ডরির হুমকি তখনও যেন কানে বাজছে তিন গোয়েন্দার। দেখলো, চলন্ত ওয়াগনটার দিকে তাকিয়ে আছে পিনটু, চোখে বিতৃষ্ণা।

এই অহংকারই সর্বনাশ করলো আমাদের! দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে তার অন্তর থেকে বেরিয়ে এলো ক্ষোভটা।

না, পিনটু, প্রতিবাদ করলো লম্বা লোকটা, এটা অহংকার নয়। আত্মসম্মানজ্ঞান। আলভারেজদের গর্ব।

তিন গোয়েন্দার সঙ্গে লোকটার পরিচয় করিয়ে দিলো পিনটু, আমার ভাই, রিগো। বর্তমানে আমাদের পরিবারের কর্তা। ভাইয়া, এরা হলো আমার বন্ধু, কিশোর পাশা, মুসা আমান, আর রবিন মিলফোর্ড।

ছেলেদের দিকে তাকিয়ে সামান্য একটু মাথা নোয়ালো রিগো। বয়েস পঁচিশের বেশি নয়, পরনের কাপড়-চোপড়ও পুরানো কিন্তু তবু আচার-আচরণই স্পষ্ট বলে দেয় এককালে বড় জমিদার ছিলো বাপ-দাদারা। বললো, তোমাদের সঙ্গে পরিচিত হয়ে খুশি হলাম।

ডা নাদা! বলে স্প্যানিশ কায়দায় বাউ করলো কিশোর।

বাহ্! এই প্রথম হাসি ফুটলো রিগোর মূখে। তুমি স্প্যানিশ জানো?

একআধটু চৰ্চা করি ইস্কুলে, কিছুটা লজ্জিত কণ্ঠেই বললো কিশোর। তবে তেমন পারি না। আপনাদের মতো করে বলার তো প্রশ্নই ওঠে না।

স্প্যানিশ কলার দরকার নেই আমাদের সঙ্গে, ভদ্রতা করে কললো রিগো। আমরা নিজেরা যখন কথা বলি দেশী ভাষায়ই বলি। কিন্তু এখন আমরা আমেরিকারও নাগরিক, তোমাদেরই মতো, কাজেই ইংরেজিও আমাদের ভাষা কলা চলে।

কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো কিশোর, তার আগেই অধৈর্য হয়ে হাত নাড়লো মুসা, বলে উঠলো, আচ্ছা, পস্তাবে বলে শাসিয়ে গেল কেন কাউবয়টা?

ওই এমনি বলেছে, বিশেষ পাত্তা দিলো না রিগো, কথার কথা। পিনটুর কণ্ঠে অস্বস্তি ফুটলো, কিন্তু ভাইয়া, মিস্টার ডয়েল…

থাক থাক বাধা দিয়ে বললো রিগো, আমাদের ব্যক্তিগত সমস্যা ওটা। অন্যকে বিরক্ত করার দরকার নেই।

কোনো গোলমাল হয়েছে? জিজ্ঞেস করলো কিশোর। কিছু করেছে ডরি আর টেরিয়ার?

না, না, তেমন কিছু না।

ভাইয়া, প্রতিবাদ জানালো পিনটু, আমাদের র‍্যাঞ্চ চুরি করে নিয়ে যেতে চাইছে, আর একে তুমি কিছু না বলহো!

হাঁ হয়ে গেল রবিন আর মুসা। রবিন বললো, তোমাদের র‍্যাঞ্চ? মুসা বললো, করে কিভাবে?

কথা শুদ্ধ করে বলবে, পিনটু, বললো তার ভাই। চুরি শব্দটা ঠিক হয়নি।

কোন শব্দটা হলে ঠিক হতো? ফস করে জিজ্ঞেস করলো কিশোর।

দ্বিধায় পড়ে গেল যেন রিগো। মুখ ফসকে বলে ফেলেছে, এখন বাকিটা বলবে কিনা ভাবছে যেন। শেষে বলেই ফেললো, কয়েক মাস আগে আমাদের পাশের র‍্যাঞ্চটা কিনেছেন মিস্টার ডয়েল। তারপর আশেপাশে যত বড় বড় র‍্যাঞ্চ আছে সব কিনে ফেলবেন ঠিক করেছেন। আমার বিশ্বাস জমির ওপর টাকা খাটাচ্ছেন। আমাদের র‍্যাঞ্চটাও চাইছেন। অনেক টাকা দাম দিতে চেয়েছেন। কিন্তু আমরা বিক্রি করতে রাজি না হওয়ায় ভীষণ রেগে গেছেন তিনি।

তোমার শব্দ-চয়নও ঠিক হয়নি, হেসে বললো পিনটু। বরং বলো পাগলা ঘোড়া হয়ে গেছেন।

ভাইয়ের কথায় কান না দিয়ে বলতে থাকলো রিগো, বুঝেছে, আসলে আমাদের জমির দরকার খুব একটা নেই তার কাছে। তিনি চাইছেন অন্য জিনিস। পুরানো একটা ড্যাম আর রিজারভোয়ার রয়েছে আমাদের এলাকায়, নাম সান্তা ইনেজ ক্রীক। মিস্টার ডয়েরে বিশাল র‍্যাঞ্চের জন্যে পানি দরকার, তাই বাধ আর ওই দীঘিটা চায়। প্রথমে এসে কেনার প্রস্তাব দিলো আমাদের কাছে, রাজি হলাম না। আরও বেশি দাম দিতে চাইলো। তারপরও যখন রাজি হলাম না, আমাদের পুরানো দলিল ঠিক না বলে প্রমাণ করার চেষ্টা করলো। পারলো না। আমাদের জমি আমাদেরই রইলো।

তখন অন্য পথ ধরলো ডয়েল, মিস্টার ডয়েলকে সৌজন্য দেখানোর ধার দিয়েও গেল না পিনটু। ডরিকে দিয়ে শেরিফকে বলে পাঠালো, প্রায়ই আমাদের র‍্যাঞ্চে আগুন লাগে। সেই আগুন নাকি তার র‍্যাঞ্চেও ছড়িয়ে পড়তে পারে। বলে আমাদের লোক কম। আরও লোক রাখা দরকার যাতে ওরকম দুর্ঘটনা আর না ঘটতে পারে। রাগ চাপা দিতে পারলো না সে।

এই ডরিটাকে? রবিন জানতে চাইলো।

মিস্টার ডয়েলের র‍্যাঞ্চ ম্যানেজার, জানালো রিগো। মিস্টার ডয়েল হলেন গিয়ে ব্যবসায়ী মানুষ। র‍্যাঞ্চ সম্পর্কে কোনও ধারণা নেই। তাই লোক রেখে চালাতে চাইছেন আমার মনে হয়।

ডরির কথা নিশ্চয় বিশ্বাস করেননি শেরিফ, মুসা আশা করলো। নইলে এতোদিনে হাতছাড়া হয়ে যেতো আপনাদের র‍্যাঞ্চ, তাই না?

ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেললো রিগো। কাগজ-পত্র সব ঠিক আছে বলেই কিছু করতে পারছে না। কিন্তু আমাদের টাকা নেই, কতোদিন ঠেকাবো? ট্যাক্স জমে গেছে অনেক। সেটা জেনে ফেলেছেন মিস্টার ডয়েল। কাউন্টিকে ফুসলাচ্ছেন যাতে নীলামে তোলে আমাদের জমি, তাহলে তিনি কিনে নিতে পারবেন। এখন যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব ট্যাক্স ক্লিয়ার করতে হবে আমাদের…

ব্যাংকের কাছে বাধা দিয়ে টাকা ধার নিতে পারেন, কিশোর বললো।

হ্যাঁ, কিশোরের কথা সমর্থন করতে পারলো না মুসা, তারপর ব্যাংক এসে জমিটা নিয়ে নিক। ফুটন্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত চুলায় ঝাপ দেয়ার পরামর্শ দিচ্ছো।

না, তা কেন হবে? কিশোরের উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে তার পক্ষ নিলো রবিন। নিশ্চয় অনেক টাকা ট্যাক্স জমেছে। সেটা ব্যাংক দিয়ে দেবে। সেই টাকার ওপর কিছু সুদ ধরে কিস্তিতে শোধ দিতে কলবে জমির মালিককে। একবারে দেয়ার চেয়ে অল্প অল্প করে দেয়া অনেক সহজ, আর দেয়ার সময়ও পাওয়া যাবে।

তা ঠিক, রাগ ফুটলো রিগোর কণ্ঠে। কিন্তু কথা হলো আমাদের মতো বাইরের লোকদের ধার দিতে চায় না ক্যালিফোর্নিয়ার ব্যাংক। খাঁটি আমেরিকান না হলে বিশ্বাস করে না। জমি বন্ধক রেখে ট্যাক্সের জন্যে ধার আমরা নিয়েছি, আমাদেরই এক পুরানো বন্ধু, প্রতিবেশী, আমাদের মতোই মেকসিকান-আমেরিকান রডরিক হেরিয়ানোর কাছ থেকে। কয়েক দিনের জন্যে। টাকাটা শীঘ্রি শোধ করতে হবে। সে-কারণেই তোমার কাছে এসেছি, কিশোর পাশা।

আমার কাছে?

যেহেতু র‍্যাঞ্চ ছাড়ছি না আমরা, জায়গা আর বিক্রি করতে পারছি না। বিক্রি করার মতো জমিই নেই। যা আছে সেগুলো দিয়ে আমাদেরকে চলতে হবে। অনেক পুরুষ ধরে অনেক জিনিসপত্র কিনেছে আলভারেজরা, অনেক কিছু জমিয়েছে। এই যেমন আসবাবপত্র, ছবি, ভাস্কর্য, বই, পোশাক, যন্ত্রপাতি, আরও নানারকম জিনিস। আলভারেজদের ইতিহাসই বলা চলে ওগুলোকে। কিন্তু জমির চেয়ে তো বড় না, তাই ওগুলো বিক্রি করে ধারশোধ করবো ঠিক করেছি। পিনটুর কাছে শুনেছি, তোমার চাচা নাকি সব ধরনের পুরানো জিনিস কেনেন।

নিশ্চয়ই কেনেন, কিশোরের আগেই চেঁচিয়ে উঠলো মুসা। আর যতো বেশি পুরানো জিনিস হয় ততো বেশি খুশি হন।

হ্যাঁ, কিশোর কললো, পুরানো হলে খুশি হয়েই কিনবেন। আসুন।

সত্যিই খুশি হলেন রাশেদ পাশা। মুসা আর কিশোরের মুখে শুনে প্রায় লাফিয়ে উঠলেন। মুখ থেকে পাইপ সরিয়ে বললেন, তাহলে আর বসে আছি কেন? উত্তেজনায় চকচক করছে চোখ।

কয়েক মিনিট পরেই স্যালভিজ ইয়ার্ডের একটা ট্রাক উত্তরে রওনা হলো। প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূল থেকে দূরে সরে যাচ্ছে, পার্বত্য এলাকার দিকে চলেছে, আলভারেজদের র‍্যাঞ্চের দিকে। গাড়ি চালাচ্ছে ইয়ার্ডের কর্মচারী, ব্যাভারিয়ান ভাইদের একজন, বোরিস। পাশে বসেছেন রাশেদ পাশা আর পিনটু। ট্রাকের পেছনে চড়ে চলেছে কিশোর, মুসা, রবিন আর রিগো। নভেম্বরের বিকেলের রোদ এখনও মুছে যায়নি, তবে পর্বতের মাথায় কালো মেঘ জমতে আরম্ভ করেছে।

সেদিকে তাকিয়ে রবিন বললো, বৃষ্টি তাহলে নামবে মনে হয়। গত মে-এর পর থেকে এক ফোঁটা বৃষ্টিও হয়নি। সময় হয়েছে এখন। যখন তখন শুরু হতে পারে শীতের বর্ষণ।

কাঁধ ঝাঁকালো রিগো। মনে হয়। না-ও হতে পারে। গত কিছু দিন ধরেই দেখছি, মেঘ জমে, কেটে যায়, জমে আবার কেটে যায়। বৃষ্টি হলে ভালোই হতো। পানি দরকার। আমাদের দীঘিটা আছে বলে বেঁচে গেছি। ওটার পানিতেই চলে সারা বছর। তবে এবছর খরা পড়েছে বেশি, পানি একেবারে নিচে নেমে গেছে। শীঘ্রি বৃষ্টি হলে বিপদ হবে।

পথের পাশে শুকনো বাদামী অঞ্চল। মাঝে মাঝে ওক গাহ, সবুজ পাতাগুলো লালচে হয়ে আছে ধূলিতে।

সেদিকে তাকিয়ে বিষণ্ণ কণ্ঠে বললো রিগো, একসময় এসবই ছিলো আলভারেজদের জায়গা। এদিকের উপকূল থেকে শুরু করে ওদিকে ওই যে ওই পর্বতের একেবারে গোড়া পর্যন্ত। বিশ হাজার একরের বেশি।

দ্য আলভারেজ হাসিয়েনডা, মাথা ঝাঁকিয়ে বললো রবিন। পড়েছি। স্পেনের রাজার কাছ থেকে এই জমি ভোগদখলের অনুমতি পেয়েছিলো আলভারেজরা।

হ্যাঁ, রিগো বললো। অনেক দিন ধরে এখানে আছি আমরা। প্রথম যে ইউরোপিয়ান মানুষটি ক্যালিফোর্নিয়ায় পা রাখেন তাঁর নাম হুয়ান ক্যাবরিলো। পনেরো শো বিয়াল্লিশ সালে এটা স্পেনের সম্পত্তি বলে দাবি করেন। কিন্তু তারও আগে থেকেই আমেরিকায় ছিলেন নিরো আলভারেজ। হারনানদো করটেজের সেনাবাহিনীতে একজন সৈনিক ছিলেন তিনি। করটেজের নাম নিশ্চয় অনেহো, পনেরোশো একুশ সালে দক্ষিণ মেকসিকোতে আজটেকদেরকে পরাজিত করেছিলেন যে বীর সেনাপতি।

খাইছে! প্রায় চেঁচিয়ে উঠলো মুসা। তারমানে প্লাইমাউথ রকে খ্রীষ্টান তীর্থযাত্রীদের ঢোকারও একশো বছর আগের ঘটনা সেটা।

তাহলে আলভারেজরা ক্যালিফোর্নিয়ায় এলো কবে? এই ইতিহাস শুনতে খুব ভালো লাগছে কিশোরের, আগ্রহের সঙ্গে জিজ্ঞেস করলো।

অনেক পরে, রিগো জানালো। ক্যাবরিলো ক্যালিফোর্নিয়ায় ঢোকার পর থেকেই ধীরে ধীরে স্প্যানিশ এই এলাকায় ঢুকতে আরম্ভ করলো। তবে ঠিকমতো বসতি জমাতে দুশো বছরেরও বেশি সময় লেগে গেল তাদের। এর কারণ, নিউ স্পেনের তৎকালীন রাজধানী মেকসিকো সিটি থেকে ক্যালিফোর্নিয়া অনেক দূরে। দুর্গম ছিলো তখন এই এলাকা, আর ভয়ংকর ছিলো এখানকার ইনডিয়ানরা। শুরুর দিকে তো স্থলপথে এখানে আসতেই পারতো না স্প্যানি, আসতো সমুদ্রপথে।

ক্যালিফোর্নিয়াকে তখন দ্বীপ মনে করতো স্প্যানিশরা, তাই না? কিশোর কলো।

মাথা ঝাঁকালো রিগো।। তারপর, সতেরোশো ঊনসত্তর সালে স্থলপথে এক অভিযান চালালেন ক্যাপ্টেন গ্যাসপার ডা পরটোলা। উত্তরে এগোতে এগোতে তিনি পৌঁছে গেলেন স্যান দিয়েগোতে। আমাদের পূর্বপুরুষ লেফটেন্যান্ট ডারিগো আলভারেজ ছিলেন তখন তাঁর সঙ্গে। সান ফ্রানসিসকো বে-এর অনেক জায়গা ঘুরে ঘুরে দেখলেন পরটোলা। তারপর সতেরোশো সওর সালে মনটেরোতে বসতি স্থাপন করলেন। ওই সময়ই রকি বীচকে চোখে লেগে গিয়েছিলো ডারিগোর। ঠিক করলেন, এখানেই বসতি করবেন। ক্যালিফোর্নিয়ার প্রভিনশিয়াল গভার্নমেন্টের কাছে দরখাস্ত করলেন জায়গা চেয়ে। অনুমতি পেলেন সতেরোশো চুরাশি সালে।

আমার তো ধারণা ছিলো স্পেনের রাজা তাকে জমি দিয়েছেন, মুসা কললো।

মাথা ঝাঁকালো রিগো। একদিক থেকে তা-ই করা হয়েছে আসলে। নিউ স্পেনের সমস্ত জায়গাই অফিশিয়ালি তখন রাজার সম্পত্তি। তাঁর পক্ষেই অনুমতিপত্র সই করতেন তৎকালীন মেকসিকো আর ক্যালিফোর্নিয়ার গভার্নার। ডারিগো পেলেন ফাইভ স্কোয়ার লীগস, অর্থাৎ বিশ হাজার একরেরও বেশি। এতো জায়গা ছিলো, অথচ এখন আমাদের আছে মাত্র একশো একর।

বাকি জমি? জানতে চাইলো রবিন।

বাকি? বিষণ্ণ চোখে ট্রাকের পাশ দিয়ে ছুটে যাওয়া জমির দিকে তাকিয়ে রইলো রিগো এক মুহূর্ত। বোধহয় ঈশ্বরের বিচার! ইনডিয়ানদের কাছ থেকে তাদের জায়গা কেড়ে নিয়েছিলো স্প্যানিশরা; কাজেই ও-জমি তাদের দখলে থাকবে কেন? যাবেই। বছরের পর বছর আলভারেজদের সংখ্যা বেড়েছে, জমি ভাগাভগি হয়েছে। কিছু বিক্রি করেছে, কিছু কায়দা করে দখল করে নিয়েছে শরা, আর কিছু কেড়ে নিয়ে গেছে কলোনির উচ্চপদস্থ কর্মচারীরা।

ধীরে ধীরে হোট থেকে ছোট হয়ে এলো আমাদের র‍্যাঞ্চ। কিন্তু জমিদারি মেজাজ আর অহংকার হাড়তে পারিনি আমরা। বড় বড় লোকদের সঙ্গে ছিলো আমাদের পূর্বপুরুষদের আত্মীয়তা। ক্যালিফোর্নিয়ার শেষ মেকসিকান গভার্নার পিও পিকো ছিলেন আমাদের আত্মীয়। বহু বহুর আগে করটেজের একটা মৃর্তি স্থাপিত হয়েছিলো আলভারেজদের জমিতে, এখনও সেটা আমাদের সীমানার মধ্যেই আছে।

মিষ্টার ডয়েল তাহলে আপনাদের এই শেষ সম্বলটুকু ছিনিয়ে নিতে চাইছেন, সহানুভূতি মিশিয়ে বললো মুসা।

এতো সহজে নিতে দেবো না, দৃঢ়কণ্ঠে ঘোষণা করলো যেন রিগো। খুব একটা ভালো জায়গা নয় ওটা, ভালো তৃণভূমি নেই, ফসল ফলানো কঠিন। শুধু বাপ-দাদার জায়গা বলেই ভিটে আঁকড়ে পড়ে আছি। পড়ে থাকবো। ঘাস বেশি নেই বলে গরু তেমন পোষা যাচ্ছে না। তবে বিকল্প হিসেবে ঘোড়ার প্রজনন শুরু করেছি আমরা। অ্যাভোক্যাডো গাছ লাগিয়েছি। ছোটখাটো একটা তরকারীর খামারও করেছি। তারপরেও আমার বাবা আর চাচাকে গিয়ে শহরে নানারকম কাজ করতে হয়েছে র‍্যাঞ্চটা খাড়া রাখার জন্যে। এখন তারা নেই, মারা গেছে। র‍্যাঞ্চটা টিকিয়ে রাখতে হলে এখন আমাকে আর পিনটুকেও গিয়ে তাদের মতো কাজ করতে হবে।

কাউন্টি রোড ধরে চলেছে এখন ট্রাক। পাহাড়ী অঞ্চল। উত্তরে চলেছে ওরা। ধীরে ধীরে ওপরে উঠছে পথ। হঠাৎ করেই যেন পাহাড়ের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো ছড়ানো একটা সমতল জায়গায়। বাঁয়ে সামান্য মোড় নিয়ে পশ্চিমে এগিয়ে গেছে এখন রাস্তাটা। মোড়ের কাছ থেকে আরেকটা কাছা রাস্তা বেরিয়ে গেছে ডানে।

সেই রাস্তাটা দেখিয়ে রিগো কললো, ডয়েল র‍্যাঞ্চে গেছে ওটা।

দূরে ডয়েল র‍্যাঞ্চ দেখতে পেলো গোয়েন্দারা, তবে বাড়িটার পাশে কোনো গাড়িটাড়ি চোখে পড়লো না। টেরি আর ডরি কি তাহলে ফেরেনি?

কাউন্টি রোডটা যেখানে মোড় নেয়া শেষ করেছে ওখানে একটা ছোট পাথরের ব্রিজ আছে। নিচে শুকনো খট খটে বুক চিতিয়ে রেখেছে যেন পাহাড়ী নালা, পানি নেই।

সান্তা ইনেজ ক্রীক, নালাটা দেখিয়ে বললো রিগো, আমাদের সীমানা এখান থেকে শুরু। বৃষ্টি না নামলে আর পানি আসবে না ওটাতে। ওটা ধরে মাইলখানেক উত্তরে বাঁধ। ওই ওদিকে।

কতগুলো শৈলশিরা দেখালো সে। বোঝালো বাধটা ওগুলোর ওপাশে। নালার অন্যপাশে রয়েছে একটা শিরা, কাউন্টি রোডের সঙ্গে তাল রেখে পাশাপাশি এগিয়ে গেছে। উত্তরের পর্বতের গায়ে গ্রিগুলো এমনভাবে বেরিয়ে রয়েছে, দেখে মনে হয় হাতের হুড়ানো আঙুল।

আঙুলগুলোর পাশ দিয়ে গেছে পথ। শেষ আঙুলের কাছে এসে হাত তুলে দেখালো রিগো। ওটার ওপরে পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে রয়েছে একটা কালো বিশাল মূর্তি-ঘোড়ার পিঠে বসে আছে ঘোড়সওয়ার, একটা হাত এমন ভাবে তুলে রেখেছে, মনে হয় যেন পেছনের সেনাদলকে এগোনোর নির্দেশ দিচ্ছে।

মহাবীর কটেজ, গর্বের সঙ্গে বললো রিগো। আলভারেজদের প্রতীকই বলা চলে ওটাকে। আলভারেজ হীরো। দুশো বছর আগে বানিয়েছিলো ইনডিয়ানরা।

শেষ শিরাটা পেরোনোর পর আবার দেখা গেল সমভূমি। আরেকটা পাথরের বিজ পেরোতে হলো। নিচে গভীর খাদ, এটাও শুকনো।

আরেকটা নালা? জিজ্ঞেস করলো মুসা।

নালা হলে তো ভালোই হতো, রিগো বললো। এটার মেকসিকান নাম অ্যারোইও। জোর বৃষ্টি হলেই শুধু এসব অ্যারোইওতে পানি জমে। আর কোনো উৎস নেই।

আর উৎস মানে?

পর্বতের গা থেকে বেরোনো ঝর্নার কথা বলছি। সান্তা ইনেজ ক্রীকে যেমন আসে।

সান্তা ইনেজ ক্রীকেও না বললেন বৃষ্টি হলে পানি আসে?

হ্যাঁ, তাই তো। বৃষ্টি হলে পর্বতের ভেতরের ফাঁকফোকরে পানি ঢুকে যায়, ঝর্না হয়ে বেরিয়ে আসে আবার নিচের নালা বেয়ে। কিন্তু অ্যারোইওর মুখ বন্ধ থাকে বলে ঢুকতে পারে না।

ডানে মোড় নিয়ে একটা কাঁচা রাস্তায় নামলো ট্রাক। পথের দুপাশে এখানে অ্যাভোকাডো গাছ লাগানো। আরেকবার ডানে মোড় নিয়ে পথটা বেরিয়ে এলো একটা ছড়ানো, খোলা চত্বরের মতো জায়গায়।

সিয়েনডা অ্যালভারেজে স্বাগতম, নাটকীয় ভঙ্গিতে বললো রিগো। নিচের মাটিতে ধুলো জমে আছে। লাফ দিয়ে দিয়ে ট্রাক থেকে নামলো গোয়েন্দারা। লম্বা, নিচু হাতওলা একটা বাড়ি। দেয়ালে সাদা চুনকাম। কোটরে বসা চোখের মতো যেন ক্ষ দেয়ালের গভীরে বসে রয়েছে জানালাগুলো। লাল টালির ঢালু ছাত। কালচে বাদামী রঙের খুঁটি আর কড়িকাঠের ওপর ভর দিয়ে হাতটা এসে যেন ঝুলে রয়েছে বারান্দার ওপর। এই বাড়িটাই অ্যালভারেজদের হাসিয়েনডা। বাঁয়ে ঘোড়ার ঘর, এটারও হাত নিচু। অনেকটা গোলাঘরের মতো দেখতে। সামনে তারের বেড়া দিয়ে তৈরি করা হয়েছে কোরাল। মুরগীর খোয়াড়ের বাইরে যেমন দিনের বেলা চরে খাওয়ার জন্যে ঘেরা জায়গা থাকে, কোরালও অনেকটা এরকমই। কোরাল আর গোলাঘরের চারপাশে গজিয়ে উঠেছে বাকাচোরা ওকগাছ। নভেম্বরের এই মেঘলা বিকেলে সব কিছুই কেমন যেন মলিন, বিষণ্ণ দেখাচ্ছে।

হাসিয়েনডার পেছনে খানিক দূরেই দেখা গেল সেই অ্যারোইওটা, যেটা পেরিয়ে এসেছে ট্রাক। তার ওপাশে মাথা তুলে রেখেছে শৈলশিরাগুলো। হাত তুলে করটেজের মূর্তিটা চাচাকে দেখালো কিশোর।

ওটাও কি বিক্রি হবে? রিগোকে জিজ্ঞেস করে বসলেন রাশেদ পাশা কিছু না ভেবেই।

না না, রিগো মাথা নাড়লো। বিক্রির জিনিস রয়েছে গোলাঘরের ভেতরে।

কোরারে কাছে ট্রাক পিছিয়ে নিতে শুরু করলো বোরিস। অন্যেরা দ্রুত এগোলো ধুলো মাড়িয়ে গোলাঘরের দিকে। ভেতরে আলো খুব কম। একটা কাঠের হুকের মাথায় হ্যাটটা প্রায় ছুঁড়ে ফেললো রিগো, পারিবারিক রত্নগুলো ভালোমতো দেখার এবং দেখানোর জন্যে। হাঁ হয়ে গেছে তিন গোয়েন্দা।

লম্বা ঘরটার অর্ধেকটা জুড়ে রয়েছে ঘোড়া রাখার স্টল, আর কৃষিকাজের সাধারণ যন্ত্রপাতি। বাকি অর্ধেকটা গুদাম। মেঝে থেকে হাত পর্যন্ত জিনিসপত্রে বোঝাই। টেবিল, চেয়ার, ট্রাংক, আলমারি, লণ্ঠন, কাজের যন্ত্রপাতি, জমকালো পোশাক, তৈজসপত্র, গোসল করার ব্রিট গামলা আর আরও নানা জিনিস। দুই চাকার একটা রানো ঠেলাগাড়িও দেখা গেল। দেখে তিন গোয়েন্দার মতোই স্তব্ধ হয়ে গেছেন রাশেদ পাশাও।

অনেক ঘর ছিলো আলভারেজদের, জানালো রিগো। এখন অবশিষ্ট আছে মাত্র একটা হাসিয়েনডা। ওসব ঘরের প্রায় সমস্ত জিনিসপত্ৰই এনে রাখা হয়েছে এখানে।

সব কিনবো আমি! ঘোষণা করে দিলেন রাশেদ পাশা। এই দেখো দেখো! প্রায় চিৎকার করে বললো রবিন। পুরানো আরমার! একটা হেলমেট, একটা ব্রেস্ট-প্লেট …

…একটা তলোয়ার, একটা জিন! রবিনের কথাটা শেষ করলো মুসা। দেখো, জিনের গায়ে আবার রূপার কাজ!!

মালপত্রের মাঝে মাঝে সরু গলিমতো করে রাখা হয়েছে ভেতরে ঢোকার জন্যে। ঢুকে পড়লো তিন গোয়েন্দা। তালিকা তৈরি করার জন্যে সবে নোটবুক ব্বে করেছেন রাশেদ পাশা, এই সময় বাইরে শোনা গেল চিৎকার।

ভালো করে শোনার জন্যে কান পাতলে সবাই। আবার শোনা গেল চিৎকার। স্পষ্ট বোেঝা গেল এবার কি কলহেঃ আন্ন! আগুন!

আগুন লেগেছে! জিনিস দেখা বাদ দিয়ে দৌড় দিলো সবাই দরজার দিকে।

<

Super User