১৮৬৫ সালের ২৪ মার্চ। প্রশান্ত মহাসাগরের এক নির্জন দ্বীপে বিধ্বস্ত হলো ঝড়ের কবলে পড়া এক আমেরিকান বেলুন। কেউ নেই দ্বীপে। শুধু পাঁচজন অভিযাত্রী, সাথে একটি কুকুর  না আছে খাবার, অস্ত্র, না বাড়তি জামা-কাপড় কিচ্ছু না।

শুরু হলো ক্যাপ্টেন সাইরাস হার্ডিং-এর নেতৃত্বে ওদের টিকে থাকার সংগ্রাম। অদ্ভুত সব অভিজ্ঞার মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলেছে ওদের জীবনযাত্রা  সবাই টের পাঁচ্ছে, বিপদে-আপদে কে যেন অলক্ষে সাহায্য করে যাচ্ছে ওদের। একের পর এক ঘটে চলেছে রহস্যজনক কান্ড-কারখানা। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, ওরা ছাড়াও নিশ্চয়ই আরও কেউ রয়েছে এই দ্বীপে। কিন্তু সামনে আসে না কিছুতেই।

কে সে?

কোন অপদেবতা, নাকি মহামানব?

—————

০১.

ওপরে কি উঠছি আমরা?

মোটেই না।

নামছি?

তার চেয়েও ভয়ানক অবস্থা, ক্যাপ্টেন। আমরা পড়ছি।

বোঝা হালকা করো।

অনেক আগেই করা হয়েছে।

তবুও উঠছে না বেলুন?

উত্তর নেই।

ঝোড়ো হাওয়ার হুঙ্কার ছাপিয়ে আবার এই প্রশ্নটাই করল আরেকজন, অল্প অল্প করেও কি ওপরে উঠছে না বেলুন?

এক্কেবারে না। আরে! নিচে সাগরের গর্জন শোনা যাচ্ছে না?

কথাটা শেষ হবার সাথে সাথে আর একটি উত্তেজিত কণ্ঠস্বর শোনা গেল, সেরেছে! সমুদ্র তো আর পাঁচশো ফুটও নিচে নয়।

ফেল, ফেল। মালপত্র সব ফেলে দাও। গোলাবারুদ, বন্দুক, বালির বস্তা, খাবার দাবার সব, সব ফেল।

সেদিন ১৮৬৫ সালের তেইশে মার্চ। বিকেল প্রায় চারটায় দিগন্ত বিস্তৃত প্রশান্ত মহাসাগরের আকাশে শোনা গিয়েছিল উত্তেজিত এই কটি কণ্ঠ। ওই বছরের ১৮ থেকে ২৬ মার্চ পর্যন্ত বয়ে যাওয়া সেই ভয়ঙ্কর ঝড় পরবর্তীকালে কিংবদন্তীর রূপ নেয়। সেই প্রচন্ড ঝড়ে এশিয়া, ইউরোপ, আমেরিকার অনেক জনপদ ধ্বংস হয়ে যায়, উপড়ে পড়ে বিশাল সব গাছপালা। তীরে আছড়ে পড়ে চুরমার হয়ে যায় প্রায় শতখানেক জাহাজ। আর প্রাণহানী যে কত হয়েছে তার হিসেব নেই।

ঝোড়ো হাওয়ার ঝাপটায় কুয়াশার মধ্যে দিয়ে পাক খেতে খেতে পড়ছিল একটা বিশাল বেলুন। বেলুনটার সর্বাঙ্গ দড়ির জালে মোড়া। তলায় ঝোলানো দোলনায় পাঁচজন আরোহীর কাউকেই দেখা যাচ্ছে না ঘন কুয়াশার জন্যে। পথ হারানো বিশাল বেলুনের গায়ে ফুটো হয়ে গেছে। হু হু করে গ্যাস বেরিয়ে গিয়ে ক্রমেই চুপসে লম্বাটে হয়ে আসছে গোল বেলুন। নিচে ফুঁসছে সাগর। উথাল পাতাল ঢেউয়ের উপর আছড়ে পড়তে যাচ্ছে বেলুনের আরোহীরা  অথচ ধারে কাছে ডাঙা আছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না কুয়াশার জন্যে।

২৪ মার্চ সকাল। আরও চুপসে গেছে বেলুন।

এবার কি করব? জিজ্ঞেস করল একজন।

উত্তর দিল না কেউ। আরও নিচে নেমে এল বেলুন।

পানিতে ডুবেই মরব তাহলে? বলল আর একজন।

দূর! এত ভেঙে পড়ার কি আছে? আশ্বাস দিল তৃতীয় জন, সব জিনিসই কি ফেলে দেয়া হয়েছে?

না, চার হাজার ডলার ভর্তি থলেটা এখনও আছে। কথা শেষ হবার সাথে সাথেই দোলনা থেকে ছিটকে বাইরে পড়ল কাঁচা টাকার বস্তা। সামান্য উপরে উঠল বেলুন, কিন্তু বেশ বোঝা গেল একটু পরই নামতে শুরু করবে আবার। অথচ ফেলার মত আর কিছু নেই বেলুনে।

হঠাৎ মনে করিয়ে দিল একজন, দোলনাটা তো ফেলা হয়নি এখনও।

ভারি উইলো কাঠের তৈরি দোলনাটা পানিতে ভাসবে না। সাথে সাথেই কাজে লেগে গেল অভিযাত্রীরা। বেলুনের গায়ে মোড়া দড়ির জালের সঙ্গে নিজেদের ভাল করে বেঁধে নিয়ে দোলনার দড়ি কেটে দিল ওরা।  দোলনা ফেলতেই অনেক হালকা হয়ে গেল বেলুন! এক লাফে উঠে গেল হাজার ফুট  কিন্তু তাতেই বা কি? অতবড় ফুটো দিয়ে গ্যাস বেরোতে থাকলে কতক্ষণ আর টিকতে পারে বেলুন? অল্পক্ষণ পরই টলমল করে নামতে নামতে বিকেল চারটে নাগাদ আবার পানির শপাঁচেক ফুট উপরে নেমে এল সেটা।

এমন সময় ঘেউ ঘেউ করে চেঁচাতে শুরু করল কুকুরটা। কিছু দেখল নাকি টপ? বলল একজন।

সঙ্গে সঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল আর একজন, ডাঙা! ডাঙা! ওই যে, ডাঙা দেখা যাচ্ছে।

শেষ পর্যন্ত সত্যিই ডাঙার দেখা মিলল। একেবারে বেলুনের গতিপথেই। আর মাত্র ঘণ্টাখানেক টিকে থাকতে পারলেই মাইল তিরিশেক দূরের স্থলভূমিতে পৌঁছে যেতে পারবে ওরা। কিন্তু একঘণ্টা টিকবে কি বেলুন? আরও বেরিয়ে গেল বেলুনের গ্যাস। সাগরের ঢেউ ছুঁয়ে ছুঁয়ে উড়ে চলল বেলুন। তলার দিকটা পানির ঝাপটায় ভিজে গেছে। আরোহীরাও শুকনো নেই কেউ। সাঁতার কাটার সুবিধের জন্যে শরীর থেকে বাঁধন খুলে ফেলার হুকুম দিলেন নেতা।

প্রচন্ড উৎকণ্ঠার মাঝে কাটল আরও আধঘন্টা। হঠাৎ একটা ঘূর্নি হাওয়ার ধাক্কায় বেশ খানিকটা উপরে লাফিয়ে উঠল বেলুন। দড়ি ধরে ঝুলে রইল আরোহীরা।

তীরে পৌঁছতে আর মাত্র আধ মাইল বাকি। বাঁচার আশা ফিরে এল আরোহীদের মনে। একটু পরই দুলতে দুলতে বালুকাবেলায় এসে পড়ল বেলুন। জালের দড়ি ছেড়ে দিয়ে লাফিয়ে নিচে নামল আরোহীরা। একসাথে এত ওজন কমে যাওয়াতে ছিটকে আকাশে উঠে গেল প্রায় চুপসানো বেলুন। সাঁ সাঁ করে চোখের আড়ালে উধাও হয়ে গেল ঝোড়ো বাতাসের ধাক্কায়  কিন্তু তাতে বিন্দুমাত্র চিন্তিত হলো না আরোহীরা। খুশিতে ধেই ধেই করে নাচতে শুরু করল সবাই। হঠাৎ মুখের হাসি মিলিয়ে গেল সবার।

ক্যাপ্টেন সাইরাস হার্ডিং আর তাঁর প্রিয় কুকুর টপ ওদের মাঝে নেই।

<

Super User