ছেলেমেয়েদেরকে নিয়ে বেরোলেন মিসেস পারকার। ঘুরে ঘুরে শহর দেখলেন, কেনাকাটা করলেন বড়দিনের জন্যে, উপহার কিনলেন।

পরের দিনও একইভাবে কাট।

তার পরের দিন সকালে উঠে জিনার মা বললেন, রাস্তার মোড়ে একটা সিনেমা হল আছে না? তাতে ডিজনির একটা ছবি চলছে। বিকেলে যাবি নাকি দেখতে? আমি অবশ্য যেতে পারব না। কাল নিলাম হবে, আজই গিয়ে জিনিসগুলো দেখে আসতে হবে। পছন্দ করে রেখে আসব। চাইলে যেতে পারিস আমার সঙ্গে।

মায়ের সঙ্গেই যেতে চাইল জিনা। সিনেমা পছন্দ করে না সে তা নয়। কিন্তু হলে রাফিয়ানকে ঢুকতে দেয়া হবে না, আর ওকে ফেলে যেতে রাজি নয় সে। তাড়াতাড়ি বলল, আমি তোমার সাথে যাব। নিলাম ডাকাই দেখব।

কিশোর বলল। আমিও।

আমিও যাব, রবিন বলল।

মুসার সিনেমা দেখতে যাবারই ইচ্ছে ছিল, কিন্তু সবাই যাচ্ছে অন্যখানে, সে। একা যায় কি করে?

বেশ, মা বললেন, যাবে। কাগজে পড়লাম, এক বৃদ্ধা মহিলার মাল নিলাম। হবে। মারা গেছেন। তাঁর নাম ছিল মিস আরনিকা মেয়ারবাল। আত্মীয়স্বৰ্জন কেউ নেই। অনেক ভাল ভাল জিনিস আছে শুনেছি। সেল-রুমে দেখানোর জন্যে আজ ওগুলো রাখা হবে। আগ্রহী যে-কেউ গিয়ে দেখতে পারে।

সেদিন বিকেলে ট্যাক্সিতে করে রওনা হল ওরা। শহরের একপ্রান্তে বাড়িটা। দেখানোর ব্যবস্থা হয়েছে ৮ নাম্বার কামরায়। ইতিমধ্যেই ভিড় হয়ে গেছে। পুরানো আসবাবপত্র আর অন্যান্য জিনিস দেখছে। ছোটখাট কিছু জিনিস রয়েছে কাচের বাক্সে, নিশ্চয় খুব দামি ওগুলো। প্রহরী রয়েছে, যারা আসছে যাচ্ছে নজর রাখছে তাদের ওপর।

দরজার পাশে রাখা হয়েছে বাক্সগুলো। সুন্দর সুন্দর চীনা অলঙ্কার, ব্রোঞ্জের ছোট মূর্তি, হাতির দাঁতে খোদাই করা নানারকম চমৎকার জিনিস। অনেকক্ষণ ধরে পঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওগুলো দেখলেন মিসেস পারকার, ছেলেময়েরাও দেখল। কারোরই বুঝতে অসুবিধে হল না জিনিসগুলো অনেক দামি। তারপর ওরা চলল আসবাব দেখতে। বড়গুলোর দিকে একবার চেয়েই চোখ ফিরিয়ে নিলেন মিসেস পারকার তারপর হোট একটা আর্মচেয়ারের সামনে এসে দাঁড়িয়ে গেলেন।

এই আদলের চেয়ারগুলোকে বলে টাব চেয়ার, বললেন তিনি। সুন্দর, না?

হ্যাঁ, রবিন বলল, সুন্দর।

বসতেও বোধহয় খুব আরাম,মুসা বলল। তার কথায় হেসে উঠল সবাই।

খুব দ্র হয়ে রইল রাফিয়ান। ঢোকার সময় প্রহরীরা তার দিকে ভুরু কুঁচকে তাকালেও পরে নিশ্চয় তাদের মত পরিবর্তন করেছে। মুসার কথায় যেন একমত হয়েই চেয়ারটার দিকে তাকাল সে, যেন বলতে চাইছে, হা, কওলী পাকিয়ে ওয়ে ঘুমাতে বেশ আরাম লাগবে।

ওটা নেবে নাকি তুমি, মা? জিনা জিজ্ঞেস করল।

বাড়িতে সিটিং রুমে রাখলে ভালই হবে, কি বলিস? মা বললেন।

হ্যাঁ, তা লাগবে, জবাবটা দিল কিশোর।

দেখি, দামে বলে নিয়ে নেব কাল, মা বললেন।

চেয়ারটাকে কাছে থেকে আরও ভালমত দেখার ইচ্ছে মিসেস পারকারের, কিন্তু একটা লোকের জন্যে পারছেন না। ঢাকার পর থেকেই সেই যে ওটার কাছে দাঁড়িয়ে আছে তো আছেই, ঘুরেফিরে চারপাশ থেকে দেখছে। সরার নামও নেই। চেয়ারটার সামনের দিকে এসে ঘাড় কাত করে দেখতে লাগল। মখমলে মোড়া গদি, রঙ চটে গেছে। এছাড়া আর সব ভালই আছে জিনিসটার। চেয়ারের পিঠে হাত বুলিয়ে দেখল সে, হাতল দেখল, পায়া দেখল। তারপর যেন নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও সরে গেল ওখান থেকে।

এইবার মিসেস পারকারের দেখার পালা।

লোকটাকে সুবিধের লাগল না, নিচু গলায় বলল জিনা, তাই না? আমি শিওর, কাল নিলামে সে-ও আসবে। চেয়ারটা নিতে চাইবে।

 

জিনার অনুমান ঠিকই হল। পরদিন লংফীন্ডের সেল-রুমে পৌঁছে ওরা দেখল, লোকটা আগেই চলে এসেছে। ভিড়ের মধ্যে দেখা গেল তাকে।

ওই যে, ফিসফিসিয়ে জিনা বলল। টাব চেয়ারের আরেক ক্রেতা।

বেড়টা বেশ সাইজমত, হেসে বলল মুসা, চেয়ারটা ওরই নেয়া উচিত। বসলে মানাবে ভাল। মুখটা দেখছ? আস্ত এক কোলাব্যাঙ।

হাসি চাপল কিশোর। কিন্তু রবিন ফিক করে হেসে ফেলল। ঠিকই বলেছে মুসা। ব্যাঙই। ব্যাঙের মত চওড়া পাতলা ঠোঁট, গোল গোল চোখ যেন বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে কোটর থেকে।

ডাক শুরু হল। চড়া দামে বিক্রি হয়ে গেল কয়েকটা আসবাব। তারপর দুজন লোক চেয়ারটা ধরাধরি করে এনে রাখল মঞ্চে, যাতে সবাই দেখতে পায়। ডাক শুরুর অনুরোধ জানাল নিলামকারী।

তিরিশ পাউন্ড থেকে শুরু হল।

চল্লিশ! বলল একজন।

পয়তাল্লিশ! আরেকজন।

পঞ্চাশ! বলল অন্য আরেকজন।

দাম উঠছে। চেয়ারটার ওপর অনেকের চোখ পড়েছে বোঝা গেল। তবে পঁচাত্তরের পর দুজন বাদে সবাই চুপ হয়ে গেল। সেই দুজন হল কোলাব্যাঙ, আর মিসেস পারকার।

আশি! লোকটা বলল।

নব্বই! মিসেস পারকার বললেন।

পঁচানব্বই!

একশো!

ছেলেমেয়েরা বুঝতে পারল, এর বেশি আর দাম দেবেন না মিসেস পারকার। সামান্য একটা চেয়ারের জন্যে, অ্যানটিক মূল্য যতই থাক ওটার, একশোই যথেষ্ট। আগের রাতে জিনার বাবার সঙ্গে চেয়ারটা নিয়ে কথা হয়েছে তাঁর। ঠিক করেছেন দুজনেই, একশোর বেশি হলে নেবেন না। লোকটা কি এর বেশি দেবে? কিছু বলল না লোকটা। ভাবহে বোধহয়। কাশলো একবার।

হাতুড়ি ঠকতে শুরু করল নিলামকারী, একশো পাউও!…একশো পাউওে গেল গেল…আর কেউ কিছু বলবেন…নেই?…বেশ…ওয়ান…টু…।

ছেলেমেয়েরা জানে, লোকটা থ্রি বললেই ডাক শেষ হয়ে যাবে। তারমানে যে বেশি হেঁকেছে, জিনিসটা তার হয়ে যাবে। হাতুড়ি তুলল লোকটা। নামিয়ে আনতে শুরু করল। ঠুকবে, এবং খ্রি বলবে।

শেষ মুহর্তে হাত তুলতে আরম্ভ করল কোলাব্যাঙ। তারমানে আরও বেশি ডাকতে যাচ্ছে সে। হাতটা পুরো তুলতে পারলেই হয়ে যেত, কিন্তু সেই মুহূর্তে  ভাগ্য বিরূপ হল তার। ভিড়ের মধ্যে আঁউ করে উঠল একজন লোক। পরক্ষণেই ধাক্কা খেয়ে যেন কাত হয়ে গেল মুসা, পড়ল একেবারে লোকটার ওপর। কখন তার পাশে চলে গেছে, উত্তেজনায় খেয়াল করেনি জিনা কিংবা রবিন।

ব্যাঙমুখো লোকটা আর ডাকতে পারল না, তার আগেই নিলামকারীর হাতুড়ি ঠকাস করে পড়ল টেবিলে, বলল, থ্রি!

টাব চেয়ারটার মালিক হয়ে গেলেন মিসেস পারকার। খুব খুশি হলেন জিনিসটা পেয়ে।

ভিড় থেকে বেরিয়ে এল ছেলেমেয়েরা।

হেসে মুসা বলল, আমার জন্যেই পেয়েছেন তিনি ওটা, তাই না? একেবারে সময়মত ধাক্কা মারল আমাকে পাশের লোকটা।

তুমি ওখানে গেলে কখন? জিনার চোখে সন্দেহ। কিভাবে?

গেছি। দায়সারা জবাব দিয়ে দিল মুসা।

ইচ্ছে করেই গেছো, তাই না? ভুরু কোঁচকালো রবিন।

চট করে কিশোরের দিকে তাকাল মুসা।

একসাথে গোয়েন্দাপ্রধানের দিকে ঘুরে গেল রবিন আর জিনা।

হেসে আরেক দিকে মুখ ফেরাল কিলোর।

একেবারে রামচিমটি কেটেছি, বুঝলে, হেসে বলল মুসা। পাশের লোকটাকে এমন জোরে চিমটি দিলাম, আঁউ করে উঠে ধাক্কা মারল আমাকে। সহজেই সামলে নিতে পারতাম ধাক্কাটা। কিন্তু কেন সামলাব বল?

কাজটা কিন্তু উচিত হল না, জিনা বলল। মা শুনলে রাগ করবে। চেয়ারটা নেবে না, লোকটাকে দিয়ে দেবে।

বলতে যাচ্ছে কে তাঁকে? কিশোর বলল। আমরা বলছি না। তুমি বলবে?

নাহ্‌, হেসে ফেলল জিনা।

হুফ! করে উঠল রাফিয়ান। যেন কথা দিল, সে-ও মুখ বন্ধ রাখবে।

মিসেস পারকার চেয়ারটা পেয়ে যাওয়ায় ছেলেমেয়েরা খুবই খুশি হল। ওরা। কথা বলছে, তিনি ওটার দাম মিটিয়ে দিয়ে এলেন। তিনি যেমন খুশি হয়েছেন, তেমনি বেজার হয়েছে ব্যাঙমুখখা। সেল-রুম অ্যাসিসটেন্টকে বললেন মিসেস পারকার, চেয়ারটা কোথায় দিয়ে আসতে হবেঃ ১৬ লাইম অ্যাভেন্য, ৩ নাম্বার ফ্ল্যাট।

এই সময় তাঁর কাছে এসে দাঁড়াল লোকটা। জোর করে মুখে হাসি টেনে বলল, বিরক্ত করতে এলাম, ম্যাডাম, কিছু মনে করবেন না। ওই চেয়ারটা সত্যিই আমার খুব পছন্দ…না না, দরকার। আপনি বিক্রি করে দিন আমার আছে। আপনি যা দিয়েছেন, তার চেয়ে অবশ্যই বেশি দেব।

লোকটার দিকে মুখ তুলে তাকালেন মিসেস পারকার। ভাল পোশাক পরেছে লোকটা, কথাবার্তাও বেশ দ্র। কিন্তু তারমাঝেও সূক্ষ্ম একটা হুমকির ভঙ্গি রয়েছে, এবং সেটা তাঁর কান এড়ালো না। এই ব্যাপারটা মোটেও পছন্দ হল না তাঁর। সরি, শীতল কণ্ঠে বললেন তিনি। চেয়ারটা আমারও খুব পছন্দ। বিক্রি করব না।

তর্ক করার চেষ্টা করল লোকটা। থামিয়ে দিলেন মিসেস পারকার। আশেপাশের লোকেরাও ধমক লাগাল লোকটাকে, চুপ করার জন্যে, নিলামের ডাক শুনতে অসুবিধে হচ্ছে। রাগে গটমট করে দরজার দিকে এগোল ব্যাঙমুখখা।

।খাইছে! মুসা বলল। লোকটা বুঝতে পারেনি, আমি ইচ্ছে করে… জিনার মায়ের দিকে তাকিয়ে থেমে গেল সে। খুব খারাপ লোক!

হ্যাঁ, আনমনে মাথা ঝাঁকালেন মিসেস পারকার। মুসার কথা বুঝতে পারেননি।

নিলাম দেখার জন্যে আরও কিছুক্ষণ থাকলেন ওখানে মিসেস পারকার। আরেকটা জিনিস পছন্দ হল তাঁর। আগের দিন ওটা চোখে পড়েনি। ছোট একটা লেখার টেবিল। ওটার জন্যে তেমন প্রতিযোগিতা হল না, সস্তায়ই কিনে ফেললেন। সেল-রুম অ্যাসিসটেন্ট জানাল, আগামী দিন জিনিসগুলো পৌঁছে দেয়া হবে ঠিকানামত।

এখানে তো নাহয় পৌঁছে দিল, জিনা বলল, কিন্তু বাড়িতে নেমে কি করে, মা?

সেটা দেখা যাবে। স্টীমারেও নেয়া যায়। প্লেনেও।

একজায়গায় ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকতে আর ভাল লাগছে না রাফিয়ানের। এই কোলাহল, লোকজন তার পছন্দ হচ্ছে না। তাছাড়া মঞ্চের ওপর কি ঘটছে, তা-ও দেখতে পাচ্ছে না। উসখুস শুরু করল সে। মাথায় হাত বুলিয়ে তাকে শান্ত করল জিনা।

ফ্ল্যাটে ফিরে এল ওরা। কিছু নাস্তা খেয়ে রাফিয়ানকে নিয়ে হাঁটতে বেরোল জিনা আর তিন গোয়েন্দা।

একেকজন একেক কথা বলছে। কিশোর হাঁটছে নীরবে। আনমনে নিচের ঠোঁটে চিমটিও কাটল বার দুই।

ব্যাপারটা লক্ষ্য করল রবিন। জিজ্ঞেস করল, এই কিশোর, কি ভাবছ? সেই সেল-রুম থেকেই দেখছি, বড় বেশি চুপচাপ তুমি। কি ব্যাপার?

ভাবছি ব্যাঙমুখোর কথা। চেয়ারটার জন্যে বড় বেশি আগ্রহ তার। একজন কিনে নেবার পরও সেটা বেশি দাম দিয়ে তার কাছ থেকে কিনতে চাইল। ভাবনার বিষয়, তাই না?

 

পরদিন সকালে দিয়ে গেল টাব, চেয়ার আর ছোট ডেস্কটা। যারা নিয়ে এসেছে, তাদেরকে বকশিশ দিতে গেলেন মিসেস পারকার। ইতিমধ্যে মালগুলো বয়ে সিটিং রুমে নিয়ে এল ছেলেময়েরা। ডিসেম্বরের উজ্জ্বল সূর্যালোকে ভরে গেছে ঘর। ময়লা হয়ে আছে চেয়ার, ডেস্ক, দুটোই। পরিষ্কার করতে লেগে গেল ওরা।

লোকগুলো বেরিয়ে যাওয়ার পর সবে দরজা বন্ধ করেছেন মিসেস পারকার, আবার বেজে উঠল দরজার ঘন্টা। অবাক হলেন তিনি। কারও তো আসার কথা নয়! দরজা খুললেন আরেকবার।

দাঁড়িয়ে রয়েছে কোলাব্যাঙ! আগের দিন নিলামে তার সঙ্গে যে লোকটা প্রতিযোগিতা করেছিল। মুখ খুলতে যাচ্ছিলেন তিনি, তার আগেই বলে উঠল সে, ঠিক একইরকম দ্র কঠে, প্লীজ, ম্যাডাম, আমাকে অন্তত কথা বলতে দিন। আপনাকে বার বার বিরক্ত যে করছি, তার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। সত্যি বলছি, বিশ্বাস করুন আমার কথা।

কি বলবেন বুঝতে পারলেন না মিসেস পারকার। সরে দাঁড়ালেন। ঘরে ঢুকল লোকটা। পরিচয় দিল, আমার নাম রবার্ট ম্যাকি। একটা দোকান আছে আমার, কিউরিও আর ভনির বিক্রি করি। মিমোসা অ্যাভেন্যুতে। কাল যে চেয়ারটা আপনি কিনে এনেছেন, ওটার জন্যে অনেকদিন অপেক্ষা করেছি…যার জিনিস তিনি আমার বন্ধু ছিলেন। ওই চেয়ারটা আমি তার স্মৃতি হিসেবে রেখে দিতে চাই। প্রায়ই বসতেন তিনি ওটায়। আর যে ডেটা কিনেছেন আপনি, লেখাপড়ার কাজ ওটাতেই বেশি করতেন মিস মেয়ারল। টেবিল আমার দরকার নেই, শুধু চেয়ারটা পেলেই চলবে। দেখে মনে করতে চাই তাঁর কথা।

গল্পটা আন্টিকে নাড়া দিত অবশ্যই, যদি লোকটা আন্তরিক হত, কিন্তু তার কথা আর মুখের ভাবে কোন মিল দেখলেন না তিনি।

ঠাণ্ডা গলায় বললেন মিসেস পারকার, চেয়ারটা আমার খুব পছন্দ, কালই বলেছি। আমি ওটা রাখার জন্যেই কিনেছি। আর স্মৃতির ব্যাপার তো? মিস মেয়ারবালের ব্যবহার করা আরও অনেক জিনিস আছে, ওগুলো থেকে কোন একটা বেহে কিনে রেখে দিন।

কিন্তু আমি…মানে…ওই চেয়ারটাই…ওটা আমার দরকার! ওটাই বেশি ব্যবহার করতেন কিনা মিস মেয়ারবাল… যাকগে। ভাল দাম দিতে রাজি আছি। আমি। এই ধরুন, একশো পঞ্চাশ ডলার?

খুব বিরক্ত হলেন আন্টি। কড়া গলায় জবাব দিয়ে দিলেন, দাম ডাবল করে দিলেও বেচবেন না তিনি। তারপর বললেন, ব্যাপারটা টাকার নয়, পছন্দের। আমি ওটা কোন দামেই বেচব না। ঠিক আছে?

চেয়ার ঝাড়ার জন্যে একটা ঝাড়ন আনতে রান্নাঘরে চলেছিল জিনা, যেতে হয় হলঘর পেরিয়ে, এই সময় বেল বাজিয়েছে ম্যাকি। লোকটাকে দরজায় দেখেই তাড়াতাড়ি সিটিং রুমে ফিরে এসে বন্ধুদেরকে খবর জানিয়েছে জিনা। পা টিপে টিপে তিন গোয়েন্দাও এসে দাঁড়িয়েছে তখন দরজার বাইরে। কেরিআন্টি আর লোকটার সব কথা শুনেছে।

চেয়ার বিক্রি করতে তাকে কিছুতেই রাজি করাতে পারল না লোকটা। ও চলে গেলে দরজাটা আবার ভালমত লাগিয়ে দিলেন আন্টি।

ছেলেমেয়েরা এসে ঢুকল হলঘরে।

আস্ত শয়তান! জিনা বলল। আবার এসে হজির হয়েছে চেয়ার কিনতে। ব্যাটা ঠিকানা পেল কোথায়?

ওটা কোন ব্যাপার না, মা বললেন। সেলস-রুম অ্যাসিসটেন্টদের ঠিকানা দিয়ে এসেছিলাম। ওদের কাছ থেকে জোগাড় করে নিয়েছে হয়ত।

কিংবা আপনি যে বলেছেন কাল, সেটাই হয়ত শুনেছে, কিশোর বলল। বেশ জোরেই তো বললেন।

হ্যাঁ, মুসা মাথা দোলাল, ব্যাটা শুনেছে। তারপর এসে দাঁড়িয়েছিল বাড়ির বাইরে। লোকগুলো জিনিস রেখে বেরিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এসে বেল বাজিয়েছে।

অতি আগ্রহ, রবিন বলল। চেয়ারটা সুন্দর, সন্দেহ নেই, তবু পুরানো একটা চেয়ারের জন্যে এত আগ্রহ কেন?

ভ্রূকুটি করল কিশোর। সৃতি-ফিতি সব বাজে কথা। অন্য কারণ আছে। এমন কোন দামি চেয়ার নয় ওটা, দুর্লভও নয়। খুঁজলে ঠিক ওরকম মডেলের চেয়ার অনেক পাবে এই শহরে। মিথ্যে কথা বলছিল সে, বোঝাই গেছে। স্মৃতির জন্যে ওই চেয়ারটাই একমাত্র জিনিস নয়, আন্টি ঠিকই বলেছেন।

এর মাঝেও রহস্য খুঁজে পেলে নাকি? হাসতে হাসতে বলল মুসা। পেয়ে গেছ গন্ধ?

হ্যাঁ, পেয়েছি, বেশ জোর দিয়ে বলল কিশোর। ওই ব্যাঙমুখো লোকটাকে মোটেই ভাল লাগেনি আমার।

আমারও না, বলে বেরিয়ে গেলেন আন্টি। রান্নাঘর থেকে ব্রাশ আর একটা হোট ভ্যাকুয়াম ক্লিনার নিয়ে এলেন। এই নাও, ওগুলো পরিষ্কার করে ফেল গিয়ে।  আমি রান্না করতে যাচ্ছি।

সিটিং রুমে ফিরে এল ওরা। পুরানো জিনিস সাফ করতে অভ্যস্ত তিন গোয়েন্দা, প্রায়ই একাজ করতে হয় তাদেরকে স্যালভিজ ইয়ার্ডে। জিনা পারে না এসব। করতে দিলে আরও নষ্ট করবে।

ডেস্কটায় হাত লাগাল কিশোর আর মুসা। রবিন ব্রাশ দিয়ে চেয়ারের গদির ধুলো ঝাড়তে লাগল। জিনা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে। রাফিয়ান শুয়ে আছে রোদে পিঠ দিয়ে। আয়েসী ভঙ্গিতে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে তিন গোয়েন্দার কাজ।

ধুলো বেশি নেই,ব্রাশটা রেখে দিল রবিন।

ব্যাঙটা তো বললই, জিনা বলল। বুড়ো মহিলা নাকি প্রায়ই বসতেন এই চেয়ারে। মুছে-টুছে রাখতেন আরকি।

চেয়ারের হেলানের সঙ্গে সিটটা যেখানে জোড়া দেয়া হয়েছে, ওই ফাঁক, আর হাতলের নিচের ধুলো বের করা সব চেয়ে কঠিন। ধুলো ওসব জায়গায়ই জমে। বেশি, রবিন বলল। হাত ঢুকিয়ে দিল ফাঁকটায়। হঠাৎ স্থির হয়ে গেল সে। কিশোর, কি যেন লাগছে! কোনভাবে ঢুকে গিয়েছিল ফাঁকের মধ্যে!…না, আপনাআপনি ঢুকতে পারবে না, বেশ বড়ই লাগছে। নিশ্চয় ইচ্ছে করে ঢুকিয়ে রাখা হয়েছে ওখানে।

বকের মত গলা বাড়িয়ে এল জিনা। কি জিনিস? বের করা যায় না?

বেশ কিছুক্ষণ চেষ্টার পর বের করে আনতে পারল রবিন। চ্যাপ্টা একটা বাক্স, ফ্যাকাসে নীল রঙ।

আরি, গহনার বাক্স মনে হচ্ছে! জিনা বলল।

ডেস্ক মোছা বাদ দিয়ে কাছে এসে দাঁড়াল কিশোর আর মুসা।

খোলো খোলো, জলদি! মুসা বলল।

রবিনের হাত থেকে নিয়ে বাক্সটা খুলল জিনা। মুক্তাআ! চেঁচিয়ে উঠল সে।

আশ্চর্য! বিড়বিড় করল কিশোর।

দারুণ একখান নেকলেস! মুসা বলল। কটা মুক্তো আছে?

আসল তো? রবিনের প্রশ্ন।

মনে তো হচ্ছে, জিনা বলল। চলো, মাকে দেখাই।

রান্নাঘরে ছুটে এল ওরা। পেছনে লাফাতে লাফাতে এল রাফিয়ান।

মা, মাআ! চেঁচিয়ে বলল জিনা, দেখ, কি পেয়েছি!

<

Super User