বাঁয়ে তীক্ষ্ণ মোড় নিল বুশ প্লেন। ফায়ারওয়ালে বুট চেপে ধরে নিজেকে সামলাল পাইলটের পাশের সিটে বসা মুসা। থাবা দিয়ে ধরে ফেলল মাথার ওপরের হাতলটা। জানালা দিয়ে তাকাল হাজার ফুট নীচে।

পাইলট ডিউক আইকহ্যাম বুড়ো আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলল, ওই, যে গ্লিটার টাউন।

শহরটাকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে মুসা। যেদিকেই তাকায়, শুধু গাছ আর গাছ। সাদা রঙের চওড়া একটা কাস্তে চলে গেছে যেন গাছের জঙ্গলকে ভেদ করে। ওপর থেকে মহাসড়কের মত লাগছে কাস্তেটাকে। কিন্তু মুসা জানে, ওটা রাস্তা নয়, নদী। ইউকন রিভার। বছরের এ সময়টায় নদীর পানি জমাট বরফ। দশ ফুট পুরু হয়ে বরফের স্তর পড়েছে। শহরটা চোখে পড়ল হঠাৎ। নদীর দিকে মুখ করা। দূর থেকে বাড়ি-ঘরগুলোকে খেলনার মত লাগছে। ওখানেই চলেছে কিশোর ও মুসা।

দারুণ! চিৎকার করে বলল মুসা। সাংঘাতিক!

হাসল ডিউক। এটা সত্যিকারের বুশ কান্ট্রি। নির্জন। বিশাল এলাকা জুড়ে কোন মানুষের দেখা পাবে না।

বিগ কান্ট্রি আলাস্কা! বিড়বিড় করে বলল পিছনের সিটে বসা কিশোর। এয়ারস্ট্রিপটা কই, ডিউক? শুরুতে মিস্টার ডিউক বলেছিল, কিন্তু ডিউক জোরে হাত নেড়ে বাতাসে থাবা মেরে জানিয়ে দিয়েছে, শুধু ডিউক। মিস্টার-ফিস্টার ভাল্লাগে না আমার।

ডিউকের হাসিটা চওড়া হলো। আছে তো। ওই যে নীচেই। এক মাইল চওড়া, দুই হাজার মাইল লম্বা।

তারমানে নীচের ওই বরফে ল্যাণ্ড করবেন? অবাক হলো মুসা।

এত অসমান…

আগে আরও খারাপ ছিল, ডিউক জানাল। গেল শীতে এখানকার লোকে সমান করে দিয়েছে। আমার নামার সুবিধের জন্য। আচমকা সামনের দিকে নিচু হয়ে গেল প্লেনের নাক। গাছের ওই সারি দুটো দেখছ? ওগুলোই রানওয়ের নিশানা। দুটোর ঠিক মাঝখানে নামালে আর কোন ভয় নেই।

থ্রটল অ্যাডজাস্ট করল ডিউক। ফ্ল্যাপ নামিয়ে, গতি কমিয়ে নামার জন্য তৈরি হচ্ছে।

শূন্য থেকে পাথর পড়ার মত ঝপ করে অনেকখানি নীচে নেমে এল প্লেন। এয়ার পকেটে পড়েছে। পেটের মধ্যে পাক দিয়ে উঠল মুসার। ডিউকের সঙ্গে কথা বলাটা এখন নিরাপদ নয়। কাঁধের ওপর দিয়ে ফিরে তাকাল কিশোরের দিকে। দারুণ একটা অ্যাডভেঞ্চার হবে, কী বলো? জোসিও আমাদের দেখলে খুশি হবে। বিশ্বাসই করতে পারবে না, ওর দাওয়াতে সাড়া দিয়ে সত্যি সত্যি চলে আসব আমরা।

তা ঠিক, মাথা ঝাঁকাল কিশোর।

জোসি মানে জোসেফ টিনুক। ওদের বন্ধু। অ্যাথাবাস্কান। গ্লিটারের স্থানীয় অধিবাসী। জন্মের পর থেকেই নীচের ওই খুদে শহরটায় বাস করছে। ব্যুরো অভ ইণ্ডিয়ান অ্যাফেয়ার্সের স্পন্সর করা খেলাধূলার প্রোগ্রামে ফুটবল খেলতে কিছু দিনের জন্য লস অ্যাঞ্জেলেসে যাবার সুযোগ পেয়েছিল। কয়েক হপ্তা কাটিয়ে এসেছে তিন গোয়েন্দার সঙ্গে, রকি বিচে। ফিরে আসার সময় গ্লিটার টাউনে ওদেরকে দাওয়াত করেছিল জোসি। বসন্তের ছুটিতে স্কুল বন্ধ হতেই তাই বেরিয়ে পড়েছে কিশোর ও মুসা। আলাস্কাও দেখা হবে, ভগ জে রেসে বন্ধুকে সাহায্যও করতে পারবে। অ্যাঙ্কারেজ থেকে শুরু হয় ইডিটাররাডের বিখ্যাত এই কুকুর-দৌড়।

বাবা-মার সঙ্গে নিউ ইয়র্কে যেতে হয়েছে রবিনকে, তাই আসতে পারেনি। ওর বাবা মিস্টার মিলফোর্ড ওখানকার একটা বড় পত্রিকায় কাজ নিয়েছেন। যদি ভাল লাগে, ওখানেই থেকে যাবেন, রকি বিচে আর ফিরবেন না। আপাতত ওখানকার কোনও একটা স্কুলে ভর্তি করে দেয়া হবে রবিনকে। বন্ধুদের ছেড়ে যেতে হচ্ছে বলে দুঃখে কাতর হয়ে পড়েছিল রবিন। মুসা তো কেঁদেই ফেলেছিল। মন খারাপ হয়ে। গিয়েছিল কিশোরেরও।

শক্ত হয়ে বসো, ডিউকের কথায় ভাবনার জগৎ থেকে ফিরে এল কিশোর।

প্লেনের নাক আরও নামিয়ে দিল ডিউক।

মাথার ওপরের হ্যাণ্ডেলটায় মুসার আঙুলের চাপ আরও শক্ত হলো। ওপর থেকে নীচে তাকিয়ে ওর মনে হচ্ছে, প্লেনটা নামছে না, বরং বিশাল ধরণীই দ্রুতবেগে উঠে আসছে ওদের দিকে।

আরও গতি কমাল ডিউক। জয় স্টিক টেনে নাক সোজা করল। সামান্য সামনে ঠেলে দিল স্টিকটা। নদীর বরফ স্পর্শ করল প্লেনের স্কি। রিভার্স-এ দিল প্রপেলার। থ্রটল বাড়িয়ে দিল। গর্জন করে উঠল ইঞ্জিন। থরথর করে কেঁপে উঠল প্লেনের শরীর। আঁকি খেল দুতিনবার। নাচতে নাচতে এগিয়ে গেল কয়েক গজ। তারপর থেমে গেল।

হাত বাড়িয়ে সুইচ টিপে মোটর বন্ধ করে দিল ডিউক। জোরে নিঃশ্বাস ফেলল। হঠাৎ করে নীরবতা এসে ধাক্কা মারল যেন কানের পর্দায়। রীতিমত ব্যথা হচ্ছে কানে।

পার্কার জিপার তুলে দাও, বলতে বলতে দরজা খোলার হ্যাণ্ডেলের দিকে হাত বাড়াল ডিউক। এখানকার ঠাণ্ডা কিন্তু ভয়ানক। বাতাস ছাড়াই তাপমাত্রা নেমে যায় শূন্যের নীচে, আর যখন বাতাস বয়, তখন তো ভয়াবহ অবস্থা।

পার্কার জিপার তুলে দিয়ে প্লেন থেকে নেমে এল কিশোর ও মুসা।

আমরা যে এসেছি শহরবাসী কি জানে? কথা বলার সময় নিজের মুখ থেকে বেরোনো বাতাস মুহূর্তে বরফের কণা হয়ে যেতে দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল মুসা।

তা তো জানেই, ডিউক বলল। ও, বুঝতে পারনি তা হলে, জানানোর জন্যই তো শহরের ওপর দিয়ে চক্কর দিয়ে এলাম। ব্যাগেজ কম্পার্টমেন্ট খুলে কিশোর-মুসার ডাফেল ব্যাগগুলো বের করে বরফের ওপর নামিয়ে রাখল ও।

গ্লিটার টাউন, চারপাশে তাকাতে তাকাতে বিড়বিড় করে নিজেকেই প্রশ্ন করল কিশোর, আজৰ নাম। নেটিভ আমেরিকান

শহরগুলোর সাধারণত এ রকম নাম হয় না।

ফ্রেইট কম্পার্টমেন্ট থেকে নানা রকম বাক্স আর প্যাকেট টেনে নামাতে শুরু করল ডিউক। সেই গোল্ড রাশের যুগে… গোন্ড রাশ বোবো তো?

যে সময়টায় সোনার খোঁজে খেপা হয়ে গিয়েছিল মানুষ, কিশোর জবাব দিল। পাগলের মত সোনা খুঁজে বেড়াত, স্বর্ণসন্ধানের সেই যুগটাকে বলে গোন্ড রাশ। স্বর্ণসন্ধানীদের বলে প্রসপেক্টরস।

হ্যাঁ, মাথা ঝাঁকাল ডিউক। একশো বছর আগে সেই গোন্ড রাশের যুগে হাজার হাজার খনি-শ্রমিক আর প্রসপেক্টরস এসে হানা দিয়েছিল এখানকার পাহাড়-পর্বতগুলোয়। চকচকে সোনা-বোধহয় এই কথাটার ওপর ভিত্তি করেই ওরা শহরটার নাম রেখেছিল গ্লিটার টাউন। ভীষণ পছন্দের জায়গা ছিল এটা ওদের কাছে। কিন্তু সব কিছুরই শেষ আছে। ধীরে ধীরে এখানকার সোনা শেষ হয়ে এল। চলে গেল বাইরে থেকে আসা খনি-শ্রমিকেরা প্রায় সবাই…।

কিশোর! নদীতীরের দিকে আঙুল তুলল মুসা, দেখো, ও জোসি না?

ওর মতই তো লাগছে, কিশোরের কণ্ঠে উত্তেজনা।

প্রায় এক শ গজ দূরে মাঝারি উচ্চতার একটা গাট্টাগোট্টা মূর্তিকে দ্রুত এগিয়ে আসতে দেখা গেল বরফে ঢাকা নদীতীর ধরে। পার্কার হুড পিছনে নামানো। চওড়া মুখ, উঁচু চিবুক আর কালো চুল দেখে দূর থেকেও বন্ধুকে চিনতে পারল মুসা।

টান দিয়ে যার যার ব্যাগ তুলে নিল কিশোর ও মুসা। প্রায় ছুটতে শুরু করল জোসির দিকে।

কিশোর! মুসা! চিৎকার করতে করতে জোসিও ছুটে এল। কাছে এসে হাত মেলাল। পিঠ চাপড়ে দিতে দিতে জিজ্ঞেস করল, কেমন আছ?

ভাল, জবাব দিল কিশোর।

রবিন আসেনি?

নাহ্, আসতে পারেনি। নিউ ইয়র্কে।

আহহা, তাই। ও এলে খুব ভাল হতো।

তা তো হতোই। কিন্তু কী আর করা।

পথে কোন অসুবিধে হয়নি তো?

হয়েছে কি না টেরই পাইনি, এতই কুঁদ হয়ে ছিলাম। দেখার মত জায়গা।

ডিউকের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে জোসির পিছু পিছু শহরের দিকে হেঁটে চলল কিশোর-মুসা। গ্লিটারকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেল। দুই সারি পাহাড়ের মাঝখানে উপত্যকায় গড়ে উঠেছে শহরটা। ছড়ানো ছিটানো কাঠের কেবিনগুলো জড়সড় হয়ে আছে তীব্র শীতে। ধাতব স্টোভের পাইপ বেরিয়ে গেছে কেবিনের ছাত ফুড়ে। সেগুলো দিয়ে সাদা ধোয়া উঠে যাচ্ছে সুমেরুর পরিষ্কার নীল আকাশে।

জোসি বলল, তোমাদের কেবিনের স্টোভটা চালু করা দরকার। ঠিক আছে নাকি কে জানে। অনেকদিন চালু করা হয় না। আগে ওটা আমার কেবিন ছিল। আব্বা-আম্মা ফেয়ারব্যাংকসে জুততার ফ্যাক্টরিতে চাকরি করতে চলে যাবার পর থেকে বহুদিন ঢুকিও না ওখানে, দেখাও হয় না। এখন ওদের বড় কেবিনটায় আমি থাকি। চাচা-চাচীর ওখানে খাই।

জোসি জানাল, ওর চাচার নাম জেফরি, চাচী এরিনা।

চলতে চলতে শহরের একমাত্র দোতলা বাড়িটার দিকে চোখ পড়ল মুসার। এটাও কাঠের তৈরি। সামনের দিকে কাঠের সাইনবোর্ডের লেখাগুলো জোরে জোরে পড়ল ও, জেনারেল স্টোর, প্রোপ্রাইটরলুক স্টার্লিং। বলল, সিনেমায় দেখা পুরানো ওয়াইল্ড ওয়েস্টের মত করে লিখেছে।

হাসল জোসি। তা ঠিক। পুরানো আমলে বুনো পশ্চিমের মতই স্টেজকোচ আর ওয়্যাগন ট্রেন আসত এখানেও, এখন আসে ডিউকের এরোপ্লেন। ফেয়ারব্যাংকসে মালের অর্ডার দেয় লুক। ওর দোকানে যদি কিছু না পাও, গ্লিটারের আর কোথাও সেটা পাবে না, ওই জিনিসটা ছাড়াই চালাতে হবে তোমাকে।

নদীর দিক থেকে ইঞ্জিনের শব্দ শোনা গেল। ফিরে তাকাল তিন কিশোর।

ডিউক চলে যাচ্ছে, জোসি বলল। সপ্তাহে একবার করে মালপত্র আর ডাক নিয়ে আসে ও।

নদীর দুই তীরে প্রুস গাছের সারি। মাঝখানের বরফে ঢাকা নদীর ওপরের অস্থায়ী রানওয়ে ধরে ছুটতে শুরু করল প্লেনটা। হঠাৎ লাফিয়ে উঠল বিশাল রাজহাঁসের মত। মোড় নিয়ে উড়ে গেল পশ্চিমে।

শহরের ভিতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সাদা একটা বাড়ি দেখাল জোসি। ছোট ছোট জানালা। অ্যাসেম্বলি রুম। পুরানো আমলে গোল্ড রাশের দিনে ওটাকে ড্যান্স হল হিসেবে ব্যবহার করা হতো। এখন শহরের লোকে ওখানে সভাটভা করে।

বাড়িটার প্রবেশ পথের একপাশে বুলেটিন বোর্ড। তাতে বড় বড় দুটো পোস্টার লাগানো। একটা পোস্টার ভাল কাগজে মেশিনে ছাপা। গ্লিটার টাউনের ভবিষ্যৎ উন্নতিতে যারা বিশ্বাসী, তাদেরকে হ্যাঁ ভোট দিতে অনুরোধ করা হয়েছে। আরেকটা পোস্টার সস্তা কাগজে, হাতে লেখা। যারা লিখেছে তাদের স্লোগান শহর বাঁচাতে চাইলে না ভোট দিন।

কী ব্যাপার? পোস্টার দুটো দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল কিশোর, শহরে নির্বাচন নাকি?

নির্বাচন না, জোসি জানাল, থিম পার্ক কর্পোরেশন নামে একটা কোম্পানি গ্লিটারকে টুরিস্ট স্পট বানাতে চায়। এ ব্যাপারে এখানকার জনগণের মতামত যাচাইয়ের জন্য এই ভোটের ব্যবস্থা।

ডিজনি ওয়ার্ল্ডের মত কোন কিছু? জড়সড় হয়ে কুঁকড়ে থাকা কেবিনগুলোর দিকে তাকাল মুসা।

হাসল জোসি। কেন, আইডিয়াটা খারাপ মনে হচ্ছে? এ রকম একটা আদিম জায়গাকে থিম পার্ক বানাবে, বিশ্বাস করতেই কষ্ট হয়, তাই না?

শহরের লোকের প্রতিক্রিয়া কী? কিশোর জিজ্ঞেস করল। তারা কী বলে?

এ সব ক্ষেত্রে সাধারণত যা হয়, মিশ্র প্রতিক্রিয়া। কেউ থিম পার্কের পক্ষে, কেউ বিপক্ষে।

সামনে মূল রাস্তাকে ক্রস করে গেছে আরেকটা রাস্তা। সেটা ধরে দ্রুত এগিয়ে আসছে একজন মানুষ। বড় বড় চুল প্রায় জট পাকিয়ে গেছে। গায়ে সবুজ পার্কা। পরনে উলের ঘন বুনটের ভারী প্যান্ট। দোমড়ানো। ময়লা। নিচুস্বরে জোসিকে জিজ্ঞেস করল মুসা, কে লোকটা?

টেক্স ফেরানি। লোকে ডাকত গোল্ড ফেরানি। ডাকতে ডাকতে এখন গোল্ড হয়ে গেছে ওর ডাকনাম, জোসি বলল। শহরের বাইরে ছোট্ট একটা গোল্ড ক্লেইম আছে ওর। গোল্ড ক্লেইম বোঝো?

মাথা ঝাঁকাল মুসা। সোনা পাওয়ার সম্ভাবনা আছে এমন জায়গার বৈধ মালিক।

হ্যাঁ। গোল্ড এক বিচিত্র চরিত্র।

সোনা মানে তো বিরাট ব্যাপার, মুসা বলল। কিন্তু এ লোকটাকে দেখে খাবার পায় বলেই মনে হয় না।

আসলেই তা-ই, টাকা নেই ওর। পঞ্চাশ বছর কাটিয়েছে সোনা খুঁজে খুঁজে। এখনও কিছুই করে উঠতে পারল না বেচারা। তবে আশা ছাড়েনি, সোনা খোজায় ওর বিরাম নেই।

জোসির সঙ্গে শহরের ভিতর দিয়ে এগিয়ে চলল কিশোর-মুসা। শহরের অন্যপাশে এসে একটা কেবিন দেখিয়ে জোসি বলল, ওইটা আমার চাচার কেবিন।

তোমার চাচার ছেলেমেয়ে নেই? মুসা জানতে চাইল।

আছে। এক মেয়ে। নাম মুনস্টোন। তোমাদের এগিয়ে আনার জন্য আমার সঙ্গে যেতে চেয়েছিল, কিন্তু লাকড়ি কেটে আনাটাও জরুরি। সেজন্য বনে গেছে। অসুবিধে নেই, পরেও দেখা করতে পারবে। আর ওই যে কেবিনটা দেখছ, এটা তোমাদের।

চাচার কেবিন থেকে দশ-বারো গজ দূরে আরেকটা ছোট কেবিনে কিশোরদেরকে নিয়ে এল জোসি। দুটো বাংক। একগাদা কম্বল। এ ছাড়া একটা টেবিল, একটা চেয়ার, আর পেটমোটা এক পুরানো চুলা আছে। মাটিতে বিছানো ভালুকের চামড়ায় তৈরি একটা মাদুর। চুলার পাশে একটা কাঠের খোলা বা লাকড়িতে বোঝাই।

এখানে থাকতে তোমাদের কষ্ট হবে না তো? জোসি জিজ্ঞেস করল। তোমাদের বাড়ির মত আরাম পাবে না আগেই বলে দিচ্ছি।

আমার তো খারাপ লাগছে না, হাতের ব্যাগটা একটা বাংকে নামিয়ে রাখল কিশোর। বরং মনে হচ্ছে আরামেই থাকতে পারব। শোনো, আমাদের নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। বহু খারাপ জায়গায় থেকে অভ্যাস আছে আমাদের।

ঠিক, মুসা বলল। ওসব জায়গার তুলনায় কেবিনটা তো পাঁচতারা হোটেল।

স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল জোসি। বন্ধুদের থাকার জায়গা নিয়ে দুশ্চিন্তায় ছিল ও, বোঝা গেল। জিজ্ঞেস করল, আমার জেটানা কুকুরগুলো দেখবে?

নিশ্চয়ই, জবাব দিতে এক মুহূর্ত দেরি করল না মুসা।

কেবিন থেকে বেরিয়ে শহরের সীমানা ধরে এগিয়ে চলল ওরা। এক জায়গায় কতগুলো কেনল চোখে পড়ল। কুকুরের ঘরগুলোর কাছে প্রায় দুই ডজন কুকুর বাধা। ওদের দেখে জোর গলায় চচামেচি শুরু করল ওগুলো। প্রচুর লাফালাফি আর লেজ নেড়ে স্বাগত জানাল।

সবগুলো তোমার কুকুর? অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল মুসা।

হ্যাঁ। এখানে আছে একুশটা। তবে ইডিটারোড রেসে বারোটার বেশি ব্যবহার করব না। হাতে আরও সময় নিয়ে আসা উচিত ছিল তোমাদের। তাহলে রেসের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দেখে যেতে পারতে।

থাকতে পারলে খুশিই হতাম, মাথা ঝাঁকাল কিশোর। কিন্তু কী করব, স্কুল খুলে যাবে।

স্কুল কামাই দিয়ে হলেও থাকতে রাজি আছি আমি, মুসা বলল। রেসের শেষ দেখতে না পারলে মনে খুঁতখুঁতি থেকে যাবে।

নাহ্, রেসের জন্য স্কুল কামাই দেয়া ঠিক হবে না, কিশোর বলল।

বেশির ভাগ দর্শকই রেসের শুরুটা কেবল দেখে, জোসি বলল। অনেক লম্বা পথ। অ্যাঙ্কারেজ থেকে নৌম পর্যন্ত এগারোশো মাইল। এতখানি তো আর সঙ্গে সঙ্গে যাওয়া সম্ভব না।

হাঁ করে তাকিয়ে রইল মুসা। এগারোশো মাইল!

একটা কুকুরের কাছে গিয়ে দাঁড়াল জোসি। ওদের প্রতিটি নড়াচড়া লক্ষ করছে কুকুরটা। ওর নাম ডায়মণ্ডহার্ট।

হীরকহৃদয়, বিড়বিড় করল কিশোর।

কী বললে?

ডায়মণ্ডহার্টের বাংলা করলাম।

আচ্ছা, হাসল জোসি। বাংলা নামটাও শুনতে ভাল লাগছে। সুন্দর একটা ছন্দ আছে। কিন্তু এখন আর বাংলা নামে ডাকলে সাড়া দেবে না ওটা, নইলে রেখেই দিতাম।

বড় একটা হাস্কি কুকুরের পাশে বসে ওটার গলা জড়িয়ে ধরল জোসি। কুকুরটার গায়ের রঙ সাদা আর ধূসরে মিশানো। চোখ টলটলে নীল। আদর পেয়ে জোরে জোরে লেজ নাড়তে লাগল। কিশোর ও মুসার দিকে তাকাল জোসি। ও আমার লিড ডগ।

মানে নেতা কুকুর? মুসা বলল।

মাথা ঝাঁকাল জোসি। হ্যাঁ।

মনিবের গাল চেটে দিতে লাগল ডায়মণ্ডহার্ট। হেসে মুখ সরিয়ে নিল জোসি।

দলের সবচেয়ে মূল্যবান সদস্য লিড ডগ, জোসি বলল। হোয়াইট আউটের মধ্যে পড়লে ওকে ছাড়া নিস্তার পাওয়া কঠিন।

হোয়াইট আউট কী? মুসা জানতে চাইল।

তুষার ঝড়, জোসি বলল। যখন তখন শুরু হয়ে যায়। এতই ঘন হয়ে তুষার পড়ে, নিজের হাতও দেখা যায় না। ভয়ঙ্কর ব্যাপার। তবে ডায়মণ্ডহার্টের মত একটা হাস্কি সঙ্গে থাকলে নিরাপদ। পথের মোড়ে কোনখানে কী বিপদ ওত পেতে আছে, নদীর বরফের স্তর কোথায় অতিরিক্ত পাতলা, ভার সইতে না পেরে ভেঙে যাবে, আগে থেকেই সব বুঝতে পারে। ওকে ছাড়া ইডিটারোড রেসে অংশ নেয়ার কথা ভাবতেই পারি না আমি।

রেস শেষ হতে কতদিন লাগে? জানতে চাইল কিশোর।

সেটা অনেক কিছুর ওপর নির্ভর করে। ঘুরে ঘুরে প্রতিটি কুকুরের মাথা চাপড়ে আদর করে দিতে লাগল জোসি। তবে মোটামুটি এগারো-বারোদিনের মত লাগে। ভীষণ বিপজ্জনক আর উত্তেজনায় ভরা এই রেস।

কুকুরগুলোর ওপর নিশ্চয় খুব চাপ পড়ে? মুসার প্রশ্ন।

তা পড়ে। তবে সেটা ওরা পছন্দও করে। শূন্যের বিশ ডিগ্রি নীচে নেমে যায় তাপমাত্রা। শরীর গরম হতে চায় না। মাশিঙের জন্য অস্থির হয়ে ওঠে ওরা।

মাশিং কী? কুকুরের খাবার?

হাসল জোসি। উঁহু। ডগস্লেজিঙের স্থানীয় নাম মাশিং। ফরাসি শব্দ মার্শা থেকে এসেছে শব্দটা। এর মানে চলো যাই।

কিশোর জিজ্ঞেস করল, রেসের সময় বাইরের সহযোগিতা পাওয়া যায়?

মাথা নাড়ল জোসি। না। ইডিটারোড রেসে যা যা করার রেসারকে একলাই করতে হয়। নিজের খাবার, কুকুরের খাবার, কাপড়-চোপড়, প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বয়ে নিয়ে যেতে হয়। টিকে থাকার জন্য যা কিছু প্রয়োজন, সব সঙ্গে নিতে হয়।

মুসা বলল, তারমানে নিয়ম-নীতি খুব কঠোর।

কঠোর না হয়ে উপায় নেই, জোসি বলল। ইডিটারোড রেসটা শুধু খেলা বা প্রতিযোগিতা নয়, রেসার তৈরিতেও এর গুরুত্ব অপরিসীম। সেই উনিশশো পঁচিশ সাল থেকে এ নিয়ম চালু আছে। নৌমে সেবার মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়েছিল ডিপথেরিয়া। সারা শহরে কোথাও এর ওষুধ ছিল না। গাড়ি আসার রাস্তা ছিল না। প্লেন নামতে পারত না। কিন্তু আলাস্কার কিছু বেপরোয়া ডগস্লেজ মাশার প্রচণ্ড তুষার ঝড়ের তোয়াক্কা না করে অ্যাঙ্কারেজ থেকে নৌমে ওষুধ পৌঁছে দিয়েছিল। বাঁচিয়ে দিয়েছিল শহরটাকে। সেই থেকে ইডিটারোড রেসের গুরুত্ব ভীষণভাবে বেড়ে গেছে এই এলাকার লোকের কাছে। নিউ ইয়র্ক সিটির সেন্ট্রাল পার্কের বিখ্যাত কুকুরের মূর্তিটার কথা নিশ্চয় জানো, বাল্টোর মূর্তি। নৌমের সেই উদ্ধারঅভিযানে একটা দলের লিড ডগ ছিল বাল্টো। ওষুধ আনার পর থেকে হিরো হয়ে গেছে। ডায়মণ্ডহার্টের মাথা চাপড়ে দিতে আবার নিচু হলো ও। আমাদের ডায়মণ্ডও বাল্টোর চেয়ে কম নয়, কি বলিস ডায়মণ্ড? এবারের ইডিটাররাডে আমরাই জিতব। পঞ্চাশ হাজার ডলারের পুরস্কার বাড়িতে আনব।

শিস দিল মুসা। ওর মুখ থেকে বেরোনো বাতাসে তুষারকণার লম্বা একটা রেখা তৈরি হলো। পঞ্চাশ হাজার!

বেশি মনে হচ্ছে? হাসতে লাগল জোসি। তবে এতে যে পরিমাণ বিপদ, সেই তুলনায় টাকাটা খুব বেশি না। পদে পদে মৃত্যুর আশঙ্কা। কুকুর ছাড়া একশো গজও যেতে পারবে না।

হাঁটতে হাঁটতে শহরে ফিরে এল ওরা। ওদের বয়েসি আরেকটা ছেলেকে উল্টো দিক থেকে আসতে দেখা গেল। জোসির মত ওর পরনেও চামড়ার পার্কা আর উলের প্যান্ট। মাথার হুড তুলে দেয়া। অন্য দিকে নজর। ওদের যেন দেখেইনি।

ও টেড সিউল, জোসি বলল। গলা চড়িয়ে ডাকল, এই টেড, শোনো। এরা আমার বন্ধু। মেহমান। লস অ্যাঞ্জেলেসের রকি বিচ থেকে এসেছে।

থামল টেড। তবে জোসির দিকে তাকাল না।

টেডও রেসে অংশ নিচ্ছে, জানাল জোসি। ইডিটারোড রেসে এই প্রথমবারের মত প্রতিযোগিতা করতে যাচ্ছি আমরা। গোটা শহর আমাদের নিয়ে উত্তেজিত। অনেকেই বলাবলি করছে প্রতিযোগিতা আমার আর টেডের মধ্যেই হবে। দুজনের যে কোন একজন জিতব।

জ্বলন্ত চোখে জোসির দিকে তাকাল টেড। আমি না জিততে পারলে তোমাকেও জিততে দেয়া হবে না, কথাটা মনে রেখো। তার জন্য যদি আমাকে…

কথাটা শেষ করল না ও। ঝট করে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে চলে গেল।

<

Super User