের সঙ্গে লেগে থাকে। নাম বালথযার। কম বয়সে বালথাযারও নামকরা এক ডুবুরি ছিল। অন্যদের তুলনায় দ্বিগুণ সময় পানির নিচে থাকতে পারত। কেউ তার এই ক্ষমতায় বিস্ময় প্রকাশ করলে হাসত বালথাষার

আগেপরে একটা কথাই বলে আসছে সে, আমাদের আমলে ডুবুরির বিদ্যা খুব যত্নের সঙ্গে শেখানো হতো। শিক্ষা শুরু হয়ে যেত প্রায় বাচ্চা বয়স থেকে। মাত্র দশ বছর বয়সে বাবা আমাকে কাজ শিখতে হোসের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিল। আমার মতোই শিক্ষানবীশ দশ-বারোজনকে নিয়ে পাল তোলা একটা জাহাজে করে সাগরে বেরিয়ে পড়ত হোসে। তার শেখানোর নিয়মটা ছিল খুব সুন্দর। একটা সাদা পাথর বা ঝিনুক পানির মধ্যে ফেলে দিয়ে নির্দেশ দিত, তুলে নিয়ে এসো! তুলে আনতাম আমরা। একটু একটু করে গভীর পানিতে পাথর বা ঝিনুক ছুঁড়ত সে। কেউ যদি তার পালার সময় ডুব দিয়ে হোসের পাথর তুলে আনতে না পারত, তাহলে তার কপালে জুটত চাবুকের ঘা। চাবুক পেটা করে তাকে আবার সেই একই জায়গায় ডুব দিতে বাধ্য করত হোসে। তার কারণেই ধীরে ধীরে দক্ষ হয়ে উঠলাম আমি। প্রচুর আয়ও করেছি জীবনে।

বয়স বেড়ে যাওয়ায় ডুবুরির পেশা ছাড়তে বাধ্য হয়েছে বালথাযার। এমনিতেও ছাড়তেই হতো। একটা হাঙর তার বাম পা জখম করে দিয়েছিল। তাছাড়া নোঙরের শিকলে চোট লেগে শারীরিক ভাবে প্রায় অথর্ব হয়ে পড়েছিল সে।

বুয়েন্স আয়ার্সে সামুদ্রিক জিনিসের ছোট একটা দোকান করেছে বালথাযার। প্রবাল, মুক্তো, ঝিনুক, শামুক আর নানা ধরনের সামুদ্রিক সৌখিন জিনিস বিক্রি হয় তার দোকানে। ব্যবসা ভাল চলছে, কিন্তু পুরো মনোযোগ কখনোই দিতে পারে না বালথাযার। বয়স যতই হোক, সাগর তাকে আজও কাছে টানে প্রবল আকর্ষণে। মুক্তোশিকারীদের সঙ্গে সাগরে যাওয়ার সুযোগ ঘটলে জুটে পড়ে সে। মুক্তো ব্যবসায়ীরাও তাতে খুশি হয়। লা প্লটা মোহনা বা সাগরের বিভিন্ন জায়গায় কোথায় বেশি মুক্তো পাওয়া যাবে সেটা বালথাযারের চেয়ে ভাল আর কেউ জানে না।

যুবক ডুবুরিরাও বালথাযার সঙ্গে থাকলে খুশি হয়। অনেক ব্যাপারেই তার সাহায্য পায়। শিখতে পারে নতুন কৌশল। কি করে বেশিক্ষণ দম রাখতে হয়, কিভাবে হাঙরের হামলা ঠেকাতে হয় থেকে শুরু করে আরও অনেক কিছুই আছে তার শেখানোর ঝুলির মধ্যে। কি করে মালিকের চোখ এড়িয়ে দামি মুক্তো প্লিস করে দিতে হয় সেটাও তার কাছ থেকে শেখে গরীব ডুবুরিরা।

মালিকপক্ষের কাছেও বালথাযারের গুরুত্ব কম নয়। কোন্ মুক্তো বাজারে কততে বিকোবে সেটা মুক্তোয় একবার চোখ বুলিয়েই বলে দিতে পারে বালথাযার। এক পলকে বেছে দিতে পারে সেরা মুক্তোগুলো। বালথাযার জাহাজে থাকলে তাই মালিকরাও খুশি হয়।

ক্যাপ্টেন জুরিতা পেদরোর জাহাজে রাতে প্রহরার দায়িত্ব পড়েছে আজ বালথাযারের। একটা পিপের ওপর আয়েস করে বসে আছে সে, চুরুট টানছে। মাস্তুলে ঝোলানো লণ্ঠনটার এক চিলতে আলো এসে পড়েছে তার মুখে। আরাউকান ইন্ডিয়ানদের সমস্ত বৈশিষ্ট ফুটে উঠেছে মৃদু আলোয়। ঘুমে বুজে আসছে বালথাযারের দুচোখ, কিন্তু সতর্কতায় কোন ঢিল নেই। ডেকের ওপর ঘুমন্ত ডুবুরিদের নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের আওয়াজ স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে সে। ঘুমের ঘোরে বলা ডুবুরিদের কথাও কান এড়াচ্ছে না।

সাগর সৈকতের দিক থেকে বাতাস বইছে। সে বাতাস বয়ে আনছে ঝিনুক পচার উৎকট দুর্গন্ধ। মুক্তো সহজে বের করার জন্যে সাগর থেকে ঝিনুক তুলে সৈকতে ফেলে রাখা হয়। পচলে পরে ঝিনুকের ভেতর থেকে মুক্তো সংগ্রহ সহজ। সাধারণ মানুষ ঝিনুক পচার গন্ধে স্রেফ বমি করে দেবে, কিন্তু বালথাযারের কাছে গন্ধটা চমক্কার বলে মনে হয়। গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে স্মৃতির অতলে ডুব দেয়। সে। তারুণ্যে ফিরে যায়। ফেলে আসা রোমাঞ্চকর অতীত রোমন্থন করে। সমুদ্রের অমোঘ নিরব আহ্বানে বুকের ভেতর শিরশির করে ওঠে তার।

হঠাৎ পূর্ণ সজাগ হলো বালথাযার। মনে হলো দূর থেকে অস্পষ্ট ভাবে শুনতে পেয়েছে তীক্ষ্ণ একটা শব্দ। তার পরপরই কমবয়েসী একজন পুরুষের চিৎকার ভেসে এলো।

আ-আ-আ!

ঠোঁট থেকে চুরুট খসে পড়েছে বালথাষারের। কান খাড়া করে অপেক্ষা করছে সে, আবারও শুনতে পেল, বাঁশির মতো তীক্ষ্ণ আওয়াজটা হলো। আবার আ-আ-আ করে চেঁচিয়ে উঠল তরুণ কণ্ঠ। বাঁশির আওয়াজ আর তরুণের চিৎকার দুটোই নিরব পরিবেশে এত অদ্ভুত শোনাল যে গা শিরশির করে উঠল বালথাযারের। মনে হলো পার্থিব কোন আওয়াজ নয় ওগুলো।

পিপে ছেড়ে উঠে চারপাশে তীক্ষ্ণ নজর বোলাল বালথাযার। কালিগোলা অন্ধকারে কিছুই দেখতে পেল না। আওয়াজ থেমে গেছে। কানে পীড়া দেয়, এতই নিস্তব্ধ চারপাশ। অস্বস্তির বোধ কাটাতে পারল না, রেড ইন্ডিয়ান এক ডুবুরিকে বুটের গুঁতো দিয়ে ঘুম থেকে তুলল বালথাযার, নিজে কিছু শুনতে পাচ্ছে না, তবুও জিজ্ঞেস করল, শুনতে পাচ্ছ কিছু?

তার কথা শেষ হওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে আবার সেই আর্তচিৎকার শোনা গেল।

আ-আ-আ!

ভয়ে কেঁপে উঠল রেড ইন্ডিয়ান ডুবুরি। এক পলকে কেটে গেল ঘুমের ঘোের। আতঙ্কগ্রস্ত অস্ফুট স্বরে বলল, এ ও ছাড়া আর কেউ না!

আরও কয়েকজন ডুবুরির ঘুম ভেঙেছে। একটু পরই একজনও ঘুমন্ত থাকল না। বালথাযারের দেখাদেখি লণ্ঠনের কাছে ভিড় করল তারা। আলো ওদের সাহস ফিরিয়ে দিচ্ছে। ভাব দেখে মনে হলো ওই আলো ওদের সমস্ত অপার্থিব বিপদ থেকে রক্ষা করবে।

নিচু স্বরে যার যার মতামত জানাচ্ছে সবাই। কেউ চুপ করে নেই। সবারই বক্তব্য আছে।

এ সেই সাগর-দানো ছাড়া আর কেউ নয়।

জানে বাচলে এই এলাকা ছেড়ে পালাব।

হাঙরের চেয়েও ভয়ানক ও!

ক্যাপ্টেনকে ডাকো কেউ একজন!

ডেকে হৈ-চৈয়ের আওয়াজ পেয়ে কেবিন ছেড়ে বেরিয়ে এলো পেদরো জুরিতা! এখনও ঘুম লেগে আছে তার চোখে। গরমের কারণে উর্ধাঙ্গে কোন পোশাক পরেনি সে। পরনে শুধু ক্যানভাসের প্যান্ট। বেল্টে রিভলভার খুঁজতে ভুল করেন। ডুবুরিদের কাছে এসে দাঁড়াল সে লণ্ঠনের আলোয় দেখা গেল তার রোদে পোড়া তামাটে চেহারা। গোঁফ-দাড়ির জঙ্গলের কারণে ভয়ঙ্কর বদমেজাজী মনে হচ্ছে তাকে এমুহূর্তে চড়া গলায় বলল, কি ব্যাপার! কি হচ্ছে এখানে।

সবকজন এক সঙ্গে মুখ খোলায় মনে হলো সম্মিলিত চিঙ্কার জুড়েছে সবাই। একটা কথাও স্পষ্ট হলো না। হাত তুলে, হাঁকডাক দিয়ে সবাইকে চুপ করাল বালথাযার। উপযাচক হয়ে বলল, সাগর দানোর চিৎকার শুনেছি আমরা।

ঘুম থেকে উঠে এখনও ধাতস্থ হতে পারেনি পেদরো জুরিতা। গোটা ব্যাপারটা তার কাছে আজগুবি মনে হলো। বলে উঠল, স্বপ্ন, স্বপ্ন দেখেছ তোমরা।

স্বপ্ন না, প্রতিবাদ করল ডুবুরিরা। একটু আগেই তার চিৎকার শোনা গেছে। বাঁশির মতো তীক্ষ্ণ সেই আওয়াজটাও ছিল।

বালথাযার উৎসাহী ডুবুরিদের থামিয়ে দিয়ে বলল, আমি নিজে। শুনেছি। সাগর-দানো ছাড়া ওভাবে কেউ তীক্ষ্ণ বাঁশি বাজায় না। চিকারও করছিল। আমার মনে হয় এখানে আমাদের না থাকাই উচিত হবে।

মুখ বাঁকাল পেদরো জুরিতা। যতসব গুজব। আর কিছু নয়।

জুরিতার কথা ডুবুরিদের এক কান দিয়ে ঢুকে আরেক কান দিয়ে বেরিয়ে গেল। ভয় পেয়েছে ওরা। উত্তেজিত হয়ে পড়ছে। একজোট হয়ে দাবি জানাল, এক্ষুণি জাহাজ এখান থেকে সরিয়ে নিতে হবে। ক্যাপ্টেন যদি তাদের কথা না শোনে তাহলে কাল সকালেই জাহাজ ত্যাগ করবে সবাই, ফিরে যাবে বুয়েন্স আয়ার্সে। বেতন যুতই হোক এজাহাজে আর কাজ করবে না।

রাগে গা জ্বলে গেল পেদরো জুরিতার। বিড়বিড় করে ডুবুরিদের অভিশাপ দিল। দুএকটা ধমকধামকও দিল, কিন্ত কোন কাজ হলো না। বাড়াবাড়ি করার আর সাহস হলো না, তার, ডুবুরিদের তখনকার মতো শান্ত করে তাদের কথা মতো জাহাজ সরিয়ে নেবে কিনা, সেব্যাপারে ভাবার জন্যে সময় দরকার এটা বলে নিজের কেবিনে ঢুকল।

মুখে ক্যাপ্টেন যাই বলুক, মনে মনে সে ভীষণ চিন্তিত হয়ে পড়েছে। কেবিনে পায়চারি করতে করতে ভাবনার জাল বুনে চলল।

গুজব রটেছে এদিকের সমুদ্রে একটা অদ্ভুত প্রাণীকে দেখা গেছে। ডুবুরি আর সাগর তীরের মানুষদের ওটা নাকি ভয় দেখাচ্ছে। সবই শোনা কথা। কেউ দাবি করেনি যে নিজের চোখে জন্তুটাকে দেখেছে। ওই জন্তু নাকি ক্ষতি যেমন করে তেমনি কারও কারও উপকারও করেছে। বুড়ো রেড ইন্ডিয়ানদের মত হচ্ছে ওটা শুধু একটা জম্ভ নয়, ওটা সাগরের দানো। সহস্র বছর পর পর পৃথিবীর বুকে ন্যায় প্রতিষ্ঠিত করতে সাগরের অতল থেকে উঠে আসে দানো।

বুয়েন্স আয়ার্স শহরেও এই সাগর-দানোর কাহিনী রটে গেছে। খবরের কাগজে আলোচিত হচ্ছে সাগর-দানো। বিভিন্ন বিজ্ঞ মতামত প্রকাশ করছেন সম্পাদকরা। সাগরে কোন দুর্ঘটনা হলেই হয়, সাগর দানোর সঙ্গে সেটাকে জড়িয়ে নিয়ে খবর ছাপা হচ্ছে। নানা মুনির নানা মত। কেউ কেউ বলে জেলেদের নৌকোতে বড় বড় মাছ ছুঁড়ে দিতে দেখা গেছে তাকে। অসহায় ডুবন্ত মানুষকে নাকি প্রাণেও বাঁচিয়েছে। অনেকে দাবি করছে সাগর-দানোকে তারা অস্পষ্ট ভাবে দেখেছে, ডুবন্ত মানুষকে উদ্ধার করে সৈকতে রেখে গেছে।

কারও বর্ণনা বিশ্বাসযোগ্য নয়। বুদ্ধিমান যে কেউ বুঝবে আসলে আজ পর্যন্ত জানোয়ারটাকে চোখে দেখেনি কেউ, আসর জমানোর জন্যে কল্পনার আশ্রয় নিয়েছে স্রেফ। কেউ বলছে সাগর-দানোর মাথায় শিং রয়েছে, থুতনির নিচে রয়েছে ছাগলা দাড়ি। তার হাত-পা নাকি ঠিক পশুরাজ সিংহের থাবার মতো। শোনা যায় মাছের মতো লেজও আছে তার। আবার কেউ কেউ বলছে, এই সাগর-দানো নাকি বিরাটাকার একটা ব্যাঙের মতো দেখতে।

বুয়েন্স আয়ার্সের সরকারী মহল প্রথমটায় এসব গুজবে কোন গুরুত্ব দেয়নি। কিন্তু গুজব এতটাই ডানা মেলল যে ইচ্ছে করলেই চট করে উপেক্ষা করা যায় না। জেলেরা এমন ভয় পেয়েছে যে সাগরে তাদের মাছ ধরা বন্ধ। শহরে মাছের আকাল পড়েছে। নাগরিকদের খাদ্য সংকট মোকাবিলা করতে হচ্ছে। এতদিনে সরকারী ভাবে পদক্ষেপ নেয়া হলো। গোটা কয়েক স্টীমার আর লঞ্চ পাঠানো হলো, উপকূলে প্রহরা দেবে। নির্দেশ দেয়া হলো, যে জানোয়ার মানুষের মনে আতঙ্ক ছড়িয়ে দিচ্ছে সেটাকে যেভাবে হোক বন্দি করতে হবে।

জল-পুলিশের বিশ্রাম মাথায় উঠল, লা প্লাটা উপসাগর চষে বেড়াতে লাগল তারা। রাত নেই দিন নেই তন্ন তন্ন করে খোজা চলল। মিথ্যে গুজব রটানোর অভিযোগে বেশ কয়েকজন লোক গ্রেপ্তারও হলো, কিন্তু আসল কাজ কিছুই হলো না। সাগর-দানোকে ধরা সম্ভব হলো না!

ব্যর্থতা স্বীকার করার চেয়ে অভিযোগ উড়িয়ে দেয়া সহজ, কাজেই সাগর-দানোকে ধরতে না পেরে পুলিশের প্রধান বিজ্ঞপ্তি জারি করলেন, সাগর-দানো বলে আসলে কিছু নেই, সব অশিক্ষিত মানুষের গালগল্প। বলে দেয়া হলো গুজব ছড়ানোর অপরাধে যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে তাদের কঠোর শাস্তি দেয়া হবে। জেলেদের উদ্দেশে বলা হলো তারা যেন মানুষের কথায় কান না দিয়ে নির্দ্বিধায় সাগরে মাছ ধরতে যায়। কোন বিপদ হবে না।

আশ্বাস পেয়ে মাছ ধরতে শুরু করল জেলেরা। পরিস্থিতি প্রায় স্বাভাবিক হয়ে এলো। লোকে হয়তো ভুলেই যেত সব, কিন্তু নতুন। করে আবার শুরু হলো সাগর-দানোর উৎপাত।

কিছুদিন পর এক গভীর রাতে ছাগলের ডাকের মতো বিকট একটা চিৎকারে ঘুম ভাঙল তীরবর্তী জেলেদের। ভয় পেলেও সমুদ্রের তীরে ছুটে গেল সবাই। কোথাও কিছু নেই! একের পর এক মস্ত বড় ঢেউ শুধু কল্লোল তুলে আছড়ে পড়ছে বালিয়াড়িতে। খাঁ খাঁ করছে চারদিক।

সমুদ্রে মাছ ধরছিল কিছু জেলে! জাল তোলার পর তারা দেখল কে যেন ছুরির মতো ধারাল কিছু দিয়ে ছিঁড়ে ফালাফালা করে দিয়েছে তাদের জাল।

আবার শুরু হয়েছে সাগর-দানোর উপদ্রব!

ব্যাখ্যার জন্যে সাংবাদিকরা গেল বৈজ্ঞানিকদের কাছে। আশা করা গিয়েছিল তাঁরা এর একটা জবাব দিতে পারবেন। কিন্তু তাঁরাও ব্যর্থ হলেন। জানালেন মানুষের মতো কাজ করতে সক্ষম এমন কোন সামুদ্রিক প্রাণীর কথা তাদের জানা নেই। আগের বার হাল ছেড়ে দিয়েছিল পুলিশ। এবার বিজ্ঞানীরাও হাল ছাড়লেন। তবে পুলিশের মতোই তারাও অজ্ঞতা ঢাকার জনে বললেন, এসব গুজব। নিশ্চই কোন বাজে লোকের কীর্তি। তাকে ধরা পুলিশের কাজ, বিজ্ঞানীদের নয়।

বৈজ্ঞানিকদের পাশ কাটানো ব্যাখ্যায় অনেকেই সন্তুষ্ট হতে পারল। এমনকি বিজ্ঞানীদের মাঝেও দ্বিমত পোষণ করল কেউ কেউ। একজন শয়তান লোক এতদিন ধরে এসব কাণ্ডকীর্তি করছে, কিন্তু কিজন্যে? তার উদ্দেশ্য কি? কোন উদ্দেশ্য ছাড়াই সে এমন করছে। তাছাড়া কেউ তাকে দেখতে পেল না এটাও কি একটা বিশ্বাসযোগ্য কথা? আরও আছে, খুব কম সময়ের মধ্যে দূরবর্তী অনেক এলাকায়। উপদ্রব হয়েছে। কোন মানুষের পক্ষে অল্প সময়ে অত দূর এ সাঁতরে পাড়ি দেয়া সম্ভব নয়। তারমানে যাকে সাগর-দানে বলা হচ্ছে সে অতি দ্রুত সাঁতার কাটতে সক্ষম।

চিন্তার জাল বুনছে আর চুরুট ফুঁকতে ফুঁকতে একটানা পায়চারি করছে পেদরো জুরিতা, কি করা উচিত বুঝে উঠতে পারছে না। কথন ভোর হয়ে গেছে সে জানে না। জানল জানালা দিয়ে শিশু সূর্বের লাল রশ্মি প্রবেশ করতে। কেবিন ছেড়ে বের হলো সে, হাতমুখ ধুবে। মুখে পানি দিয়েছে মাত্র, এমন সময় শুনতে শে নাবিক আর ডুবুরিদের সম্মিলিত চিৎকার। উত্তেজিত চিৎকার নয়, আর্তচিৎকার! হাতের মগ নামিয়ে রেখে আওয়াজ লক্ষ্য করে ডেকের উদ্দেশে ছুটল জুরিতা।

ডুবুরিরা রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে, হাত-পা লেড়ে উন্মত্তের মতো চিৎকার করছে সবাই। তাদের দেখাদেখি তীরের দিকে তাকাল জুরিতা। সাগর বেলায় যতগুলো নৌকো বাঁধা ছিল, সবগুলোর বাঁধন কেটে দিয়েছে কে যেন। নৌকোগুলো ভাসতে ভাসতে সাগরে চলে এসেছিল, এখন সাগর থেকে বয়ে আসা বাতাসের ধাক্কায় আবার তীরের দিকে ফিরছে। একটা নৌকোতেও দাঁড় নেই, ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে কেউ। দাড়গুলোও নৌকোর আশেপাশে ভাসছে।

নৌকোগুলো ধরে নিয়ে এসো, নির্দেশ ঝাড়ল জুরিতা। বেশি দূরে নেই, অল্পক্ষণ সাঁতরালেই হবে।

মাঠে মারা গেল তার আদেশ। নড়ল না কেউ। আবার নির্দেশ দিল জুরিতা। অসন্তোষের গুঞ্জন উঠল ডুবুরিদের মাঝে। কে একজন টিটকারি মেরে বলল, সাহস থাকলে নিজেই যাও না। সাগর-দানোর শিকার হয়ে মরার শখ নেই আমাদের।

রাগে সারাশরীর জ্বলতে শুরু করল জুরিতার, কোমরে বাঁধা হোলস্টারের কাছে হাত চলে গেল।

রেলিঙের কাছ থেকে সরে মাস্তুলের নিচে জড় হলো ডুবুরিরা। রাগান্বিত দৃষ্টিতে দেখছে তারা পেদরো জুরিতাকে। বিদ্রোহের আলামত সুস্পষ্ট! যে কোন সময় বেধে যেতে পারে সংঘাত।

লাগতো, কিন্তু দুপক্ষের মাঝে এসে দাঁড়াল বৃদ্ধ বালথাযার। সবাইকে অবাক করে দিয়ে বলে উঠল, আমি রেড ইন্ডিয়ান এই বালথাযার কোনদিন হাঙরকে ভয় পাইনি। সাগর-দানোকেও ভয় পাব

কেউ কিছু বলার আগেই রেলিঙের কাছে চলে গেল বালথাযার, দুহাত সামনে বাড়িয়ে ঝাঁপ দিল সাগরে। একে তো বয়স অনেক, তারওপর একটা পা পুরোপুরি সক্ষম নয়, তবুও দ্রুত সাঁতরাচ্ছে। বালথাযার। একটা নৌকোয় গিয়ে উঠল। ভাসন্ত একটা দাঁড় তুলে। নিয়ে নৌকোটা নিয়ে তীরের দিকে চলল সে।

বালথাযারের কোন বিপদ হলো না দেখে অন্য জুবুরিদেরও সাহস ফিরল। তারাও ঝাঁপ দিল সাগরে। নৌকোগুলো নিয়ে তীরের দিকে ফিরতে শুরু করল।

সবাই খেয়াল করেছে, প্রত্যেকটা নৌকোর দড়ি যেন কেটে, দিয়েছে কেউ। কেটে দিয়েছে ধারা ছুরি বা ক্ষুর দিয়ে।

<

Super User