এ গল্প এক কিশোরের গল্প, কৈশোর সবে ছাড়তে উদ্যত হয়েছে যাকে। সেই বুনো পশ্চিমে খুনে ইনডিয়ানদের যখন-তখন হামলা তখনও বন্ধ হয়নি, টেকসাসে বসতি স্থাপন সবে শুরু হয়েছে, সেটলারদের টাকার অভাব, দল বেঁধে গরু নিয়ে দুর্গম পথ পেরিয়ে বিক্রি করতে যাওয়ার জন্যে পাড়ি দিতে হচ্ছে শত শত মাইল পথ, রোগ-বালাই মহামারী আকারে দেখা দেয়, বিরূপ প্রকৃতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মানুষের জীবনকে অতিষ্ঠ করে তোলে বুনো জানোয়ারের দল; সেই সময় সল্ট লিকের মত এক বুনো অঞ্চলে টিকে থাকার সংগ্রামে নামল এই দুঃসাহসী কিশোর, একা, অস্ত্র বলতে শুধু একটা আদিম বন্দুক। কেবল বাড়িঘর আর খেতখামারই নয়, মা আর ছোট্ট ভাইটিকে সামলানোর দায়িত্বও তার ওপর। পাশে এসে দাঁড়াল ওল্ড ইয়েলার…

———

০১.

আমরা ওকে ডাকতাম ওল্ড ইয়েলার বলে। এর দুটো কারণ। এক, ওর খাটো খাটো লোমগুলোর কালচে হলুদ রঙ। ইয়েলো অর্থাৎ হলুদ রঙকে বিকৃত করে বলতাম ইয়েলার। দুই, গলা ছেড়ে যখন চিৎকার করত সে, ঘেউ ঘেউয়ের বদলে তার গলা দিয়ে বেরোত এক ধরনের ইয়েল অর্থাৎ তীক্ষ্ণ আর্তনাদ।

মনে হয় এই তো কালকের কথা, আমাদের বার্ডসং ক্রীকের কাঠের বাড়িটাতে ঘুরে বেড়াত সে। ঘরে-বাইরে সবখানে ছিল তার অবাধ বিচরণ।

সে-বছর আব্বা সল্ট লিকের আরও কয়েকজন সেটুলারের সঙ্গে একটা পুল হার্ড গঠন করে গরুর পাল নিয়ে চলে গিয়েছিল কানসাসের অ্যাবিলনে নতুন গজিয়ে ওঠা একটা গরুর বাজারে। নগদ টাকার জন্যে। সিভিল ওঅরের পরের ওই সময়টায় টেকসাসের মানুষের টাকার বড় টানাটানি ছিল।

আমরা একটা সুন্দর জায়গায় বাড়ি করেছি তখন। প্রচুর ঘাস ছিল আমাদের এলাকায়। বন ছিল, পানি ছিল। প্রচুর শিকার মিলত, মাংসের অভাব হত না। মাটিও খুব উর্বর, শস্য ফলত চমৎকার। ইনডিয়ানদের ভয়ও ছিল না। তাদের জন্যে নির্দিষ্ট জায়গা বরাদ্দ করা হয়েছিল। টেকসাসে দুর্গ তৈরি করল আমেরিকান সৈন্যরা। ইনডিয়ানদেরকে সরে যেতে বাধ্য করল।

আব্বা বলত, সবই আছে আমাদের, নেই কেবল নগদ টাকা। অ্যাবিলেনে গেলে সেটাও জোগাড় করে ফেলতে পারব।

টাকার কথা শুনতে খুবই ভাল লাগে, কিন্তু তবু কিছু কিছু লোক দ্বিধা করতে লাগল। টেকসাসের পাহাড়ী এলাকায় যেখানে বাস করতাম আমরা তার থেকে ছশো মাইলেরও বেশি উত্তরে অ্যাবিলেন। গরু বিক্রি করার জন্যে যেতে-আসতে কয়েক মাস লেগে যাবে। এই সময়টা সল্ট লিকের বুনো ওই সীমান্ত এলাকায় একা একা থাকতে হবে তাদের বউ-বাচ্চাদের।

কিন্তু টাকার সমস্যা বড় সমস্যা। সেটা পেতে চাইলে ঝুঁকি কিছুটা নিতেই হবে। অনেক আলাপ আলোচনা করে, অনেক ভেবেচিন্তে শেষে ঠিক করল পুরুষেরা, যাওয়াই উচিত। যাওয়ার জন্যে তৈরি হতে লাগল তারা। বাড়িতে যারা থাকবে তাদেরকে শিখিয়ে দিতে লাগল, চুক্তি ভেঙে হঠাৎ যদি হামলা করে বসে ইনডিয়ানরা, ফসলের খেত নষ্ট করে কুন, বন থেকে বেরিয়ে পোষা শুয়োর মারে ভালুক, তাহলে কি করতে হবে। তারপর যার যা গরু আছে জড় করে, ওগুলোর পেছনে যার যার ব্র্যাণ্ডের ছাপ মেরে, একদিন দল বেঁধে রওনা হয়ে গেল কানসাসের পথে দীর্ঘ যাত্রায়।

আব্বা যেদিন চলে গেল সেই দিনটার কথা খুব মনে আছে আমার। মনে আছে, ঘোড়ায় জিন পরিয়ে কেবিনের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। খাপে পোরা বন্দুক, জিনের পেছনে বাঁধা গোটানো বিছানা। মনে আছে, কী লম্বা, সুঠাম দেহী, সুদর্শন একজন পুরুষ। মাথায় হাই-ক্রাউন হ্যাট, নাকের নিচে লম্বা গোঁফের কোণ গরুর শিঙের মত বাঁকা হয়ে ডগা দুটো গিয়ে নেমেছে ঠোটের কোণে। মনে আছে, আব্বা চলে যাচ্ছে বলে কিভাবে কান্না ঠেকানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছিল আম্মা। পাঁচ বছরের ছোট্ট আরলিস গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছিল। আব্বা চলে যাচ্ছে বলে নয়, আব্বার সঙ্গে চলে যাওয়ার জন্যে।

আমার কাঁদার উপায় ছিল না। চোদ্দ বছর বয়েস হয়েছে, বড় হয়ে গেছি, এই সময় আমার কান্না শোভা পায় না। দাঁড়িয়ে থেকেছি চুপচাপ। একটুও বুঝতে দিইনি যে আমারও কাঁদতে ইচ্ছে করছে।

আম্মাকে আদর করল আব্বা, আরলিসকে চুমু খেলো, তারপর গিয়ে চাপল ঘোড়ায়। তার দিকে তাকালাম আমি। ইশারায় আমাকে কাছে ডাকল। সঙ্গে যেতে বলল। তার ঘোড়ার সঙ্গে সঙ্গে এগোলাম আমি। রাস্তা চলে গেছে ঝর্নার ওপারের বিশাল ওক গাছটার দিকে।

বাড়ির কাছ থেকে সরে এসে কাত হয়ে আমার কাঁধে হাত রাখল আব্বা। এখানে তার কথা শুনতে পাবেনা আম্মা কিংবা আরলিস।

শোন, ট্রাভিস, তুই এখন বড় হয়েছিস। আমার অবর্তমানে এ বাড়ির কর্তা। কাজেই সে ভাবেই চলতে হবে তোকে। মা আর আরলিসের দেখাশোনা করবি। ঘরের প্রয়োজনীয় কাজকর্ম করবি। মা বললে তারপর করব, এই মনোভাব নিয়ে কক্ষনো থাকবি না। যেটা করতে হবে করে ফেলবি। পারবি?

পারব, জবাব দিলাম।

গরুর দুধ দোয়াতে হবে তোকে, কাঠ কাটতে হবে, শুয়োরগুলোকে দেখেশুনে রাখতে হবে, মাংসের দরকার পড়লে শিকার করে আনতে হবে। তবে সবচেয়ে জরুরী ফসলের খেতের যত্ন নেয়া। ঠিকমত করতে না পারলেই গেল, গাছের গোড়া কেটে দেবে ইঁদুরে, কুনে গমের শিষ খেয়ে শেষ করবে। শীতে কপালে আর রুটি জুটবে না।

জানি।

গুড বয়। ভাবিসনে, বছর শেষ হতে হতেই চলে আসব আমি।

দাঁড়িয়ে রইলাম। আর কিছু বলার নেই। ঘোড়ায় করে চলে যাচ্ছে আব্বা।

হঠাৎ কথাটা মনে পড়ল। ডাকতে ডাকতে তার পেছনে দৌড় দিলাম।

থামল আব্বা, কি বলবি?

ঘোড়া।

কোন ঘোড়া? যেন আমার মুখে ওই শব্দটা তার কাছে নতুন।

দেখো, আব্বা, কিছুটা অভিমানের সুরেই বললাম, আমি কি বলছি ভাল করেই জানো তুমি, একটা ঘোড়ার জন্যে কী করি। বহুবার বলেছি তোমাকে।

হাসছে আব্বা। না জানার ভান করার কারণটা বুঝে ফেললাম। আমাকে রাগাচ্ছিল আব্বা। লজ্জা পেলাম। ভীষণ বোকা মনে হলো নিজেকে।

ঘোড়ার চেয়ে তো কুকুর বেশি পছন্দ করিস।

করতাম, তবে এখন ঘোড়াই বেশি পছন্দ।

এখন তোর একটা কুকুর খুব প্রয়োজন।

জানি। তবু ঘোড়াই লাগবে আমার।

বেশ, বড় হ, বড়দের মত আচরণ কর, কাজ দেখা, তখন বুঝব অত কষ্টের গরু বেচা পয়সা দিয়ে তোকে একটা ঘোড়া কিনে দেয়া যায় কিনা। এই কথাই রইল তাহলে।

হাত বাড়িয়ে দিল আব্বা। ধরে সেটা ঝাঁকিয়ে দিলাম। ওই প্রথম বড়দের সঙ্গে তাদের মত করে হাত মেলালাম। অদ্ভুত এক অনুভূতি হলো। মনে হলো, অনেক বড় হয়েছি, নিজেকে পুরুষ মনে হতে লাগল। আত্মবিশ্বাস বেড়ে গেল। যে কাজের দায়িত্ব আব্বা আমার ওপর চাপিয়ে দিয়ে গেল, ঠিকই সামলে নিতে পারব সেটা।

মাথা সোজা করে আঁকাবাঁকা পথ ধরে হেঁটে চললাম বাড়ির দিকে। আব্বা ঠিকই বলেছে। এই ক্ষণে আমার একটা কুকুরই দরকার সব চেয়ে বেশি। অন্য সব সেটলারদেরই কুকুর আছে। বড় বড় ভয়ঙ্কর সব খেকি কুকুর, বুনো শুয়োর ধরতে, গরু খেদিয়ে আনতে, আর ফসলের খেত থেকে কুন তাড়াতে খুব কাজে লাগে ওগুলো। যখন তখন এসে পশুর খোয়াড়ে হামলা চালিয়ে বসে পাজি নেকড়ে, ভালুক, চিতাবাঘ। সাদা মানুষের বাড়িতে খাবার লুট করতে আসে ইনডিয়ানরা। এই সব উপদ্রব পুরোপুরি ঠেনোর সাধ্য কুকুরের নেই, কিন্তু পাহারা তো দিতে পারে, সাবধান করে দিতে পারে মানুষকে। একটা ব্যাপারে সন্দেহের কোন অবকাশই নেই; যে এলাকায় বাস করছি আমরা, সেখানে একটা ভাল কুকুর থাকা খুবই প্রয়োজন। অনেক সময় দুতিনজন মানুষ মিলে যা করতে পারে না একটা মাত্র কুকুর তা করে ফেলে। কুকুরের ব্যাপারে কারও চেয়ে কম জানি না আমি, কারণ গত গ্রীষ্মেও ভাল একটা কুকুর ছিল আমার।

ওটার নাম ছিল বেল। বয়েস প্রায় আমারই সমান। জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই দেখেছি ও আমাদের বাড়িতে আছে। ছোটবেলায় অনেক বার র্যাটল স্নেক আর বুনো শুয়োরের হাত থেকে বাঁচিয়েছে আমাকে। আমি বড় হওয়ার পর আমার সঙ্গে শিকারে বেরিয়েছে। একবার বার্ডসং ক্রীকে পানিতে ডুবে মরে যাচ্ছিলাম আমি, টেনে তুলে বাঁচিয়েছে আমাকে। আরেকবার সতর্ক করে দিয়েছে কোমাঞ্চি ইনডিয়ানদের ব্যাপারে। কয়েকজন ইনডিয়ান সেবার আমাদের খচ্চর জাম্পারকে মেরে খেয়ে ফেলতে এসেছিল।

তারপর একটা ছোট্ট বোকামির জন্যে মরতে হলো কেলকে।

ঘটনাটা খুলেই বলি। বাড়ির পেছনে একটুকরো প্রেইরিতে শুকনো ঘাস কাটছিলাম আমি আর আব্বা। ফণার পেছনে হীরে আঁকা বিরাট এক সাপ হঠাৎ ফোস করে উঠে ছোবল মারতে গেল আব্বাকে, দায়ের এক কোপে ওটার মাথা আলাদা করে দিল আব্বা। ধড়টা মোচড় খেতে লাগল, আর ওটার তিন-চার হাত দূরে কুৎসিত মুণ্ডটা মাটিতে পড়ে বার বার হাঁ করতে লাগল, যেন এই অবস্থায়ও কাউকে কামড়ানো হচ্ছে।

বেলের মত বুদ্ধিমান একটা কুকুর যে বোকামিটা করে বসবে কল্পনাও করতে পারিনি আমরা। মাথাটাকে গুঁকতে গেল। পরক্ষণেই গলা ফাটিয়ে দিল বিকট চিৎকার। জোরে জোরে মাথা ঝাড়া দিতে লাগল। কিন্তু ক্ষতি যা হওয়ার হয়ে গেছে। তার নাক কামড়ে ধরে ঝুলছে কাটা মুণ্ডটা, বিষাদাঁত ঢুকে গেছে নাকের নরম মাংসে। মিনিটখানেক কসরত করার পর ওটাকে নাক থেকে ফেলতে পারল বটে, কিন্তু অনেক দেরি হয়ে গেছে তখন।

সেই রাতে মারা গেল বেল। পুরো একটা হপ্তা কেঁদেছি আমি ওর জন্যে। আমাকে শান্ত করার অনেক চেষ্টা করেছে আব্বা, তখুনি আরেকটা কুকুরও এনে দিতে চেয়েছে, কিন্তু আমি নিইনি। আরেকটা কুকুর পাব ঠিক, কিন্তু বেলকে তো আর পাব না। অন্য কুকুর এসে ওর জায়গা দখল করবে এটা ভাবতেও রাগ হচ্ছিল।

কুকুরের ব্যাপারে এখনও মনের অবস্থা একই আছে আমার। অন্য কোন কুকুর আর সহ্য করতে পারব না। সে জন্যে একটা ঘোড়াই চাই।

যে পথ দিয়ে হাঁটছি সেটা দিয়ে বার্ডসং ক্রীকে যাওয়া যায়। খাঁড়িটার পাড়ে বেশ কিছু বীমারটল ঝোপ হয়ে আছে। সাদা ফুল ফুটেছে, চমৎকার সুগন্ধ। একটা ঝোপের মাথায় বসে গান গাইছে একটা মকিংবার্ড। মনে করিয়ে দিল, বার্ডসং ক্রীক নামটা কি করে হয়েছে। আব্বার সঙ্গে যেদিন এসে এই এলাকায় উঠেছিল আম্মা, সেদিনই নামটা দিয়েছিল, আমি তখন হইনি, আম্মার মুখে গল্প শুনেছি। বাড়ি করার মালপত্র ছিল একটা গরুর গাড়িতে, বলদগুলোকে চালাচ্ছিল আম্মা, আব্বা তাড়িয়ে নিয়ে আসছিল গরুর পাল আর ঘোড়াগুলোকে। সল্ট ব্রাঞ্চের ওদিকটায় অন্যান্য সেটলারদের কাছাকাছিই বাড়ি করার ইচ্ছে ছিল তাদের। রাত কাটানোর জন্যে তাঁবু ফেলল ঝর্নাটার ধারে। সেদিন ফুলে ফুলে ছেয়ে গিয়েছিল মার্টল ঝোপ, আর প্রতিটি ঝোপেই বসেছিল একটা করে মকিংবার্ড, গলা ছেড়ে গান গাইছিল। গান গাওয়ার নেশায় পেয়ে গিয়েছিল যেন পাখিগুলোকে। এত সুন্দর জায়গা, এত সুন্দর গন্ধ, এত সুন্দর গান মুগ্ধ করে দিয়েছিল আম্মাকে, জায়গাটা ছেড়ে যাওয়ার কথা ভাবতেই পারেনি আর।

আব্বাকে বলল, এখানেই ঘর করব আমরা।

আব্বা আপত্তি করেনি। দুজনে মিলে একটা ঘর তুলল। ইনডিয়ানদের সঙ্গে রীতিমত লড়াই করে জায়গাটা দখলে রাখল। এক টুকরো জমি পরিষ্কার করে নিয়ে গম চাষ করল। আমাকে, আরলিসকে, আর আমাদের একটা বোনকে জন্ম দিল। জ্বরে মারা গেছে আমাদের সেই বোনটা।

এক সময় আব্বার আর আম্মার ছিল বাড়িটা, এটা এখন আমারও বাড়ি। আব্বা নেই, কাজেই এটাকে দেখে রাখা আমার দায়িত্ব।

আমাদের ঝর্নাটার কাছে চলে এলাম। পাথরের ফাটল থেকে ফিনকি দিয়ে বেরোচ্ছে টলটলে পরিষ্কার ঠাণ্ডা পানি। জমা হচ্ছে গিয়ে একটা বিরাট গামলার মত জায়গায়। তাতে নেমেছে আরলিস। কান পর্যন্ত ডুবিয়ে রেখেছে পানিতে। খাওয়ার পানি নষ্ট করছে।

ডাকলাম, আরলিস, উঠে এসো!

আমাকে জিভ দেখাল আরলিস।

দেখো, ডাল ভেঙে আনছি কিন্তু! ধমক দিলাম।

জবাবে আরেকবার জিভ দেখাল। রাগানোর জন্যে পানি ছিটাতে লাগল আমার দিকে।

ছুরি বের করে একটা মেসকিটের ডাল কাটলাম। ছেঁটে ফেললাম পাতাগুলো, কাঁটা চাঁছলাম। ওটা হাতে নিয়ে এগোলাম তার দিকে।

আরলিস বুঝল মিথ্যে হুমকি দিচ্ছি না আমি। লাফাতে লাফাতে উঠে এল পানি থেকে, গায়ের পানি দিয়ে ভেজাল খুলে রেখে যাওয়া জামা-কাপড়। ন্যাংটো হয়েই গলা ফাটিয়ে চেঁচাতে চেঁচাতে দৌড় দিল বাড়ির দিকে। ওর চিৎকারে মনে হলো কোমাঞ্চিরা আক্রমণ করেছে বুঝি, জবাই করতে শোয়ানো হয়েছে।

ঘর থেকে ছুটে বেরোল আম্মা। আরলিসকে দেখল। আমাকে দেখল তার পেছনে। আমার এক হাতে মেসকিটের ডাল, আরেক হাতে ভেজা জামা-কাপড়।

রেগে গেল আম্মা, ট্রাভিস, এটা কি হচ্ছে? ও না তোর ছোট ভাই!

জবাব দিলাম, এখনও কিছু হয়নি। তবে খাওয়ার পানি আবার নষ্ট করতে নামলে পিটিয়ে ওর ছাল তুলব আমি।

ওই গর্তে নেমে পানি নষ্ট করলে আব্বা ঠিক একথা বলেই শাসায় আরলিসকে। আমার মনে হলো, আব্বার জায়গা দখল করতে হলে তার মত করেই কথা বলতে হবে।

পুরো একটা মিনিট আমার দিকে তাকিয়ে রইল আম্মা। বোধহয় বোঝার চেষ্টা করল, ওভাবে কথা বলার উপযুক্ত আমি সত্যিই হয়েছি কিনা। বেশি পাকামো করি আমি, আম্মার মুখে একথাটা প্রায়ই শুনতে হয় আমাকে। আজও সেকথা বলবে কিনা ভাবছে বোধহয়। কিন্তু বলল না। ঠোঁটে হাসি ফুটল। চেপে ধরল আরলিসের কান।

আরও জোরে চেঁচিয়ে উঠে কান ছাড়ানোর জন্যে লাফালাফি করতে লাগল আরলিস। ভেজা কাপড়গুলো নিয়ে এগিয়ে গেলাম। কান ছেড়ে তাকে কাপড় পরিয়ে দিতে দিতে আম্মা শাসাল, দেখ, বিচ্ছু, যদি পিটুনি খেতে না চাস, বড় ভাইয়ের কথা মেনে চলবি। চুপ করে বসে থাকার জন্যে ডগ রান-এ পাঠিয়ে দিল তাকে।

ডগ রান হলো আমাদের কেবিনের দুটো ঘরের মাঝের চালা দেয়া এক টুকরো জায়গা, যার কোন বেড়া নেই। ভীষণ গরমের দিনে ওখানে বসে তরমুজ খাওয়াটা খুব মজার। সে সময় রাতে ওখানে ঘুমাতেও আরাম। অনেক সময় শিকার করে আনা মাংস আমরা ওখানে ঝুলিয়ে রাখি।

ডগ রানে বসে বসে কিছুক্ষণ ফোঁপাল আরলিস। আমি গিয়ে ঝর্না থেকে বালতি দিয়ে পানি তুলে আনলাম। গরুর চামড়া দিয়ে বালতিটা বানিয়েছে আব্বা। পানি এনে ঢাললাম কেবিনের পাশের অ্যাশ হপারে। কাঠের ছাইয়ের ভেতর দিয়ে চুইয়ে ওই পানি গিয়ে জমা হয় নিচে রাখা পাত্রে, একে বলে লাই ওয়াটার। আম্মা ওই পানিতে শুয়োরের চর্বি মিশিয়ে লোহার পাত্রে ফুটিয়ে সেদ্ধ করে সাবান তৈরি করে।

পানি তোলা শেষ করে রান্নার জন্যে লাকড়ি কাটতে গেলাম। ডগ রানে আর বসে থাকতে পারল না আরলিস। আমার পিছে পিছে এল। আমি লাকড়ি ফাড়তে গেলেই সব সময় যেখানে দাঁড়ায়, আজও ঠিক সেই জায়গাটাতেই দাঁড়াল সে। ইচ্ছে করেই দাঁড়াল, যাতে কুড়ালের কোপে কাঠের চিলতে ছিটকে গিয়ে তার চোখে লাগে আর সে চেঁচাতে পারে, আমার দোষ দিয়ে আম্মার বকা শোনাতে পারে আমাকে। আজ তাকে সে সুযোগ দিলাম না, কড়া গলায় ধমক দিয়ে বললাম, এখানে কি? যাও, ঘরে যাও!

অন্য দিন বললে যেত না, কিন্তু আজ টু শব্দ না করে চলে গেল। এমনকি এবার আর জিভও দেখাল না আমাকে। এক জায়গায় ঠায় বসে থাকল।

ডিনার তৈরি করে আমাদের খেতে ডাকল আম্মা।

গমের খেতে চাষ দেয়া বাকি। খাওয়ার পর আমাকে সে কথা আজ আর মনে করিয়ে দিতে হলো না আম্মাকে। টেবিল থেকে উঠেই লাঙলের সঙ্গে জাম্পারকে জুতে নিয়ে রওনা হয়ে গেলাম। তাড়াহুড়া করে বেরোলাম, তখনই শুরু করতে পারলে সূর্য ডুবতে ডুবতে শেষ করে ফেলতে পারব। আগের দিন যেখানটায় চাষ দেয়া শেষ করে রেখেছে আব্বা, তারপর থেকে দিতে শুরু করলাম।

জাম্পারের চামড়া মেটে রঙের। ঘাড়ের কেশরের ভেতর থেকে কালো সরু একটা ডোরা বেরিয়ে শিরদাঁড়া ধেয়ে চলে গেছে লেজের কাছে। আব্বা ওটার নাম রেখেছে জাম্পার। কারণও আছে। এমন কোন বেড়া ওই এলাকায় আজতক বানাতে পারেনি কেউ যেটা লাফিয়ে ডিঙোতে পারে না খচ্চরটা। হাসতে হাসতে আব্বা বলে, চাঁদের অপর পিঠ দেখারও যদি ইচ্ছে হয়, লাফ দিয়ে ঠিক ওখানে চলে যেতে পারবে সে।

খচ্চর হিসেবে জাম্পার যে খুব ভাল তাতে কোন সন্দেহ নেই। এমনিতে খুব শান্ত, পিঠে চড়লে রাগে না, কাঁচা মাংসের বোঝা বয়ে আনলে রক্তের গন্ধে ঘাবড়ায় না, লাঙল জুতে দিয়ে যতই টানানো হোক ঠিক টেনে যাবে। তবে সেটা আব্বার বেলায়। আমি নিয়ে গেলেই গোলমাল বাঁধায়। হয়তো ভাবে পিচ্চি ছেলেকে অতটা পাত্তা না দিলেও চলবে। যখনই তার মনে হবে অনেক কাজ হয়েছে, আর দরকার নেই, সঙ্গে সঙ্গে কাজ থামিয়ে দিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে যাবে। হয়তো খেতের মাঝখানে আছি, কাজ অনেক বাকি, কিন্তু তার মনে হলো ডিনারের সময় হয়ে গেছে। ব্যস, আর কোন কথা নেই, জমি চষা বাদ দিয়ে সোজা মুখ ঘুরিয়ে বাড়ির দিকে রওনা দেবে। লাঙলের টানে টানে গমের চারা উপড়ে চলে গেলেও খেয়াল করবে না। লাগাম ধরে থাম, থাম বলে যতই চেঁচাই, কানে তুলবে না।

সেদিন বিকেলেও জাম্পার আমার সঙ্গে এই বেয়াদবিটা করতে চাইল। তবে তৈরি হয়েই এসেছি আমি। আব্বা নেই, জাম্পারকে বুঝিয়ে দিতে হবে আমিই এখন তার বস্। সিডার গাছের একটা ডাল গুঁজে রাখলাম লাঙলের হাতলের ফাঁকে।

তিন-চারটে টান দিলেই চাষ দেয়া শেষ হয়ে যাবে, এই সময় শয়তানীটা করল জাম্পার। জোরে একবার ভ্যাঁ করে উঠে লেজ নাড়তে নাড়তে রওনা হয়ে গেল। যেন লাট সাহেব, দুনিয়ায় আর কারও তোয়াক্কা করার দরকার নেই। ঘুরে গেলে রাস্তা বাড়বে সে জন্যে খেতের কোণাকুণি হাঁটা দিল। গমের চারা উপড়ালে তার কি?

আজ তাকে ডাকলাম না, থাম থাম বলে চেঁচালাম না, সিডারের ডালটা একটানে বের করে নিয়েই ধা করে মেরে দিলাম। চোয়ালের একপাশে লাগল বাড়িটা। এত জোরে মেরেছি, আরেকটু হলেই পড়ে যেত।

অবাক হয়ে গেল খচ্চরটা। দৌড় দিতে গিয়েও দিল না। গোঙাল একবার। ওখানেই স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল আমাকে। যেন বিশ্বাস করতে পারছে না আমি বড় হয়ে গেছি, আমার পক্ষে অত জোরে বাড়ি মারা সম্ভব।

আবার লাঠি তুলে শাসালাম, জাম্পার, জলদি গিয়ে কাজ শেষ কর, নইলে একটা বাড়িও মাটিতে পড়বে না! যা-আ!

আমার প্রতিটি কথা যেন বুঝতে পারল জাম্পার। কাজে ফিরে গেল। বাকি জমিটা চাষ দিয়ে শেষ করলাম, একটি বারের জন্যে আর বেয়াড়াপনা করল না। আব্বা চাষ দিতে গেলে যে আচরণ করে আমার সঙ্গেও তখন তা-ই করল। একটা তফাৎ কেবল, যতক্ষণ তার পাশে পাশে হাঁটলাম, ঘাড় কাত করে একচোখ দিয়ে সতর্ক দৃষ্টি মেলে রাখল আমার দিকে।

কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরলাম। দুধ দোয়ানো সেরে ফেলেছে আম্মা। রাতের খাবার রেডি করে আমার জন্যে অপেক্ষা করছে আরলিসকে নিয়ে; আব্বা দেরি করে কাজ থেকে ফিরলে আমরা যেমন অপেক্ষা করতাম, তেমনি ভাবে।

সে রাতে আরলিসকে নিয়ে বিছানায় শুতে গেলাম আমি। কয়েকটা গরুর চামড়া সেলাই করে জোড়া দিয়ে কাঠের ফ্রেমে আটকে তার ওপর খড়ের জাজিম পাতা, এই আমাদের বিছানা। কাঁচা মেঝে থেকে দুই ফুট ওপরে। শুয়ে শুয়ে ভাবছি। বার্ডসং ক্রীকের ওপাশের বনে পেঁচা ডেকে উঠছে মাঝে মাঝে। সারা দিন যা কাজ করেছি তার একটা খতিয়ান তৈরি করলাম মনে মনে।

শুরুটা ভালই মনে হলো। আরলিস আর জাম্পারকে বুঝিয়ে দিয়েছি আর আমার সঙ্গে বেয়াদবি করা চলবে না। আম্মাও আমার জন্যে খাবার তৈরি করে নিয়ে বসে থেকেছে, তার মানে বসে থাকার উপযুক্ত মনে করেছে আমাকে।

আত্মবিশ্বাস বাড়ল। মনে হলো, আব্বা না থাকলেও ঠিক তার মত করেই সংসারটাকে চালিয়ে নিতে পারব আমি।

<

Super User