অ্যাই, শুনছ? কিশোরের ওয়ার্কশপে স্পীকারে ভেসে এল ফারিহার গলা। আছ নাকি ওখানে?
আছে ঠিকই, তবে জিভ যেন জড়িয়ে গেছে। কথা বেরোচ্ছে না মুখ দিয়ে। কতবার খেয়েছে চিকেন কিঙের রেস্টুরেন্টে? শতবার? হাজার বার? কিশোরই খেয়েছে এতবার, খাবারের প্রতি যার ঝোক নেই তেমন। আর মুসা যে কতবার খেয়েছে তার তো হিসেবই করতে পারবে না। চোখে ভাসছে, টিভির পর্দায় দেখা হার্বার্ট লারসেনের চেহারা। চেহারাটাকে নিস্পাপ করে তুলে নিরীহ কণ্ঠে বলেন, আমার মুরগী সেরা মুরগী। খেয়ে খারাপ বলতে পারলে পয়সা ফেরত।
চিকেন লারসেন… খাবারে বিষ মেশায়…? বিড়বিড় করছে মুসা। বিশ্বাস করতে পারছে না। আনমনে মাথা ঝাঁকিয়ে চলেছে। আমার বিশ্বাস হয় না!
হওয়ার কথাও নয়, কিশোর বলল। নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটল একবার চিন্তিত ভঙ্গিতে। চাচী প্রায়ই বলে, আপাতদৃষ্টিতে যেটা ঠিক মনে হরে সেটা ঠিক -ও হতে পারে। কেন একেবারে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলছি আমরা?
মানে?
মানে, চিকেন লারসেনকে দোষ দিচ্ছি কেন আমরা? ঘোরের মধ্যে তাঁর কথাই বলছে জুন, কি করে জানছি? নাম তো আর বলেনি। অন্য কারও কথাও বলে থাকতে পারে, যে খাবারে বিষ মেশাচ্ছে। মস্ত একটা শক খেয়েছে সে। নানারকম ওষুধ দেয়া হচ্ছে। ওষুধের কারণেও দুঃস্বপ্ন দেখে অনেক সময় রোগী। হতে পারে ব্যাপারটা পুরোই দুঃস্বপ্ন।
অ্যাই, শোনো, ফারিহা বলল। জুনের মুখের কাছেই নিয়ে যেতে পারতাম। তাহলে নিজের কানেই শুনতে পারতে। কিন্তু কর্ডটা অতদূর যায় না। যতটা সম্ভব কাছে নিয়ে যাচ্ছি।…শোননা। শুনতে পাচ্ছ?
মাথা নাড়ল মুসা। কিশোর বলল, না। কি বলে?
আবার সেই একই কথা, ফারিহা বলল। বলছে, না না, দিও না…লোক মারা যাবে! ওকাজ কোরো না!
ও-কে, কিশোর সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। কাল সকাল এগারোটায় জুনের সঙ্গে কথা বলব। ভিজিটিং আওয়ার স্টার্ট হলেই চলে আসব। দেখা যাক, ঘুম ভাঙে কিনা, কিছু বলতে পারে কিনা স্বপ্নের ব্যাপারে।
ভালই হয় এলে। তবে আমি বাজি রেখে বলতে পারি, রহস্য একটা আছেই। পেয়ে যাবে।
কাল সকালে দেখা হবে, ফারিহা, মুসা বলল।
লাইন কেটে দিল কিশোর।
সে রাতে ভালমত ঘুমাতে পারল না কিশোর। ভাবছে, কোন লোকটা লক্ষ লক্ষ মানুষকে বিষ খাওয়াতে চায়? কেন? চিকেন লারসেন? নাকি কোন খেপাটে সন্ত্রাসী, যার দলের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে জুন? নাকি লারসেনের ব্যবসার ক্ষতি করার জন্যে কেউ বিষ মিশিয়ে দিচ্ছে মুরগীর মাংসে তৈরি তার বিখ্যাত খাবারগুলোতে?
রাত একটায় রবিনকে ফোন করল কিশোর। পেল না বাড়িতে। তখনও ফেরেনি।
দুটোয় আবার করল। এইবার পেল। সব কথা জানিয়ে বলল, সকালে যেন হাসপাতালে হাজির থাকে।
কিশোরের ফোন পাওয়ার পর রবিনেরও ঘুম হারাম হয়ে গেল। সে-ও ভাবতে লাগল একই কথা, কে এ রকম পাইকারী হারে মানুষ মারতে চায়?
ফারিহাও ঘুমোতে পারছে না। জেগে রয়েছে বিছানায়। কান পেতে রয়েছে। আর কিছু বলে কিনা শোনার জন্যে। যতবারই গুঙিয়ে ওঠে জুন, সঙ্গে সঙ্গে জিজ্ঞেস করে সে, জুন, কে? কৈ মুরগীতে বিষ মেশাচ্ছে বলো তো? কিন্তু জবাব দেয় না জুন।
মরার মত ঘুমিয়েছে কেবল মুসা। তার কোন প্রতিক্রিয়া হয়নি।
পরদিন সকালে জানালা দিয়ে যখন হাসপাতালের ঘরে রোদ এসে পড়েছে, তখন সেখানে পৌঁছল কিশোর আর মুসা।
প্রথমেই লক্ষ্য করল কিশোর, ফারিহাকে ক্লান্ত দেখাচ্ছে। ঘরে ফুলদানীর সংখ্যা অনেক বেড়েছে, আর তাতে অনেক ফুল। জুনের বিছানার পাশে একটা চেয়ারে বসে আছে একটা স্টাফ করা মুরগী, মাথায় সোনালি মুকুট। পর্দা টেনে ঘিরে দেয়া হয়েছে জুনের বিছানা।
পর্দা টানা জায়গাটার দিকে আঙুল তুলে জিজ্ঞেস করল কিশোর। জুন কোথায়? এখুনি ওর সঙ্গে কথা বলে রহস্যটার একটা সমাধান করে ফেলতে চায়। আর কেউ আছে?
শশশ! ঠোঁটে আঙুল রেখে কিশোরকে আস্তে কথা বলতে ইঙ্গিত করল ফারিহা। ফিসফিসিয়ে বলল শুধু, জুন ঘুমিয়ে আছে।
এই সময় ঘরে ঢুকল রবিন।
সরি। দেরি হয়ে গেল। গাড়িটা ট্রাবল দিচ্ছিল। পুরানো ফোক্সওয়াগনটা বিক্রি করে দিয়ে আরেকটা গাড়ি কিনেছে রবিন। লম্বা, একহারা শরীর। গায়ের কটন সোয়েটারটা খুলে গলায় পেঁচিয়ে রেখেছে। কয়েক বছর আগেও সে ছিল রোগাটে, হালকা পাতলা এক কিশোর। পায়ে চোট পেয়েছিল। পাহাড়ে চড়তে গিয়ে ভেঙে ফেলেছিল হাড়। সেটা বড় যন্ত্রণা দিত মাঝে মাঝে। এখন সব সেরে গেছে।
অনেক বদলে গেছে রবিন। লম্বা হয়েছে। গায়ে মাংস লেগেছে। চেহারায় চাকচিক্য। ধোপদুরস্ত পোশাক পরে। চাকরি করে বার্টলেট লজের ট্যালেন্ট এজেন্সিতে। কারাতের ট্রেনিং নিচ্ছে। ওকে দেখলে কেউ এখন কল্পনাই করতে পারবে না এই রবিন মিলফোর্ডই পার্ট টাইম চাকরি করত রকি বীচের লাইব্রেরিতে, আর বইয়ে মুখ গুঁজে থাকত। রকি বীচ হাই স্কুলে মেয়েমহলে রবিন এখন একটা পরিচিত প্রিয় নাম।
কোথায় আমাদের কেস? হেসে জিজ্ঞেস করল রবিন। ডানা মেলে উড়ে গেল না তো চিকেন প্রিন্সেস?
কেস ওই পর্দার আড়ালে, মাথা নেড়ে পর্দাটা দেখিয়ে দিল মুসা। ওর সঙ্গে কথা বলতে পারিনা আমরা।
চেষ্টা করলে কিশোর পারবে, হেসে বলল রবিন। তবে যুক্তি দেখাতে গেলে মুখ খুলবে কিনা…
খোলার অবস্থাতেই নেই এখন, নিচু গলায় বলল ফারিহা। অন্তত শান্ত তো হয়ে আছে। কাল রাতে যা করেছে না! কয়েকজন লোকও এসেছিল দেখা করতে।
রাত দুপুরে! অবাক হলো কিশোর। লাল চুলওয়ালা ওই নার্সের চোখ এড়াল কিভাবে?
শ্রাগ করল ফারিহা। রহস্যময় ব্যাপার, তাই না? কারা ওরা?
ঘণ্টায় ঘণ্টায় এসেছে চিকেন লারসেন। গোটা দুই ফ্রী কুপনও দিয়েছে আমাকে।
সবাইকেই খালি কুপন বিলাচ্ছে। আর কে এসেছে?
টম হামবার নামে একটা সুন্দর লোক। নাম জানলে কি করে? মুসা জিজ্ঞেস করল।
কেন, গোয়েন্দা কি শুধু তোমরাই? ভুরু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করল ফারিহা। জিজ্ঞেস করেছিলাম। জুনের বয়ফ্রেন্ড ছিল এক সময়। ভোর চারটের দিকে এসেছিল সে। জুনের দিকে তাকিয়ে বসেছিল। যেন পাহারা দিচ্ছিল ওকে। তারপর ভোরবেলা এল আরেকজন। নাম বলল হেনা তানজামিলা। জুনের কলেজ হোস্টেলের নাকি রুমমেট সে।
হুমম, মাথা দোলাল কিশোর। ওর কথা ভুলে যেতে পারি আমরা।
কেন? রবিনের প্রশ্ন।
কারণ, জুন বলেছে লোকটা খাবারে বিষ মেশাচ্ছে। আর ওই টমকে নিয়েও মাথাব্যথা নেই আমার। একজন ভূতপূর্ব বয়ফ্রেন্ড লাখ লাখ লোক মারার প্ল্যান করবে বলে মনে হয় না।
প্রতিশোধ নিতে চাইলেও না?
লাখ লাখ লোকের ওপর কিসের প্রতিশোধ নেবে?
আগেই তর্ক শুরু করে দিলে, বাধা দিয়ে বলল ফারিহা। চার নম্বর রহস্যময় লোকটার কথা তো এখনও শোনাইনি। কণ্ঠস্বর যতটা সম্ভব খাদে নামিয়ে রাখার চেষ্টা করছে সে।
জুনের বিছানা ঘিরে টানানো পর্দার দিকে তাকাল চারজনে। যেন শিওর হতে চাইছে, জুন জেগে গেছে কিনা। তারপর লোকটার কথা বলতে লাগল ফারিহা, চার নম্বর ভিজিটরটি একজন লোক বটে! ভীষণ বদমেজাজী। বয়েস তিরিশ মত হবে। বেশ তাগড়া শরীর। একটা আর্মি ক্যামোফ্লেজ জ্যাকেট গায়ে দিয়ে এসেছিল। আমার ওপর চোখ পড়তেই জ্যাকেটের কলার তুলে নিয়ে মুখ আড়াল করে ফেলল। হতে পারে, চেহারাটা বেশি কুৎসিত, সে জন্যেই দেখাতে চায়নি।
নাম জিজ্ঞেস করেছ? মুসা জানতে চাইল।
করেছি। শুয়োরের মত ঘোৎ ঘোঁৎ করে চুপ থাকতে বলল। ধমক দিয়ে বলল, আমি ওর নাম জেনে কি করব? তারপর জুনের বিছানার চারপাশের পর্দাটা টেনে দিল যাতে আমি কিছু দেখতে না পারি।
তারপর? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
নানারকম খুটুরখাটুর শব্দ শুনলাম। মনে হলো, জুনের ওপাশে যতগুলো ড্রয়ার আছে সব খুলে খুলে দেখেছে।
তাড়াহুড়ো করে, না আস্তে আস্তে?
তাড়াহুড়ো করে।
হাসল কিশোর। তারমানে আন্দাজে কিছু করতে আসেনি। যা করতে এসেছে, জেনে বুঝেই এসেছে। কি খুঁজছিল, জানে।
কিন্তু পায়নি। খালি হাতে ফেরত যেতে দেখেছি।
পায়চারি শুরু করল কিশোর। জুন না জাগলে আর কিছুই জানা যাবে না।
আর জাগলে যেন ভিজিটিং আওয়ারে জাগে, মুসা বলল মুখ বাঁকিয়ে। নইলে যে নার্সের নার্স। এক্কেবারে দজ্জাল। একটা মুহূর্তও আর থাকতে দেবে না আমাদেরকে।
জুনের পর্দার কাছে গিয়ে উঁকিঝুঁকি দিতে আরম্ভ করল রবিন। অবস্থা খুব একটা খারাপ লাগছে না। খবরের কাগজগুলো মন্তব্য করছে, বেঁচে যে আছে এটাই ভাগ্য। অ্যাক্সিডেন্টে গাড়িটার নাকি সাংঘাতিক ক্ষতি হয়েছে, ঘুরে দাঁড়াল সে। দুর্ঘটনার জায়গাটা দেখেছ?
মাথা নাড়ল কিশোর। একভাবে পায়চারি করে চলেছে। এই সময় একগোছা ফুল নিয়ে ঘরে ঢুকল লাল চুলওয়ালা নার্স।
প্রথমে ফারিহার দিকে তাকাল সে, তারপর এক এক করে তিন গোয়েন্দার দিকে। তিনটে ছেলে! ফারিহার দিকে আবার তাকিয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, এত বন্ধু জুটিয়েছ কেন? রোগ না সারিয়ে আরও তত বাড়াবে। এতজনে দেখতে আসার কোন দরকার আছে? জুনের বিছানার কাছে ফুলগুলো রেখে দরজার দিকে এগোল সে। বেরোনোর আগে ফিরে তাকিয়ে বলল, আবার আসব আমি, যেন হুমকি দিয়ে গেল।
কেন আসবে? নার্স বেরিয়ে যাওয়ার পর বিড় বিড় করে যেন নিজেকেই প্রশ্ন করল মুসা।
ইনটারেসটিং, রেখে যাওয়া ফুলগুলো দেখতে দেখতে বলল রবিন। হেনরি অগাসটাস পাঠিয়েছে।
তাতে ইনটারেসটিঙের কি হলো? মুসা জিজ্ঞেস করল।
কারণ, অগাসটাস রেস্টুরেন্টের মালিক সে। চিকেন লারসেনের প্রতিযোগী।
তুমি জানলে কি করে? তোমার আর কিশোরের কাছে তো কোন রেস্টুরেন্টেরই কোন মূল্য নেই। আগের রাতে কুপন ছিড়ে ফেলার পর থেকেই বিরক্ত হয়ে আছে মুসা। রাগটা ঝাড়ল এখন।
হেসে ফেলল রবিন। মনে হচ্ছে তোমার খাওয়ায় বাদ সেধেছে কিশোর? ফ্রী কুপন দিয়ে গিয়েছিল নাকি চিকেন লারসেন?
দিয়েছিল, কিশোর জানাল। আজেবাজে জিনিস খেয়ে পেট নষ্ট হয়। সে জন্যে ফেলে দিয়েছি। আর কেউ কিছু মুফতে খেতে দিলেই খেতে হবে নাকি?
শব্দ করে হাসল রবিন। মুসার রাগের কারণ এখন পরিষ্কার। ওর দিকে তাকিয়ে বলল, না, রেস্টুরেন্টে খেতে গিয়ে হেনরির সঙ্গে পরিচয় হয়নি। অগাসটাস রেস্টুরেন্টের শুভ উদ্বোধনী দিনে একটা ব্যান্ড পার্টি পাঠাতে হয়েছিল আমাকে। আমিও গিয়েছিলাম সঙ্গে। টাইম যখন দিয়েছিল তার অনেক পরে এসেছিল হেনরি। ওকে ছাড়া কাজ শুরু করা যায়নি। ঝাড়া চারটে ঘণ্টা রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছিল আমাদের।
শক্রর মেয়েকে ফুল পাঠাল কেন কিছু আন্দাজ করতে পারো?
ওরকম করেই থাকে হেনরি। ব্যবসার কোন ট্রিকস হবে। তবে লোকটাকে বোধহয় তোমারও পছন্দ হবে না। শুনেছি, হেনরি আর চিকেন একজন আরেকজনের ছায়া দেখতে পারে না। লারসেন মরে গেলে তার চেয়ে বেশি খুশি আর কেউ হত না। মুখেও বলে সেকথা। লারসেন অতটা খারাপ লোক নন। মুখে কিছু বলেন না বটে, তবে অন্তরের ইচ্ছা একই হবে।
যাক, বাঁ হাতের তালুতে ডান হাতে ঘুসি মারল মুসা। সন্দেহ করার মত কয়েকজন পাওয়া গেল।
তা গেল, বলল কিশোর। কিন্তু কোন অপরাধ তো ঘটেনি। সন্দেহ করে কি হবে?
এই সময় দরজা খুললেন চিকেন লারসেন। ঘরে এত লোক দেখে যেন বরফের মত জমে গেলেন। তবে এক সেকেন্ডের জন্যে।
তার মুখের দিকে তাকাল কিশোর। গোলগাল চেহারা? চোখের কোণে কালি কেন? মেয়ের জন্যে দুশ্চিন্তায়? নাকি উন্মাদের দৃষ্টি? পাগলের চোখেও ও দৃষ্টি দেখেছে সে। খাবারে বিষ মিশিয়ে লাখ লাখ মানুষকে মেরে ফেলার কথা তার মেয়ে বলে ফেলেছে বলেও দুশ্চিন্তা হতে পারে। কোনটা?
দরজায় দাঁড়িয়েই তিনি বললেন, আমি আমার মেয়ের সঙ্গে কিছুক্ষণ একা থাকতে চাই। সুযোগ পাব?
অনিচ্ছা সত্ত্বেও বেরোতে হলো তিন গোয়েন্দাকে। চলে এল হলঘরে। চারপাশে একবার চোখ বোলাল কিশোর। তারপর হলের মাঝে নার্সরা যেখানে বসে সেদিকে এগোল। ডেস্কের পেছনে মাত্র একজন নার্স রয়েছে। সেই লাল চুলওয়ালা মহিলা। তার নেমট্যাগে লেখা রয়েছেঃ মারগারেট ইলারসন, আর এন।
শুনুন, মোলায়েম গলায় জিজ্ঞেস করল কিশোর। কাল রাতে এখানে কে ডিউটিতে ছিল বলতে পারবেন?
অবাক কান্ড! ভুরু কুঁচকে ফেলল মারগারেট, তুমি জিজ্ঞেস করার কে? শুনতে চাও? আমি ছিলাম। আমি। আরেকজন যার ডিউটিতে থাকার কথা, সে হঠাৎ করে বিয়ে করে বসেছে। কাজেই দিনরাত এখন আমাকে ডিউটি দিতে হচ্ছে। একটানা চব্বিশ ঘণ্টা।
হাসল কিশোর। তাতে উত্তেজনা মিশে আছে। তাই নাকি। তাহলে তো জুন লারসেনকে যারা যারা দেখতে এসেছে সবার কথাই বলতে পারবেন। ওর বাবা বাদে আর যে তিনজন এসেছিল।
মাথা নাড়ল মারগারেট।!না। রোগীর পারিবারিক ব্যাপারে বাইরের লোকের নাক গলানো নিষেধ।
আলাপ শেষ। মহিলার চোখ দেখেই সেটা আন্দাজ করতে পারল কিশোর। একটানা ডিউটি দিয়ে ক্লান্ত হয়ে আছে মারগারেট। মুখ গোমড়া করে রেখেছে। তাছাড়া কথা কম বলা স্বভাব। মেজাজ ভাল থাকলেও বলত না। এখন তো প্রশ্নই ওঠে না। জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেলে আরেক দিকে তাকাল গোয়েন্দাপ্রধান।
এগিয়ে এসেছে রবিন। লালচে চুলে হাত বুলিয়ে বলল, ম্যাম, ব্যাপারটা জরুরী।
কড়া চোখে তাকাল মারগারেট। বিনিময়ে মিষ্টি একটা হাসি দিল রবিন। তারপর ভদ্র কণ্ঠে বলল, ট্যালেন্ট এজেন্সিতে যে ভাবে মক্কেলদের পটায় সেভাবে, চব্বিশ ঘণ্টা ডিউটি! এ তো অমানবিক। নাহ, আপনার জন্যে মায়াই লাগছে আমার।
চোখের দৃষ্টি সামান্য নরম হলো মহিলার। রবিনের দিকে তাকিয়ে যেন সিদ্ধান্ত নেয়ার চেষ্টা করছে, ভাগিয়ে দেবে না কথা বলবে। এত ভাল একটা ছেলের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করা উচিত হবে না ভেবেই বোধহয় শেষে বলল, তিনজন তো নয়, দুজন এসেছিল। একটা ছেলে, আর একটা মেয়ে।
কেন, আর্মি জ্যাকেট পরা লোকটা? জানতে চাইল কিশোর। আসেনি?
বিস্ময় ফুটল মারগারেটের চোখে। আমি সাফ মানা করে দিয়েছিলাম, ঢুকতে পারবে না। আর বোলো না! লোকটাকে দেখলেই গা শিরশির করে। শুঁয়োপোকা দেখলে যেমন করে!
কেন? রবিনের প্রশ্ন।
দেখতেই জানি কেমন। একের পর এক প্রশ্ন করে চলল। জবাব দিতে দিতে মাথা খারাপ হয়ে যাওয়ার জোগাড় আমার। আর কি সব প্রশ্ন!
যেমন? কিশোর জিজ্ঞেস করল।
মেয়েটা কি বাঁচবে? যেন মরে গেলেই খুশি হয়। ওর জিনিসপত্রগুলো কোথায় রেখেছে, একথাও জানতে চাইল। আরও নানা রকম কথা। লারসেন পরিবারের লোক বলে মনে হলো না ওকে।
চেহারাটা দেখেছেন ভাল করে? জিজ্ঞেস করল রবিন।
মাথা নাড়ল মারগারেট। লোকের মুখের দিকে কখনোই ভাল করে তাকাই না আমি। কেবল তার জ্যাকেট আর কথাগুলো মনে আছে। বদমেজাজী যে এটুকুও বুঝতে পেরেছি। তবে তার চেহারা বলতে পারব না।
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
সরে এল তিন গোয়েন্দা। কিশোর বলল, ধরা যাক, লোকটার নাম মিস্টার এক্স। এখন এই এক্সকে বিশেষ সুবিধের লাগছে না আমার। সন্দেহ জাগানোর মত চরিত্র। জুন হয়তো জানতে পারে লোকটার আসল পরিচয়। চলো, রুমে যাই। দেখি, জাগল কিনা।
অ্যাই, ছেলেরা, ওদের কথা শুনে ফেলেছে মারগারেট। জুনের অবস্থা কিন্তু খারাপ। ঘুম দরকার। ওর জাগতে সময় লাগবে।
তাহলে আর গিয়ে লাভ নেই। অহেতুক বসে থাকা। তার চেয়ে কাজের কাজ যদি কিছু করা যায় সেই চেষ্টা করল ওরা। মুসা রয়ে গেল হাসপাতালে। ফারিহাকেও সঙ্গ দেবে, জুনের কাছে কারা কারা আসে দেখবে, আর ওর ঘুম ভাঙে কিনা খেয়াল রাখবে। কিশোর আর রবিন চলল রকি বীচ পুলিশ স্টেশনে, চীফ ইয়ান ফ্লেচারের সঙ্গে কথা বলতে।
আরেকটা ফোক্সওয়াগনই কিনেছে রবিন। গোবরে পোকার মত এই গাড়িগুলোই যেন তার বিশেষ পছন্দ। তার বক্তব্য, এই গাড়ি নাকি পথেঘাটে বন্ধ হয়ে বিপদে ফেলে না। যাই হোক, সেটা পরীক্ষার ব্যাপার। এই গাড়িটার রঙও আগেরটার মতই, লাল। সে বসল ড্রাইভিং সীটে। পাশের প্যাসেঞ্জার সীটে বসল কিশোর।
থানায় পৌঁছতে বেশিক্ষণ লাগল না। চীফ আছেন। ছেলেদের সঙ্গে দেখা করার ফুরসত আছে তার আপাতত। ওরা ঢুকে দেখল, লাঞ্চ প্যাকেট খুলছেন তিনি। চিকেন লারসেনের ফ্রাইড চিকেন।
খাবে? জিজ্ঞেস করলেন তিনি।
থ্যাংকস, বলে হাত বাড়াল রবিন। তুলে আনল সোনালি মাখন মাখানো এক টুকরো মাংস।
কিশোরের দিকে তাকালেন চীফ। নাও?
নিঃশব্দে মাথা নাড়ল কিশোর। খামচে ধরেছে চেয়ারের হাতল। যেন বিষ মাখানো খাবার খেতে দেখছে দুজনকে।
তারপর? জিজ্ঞেস করলেন ফ্লেচার। কোন কারণ ছাড়া তো নিশ্চয় আসনি। কি কেস? একটা রান তুলে নিয়ে কামড় বসালেন তিনি। চিবাতে লাগলেন। আরাম করে।
জুন লারসেনের অ্যাকসিডেন্টের ব্যাপারে জানতে এলাম, জবাব দিল কিশোর।
ওতে কোন রহস্য নেই, মুখ ভর্তি মুরগীর মাংস নিয়ে কথা বলায় স্পষ্ট হচ্ছে না কথা। কাজেই গিলে নিলেন চীফ। বৃষ্টির মধ্যে কন্ট্রোল হারিয়ে ফেলেছিল। পাহাড়ী পথে এরপর যা হবার তাই হয়েছে।
অস্বাভাবিক কিছু নেই এর মধ্যে?
দুটো প্রশ্ন জেগেছে আমার মনে। তবে অনেক দুর্ঘটনার বেলাতেই এটা ঘটে। অপরিচিত একজন ফোন করে খবরটা দিল। ওই লোকটাকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি আমরা। অ্যাক্সিডেন্টটা ঘটতে দেখে থাকতে পারে। তাতে কোন রহস্য নেই। কিন্তু নাম বলল না কেন? আরেকটা ব্যাপার। দুই সেট চাকার দাগ ছিল। একসেট জুনের গাড়ির। সোজা রাস্তা থেকে নেমে গেছে। আরেকটা সেট ছিল তার পাশে। যেখানে অ্যাক্সিডেন্টটা হয়েছে, তার কাছ থেকে আরও খানিকটা নিচে নেমে গেছে।
কি ঘটেছিল, অনুমান করার চেষ্টা করল কিশোর। দুটো গাড়ি আসছিল। একটা আগে, আরেকটা পেছনে। একটা জুনের গাড়ি। অন্যটা কার? নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটতে আরম্ভ করল সে। ভিন্ন একটা দৃশ্য ফুটতে শুরু করেছে মনের পর্দায়। স্যার, ধীরে ধীরে কথাগুলো বলল সে, যেন নিজেকেই বোঝাল। একটা সম্ভাবনার কথা কি ভেবেছেন আপনি? এমনও তো হতে পারে, জুন লারসেনকে তাড়া করেছিল কেউ?
<