ওই যে, টুইন লেকস, ঘোষণা করলেন মিস্টার উইলসন।
বড় একটা এয়ার-কণ্ডিশনড স্টেশন ওয়াগনে করে অ্যারিজোনা মরুভূমি পাড়ি দিচ্ছে ওরা। দক্ষিণ-পশ্চিমে মাথা চাড়া দিচ্ছে নিউ মেকসিকোর পাহাড়শ্রেণী। পেছনের সীটে বসে উৎসুক হয়ে জানালা দিয়ে দেখছে ছেলেরা। পাকা, চওড়া সড়কের শেষ মাথায় রুক্ষ পর্বতের কোলে সবুজে ছাওয়া একটা মরুদ্যান যেন হঠাৎ করে গজিয়েছে। ধুলোয় ধূসর পথের ধারে কাঠের বাড়িঘর চোখে পড়ছে এখান থেকেই।
আরও এগোলো গাড়ি। মেইন রোডের ধারে পথের দিকে মুখ করে রয়েছে মুদ দোকান, ওষুধের দোকান, খবরের কাগজের অফিস, আর ছোট একটা লোহালক্কড়ের দোকান।
শহরের কেন্দ্রে দোতলা একটা পাকা বাড়ি, কোর্টহাউস! বাড়িটা ছাড়িয়ে একটু দূরে পেট্রল স্টেশন, তারও পরে টুইন লেকসের দমকল বাহিনীর অফিস।
আগুন! হাত তুলে দেখাল মুসা।
শহরের বাইরে এক জায়গায় ধোঁয়ার কুণ্ডলীতে কালো হয়ে গেছে বিকেলের আকাশ।
ভয় নেই, ফিরে বলল জিনা, সামনে, চাচার সীটের পাশে বসেছে। করাত কলের চুলোর ধোয়া।
এককালে খনিই ছিল এখানকার গরম ব্যবসা, গাড়ি চালাতে চালাতে বললেন মিস্টার উইলসন। এখন কাঠের কলই ভরসা। কাঠের ব্যবসাই টিকিয়ে রেখেছে শহরটাকে। অথচ, পয়তাল্লিশ বছর আগে কি জমজমাট শহরই না ছিল।
বেশি হট্টগোল আমার ভাল্লাগে না, বলল মুসা। মন টেকে না। শান্তই ভাল।
ক্ষণিকের জন্যে ফিরে তাকালেন মিস্টার উইলসন। শান্ত? জিনা, গপ্পো দুয়েকখান শোনাও তোমার বন্ধুকে। টুইন লেকস শান্ত, হাঁহ আমি বলতে চেয়েছি, আগের টাকার গরম আর নেই এখন শহরটার।
আমার গপ্পো এখন একটাই, সামনের দিকে চেয়ে থেমে গেল জিনা। হাত তুলে দাঁড়িয়ে আছে এক মহিলা। গাড়ি থামালেন মিস্টার উইলসন, জিনসের প্যান্ট আর লম্বা বুলিওয়ালা পশমী শার্ট পরা এক মিহলাকে রাস্তা পেরোতে দিলেন।
একটাই কথা,আবার বল জিনা, হ্যারি ম্যাকআরার একটা আস্ত ভণ্ড।
নাক দিয়ে হাসি আর গোঙানির মাঝামাঝি একটা বিচিত্র শব্দ করলেন মিস্টার উইলসন, ব্রেক চেপে রেখে ফিরলেন ছেলেদের দিকে। দেখো, জিনার কথায় মিস্টার ম্যাকআরবারের ওপর গোয়েন্দাগিরি করতে যেয়ো না। ও আমার পড়শী, আর পড়শীর সঙ্গে মুখ কালাকালি ভাল না। তাছাড়া সুখ্যাতি আছে তার। তার ওপর রয়েছে টাকা, প্রচুর টাকা। টুইন লেকস তার জন্মভূমি, এত বছর পরও তাই ফিরে এসেছে। আমাকে বলেছে, ছেলেবেলায় খনি শহরের অনেক রোমাঞ্চকর গল্প শুনেছে মা-বাবার মুখে, তখন থেকেই তার ইচ্ছে, সুযোগ হলেই সে ফিরে আসবে এখানে। খনিটা কিনেছে, তার কারণ, এককালে তার বাবা কাজ করত ওখানে। ওর কাজকর্ম আমার কাছে তো কই, অস্বাভাবিক ঠেকে না।
তাহলে খনির মুখ আবার খুলল কেন? তর্ক শুরু করল জিনা।
তাতে তোর মাথাব্যথা কিসের? বললেন চাচা। তার খনির মুখ সে খুলল না বন্ধ করল, তাতে কার কি? খোঁজ খবর নিয়েছি আমি অনেক, লোকটার কোন বদনাম শুনিনি।
ছেলেদের দিকে চেয়ে হাসলেন। কেন দেখতে পারে না জানো? জিনাকে শার্টের কলার চেপে ধরে বের করে দিয়েছিল ম্যাকআরথার, তারপর থেকেই যত রাগ। তবে অন্যায় কিছু করেনি সে, তাহলে আমিই তো গিয়ে ধরতাম। কয়েক বছর আগে ওই খনিতে পড়ে এক মহিলা মরেছে। দুর্ঘটনা আরও ঘটতে পারে। জিনাকে সেজন্যেই বের করে দিয়েছে সে।
হেসে ফেলল মুসা, কি শুনছি, জিনা? তোমাকে নাকি ঘাড় ধরে…
চুপ! রাগে কেঁপে উঠল জিনার গলা।
জিনাকে কলার ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে একজন লোক, দৃশ্যটা কল্পনা করে কিশোরও হাসি চাপতে পারছে না। বুঝতে পারছে, এজন্যেই চাচাকে ভজিয়েভাজিয়ে রকি বিচে নিয়ে গেছে জিনা, তিন গোয়েন্দাকে দাওয়াত করে এনেছে। ম্যাকআরথারের ওপর প্রতিশোধ নিতে, এক কুলিয়ে উঠতে পারেনি…
ব্যাটা আস্ত ভণ্ড! চেঁচিয়ে বলল আবার জিনা।
একআধটু পাগলাটে হতে পারে, কিশোর বলল। কোটিপতিদের কেউ কেউ যেমন হয়।
তাতে দোষের কিছু আছে? বললেন মিস্টার উইলসন, ৱেক ছেড়ে গাড়ি চালু করে দিলেন আবার। জিনা, আমি চাই না ভদ্রলোককে তুমি বিরক্ত করো। তোমাদেরও বলে রাখলাম, কিশোর।
একটা কাঠের ব্রিজের ওপর উঠল গাড়ি, ঝাঁকুনি খেতে খেতে এগোচ্ছে। নিচে রু খাল, দুই মাথা গিয়ে পড়েছে দুটো ক্ষুদে দে, পুকুরই বলা চলে। ছেলেরা অনুমান করল জোড়া হদের জন্যেই নাম হয়েছে টুইন লেকস।
পুলের পরে একটা কাঁচা রাস্তায় নামলো গাড়ি, পেছনে ধুলোর মেঘ উড়িয়ে চলল। মাইলখানেক দূরে পথের বাঁয়ে সবুজ খেত। আরও পরে একটা খোলা গেট দেখা গেল, তার ওপাশে কয়েকটা বাড়িঘর। একটা বাড়ি নতুন বঙ করা হয়েছে, বাকিগুলো পুরানো, দেখে মনে হয় না মানুষ থাকে।
গতি কমালেন মিস্টার উইলসন, হর্ন বাজালেন একজন লম্বা, হালকা-পাতলা মহিলাকে উদ্দেশ্য করে, ছোট একটা বাড়ির সামনে বাগানে পানি দিচ্ছেন তিনি।
মিসেস ফিলটার, ছেলেদেরকে বলল জিনা।
হেসে হাত নাড়লেন মহিলা। পরনে ঢিলা পাজামা, গায়ে সাদা শার্ট, গলায় নীলকান্তমনি, খচিত রুপার একটা বেশ বড়সড় হার। ধূসর চুলে রুপালি ছোপ লেগেছে, বয়েস ষাটের কাছাকাছি, কিন্তু হোস নেড়ে যেভাবে পানি দিচ্ছেন, ক্ষিপ্রতা দেখে মনে হয় না এত বয়েস।
এই শহরের সুদিন কালে এখানে জন্মেছিলেন মহিলা, জিনা বলল। খনির সুপারিনটেনডেন্টকে বিয়ে করেছিলেন। খনি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর চলে গিয়েছিলেন দুজনেই। স্বামীর মৃত্যুর পর ফিনিক্সে এক দোকানে কাজ নিলেন মহিলা, টাকাটুকা জমিয়ে, চাকরি ছেড়ে এখানে ফিরে এসেছেন বাকি জীবনটা শান্তিতে কাটাতে। যে বাড়িতে বৌ হয়ে ঢুকেছিলেন, বিক্রি করে চলে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন, সেটাই কিনে নিয়েছেন আবার। আরও কিছু জায়গা কিনেছেন মহিলা, বোধহয় পুরানো দিনের
স্মৃতি ধরে রাখার জন্যেই ভুলেও কখনও ব্যবহার করেন না ওগুলো।
ম্যাকআরবারের সঙ্গে মহিলার যথেষ্ট মিল দেখা যাচ্ছে, বলল রবিন।
না না, জোর গলায় বলল জিনা, মহিলা খুব ভাল।
আসলে, এখানে যারা ফিরে আসে তাদের একজনের সঙ্গে আরেকজনের মিল থাকেই, বললেন উইলসন, টুইন লেকসকে একবার ভালবেসে ফেললে দুনিয়ার আর কোথাও গিয়ে শান্তি নেই, ফিরে আসার জন্যে খালি আনচান করে মন। শেষ বয়েস কাটানোর এত চমৎকার জায়গা কমই আছে। গেটের সামনে এনে গাড়ি থামালেন। হাত তুলে দেখালেন, পথটা গিয়ে শেষ হয়েছে পর্বতের উপত্যকায়। ওটা পশ্চিম। তার বাঁয়ে পোয়াটাক মাইল দূরে কালো রঙ করা কাঠের বেড়া। ওটাই খনিমূখ। আর ওই যে কেবিনটা, ওটাতে থাকে ম্যাকআরথার। পেছনে যে বিল্ডিংটা, ওটাও তার। আগে ওখানে খনির নানারকম কাজকর্ম হত।
গেটের ভেতরে গাড়ি ঢোকালেন তিনি। মাটির রাস্তা, তাতে চাকার গভীর খাজ। চলার সময় আপনাআপনি চাকা ঢুকে যায় খাজের মধ্যে, সরানো কঠিন। পথের দুধারে সারি সারি নবীন ক্রিস্টমাস গাছ। বেড়া দেয়া একটা পশু রাখার খোয়াড়ের পাশ কাটিয়ে এল গাড়ি, ভেতরে গোটা চারেক ঘোড়া ঘাস খাচ্ছে, ওগুলোর মাঝে জিনার কমেটকে চিনতে পারল তিন গোয়েন্দা। আরও পরে, বায়ে সুন্দর একটা র্যাঞ্চ হাউস, ছোট ছোট গাছ ঘিরে রেখেছে। সীডার-লাল রঙের ওপর সাদা অলঙ্করণ, চার পাশের সবুজের মাঝে ছবির মত লাগছে বাড়িটাকে। পথের শেষ মাথায় ভাঙাচোরা পুরানো একটা গোলাবাড়ি, কতকাল আগে রঙ করা হয়েছিল এখন আর বোঝা যায় না।
র্যাঞ্চ-হাউসের সামনে এনে গাড়ি রাখলেন উইলসন, হাই তুললেন, আড়মোড়া ভাঙছেন। আউফ। বাড়ি এলাম।
গাড়ি থেকে নামল ছেলেরা, আশপাশ দেখছে। গোলাবাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে একটা পিকআপ ট্রাক, ধুলোয় মাখামাখি। বাড়ির একপাশে তারের বেড়া দেয়া খানিকটা জায়গা, একাংশ চোখে পড়ছে, ভেতরে কয়েকটা মুরগী।
গাড়ি থেকে নামলেন উইলসন। তাজা ডিম পছন্দ আমার, মুরগীর খোঁয়াড় দেখিয়ে বললেন। সকালে মোরগের ডাকে ঘুম ভাঙার মাঝে এক ধরনের আনন্দ আছে, খুব শান্তি। আমার মোরাটার ধারণা, রাত্রি তাড়ানোর দায়িত্বটা বুঝি তারই ওপর বর্তেছে, ভোর না হতেই চেঁচিয়ে পাড়া মাথায় করে। আমার খুব ভাল লাগে।
মনিবের কথার জবাবেই যেন বাড়ির পেছন থেকে শোনা গেল তার কণ্ঠ, ডাক নয়, উত্তেজিত চিৎকার।
এক সেকেন্ড পরেই যেন একসঙ্গে খেপে গেল সব কটা মোরগ-মুরগী, বাচ্চাকাচ্চা সব। পরক্ষণে শটগানের বিকট শব্দ।
চেঁচিয়ে উঠে হুমড়ি খেয়ে পড়ল মুসা, দুহাতে মাথা ঢাকল। গাড়ির আড়ালে মাথা নুইয়ে ফেলল কিশোর আর রবিন। মুরগীর খামারের ওদিক থেকে তীব্র গতিতে ছুটে আসছে একটা বিরাট ছায়া।
পলকের জন্যে কিশোরের চোখে পড়ল একসারি ঝকঝকে ধারাল দাঁত আর কালো দুটো চোখ। পরক্ষণেই ধাক্কা দিয়ে তাকে মাটিতে ফেলে গায়ের ওপর দিয়ে লাফিয়ে চলে গেল জানোয়ারটা, হারিয়ে গেল পশ্চিমে ক্রিস্টমাস খেতের ভেতরে।
<