উপরে নির্বাক আকাশ।

নীচে বিজন ধূসর প্রান্তর। মোযেভ মরুভূমি। আজন্ম তৃষিত এক অসীম বিস্তার।

চারটে অবসন্ন দেহ পড়ে আছে রোদ ঝলসানো বালিতে। পিপাসায় মৃতপ্রায় চারজন বিপন্ন মানুষ। অপেক্ষা করছে অন্তিম মুহূর্তের।

মাথার উপরে চক্রাকারে ঘুরছে শকুন। অদূরে, পাথরের আড়ালে আড়ালে এগিয়ে আসছে নির্মম রেড ইন্ডিয়ানদের দল। খুব বেশি সময় নেবে না ওরা। চিতার ক্ষিপ্রতা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে মোযেভ ইন্ডিয়ানরা। চারটে মৃতদেহ পড়ে থাকবে বালিতে। তারপর, অভিশাপের মত নেমে আসবে শকুন।

দুঃসময় কাউকেই খুব বেশি সময় দেয় না!

এরই মাঝে কেটে গেছে চার চারটে অসহ্য দিন। বুলেট ফুরিয়ে গেছে প্রায়, খাবার নেই, গত দু’দিন ধরে পানিও নেই।

এই বিরান মরুপ্রান্তরে, মৃত্যুর চেয়েও কষ্টকর এভাবে বেঁচে থাকা।

দূরে মাথা উঁচু করে আছে উদ্ধত পাহাড়। ওটার নাম যদি ঈগল পাহাড় হয়, তবে সামান্য আশা এখনও আছে। কারণ পাহাড়টার ডানপাশে কোথাও ওয়াটারহোল থাকবার কথা। ওয়াটারহোল, অর্থাৎ পানির উৎস।

পরাজিত চারটে দেহ। মৃত্যুপথযাত্রী চারজন মানুষ। শুয়ে শুয়ে ঠোঁট নাড়ছে অসহায় ভাবে। ওরা ঈশ্বরকে ডাকছে না, পরকালের অনন্ত সুখ প্রার্থনা করছে না। শুধু দু’ফোঁটা পানি চাইছে। প্রার্থনা করছে-সামনের ওই পাহাড়টা যেন ঈগল পাহাড় হয়। আর ওখানে যেন থাকে অমৃতের চেয়েও অমূল্য-পানি!

গত তিনদিন ধরে তারা পানি খুঁজেছে, পানি চেয়েছে, পানির কথা ভেবেছে। স্বপ্ন দেখেছে শিশিরের মতো শীতল, জোছনার মত কোমল জলের।

অসহ্য এ তৃষ্ণার জ্বালা!

বর্তমানে শুধু একঢোক পানির বিনিময়ে বেহেশতের সবচেয়ে রূপসী হুরকেও তারা হাতছাড়া করতে প্রস্তুত। তবু পানি চাই। হোক তা বিস্বাদ, দুর্গন্ধময় কিংবা বিষাক্ত!

শুরুটা কিন্তু ছিল অন্যরকম।

বরাবরের মত মরুভূমিতে টহল দিতে বেরিয়েছিল ওরা। দলে ছিল ছয়জন সৈন্য, একজন অফিসার। সুদর্শন তরুণ অফিসারটির কর্মজীবন সবে শুরু হয়েছে। মরুভূমিতে এই তার প্রথম পোস্টিং। শত্রু এলাকায় এটাই তার প্রথম টহল।

প্রথম দুটো দিন কেটেছিল নির্ঝঞ্ঝাট।

কোথাও শত্রুর চিহ্ন দেখা গেল না, কোনও আক্রমণ এল না, ঘটল না কোনও অঘটন।

তৃতীয় দিন।

সন্ধ্যায় ক্যাম্প ফেলার নির্দেশ দিল অফিসার। জায়গাটা খোলামেলা। আশেপাশে পানি নেই কোথাও।

দলের ছয়জন সৈন্যের একজন রেড ইন্ডিয়ান। নাম, মোকাটো। ক্যাম্পের জন্যে জায়গাটা পছন্দ হলো না তার। কয়েক মাইল সামনে একটা ওয়াটারহোল আছে। সেখানে ক্যাম্প ফেলার পরামর্শ দিল সে অফিসারকে।

অধস্তনের পরামর্শ শুনতে বাধল তরুণ লেফটেন্যান্টের। সিদ্ধান্ত অনড় রইল তার। সমতল নরম বালিতে ফেলা হলো ক্যাম্প।

বিশ্রাম প্রয়োজন ছিল পরিশ্রান্ত দলটার। অল্পক্ষণে ঘুমিয়ে পড়ল সবাই। শুধু পাহারার জন্য জেগে রইল ইয়াসীন। রাতের প্রথম প্রহরের দায়িত্বে থাকবে সে। সময় শেষ হলে নর্টনকে জাগিয়ে দিয়ে ঘুমাতে যাবে।

পরিচ্ছন্ন রাত। নির্জন, শীতল এবং শান্ত। মরুভূমির রাতগুলো এমনই হয়।

বালি কিংবা পাথর উত্তাপ ধরে রাখতে পারে না। দিনের খররৌদ্রদহন সূর্যাস্তে যায় হারিয়ে। সন্ধ্যার সাথে সাথে নেমে আসে হিম।

অজানা অস্বস্তিতে ভুগছে ইয়াসীন। কেমন ছমছমে একটা রাত! মোকাটোকে দেখছে সে বারবার। কেবলি এপাশ ওপাশ করছে ইন্ডিয়ান। কোনও মানসিক উদ্বেগের মধ্যে থাকলে ঘুমের মধ্যে অমন করে মানুষ।

পুব অঞ্চলের বিখ্যাত এক রেডইন্ডিয়ান গোত্রের মানুষ মোকাটো। একসময় সাদা ইউরোপিয়ানদের ত্রাস ছিল গোত্রটা। তারপর সাদাদের সাথে ক্রমাগত যুদ্ধে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল সব। পশ্চিমে হটে এল ওরা। বাঁচার তাগিদে আত্মসমর্পণ করে সেনাবাহিনীতে যোগ দিল মোকাটো, গোত্রের আরও অনেকের সাথে। পায়ের ছাপ দেখে অনুসরণ করতে জুড়ি নেই ওর। যোদ্ধা হিসেবে সুনিপুণ।

হয়তো ঠিকই বলেছিল মোকাটো। ক্যাম্প এখানে না করলেই ভাল হত।

রাতটা ভাল কাটল। ভাল ঘুমাল সবাই। আক্রমণ এল ভোরের আলো ফোটার ঠিক আগে।

মরুভূমির দুর্বার সাইমুম ঝড়ের মত এল ওরা। ঘুমের মধ্যেই মারা পড়ল একজন সৈন্য। আহত হলো একজন। ঘোড়াগুলো তাড়িয়ে নিয়ে গেল ওরা। নিমেষে ওলটপালট করে দিয়ে গেল সব।

সদ্য ঘুম থেকে জেগে উঠে কিছুক্ষণ এলোপাতাড়ি গুলি ছুঁড়ল সৈন্যরা। কিন্তু ততক্ষণে হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে আক্রমণকারী মোযেভ ইন্ডিয়ানদের দল। কোথা হতে তারা এল, আর কোথায় যে উধাও হলো-বুঝতে পারল না কেউ।

        ধাতস্থ হতে কিছু সময় নিল টহলদলের সৈন্যরা। তারপর দুটো সারিবদ্ধ লাইন করে রওনা হলো। তরুণ অফিসারটি হাঁটছে দুই সারির মাঝখানে। ইয়াসীনের পাশে এগিয়ে এল সে।

        ‘হয়তো এরকম কিছু চেয়েছিল ওরা। সবকটা ঘোড়াই নিয়ে গেল এই যা দুঃখ। তবু গেছে তো!’

‘ওরা যায়নি।’

সামান্য চমকাল অফিসার। ‘কী বলছ, ইয়াসীন! কই আমি তো আশেপাশে দেখছি না কাউকে?’

‘বিনা প্রয়োজনে দেখা দেয় না ওরা। এই মরুভূমিতেই ওদের বাস। হাতের রেখার মতই এখানকার সবকিছু চেনে ওরা। জানে সামনে পিছনে কোথায় কী আছে। একবার আক্রমণ করেছে। যতটুকু চেয়েছিল ঠিক ততটুকু ক্ষতি করে গেছে। ঠিক সময়ে ঠিক জায়গায় আবার আক্রমণ করবে। যতটুকু চাইবে ঠিক ততটুকু ক্ষতি করে যাবে। ওরা ওরকমই। স্থির, হিসেবী এবং অব্যর্থ।

‘বেশ গুছিয়ে কথা বলো তুমি, ইয়াসীন। খোঁজখবরও রাখো সবকিছুর। সম্ভবত অনেক লেখাপড়া জানা আছে তোমার’।

‘হয়তো, সার। কিন্তু এই বিরান মরুভূমিতে কী-ই বা আসে যায় তাতে।’

নীরবে কিছুক্ষণ তাকে খুঁটিয়ে দেখল অফিসার। তারপর মুখ ঘুরিয়ে এগিয়ে গেল সামনে।

ক্রমেই মাথার উপর উঠে আসছে সূর্য। উত্তপ্ত আলগা বালিতে গোড়ালি সমান ডুবে যাচ্ছে পা। হেঁটে এগোনো কষ্টসাধ্য। তবু এগিয়ে চলেছে দলটা।

সবার সাথে তাল মিলিয়ে হেঁটে চলেছে ভোরের আক্রমণে আহত সৈনিকটাও। অনেকদিন ধরে সে আছে এই ইন্ডিয়ান ফাইটিং আর্মিতে। ক্ষত যত খারাপই হোক না কেন-পিছিয়ে পড়া চলবে না। মোযেভ মরুভূমিতে একা পিছিয়ে পড়ার পরিণতি জানা আছে তার।

দুঃসহ গরম। হাওয়া নেই। পরিপূর্ণ নীল আকাশে মেঘের শামিয়ানা নেই কোথাও। দূরে অনুচ্চ পাহাড়ের সারি দিগন্তে বিলীন। আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বড় বড় পাথরের চাই, গ্রীজউড কিংবা ক্যাকটাসের ঝোঁপ। সবকিছুতেই রুক্ষতার স্পষ্ট ছাপ।

দুপুর পর্যন্ত একনাগাড়ে হাঁটার পর কিছুক্ষণের জন্য থামার নির্দেশ দিল লেফটেন্যান্ট। পাথরের মত শক্ত মাংসের শুটকি আর সামান্য পানি খেলো সবাই। আবার শুরু হচ্ছিল হাঁটা। এমন সময় কথাটা বলল ইয়াসীন।

‘সার, আমি কি কিছু বলতে পারি?’

‘কী ব্যাপার, ইয়াসীন?’

‘সামনে খোলামেলা প্রান্তর। কিন্তু ডানদিকে দেখুন, পাথরের ছোট একটা স্তূপ। আমরা ওখানে গিয়ে বিশ্রাম নিতে পারি বেলা পড়ে না আসা অবধি। সামনের ফাঁকা জায়গাটায় ওরা আমাদের ঘিরে ফেলতে পারে।’

কথাটা যুক্তিসঙ্গত মনে হলো লেফটেন্যান্ট-এর। ‘ঠিক আছে, বেলা পড়ে আসুক। বিকেলের নিস্তেজ রোদে আমরা ভাল এগোতে পারব।’

দ্রুত পৌঁছে গেল দলটা ডানদিকে পাথরের স্তুপের কাছে। যে যার মত বিশ্রাম নিতে বসল, হাত-পা ছড়িয়ে। পানির বোতল মুখে ঢালতে যাচ্ছিল লেফটেন্যান্ট। হঠাৎ খেয়াল হলো আর কেউ পান করছে না। মরুভূমির কঠোর সৈন্য সব। বোতল সরিয়ে রাখল সে।

চারদিক দেখে নিচ্ছিল ইয়াসীন। কাছেপিঠে আর কোনও পাথরের স্তূপ নেই। এরকম জায়গায় আক্রমণ করতে আসবে না ইন্ডিয়ানরা। আচমকা আঘাত হেনে আড়ালে পালিয়ে যায় তারা। আশেপাশে তেমন কোনও আড়াল নেই।

মোকাটো পাশে এসে বসল। ‘অফিসার আমার কথা না শুনে ভাল করেনি; কিন্তু তোমার পরামর্শ যে শুনেছে, এটা আমাদের জন্যে মঙ্গলজনক,’ মন্তব্য করল।

‘তুমি কি চেনো এ জায়গা?’

‘ওইযে দূরে, নীল কুয়াশা, ওটা যদি ঈগল পাহাড় হয়, তবে চিনি।‘

‘বেশ ভাল ইংরেজী বলতে পারো তুমি’।

‘দেড় বছর স্কুলে পড়তে হয়েছে আমাকে। তা ছাড়া কান খোলা রাখি আমি। টেক্সাসে কর্নেল রোনাল্ডের সাথে ছিলাম বহুদিন।’

আর কোনও কথা হলো না ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও। চুপচাপ বসে রইল ওরা। মরুভূমির বাতাসে শুকিয়ে গেছে মুখ। শিরিষ কাগজের মত খসখসে হয়ে গেছে জিভ। কষ্ট হয় কথা বলতে।

বেলা মান্য পড়ে আসতেই যাত্রা করল দলটি। বিশ্রামের ফলে শক্তি ফিরে এসেছে। তাই দ্রুত হাঁটছে সবাই। পায়ের তলায় তপ্ত বালির স্পর্শ। কোথাও আলগা আবার কোথাও পাথরের মত শক্ত খটখটে। প্রতিবার পা তোলার সাথে সাথে ধুলো উড়ছে।

‘থামো। কিছুক্ষণ বিশ্রাম’। নিচু স্বরে আদেশ দিল লেফটেন্যান্ট।

তখন গোধূলি।

দু’একটা তারা দেখা দিচ্ছে। খুব দ্রুত নেমে আসে মরুভূমির রাত। অল্পসময়েই সারা আকাশ ভরে যাবে তারায়।

‘মোযেভরা কোমাঞ্চিদের মত নয়,’ বলল মোকাটো। ‘অ্যাপাচিদের মত। নেহাত প্রয়োজন না হলে রাতে যুদ্ধ করে না ওরা’।

তাই আবারও শুরু হলো যাত্রা। চেনা তারা দেখে এগিয়ে চলল দল। হাঁটতে হাঁটতে পাহাড় সারির বেশ কাছে চলে এল ওরা। আর এগোনো ঠিক নয়। সুতরাং এবারেও ক্যাম্প ফেলতে হলো পানির উৎস হতে দূরে। মোকাটো আশপাশ ঘুরে এল পানির সন্ধানে। পাওয়া গেল না।

খুব ভোরে ঘুম ভাঙল ইয়াসীনের। তখনও ভালভাবে আলো ফোটেনি। মাথা তুলতেই নজরে পড়ল একজন ইন্ডিয়ান। বেশ দূরে একটা পাথরের স্তুপের পাশে ঘোরাফেরা করছে। একজন, অর্থাৎ আরও আছে। ডেকে তুলল সে অফিসারকে।

‘ওরা এসে গেছে, সার’।

ধড়মড় করে জেগে উঠল অফিসার। জলদি ডেকে ওঠানো হলো, সবাইকে। ‘মার্চ!’ আদেশ শোনা গেল। আকাশে ওখনও মিটিমিটি জ্বলছে দু’একটা মরুতারা।

কোনও আচমকা আক্রমণ এল না। শোনা গেল না কোনও গুলির আওয়াজ। দিগন্তের দিকে চেয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল ইয়াসীন। আরও একটা নির্মম দিনের শুরু-ভাবল সে।

পায়ে পায়ে এগিয়ে চলেছে ওরা। পায়ে পায়ে অতিক্রান্ত হচ্ছে মাইলের পর মাইল। পায়ে পায়ে কমছে পথের দূরত্ব।

সামনে বিস্তীর্ণ প্রান্তর। এখানে ওখানে যোশুয়া গাছের ঝাড়, ক্যাকটাসের ঝোঁপ কিংবা বিক্ষিপ্ত পাথর। ওরা জানে, ওসবের আড়ালে আড়ালেই ক্রমে কাছে এগিয়ে আসছে মোযেভ ইন্ডিয়ানদের দল। হিসাব করে এগিয়ে আসছে তারা। সাথে একজন আহত মানুষ ও সামান্য পানি নিয়ে অনভ্যস্ত পায়ে হেঁটে এই মরুভূমিতে কতদূর এগোনো যায়, ভালই জানা আছে তাদের।

ছাউনি এখনও অনেক দূরের পথ। ঘোড়ার পিঠেই লাগত তিনদিন। ভাগ্য ভাল হলে পায়ে হেঁটে পাঁচদিনে পৌঁছানো যাবে। অথবা হয়তো কোনওদিনই পৌঁছানো যাবে না।

এবারেও আক্রমণ এল আচমকা। আশেপাশে কতগুলো পাথর ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। ওগুলোর আড়ালে কেউ ওঁৎ পেতে থাকতে পারে ভাবা যায়নি। যেন পাতাল কুঁড়ে বেরিয়ে এল ওরা।

প্রথম গুলিটা লাগল লেফটেন্যান্ট-এর বুকে। বুক চেপে ধরে বসে পড়ল সে। খক করে কেশে উঠতেই ঠোঁটের কোণে ছলকে উঠল রক্ত। সাথে সাথে পজিশন নিয়ে গুলি ছুঁড়তে শুরু করল সৈন্যরা। কিন্তু পাল্টা গুলির আওয়াজ শোনা গেল না।

চলে গেছে মোযেভরা। উদ্দেশ্য সফল হয়েছে তাদের। মরীচিকার মত মিলিয়ে গেছে সবাই।

‘আমার পানির বোতলটা ফুটো করে দিয়ে গেছে’, তিক্ত কণ্ঠে বলল নর্টন। ‘আমারটাও গেছে,’ যোগ করল মোকাটো। এবং ‘এ-ই চেয়েছিল ওরা’।

ঠোঁটের কাছে ধরা পানির বোতলটা হাত দিয়ে একপাশে সরিয়ে দিল লেফটেন্যান্ট। ‘রেখে দাও ইয়াসীন, কাজে লাগবে সামনে। সময় বেশি বাকি নেই আমার। এখন থেকে তুমিই কমান্ডার।’ মোকাটোকে ইশারায় কাছে ডাকল সে। ফিসফিসিয়ে বলল,’ তোমার কথা শুনিনি আমি। ভুল করেছিলাম’।

অসহায় ভাবে এদিক ওদিক তাকাল ইয়াসীন। সবদিকে মরুভূমির একঘেয়ে বিস্তার। সম্ভবত বাঁচানো যাবে না অফিসারকে।

অফিসারও বুঝে গেছে তা। দ্রুত নিস্তেজ হয়ে এল তার দেহ। মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল। চোখে নেমে এল দুর্বোধ্য অন্ধকার। ইয়াসীনের বাম হাতে মাথা রেখে চুপচাপ মারা গেল সে।

মোকাটো হাত রাখল ইয়াসীনের কাঁধে। ‘কোনওরকম লোকসান ছাড়াই চলে গেছে ওরা’।

‘আর মাত্র চারটে পানির বোতল আছে, পাঁচজনের জন্যে। টিকে থাকতে হলে প্রথমে আমাদের পানি প্রয়োজন।’

সামান্য গর্ত খুঁড়ে-অফিসারের মৃতদেহটা বালিচাপা দিল ওরা। তার আগে তার পিস্তল, বত্রিশ রাউন্ড গুলি, মানিব্যাগ ও টুকিটাকি জিনিসগুলো নিয়ে নিয়েছে ইয়াসীন। ছাউনিতে ফিরে এসব ফেরত দিতে হবে। ফেলে রেখে গেলে সবকিছু চলে যাবে ইন্ডিয়ানদের দখলে।

মাথার উপরে আগুন ছড়াচ্ছে গনগনে সূর্য। দূরের পাহাড়গুলোর দিকে তাকাল ইয়াসীন। মনে মনে একটা হিসাব নিল। সবাইকে নিয়ে হাঁটতে শুরু করল আবার।

চতুর্দিকে তীক্ষ্ণ নজর রাখছে ওরা। অনেকক্ষণ দেখা গেল না কাউকে। সহসা বাঁ দিকে উদয় হলো দুই ঘোড়সওয়ার রেড ইন্ডিয়ান। ডানদিকেও দেখা গেল ঘোড়ায় চড়া দুজনকে। দুটো দলই বেশ দূরে। তবু নিজেদের ঘোড়াগুলো চিনতে অসুবিধা হলো না মরু-সৈনিকদের।

বেশ দূরত্ব রেখে ওদেরকে অনুসরণ করে চলল দুটো দল। একবারও কাছে আসল না বা গুলি ছুঁড়ল না।

সাড়ে বারোটার সময় দলটাকে থামাল ইয়াসীন। ধারেকাছে কোথাও ঝোঁপঝাড় বা পাথরের আড়াল নেই। নেই কোনও ছায়ার আচ্ছাদন। তবু থামতে পেরে খুশিই হলো ক্লান্ত সৈন্যরা।

‘ওই যে দূরে-ছোট একটা টিলা, ওখানে ছায়া পাব আমরা। বিশ্রামের জন্যে জায়গাটা ভাল হবে মনে হয়,’ বলল ইয়াসীন। ‘কথাটা ইন্ডিয়ানরাও জানে,’ যোগ করল মোকাটো।

‘দ্রুত ওখানে পৌঁছাতে হবে আমাদের। পারবে তুমি, হেনরী?’ আহতজনকে জিজ্ঞাসা করল ইয়াসীন।

‘তুমি পারলে আমিও পারব।’

‘গুড। তা হলে শুরু করা যাক’।

দলকে নিয়ে এমনভাবে এগোল ইয়াসীন। যেন টিলাটাকে পাশ কাটিয়ে আরও সামনে এগোনো ওর লক্ষ্য। ওটা যখন মাত্র শ’দুয়েক গজ দূরে, তখন তীক্ষ্ণ কণ্ঠে আদেশ দিল সে। ‘টিলার দিকে-অন দা ডাবল!’ সামান্য দিক পরিবর্তন করে টিলার দিকে ছুটল সবাই।

মোযেভরা বুঝতে পারেনি ইয়াসীনের উদ্দেশ্য। ওরা ভেবেছিল টিলাটাকে পাশ কাটিয়ে আরও এগিয়ে যাবে সেনাদল। ফলে এগিয়ে এসে টিলার আড়ালে পজিশন নেয়নি কেউ।

গুলির আওয়াজ এল পিছন থেকে। কিন্তু থামল না সৈন্যরা। ক্ষুধায় তৃষ্ণায় কাতর কয়েকজন মানুষ। গত কদিনের অমানুষিক পরিশ্রমে যাদের শরীরে লেশমাত্র শক্তি অবশিষ্ট নেই। তবু ফুসফুসের শেষ বাতাসটুকু বাজি রেখে দ্রুত দৌড়াচ্ছে সবাই। দলপতির আদেশ নয়, বাঁচার প্রবল আকুতি ছুটিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ওদের।

আবার গুলির শব্দ এল পিছন থেকে। ইয়াসীনের পাশের সৈন্যটি ছুটতে ছুটতে হঠাৎ তাল হারিয়ে ফেলল। এলোমেলো কয়েক পা এগিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ল সে। ঘুরেই এক হাঁটুর উপর ঝপ করে বসল ইয়াসীন। দেখাদেখি থেমে যাচ্ছিল অন্যরা। ‘যাও!’-চিৎকার করে রাইফেল তুলল ও।

ঘোড়ার পিঠে ধেয়ে আসছে কজন মোযেভ ইন্ডিয়ান। একজনকে তাক করে গুলি করল ইয়াসীন। ঝুঁকে পড়ে গুলি এড়াল ইন্ডিয়ানটা। ঘোড়ার আড়ালে শরীর লুকাল কাৎ হয়ে। তারপর অন্যদের সাথে দিক পরিবর্তন করে পালিয়ে গেল রাইফেল সীমানার বাইরে।

নিঃসাড় হয়ে পড়ে থাকা সৈন্যটির কাছে এগিয়ে গেল ইয়াসীন।

মাথা বেকায়দা ভঙ্গিতে কাৎ হয়ে আছে একদিকে। খোলাচোখ আকাশের দিকে স্থির। মরে গেছে নর্টন।

 তার রাইফেল, গুলির বেল্ট আর খালি পানির বোতল খুলে নিল ইয়াসীন। অন্যরা পৌঁছে গেছে ততক্ষণে।

টিলার কাছে এসেও পর্যাপ্ত ছায়ার আশ্রয় মেলেনি। প্রচণ্ড ক্লান্তি নুইয়ে দিয়েছে সবাইকে। ওপাশে একটা ছোট্ট পাহাড়ের আড়ালে শুয়ে পজিশন নিয়েছে মোকাটো। অন্য দুজন ভাঙাচোরা ভঙ্গিতে লুটিয়ে আছে এপাশের বালিতে।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল ইয়াসীন। পায়ে পায়ে মোকাটোর পাশে গিয়ে ধপ করে বসে শুয়ে পড়ল।

মাথার উপরে নির্বাক নীল আকাশ। কলঙ্কের মত কালো কালো শকুন ভেসে বেড়ায় সেখানে।

দুপুরের নিথর রোদ, কেঁপে যায় দূরাগত অশ্বের চিকন চিঁহি ডাকে। ঘাম ঝরে। পাথরের আড়ালে আড়ালে ক্রমেই এগিয়ে আসে নির্মম ইন্ডিয়ানরা।

দূরের পাহাড়টার দিকে তাকিয়ে থাকে ইয়াসীন। নিঃশব্দে ঠোঁট নেড়ে অসহায় ভাবে প্রার্থনা করে চলে।

‘ওই পাহাড়টা যেন ঈগল পাহাড় হয়। আর ওখানে যেন পানি থাকে। বেশি নয়; সামান্য পানি। খুব সামান্য হলেও যেন পানি পাওয়া যায় ওখানে!’

<

Super User