এখানেই বিছাই, বলে, মেঝেতে ম্যাপ বিছিয়ে দেখতে বসে গেল কিশোর পাশা।

হ্যাঁ, এইই ভালো হয়েছে, বললো রবিন। টেবিলটা একটু সরাতে হয়েছে, এই যা। তবে বড় ম্যাপ দেখতে মাটিতেই সুবিধে।

বেশি আওয়াজ করো না, হুঁশিয়ার করলো জিনা। বাবা স্টাডিতে। শব্দ শুনলেই এসে চেঁচামেচি শুরু করবে।

না, করবো না, মাথা নেড়ে বললো মুসা।

এই রাফি, চুপ থাকবি, কুকুরটাকেও সাবধান করলো জিনা। নইলে বের করে দেবো। বুঝেছিস? বুঝতে পারলো রাফিয়ান। শুয়ে পড়লো একেবারে ম্যাপটার ওপরই।

আরে গাধা, সরা ধমক লাগালো কিশোর। তাড়া আছে আমাদের। বাটারফ্লাই হিল খুঁজে বের করতে হবে

বাটারফ্লাই হিল? জিনা বললো। দারুণ নাম তো!

হ্যাঁ, বাংলা করলে হয় প্রজাপতির পাহাড়। ওদিকেই ছুটি কাটাতে যাচ্ছি আমরা এবার। কয়েকটা গুহাও আছে কাছাকাছি। তাছাড়া রয়েছে একটা প্রজাপতির খামার…

প্রজাপতির খামার! জিনা অবাক। প্রজাপতির আবার খামার হয় নাকি!

হয়, মুসা জানালো। আমাদের ইস্কুলের এক বন্ধু, জনি, তার বাড়ি ওখানে। সে-ই আমাদের দাওয়াত দিয়েছে ওখানে যেতে…।

তা-ই বলো, মাথা দোলালো জিনা। এজন্যেই হুট করে চলে এসেছে আমাদের বাড়িতে। আমি তো ভাবলাম আমাদের এখানেই ছুটি কাটাতে এসেছে। তোমরা তাহলে বাটারফ্লাই হিলে যাচ্ছে প্রজাপতির খামার দেখতে!

যা, রবিন বললো। ভাবলাম, এদিক দিয়েই যখন যেতে হবে, তোমাকেও নিয়ে নেবো। তা যাবে তো?

যাবো না মানে? এরকম একটা চান্স ছাড়ে নাকি কেউ?

গভীর মনযোগে ম্যাপ দেখছে চারজনে। হঠাৎ ঝটকা দিয়ে খুলে গেল স্টাডিরুমের দরজা। বিড়বিড় করে আপনমনে কি বলতে বলতে এগিয়ে এলেন জিনার বাবা মিস্টার পারকার। ছেলেমেয়েদেরকে দেখতেই পেলেন না আত্মভোলা বিজ্ঞানী, এসে পড়লেন একেবারে ওদের গায়ের ওপর। হোঁচট খেয়ে মাটিতেই পড়ে গেলেন।

রাফি ভাবলো, ওদের সঙ্গে খেলতে এসেছেন মিস্টার পারকার, খুশিতে জোরে ঘেউ ঘেউ করে উঠে নাচানাচি শুরু করলো সে।

তুমি যে কি, বাবা, মিস্টার পারকারকে ধরে বললো জিনা। একটু দেখে হাঁটতে পারো না?

এই রাফি, চুপ! ধমক লাগালো কিশোর। এতো হাসির কি হলো? থাম!

তিন গোয়েন্দাও এসে হাত লাগালো। মিস্টার পারকারকে ধরে তুলে দাঁড় করিয়ে দিলো। তারপর কেউ তার কাপড় ঝেড়ে দিতে লাগলো, কেউ দেখতে লাগলো কোথাও ব্যথা-ট্যথা পেয়েছেন কিনা। কড়া চোখে ছেলেমেয়েদের দিকে তাকিয়ে আচমকা গর্জে উঠলেন তিনি, এটা একটা শোয়ার জায়গা হলো! এই জিনা, তোর মা কোথায়? জলদি যা, ডেকে নিয়ে আয়! ডেস্কটা যদি একটু গুছিয়ে রাখে! কাগজপত্র কিছু পাচ্ছি না। ডাক, জলদি ডাক!

মা তো বাড়ি নেই, বাবা। বাজারে গেছে।

নেই? সেকথা আগে বলবি তো! যত্তোসব! গজগজ করতে করতে গিয়ে আবার স্টাডিতে ঢুকলেন তিনি। দড়াম করে বন্ধ হয়ে গেল দরজা।

 

পরদিন সকালে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়লো ওরা। তিন গোয়েন্দা আর জিনা সাইকেলে চলেছে, পাশে পাশে ছুটে চলেছে রাফি। সাগরের ধার দিয়ে গেছে পথ। রোদে ঝলমল করছে নীল সাগর।

গোবেল দ্বীপটা দেখা যেতেই হাত তুলে চেঁচিয়ে উঠলো জিনা, ওই যে, আমার দ্বীপ।

মুখ ফিরিয়ে তাকালো অন্যেরা। বহুবার দেখেছে ওরা ওই দ্বীপ, আর দ্বীপের পুরানো দুর্গের টাওয়ারটা। তবু যতোবারই দেখে নতুন মনে হয়। যতক্ষণ না চোখের আড়াল হলো, সাইকেল চালাতে চালাতে ফিরে ফিরে তাকালো ওরা ওটার দিকে।

সঙ্গে প্রচুর খাবার দিয়ে দিয়েছেন তিন গোয়েন্দার প্রিয় কেরিআন্টি, জিনার মা। কাজেই দুপুরে খাবার অসুবিধে হলো না ওদের। পথের পাশে গাছের ছায়ায় বসে খেয়ে নিলো, জিরিয়েও নেয়া হলো সেই সাথে। তারপর আবার চলা।

কটা নাগাদ পৌঁছবো? জিজ্ঞেস করলো জিনা।

এই চারটে, জবাব দিলো কিশোর।

বেলা গড়িয়ে আসছে। পথের দুধারে এখন ছড়ানো প্রান্তর। কোথাও মাঠ, কোথাও চাষের জমি। দূরে দেখা গেল পাহাড়।

ওটাই বোধহয়, বলে গলায় ঝোলানো ফীন্ডগ্লাস চোখে ঠেকালো কিশোর। যা, ওটাই। অদ্ভুত চ্যাপ্টা চূড়া। বুড়ো মানুষের দুমড়ে যাওয়া হ্যাটের চূড়ার মতো লাগছে দেখতে।

সাইকেল থেকে নামলো সবাই। এক এক করে ফান্ডগ্রাস চোখে লাগিয়ে পাহাড়টা দেখলো।

চারটের আগেই পৌঁছতে পারতো ওরা, রাফির কারণে পারলো না। ওরা সাইকেলে চড়ে চলেছে, আর কুকুরটা চলেছে দৌড়ে, তাড়াতাড়ি ক্লান্ত হয়ে পড়ছে। ওকে বিশ্রাম দেয়ার জন্যে মাঝে মাঝে থামতে হচ্ছে ওদের।

অবশেষে পৌঁছলো ওরা বাটারফ্লাই হিলের গোড়ায়। ঢালু উপত্যকায় ছড়িয়ে আছে তৃণভূমি, তাতে গরু চরছে। ঢালের আরও ওপরে, ঘাস যেখানে ছোট আর শক্ত, সেখানে চরছে ভেড়ার পাল। পাহাড়ের পায়ের কাছে যেন গুটিসুটি মেরে শুয়ে রয়েছে ফার্মহাউসটা।

ওটাই জনিদের বাড়ি, বললো কিশোর। ছবি দেখেছি। এই চলল, ওই ঝর্নাটায় হাতমুখ ধুয়ে চুল আঁচড়ে নিই। রাফি, সাংঘাতিক ঘেমেছিস। ইচ্ছে করলে গোসল করে নিতে পারিস।

মুখহাত ধুয়ে, পরিপাটি হয়ে বাড়িটার দিকে এগোলো ওরা। পায়েচলা মেঠোপথ পেরিয়ে এসে থামলো ফার্মের গেটের কাছে। ভেতরে বিরাট এলাকা। উঠনে মুরগী মাটিতে ঠুকরে ঠুকরে দানা খাচ্ছে। পুকুরে হাঁস সাঁতার কাটছে।

ভেতরে ঢুকলো ওরা। সামনে এগোলো। কোথায় যেন ঘেউ ঘেউ করে উঠলো একটা কুকুর। বাড়ির এককোণ ঘূরে ছুটে বেরিয়ে এলো একটা ছোট জীব। ধবধবে সাদা।

খাইছে! দারুণ সুন্দর ভেড়ার বাচ্চা তো! মুসা বললো।

এই রাফি, চুপ! ধমক দিয়ে বললো জিনা। কিছু বলবি না ওটাকে।

বাচ্চাটার পিছে পিছে বেরোলো একটা বাচ্চা ছেলে। বয়েস পাঁচের বেশি হবে। লালচে কোঁকড়া চুল, বড় বড় বাদামী চোখ। ওদেরকে দেখে থমকে দাঁড়ালো।

তোমরা কারা? জিজ্ঞেস করলো সে।

আমরা জনির বন্ধু, হেসে জবাব দিলো কিশোর। তুমি কে?

আমি ল্যারি। আর ও, ভেড়ার বাচ্চাটাকে দেখিয়ে বললো ছেলেটা, ও টোগো। খুব দুষ্টু।

তাই নাকি? রবিন বললো। খুব সুন্দর তোমার বাচ্চাটা।

সেজন্যেই তো ওকে আমি এতো ভালোবাসি। এই টোগো, আয় আয়, আমার কাছে আয়। বাচ্চাটা এগিয়ে এলে ওটাকে ধরে কোলে তুলে নিলো ল্যারি। তা তোমরা ভাইয়ার কাছে এসেছে বুঝি?।

জনি তোমার ভাই? মুসা বললো। হ্যাঁ, তার কাছেই এসেছি। কোথায় ও?।

ওখানে, হাত তুলে মস্ত গোলাঘরটা দেখালো ল্যারি। ডবিও আছে সাথে। যাও না, গেলেই দেখা হবে।

ভেড়ার বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে যেদিক থেকে এসেছিলো সেদিকে চলে গেল ল্যারি।

ভেড়াটার যেমন লেলাম, ছেলেটার তেমনি গাল। দেখলেই আদর করতে ইচ্ছে করে, জিনা বললো।

অন্য তিনজনেও মাথা ঝাঁকালো। এমনকি রাফিয়ানও বলে উঠলো, হুফ! গোলাঘরের কাছে এসে গলা চড়িয়ে ডাকলো কিশোর, জনি! জঅনি?

বেরিয়ে এলো ওদেরই বয়েসী একটা ছেলে। সাথে একটা কুকুর। ওদেরকে দেখেই দুহাত তুলে চিৎকার করতে করতে ছুটে এলো জনি, এই যে, তিন গোয়েন্দা, এসে পড়েছে! আরি, জিনাও! আবার রাফিও! এসো এসো। ছুটিটা ভালোই কাটবে এবার আমি তো সেই কখন থেকে অপেক্ষা করে আছি। ভাবছি এই আসছে, এই আসহো!…আরি আরি, ডবি, তুই আবার যাচ্ছিস কোথায়? আরে ও তো রাফি। তোরও বন্ধু।

ঘাড়ের নোম খাড়া হয়ে গেছে রাফিয়ানের। মৃদু গরগর করছে। তার মাথায় চাপড় দিয়ে জিনা বললো, হয়েছে, আর রাগতে হবে না। ও ডবি। ওদের এখানেই বেড়াতে এসেছি আমরা।

দুটো কুকুরের ভাব হতে সময় লাগলো না। জিনা বললো জনিকে, তোমার ভাইটা কিন্তু খুব সুন্দর। ভেড়ার বাচ্চাটাও।

হেসে উঠলো জনি। আর বলো না। টোগোকে নিয়ে সারাক্ষণ ব্যস্ত ও। কিছুতেই চোখের আড়াল করতে চায় না। এসো, বাড়িতে এসো।

মায়ের সঙ্গে বন্ধুদের পরিচয় করিয়ে দিলো জনি।

তোমাদের কথা রোজই বলে জনি, হেসে বললেন মহিলা। বলেছে এখানে নাকি ছুটি কাটাবে। এসেছো, ভালো করেছে। কোনো অসুবিধে হবে না। তবু, কম্বল সব রেডি করে রেখেছে তোমাদের জন্যে ও। খাওয়ারও অসুবিধে হবে না। দুধ, ডিম, রুটি, মাখন, সব পাবে। যখন যা দরকার, চাইবে, লজ্জা করবে না।

ঘরের ভেতরে ছোটাছুটির শব্দ শোনা গেল। ওই যে, আবার শুরু করেছে! দুটোর জ্বালায়… ঘরের দিকে ফিরে চিৎকার করে মহিলা বললেন, এই ল্যারি, চুপ করলি! ভেড়ার বাচ্চাটাকে নিয়ে আবার ঢুকেছিস ঘরে! কতোবার না মানা করেছি, ওসব নিয়ে ঘরে ঢুকবি না। আবার মেহমানদের দিকে ফিরলেন তিনি। বুঝলে, কুকুর-বেড়াল আমার খারাপ লাগে না। কিন্তু ছাগল-ভেড়া একটুও পছন্দ না। কত বলি ওকে, ওটা ফেলে দিয়ে একটা কুকুরের বাচ্চা পোষ, শোনেই না ছেলেটা। টোগো টোগো করে পাগল।

মা, জনি বললো, এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথাই বলবে শুধু? চা-টা খাওয়াতে হবে না ওদেরকে?

ও, নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই। এসো, এসো তোমরা। ভেতরে এসো।

খাবারের বহর দেখে আফসোস করলো মুসা, হায় হায়, এতো! এমন জানলে দুপুরে খেতামই না।

না না, এমন আর কি করতে পারলাম, জনির মা বললেন। তাড়াহুড়ো করে করেছি। জনি, তুই খাওয়া ওদের। দেখিস, কোনো কিছু যেন বাকি না থাকে। আমার কাজ পড়ে আছে…

ঠিক আছে, ঠিক আছে, ভদ্রতা করে বললো কিশোর। আমরা নিজেরাই নিয়ে খেতে পারবো।

হ্যাঁ, খাও। নিজের বাড়ি মনে করবে। কোনো লজ্জা করবে না। চলে গেলেন মহিলা।

টোগো আর ল্যারিও বসেছে ওদের সঙ্গে। পারলে ভেড়ার বাচ্চাটাকে টেবিলেই তুলে দিতো ল্যারি, বড় ভাইয়ের ভয়ে পারছে না। কোলে নিয়ে বসেছে।

মাংসের বড়াগুলো দেখিয়ে জনি বললো, ওগুলো কি দিয়ে তৈরি হয়েছে, জানতে পারলে মোটেও খুশি হবে না টোগো। হাসলো সে। ওর দাদার মাংস দিয়ে।

তাড়াতাড়ি টোগোকে মাটিতে নামিয়ে দিলো ল্যারি। ভয়, কি জানি কোনোভাবে দাদার মাংসের অবস্থা দেখে যদি ভয় পেয়ে যায় ভেড়ার বাচ্চাটা?

কুকুর দেখে অভ্যস্ত টোগো, রাফিয়ানকে দেখে মোটেও ভয় পেলো না। তার গা ঘেঁষে গিয়ে দাঁড়ালো। রাফিও আদর করে তার গা চেটে দিলো। ব্যস, ভাব হয়ে গেল দুটোতে।

খাওয়া শেষ হলো। এই সময় হাত মুছতে মুছতে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলেন জনির মা। একটা চেয়ার টেনে বসলেন। জিজ্ঞেস করলেন, তা কি ঠিক করলে? কোথায় থাকবে? ঘরে, না বাইরে?

বাইরেই থাকি, কিশোর বললো। মজা বেশি হবে।

থাকো, যেখানে ইচ্ছে। জনি, তবুটাবুগুলো কোথায় রেখেছিস? দিয়ে দে। ওরা নিজেরাই গিয়ে জায়গা পছন্দ করুক, কোথায় থাকবে।

এসো, বন্ধুদের ডাকলো জনি।

ল্যারি আর ডবিও চললো ওদের সাথে। আর ল্যারির কোলে অবশ্যই রইলো টোগো।

তাঁবু আর অন্যান্য জিনিসপত্র বয়ে নিতে মেহমানদেরকে জনি তত সাহায্য করলোই, ল্যারি আর ডবিও করলো।

পাহাড়ের দিকে যেতে যেতে জনি বললো, যা সুন্দর জায়গা! খুব পছন্দ হবে। তোমাদের। আমিও তোমাদের সঙ্গে ক্যাম্পে থাকতে পারতাম, কিন্তু বাড়িতে অনেক কাজ।

<

Super User