ইউসুফ পাশা, দুর্ধর্ষ এক বাংলাদেশী যুবক। জন্ম আমেরিকায়, লেখাপড়াও সেখানেই। সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিল প্রথমে, সেখান থেকে আমেরিকান সিক্রেট সার্ভিসে। সারা দুনিয়ার সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে ও। বিপজ্জনক মিশন নিয়ে ঘুরে বেড়ায় দেশে দেশে। মৃত্যুর পরোয়া করে না। অ্যাডভেঞ্চার! অ্যাকশন! রহস্যভেদ! সবই রয়েছে এতে। নতুন ধরনের এই অ্যাকশন সিরিজে পাঠককে স্বাগতম।

০১.

বিশ নট গতিতে এগিয়ে চলেছে কোস্টগার্ডের পেট্রোল বোট সিজি ৪০৪০১। রুটিন পেট্রোলে বেরিয়েছে অ্যালমেডা কোস্টগার্ড বেসের সদস্যরা। এদের প্রায় সবাই টগবগে তরুণ। বোটের কমান্ডার লেফটেন্যান্ট ক্রিস্টোফার পাইকের বয়েসও তেমন বেশি নয়। কোন তাড়াহুড়াও নেই। নতুন এই বোটটা চালিয়ে পরীক্ষা করে দেখার জন্য সারাটা রাতই সামনে পড়ে আছে। কোন সমস্যা দেখা দিলে সকালে বেস-এ ফিরে রিপোর্ট করলেই চলবে।

উত্তরে বিছিয়ে থাকা কালির মত কালো পানির দিকে তাকিয়ে আছে পাইক। চাঁদহীন, মেঘে ঢাকা কালো আকাশের নিচে প্রশান্ত মহাসাগরকে দেখাচ্ছে একটা সীমাহীন কালো মখমলের চাদরের মত।

মোরগের মত ঘাড় ঘুরিয়ে পাশে দাড়ানো অস্থির তরুণের দিকে তাকালেন তিনি। ‘শান্ত হও, প্রিক। কোনরকম বিপদের সম্ভাবনা দেখছি না আমি। অন্তত আমাদের এই শিফটে তো নয়ই।’

অ্যাকাডেমি থেকে সদ্য বেরিয়েছে এনসাইন প্রিক জনসন। অফিসার হিসেবে নিয়োগ পেয়েছে অ্যালামেডায়। আজকের পেট্রোলটা ওর প্রথম পেট্রোল। অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে মাথা ঝাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কিন্তু ড্রাগ স্মাগলারদের ব্যাপারটা কী হবে, সার? শুনেছি, সব সময়ই নাকি এ জায়গাটায় ওদের সঙ্গে কোস্ট পেট্রোলের সংঘর্ষ বাধে।’

‘বেশি বেশি শুনেছ। হ্যাঁ, মাঝে মাঝে যে ওদের সঙ্গে দেখা হয় না, তা বলব না; তবে প্রতি রাতেই ওদের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধ হওয়ার কথাটা একেবারেই গুজব। স্মাগলাররা বোকা নয়, এনসাইন। ওরা জানে, আমাদের বোটটা খুব দ্রুত চলতে পারে। তা ছাড়া আমাদের কাছে রয়েছে অত্যন্ত আধুনিক যন্ত্রপাতি, যেগুলোর সাহায্যে যেকোন বোটকে শনাক্ত করে ফেলা সম্ভব।’

যেন এই কথাটাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্যই ঠিক এ সময় পাইপের ভিতর দিয়ে কথা বলে উঠল সোনার অপারেটর, ‘লেফটেন্যান্ট, সামনে ডানদিকে একটা টার্গেট শনাক্ত করেছি।’

তীরের দিকের কালো পানিতে নজর বোলালেন লেফটেন্যান্ট। কিন্তু কোন আলো চোখে পড়ল না। রেঞ্জ আর অবস্থান জানাও, সিম্যান।

রেঞ্জ ওয়ান-জিরো-নাইন-জিরো। এখন ওটা নড়ছে না, সার। কিন্তু…’

সোনারম্যানের এই অনিশ্চয়তা অস্বাভাবিক লাগল লেফটেন্যান্টের কাছে। সিম্যান রবার্ট স্টাইনের দক্ষতার ব্যাপারে বিন্দুমাত্র সংশয় নেই তার। জিজ্ঞেস করলেন, কিন্তু কী?’

‘না, সার, প্রথমবার যে সঙ্কেতটা দিল, সেটা যন্ত্রের গোলমালও হতে পারে। কারণ পানির সমতলের ঠিক নীচে থেকে এসেছিল সঙ্কেত। এখন পানির ওপরে।’

কী করবেন ভাবছেন পাইক। রুটিন টহল চালিয়ে যাবেন, নাকি জিনিসটা কী দেখতে যাবেন? সানফ্রান্সিসকো থেকে আসা মাছধরা বোট কিংবা ইয়ট বলে  মনে হলো না। জনসনের কৌতুহলী দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হলেন, দেখতে যাবেন। হয়তো কিছুই না, কিন্তু ওকে শান্ত করতে পারবেন।

‘হ্যাঁ, ওদিকে যেতে বলো,’ নির্দেশ দিলেন তিনি। ‘সবাইকে ডিউটি স্টেশনে হাজির থাকতে বলো। আর সমস্ত আলো নিভিয়ে দিতে বলো।’

ব্যস্ততা শুরু হলো জাহাজে। পুরো ব্রিজটা অন্ধকার হয়ে গেল, শুধু ইন্সট্রুমেন্ট প্যানেলের লাল-সবুজ আলোগুলো বাদে।

আবার রিপোর্ট করল স্টাইন। রেঞ্জ এক হাজার গজ, স্যার। টার্গেট এখনও আগের জায়গাতেই আছে। তিনশো ফুট গভীর একটা খাঁড়িতে।

‘আকৃতি?’ পাইক জিজ্ঞেস করল।

‘খুব সরু, সার। আশি ফুট লম্বা। টুইন প্রপেলার।

‘সার, দেখুন,’ বলে উঠল প্রিক। হাত তুলে গলুইয়ের ওপর দিয়ে দেখাল।

দ্রুত হয়ে গেল লেফটেন্যান্টের নাড়ির গতি।  তীরের ঢিবির মত উঁচু হয়ে থাকা একটা জায়গা থেকে তিনবার জ্বলল একটা আলো।

জবাব গেল পানিতে ভাসমান জলযান থেকে।

‘সিগন্যাল দিচ্ছে!’ উত্তেজিত কণ্ঠে বলল প্রিক।

রবার্ট স্টাইনের কথা শোনা গেল, টার্গেট নড়তে শুরু করেছে, সার। এক নটেরও কম গতিতে। তীরের দিকে এগোচ্ছে।

শিরশির করে উঠল পাইকের মেরুদণ্ড। কনসোল থেকে একটা নাইটভিজন স্কোপ নিয়ে অন্ধকার তীরভূমির দিকে তাকালেন তিনি। পেট্রোল বোটটা এখনও অনেক দূরে রয়েছে, ভালমত বোঝা যাচ্ছে না কিছু। তবে তার মনে হলো, বেস অ্যালামেডার সঙ্গে যোগাযোগ করে ব্যাপারটা জানানো দরকার। কিন্তু যদি ভুল হয়ে থাকে, তাহলে কৈফিয়ত দিতে হবে, আর সেটা খুব একটা সুখের বিষয় হবে না। সবচেয়ে ভাল হয়, আগে ভালমত দেখে নিয়ে নিশ্চিত হয়ে নেয়া। তারপর রিপোর্ট করা যাবে।

‘রেঞ্জ বলো, স্টাইন,’ বললেন তিনি।

‘নয়শো গজ। দ্রুত এগোচ্ছি।’ এক মুহুর্ত বিরতি দিয়ে সোনারম্যান বলল, ‘আটশো। আবার এক মুহুর্ত বিরতি দিয়ে বলল, ‘সাতশো।’

পাঁচশো গজ দূরে থাকতে স্কোপের ভিতর দিয়ে তাকালেন আবার পাইক। শক্তিশালী যন্ত্রের ভিতর দিয়ে দিনের আলোর মত দেখা গেল দৃশ্যটা।

টার্গেট’টা দেখার সঙ্গে সঙ্গে গতিবেগ পাঁচ নটে নামিয়ে ফেলার আদেশ দিলেন পাইক। চুপি চুপি গিয়ে অপরাধীকে ধরে ফেলার ইচ্ছে। স্পটলাইটের কাছে দাঁড়িয়ে আছে দুজন সিম্যান, নির্দেশ পাওয়া মাত্র আলো জ্বেেল দেবে।

‘টার্গেট আবার থেমে গেছে, সার,’ সোনারম্যান জানাল।

খাঁড়ির মুখে প্রবেশ করল পেট্রোল বোট। সামনে ঝুঁকলেন পাইক।

অবশেষে পরিস্কার দেখতে পেলেন টার্গেটটা। সরু, লম্বা, পিঠের খুব সামান্য অংশ ভেসে রয়েছে পানিতে। এ ধরনের জলযান আগে কখনও দেখেননি তিনি।

‘কী এটা’ জোরে যেন নিজেকেই প্রশ্ন করলেন তিনি। মনে করার চেষ্টা করলেন, নেভি কোনও ধরনের পরীক্ষা চালাচ্ছে কি না এই এলাকায়।

একশো পঞ্চাশ গজের মধ্যে পৌঁছে গেল নেভির পেট্রোল বোট।

‘সার,’ রবার্ট স্টাইনের তীক্ষ্ণ্ণ  কণ্ঠ বেজে উঠল পাইপের ভিতর দিয়ে। ‘প্রপেলারের গতি দ্বিগুণ হয়ে গেছে। এগিয়ে আসছে ওটা।’ ছুরির মত পানি কেটে চক্কর দিল টার্গেটটা। একইসঙ্গে তলিয়ে যেতে থাকল পানিতে।

‘টার্গেট ডাইভ দিচ্ছে।’ সোনার অপারেটরের কণ্ঠে উত্তেজনা।

নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছেন না পাইক। প্রায় পুরোটাই এখন ডুবে গেছে জলযানটার, পিঠটাকে মনে হচ্ছে বিশাল গিরগিটির পিঠের মত। পেরিস্কোপ আর অ্যানটেনাটা পানির ওপর মাথা তুলে রেখেছে। বিস্ময়ে বিড়বিড় করলেন তিনি, ‘এ হতে পারে না।’

‘টার্গেট এখন বিশ ফুট দূরে, আরও তলিয়ে যাচ্ছে!’ স্টাইন জানাল। ‘অবস্থান পরিবর্তন করেছে!’

‘এদিকে আসছে?’ পাইক জিজ্ঞেস করলেন। যানটাকে খোলা সাগরে বেরোতে হলে তাদের পাশ কাটিয়েই যেতে হবে।

‘সোজা আমাদের দিকেই আসছে, সার! স্পিড এখন দশ নট। দ্রুত বাড়ছে সেটা।’

‘স্পটলাইট!’ চেঁচিয়ে বললেন পাইক। সঙ্গে সঙ্গে দুটো উজ্জ্বল আলোর রশ্মি  জাহাজের সামনের পানিকে আলোকিত করে দিল।

রহস্যময় জলযানটার কোন চিহ্নই দেখা যাচ্ছে না আর, শুধু যেখানে তলিয়ে গিয়েছিল সেখানে মৃদু ঢেউ ছাড়া। ‘স্টাইন! ডান দিক, নাকি বা দিক দিয়ে কাটানোর চেষ্টা করছে?’

‘কোনটাই না, সার! সোজা আমাদের দিকে আসছে!’

হেলমসম্যান, জলদি বাঁ দিকে সরাও! হুইল ধরে থাকা নাবিককে আদেশ দিলেন পাইক।

বাঁ দিকে তীক্ষ্ণ মোচড় দিয়ে সরে যেতে চাইল জাহাজ, তবে খুব সামান্যই সফল হলো, কারণ, দেরি হয়ে গেছে। পাইকের মুখ থেকে নির্দেশ বেরোনোর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সোনার অপারেটরের কণ্ঠ ভেসে এল, ‘সার, ওটা আমাদের দিকে ফায়ার করছে..’

প্রচন্ড বিস্ফোরণে থরথর করে কেঁপে উঠল পেট্রোল বোট। পানি থেকে শূন্যে উঠে পড়ল। পরক্ষণে গ্রাস করে ফেলল যেন মস্ত একটা আগুনের বল। টুকরো টুকরো হয়ে গেল বোট। ভাঙা টুকরোগুলো সাগরের পানিতে ঝরে পড়তে লাগল বৃষ্টির মত।

বোটের টুকরোর সঙ্গে মানব দেহের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের টুকরোও রয়েছে…

<

Super User